রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৩৬

0
641

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩৬

৫৯।
আরিয়া ফেরদৌস খুব কম সাজগোজ করেন। তিনি হালকা রঙের শাড়ি বা সেলোয়ার-কামিজ পরেই অফিসে যান। কিন্তু ইদানীং তার রঙের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার মনে হয়, একটু সাজলে হয়তো তাকে এতোটাও বয়ষ্ক মনে হবে না। তার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু তিনি এখনো যথেষ্ট শক্ত আছেন। তাকে দেখলে অন্তত ছেলে বিয়ে দিয়েছেন বলে মনে হয় না।

আজ আরিয়া ফেরদৌস গাঢ় বাদামী বর্ণের একটা শাড়ি পরলেন। তিনি প্রতিদিন চুলে খোঁপা করেন, কিন্তু আজ চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। খোলা চুলে নিজেকে দেখে, তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আরিয়া ফেরদৌসের মা, আফিফা বেগম মাঝে মাঝে চুলগুলো খোলা রেখে বারান্দায় বসতেন, আর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতেন। আর তিনি কখনো কখনো তার বাবাকে দেখেছিলেন, তার মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে। আরিয়া মনে মনে বললেন,
“অভাবে থাকলেও মা কতোই না সুখী ছিলো! কিন্তু আমি এই জীবনে ভালোবাসা শব্দটির কোনো স্পর্শও পেলাম না।”

এরপর তিনি ড্রয়ার খুলে চুড়ির বাক্সটা বের করে দেখতে লাগলেন। এগুলো অনেক বছর আগের চুড়ি। যখন তিনি নতুন নতুন আয় করছিলেন, তখন তিনি শখ করে মেলা থেকে অনেকগুলো চুড়ি কিনেছিলেন। চুড়িগুলো হাতে নিয়ে তিনি নিজেকে আয়নায় একনজর দেখলেন। নিজেকে দেখেই তার চোখে অশ্রু টলমল করে উঠলো। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
“পৃথিবীতে মানুষ কেন জন্ম নেয়? আমি কেন জন্ম নিয়েছি? আমার এই জন্মটা এতো সংগ্রামের কেন ছিল? কেন আমি একদিনও নিজের জন্য কিছু করি নি? কেন আমি ভালোবাসা পাই নি? আমার কিসের অভাব ছিল?”

আরিয়া ফেরদৌস চোখের কোণে জমে থাকা পানিগুলো মুছে বললেন,
“আমারও ইচ্ছে করে কারো সাথে বসে নিজের মনের কথাগুলো ভাগ করে নিতে। আমারও ইচ্ছে করে কারো কাঁধে মাথা রাখতে। আমার আবার ইচ্ছে করে কাউকে ভালোবাসতে। কিন্তু মানুষ কি আমার অনুভূতি কখনো বুঝবে? বুঝবে না। মানুষের বয়স বাড়তে থাকে, কিন্তু অনুভূতিগুলো সবসময় আগের মতোই প্রানবন্ত থেকে যায়। সেই আগের আরিয়া যেভাবে স্বপ্ন দেখতো, এই নতুন আরিয়াও ঠিক সেভাবেই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পার্থক্য, তখন সুযোগ ছিল, কিন্তু পারি নি। কিন্তু এখন পারবো, কিন্তু সুযোগ নেই।”

রিদ্ধ সেন, তার অফিস প্রতিষ্ঠার বিশ বছর পূর্ণ হয়েছে, সেই উপলক্ষে আজ ছোটখাটো একটা খাবারের আয়োজন করেছেন। তার অফিসের পুরোনো কর্মকর্তা আরিয়া ফেরদৌস, এবং নতুন যোগ দেওয়া নাহিদ হোসেন, দু’জনকেই তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে রেখেছেন।

এদিকে নাহিদ হোসেন অফিসে ঢুকেই আয়োজন দেখতে লাগলেন। রিদ্ধ সেন তাকে দেখেই বললেন,
“আরেহ বন্ধু, তুই আজকে শুধু আড্ডা দিবি। আজ তোকে কিছুই করতে হবে না।”

নাহিদ হোসেন উত্তরে মুচকি হেসে আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন,
“আরিয়া আসে নি?”

রিদ্ধ সেন বললেন,
“ও তো অনেক আগেই বলল, বাসা থেকে বের হয়েছে। এখনো আসছে না কেন?”

রিদ্ধ সেন সামনে তাকিয়ে দেখলেন, আরিয়া ফেরদৌস অফিসের গেইট দিয়ে ঢুকছেন। আরিয়াকে দেখেই রিদ্ধ নাহিদকে বললেন,
“ওই তো আরিয়া।”

নাহিদ হোসেন আরিয়াকে দেখেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এদিকে রিদ্ধ সেন আরিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু নাহিদ এখনো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি শুধু অবাক দৃষ্টিতে আরিয়াকে দেখছেন, আর ভাবছেন,
“সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঠিকই বলেছেন, মনুষ্য বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না।”

আরিয়া ফেরদৌস একা একা একটা চেয়ারে বসে আছেন। হঠাৎ কোথা থেকে নাহিদ হোসেন তার পাশে এসে বসলেন। আরিয়া তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। নাহিদ হোসেন আরিয়ার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলেন। আরিয়া চোখ সরিয়ে বললেন,
“এতো জায়গা থাকতে তুমি এখানে কেন বসেছো?”

