রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৫৩:

0
638

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫৩:

৮৬।
মহুয়া বাসায় এসে মারিয়াকে দেখে চমকে গেলো। মারিয়া মহুয়াকে তার মুখোমুখি বসিয়ে বলল,
“আমার বরের সাথে বাইরে ঘুরতে গিয়ে আমাকে বলেছিস ক্লাসে। কেন মহুয়া? তুই তো এমন ছিলি না!”

মহুয়া মারিয়ার হাত ধরে বলল,
“তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি তোকে মিথ্যে বলেছি কারণ বিষয়টা আমি কাউকে জানাতে চাই নি।”

“কোন বিষয়ের কথা বলছিস?”

মহুয়া বাধ্য হয়ে মারিয়াকে পুরো ঘটনাটি বলল। মারিয়া সব শুনে বলল,
“তুই আমাকে না জানিয়ে এসব প্রহরকে কেন জানিয়েছিস? তুই তো কোনো ছেলের সাথে কথা বলিস না। কিন্তু এখন তোর তো দেখছি আমার বরের সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে।”

“না, না। তুই যেটা ভাবছিস, সেটা মোটেও সত্য না। প্রহর ভাইয়াকে এসব বলার একমাত্র কারণ, উনি এসব শুনে আমাকে সাহায্য করবেন, আর আমি ঝামেলায়ও পড়বো না। তুই নিজেই ভেবে দেখ, আমি যা করেছি সেটা ভাইয়ারা জানলে, আমি কি আর আগের মতো স্বাধীনতা পাবো? যখন তখন কি আমাকে বাতিঘরে যেতে দেবে? কিন্তু প্রহর ভাইয়া আমার সমস্যাটাও সমাধান করে দেবে, আর আমার কোনো ঝামেলাও হবে না। আর উনি ছাড়া আমি কোনো ছেলের সাথে কখনোই ওতোটা কথাবার্তা বলি নি। এমনকি তুই ভালোভাবে জানিস আমি কাজিন ভাইদের সাথেও ওতোটা কথাবার্তা বলি না। তাই আমার প্রহর ভাইয়ার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।”

মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা, সব বুঝলাম এবং মানলামও। আর মানুষের মনের উপর জোর নেই। তাই হয়তো তোর আফ্রিদিকে ভালো লেগেছে। কিন্তু তুই তো কোনো সম্পর্কে যাস নি। এমনকি কখনো কথাও বলিস নি। শুধু একটু সেজেগুজে ছাদে গিয়েছিস, ব্যস, এখানে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? আর আমিও তো সেজেগুজেই বাসা থেকে বের হই। এখন ছেলেরা যদি আমার পেছনে পড়ে থাকে, তাহলে এখানে আমার দোষ কি? আমি কি ফকিরের মতো বের হবো নাকি? শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিস। আর আমিও শুধু শুধুই তোদের সন্দেহ করলাম। সরি।”

“আরেহ, এসব বাদ দে। তুই সেজেগুজে বের হচ্ছিস, কারণ তোর সাজতে ভালো লাগে। আর আমার তো উদ্দেশ্য ভালো ছিলো না। আমি তো শো-অফ করার জন্যই সেজেছি। মারু, আমি অনেক খারাপ হয়ে গেছি। নিজেকে চড় মার‍তে ইচ্ছে করছে। হুট করে এমন কেন হলো বল তো!”

“ধুর, তুই কি মেয়ে নাকি ছেলে!”

“এটা আবার কেমন প্রশ্ন!”

“মেয়ে হলে তো ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ জন্মাবেই, এটা তো স্বাভাবিক। আর এটাই তো বয়স। মানুষ তো এই বয়সেই প্রেম করে। দেখছিস না, আমি আমার বরের প্রেমে পড়ে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছি। শুধু আমার বরের প্রেমে পড়ার বয়সটাই হয়তো শেষ হয়ে গেছে।”

“কে বলেছে শেষ হয়ে গেছে! আমার তো উনাকে খুব রোমান্টিক মনে হয়।”

“বাহ, আমার বর, আর তুই বলছিস রোমান্টিক? আমার সাথে তো রোমান্টিক সুরে কিছু বললই না, তাহলে তোর সাথে কি এমন বলেছে যে, তোর রোমান্টিক মনে হচ্ছে!”

“উনার কাব্যিক কথাবার্তা শুনে বলছি!”

“কাব্যিক কথাবার্তা!”

“হ্যাঁ, রে। ভাইয়া অনেক ভালো কবিতা লেখে। কেন তুই জানিস না?”

মারিয়ার কথাটি শুনে একটু খারাপ লাগলো। প্রহর কবিতা লিখতে পারে, অথচ সে জানে না?
মারিয়া এবার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই কিভাবে জানিস এতোকিছু!”

“আরেহ, ভাইয়া-ই তো আমাকে শুনালো।”

মারিয়া মনে মনে বললো,
“আমাকে তো কখনো শুনাই নি। তাহলে মহুয়াকে কবে শুনালো?”

কিন্তু মারিয়া হেসে মহুয়াকে বলল,
“আরেহ, আমাকেও শুনিয়েছিলো। আমি তো ভেবেছি