নাহিদ হোসেন আরিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন,
“তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।”

আরিয়া নাহিদের দিকে তাকালেন। তার বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসলো। কারণ আজ অনেক বছর পর তিনি কোনো পুরুষের মুখে তার রূপের প্রশংসা শুনছেন। গুনের প্রশংসা তো অনেকেই করে, কিন্তু রূপের প্রশংসা ভিন্ন ধারার অনুভূতির জন্ম দেয়। এটি সব প্রশংসার চেয়ে বেশি সুন্দর হয়। আরিয়ার চাহনি দেখে নাহিদ বললেন,
“মেরে ফেলবে না তো?”

আরিয়া চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন,
“মারবো কেন?”

“তুমি তো ডেঞ্জারাস মহিলা। আবার কি না কি করে বসো।”

আরিয়া কথাটি শুনে হাসলেন। নাহিদ হোসেন আরিয়ার হাসি দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আজ অনেক বছর আরিয়াকে হাসতে দেখছেন। সেই পুরোনো হাসির মাঝে চঞ্চলতা ছিল, আর এই নতুন হাসিতে গম্ভীরতা আছে। কিন্তু এই দুটো হাসিই চমৎকার। নাহিদ মনে মনে বললেন,
“হয়তো এই মেয়ের সবকিছুই চমৎকার। ওহ, মেয়ে নয়, সে এখন মহিলা।”

কথাটি ভেবেই মনে মনে হাসলেন তিনি। তাকে হাসতে দেখে আরিয়া ফেরদৌস নিজের হাসি আটকে ভ্রূ কুঁচকে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি হাসছো কেন?”

নাহিদ মুখে হাত দিয়ে হাসি আটকে বললেন,
“কোথায় হাসছি? ওই একটু..”

নাহিদকে থামিয়ে দিয়ে আরিয়া ফেরদৌস বললেন,
“তুমি আমাকে ভয় পাও?”

নাহিদ মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, মারাত্মক।”

আরিয়া আবার হাসলেন। নাহিদ এবার বললেন,
“সেদিন যদি তুমি আমায় ফিরিয়ে না দিতে তাহলে আমাদের জীবনটা অন্য রকম হতো, তাই না?”

আরিয়া কথাটি শুনে নীরব হয়ে গেলেন। নাহিদ আবার বললেন,
“মানুষ কতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়, তারপর আবার বৃদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু না পাওয়া অধিকারগুলো সারাজীবন বেঁচে থাকে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত যন্ত্রণা হয়। সবাই তো আর ভালোবাসার মানুষকে পায় না। ঠিক তেমনি আমিও পাই নি। কিন্তু মাঝে মাঝে খারাপ লাগে।”

আরিয়া শীতল কণ্ঠে বললেন,
“ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ায় উত্তম।”

“তোমার উত্তম মনে হচ্ছে, কারণ তোমার ভালোবাসার মানুষটিই ভুল ছিল। কিন্তু আমি তো ভুল মানুষকে ভালোবাসি নি। তবে সে আমাকে ভুল ভেবেছিল।”

“তুমি এসব কথা এখন কেন তুলছো?”

“কারণ আমার জীবনে আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। অতীত মনে করা ছাড়া এখন আমি আর কিইবা করতে পারি। হয়তো মৃত্যুই আমাকে মুক্তি দেবে।”

আরিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। নাহিদ বললেন,
“অতীতের দিনগুলো কি আমরা আবার ফিরে পেতে পারি না?”

আরিয়া ফেরদৌস নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি বলতে চাইছো?”

“বুড়ো বয়সে এসে ঠিক আগের মতো তোমার বন্ধু হতে চাইছি। তবে প্রমিজ করছি, এবার আর তোমার প্রেমে পড়বো না। কারণ প্রেমে তো মানুষ একবার পড়ে। আর আমিও একবার প্রেমে পড়েছিলাম। আর সেই প্রেমিক মন এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তাই দ্বিতীয়বার আমার দ্বারা তা সম্ভব না।”

“তারপর?”

“তারপর আমরা আবার বন্ধু হবো যদি তুমি হ্যাঁ বলো।”

“তাহলে কিন্তু আমাকে রোজ আচার খাওয়াতে হবে।”

কথাটি শুনে নাহিদ হোসেন হাসলেন। সাথেও আরিয়াও। আর দূর থেকে তাদের দেখে রিদ্ধ সেন মনে মনে বললেন,
“রিয়া, একটা সময় তোকে খুব ভালোবাসতাম, তোকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারতাম না, তাই তখন হয়তো নাহিদ আর তোর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা আমি মেনে নিতে পারি নি। কারণ আমি জানতাম, নাহিদ তোকে ভালোবাসতো। আর আমি জানি, নাহিদ তোকে এখনো ভালোবাসে। আমি মনে করতাম, আমার চেয়ে বেশি তোকে কেউ ভালোবাসবে না। কিন্তু নাহিদ তো আমাকেই হারিয়ে দিয়েছে। এখন আমি সত্যিই চাই, তুই সেই আগের আরিয়া হয়েই বাকী জীবন কাটা। আর কতো নিজেকে রঙিন পৃথিবী থেকে বঞ্চিত রাখবি? এবার তো একটু বাঁচার মতো বাঁচা উচিত। বাকী জীবন না হয়, তোরা একসাথে থাক। প্রেম যেখানে ধর্মকেই মানে নি, সেখানে আজ বয়স কেন মানবে? আজ আরেকবার তোদের ভালোবাসা উচিত। শুধু নিজেদের সুখের জন্য।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here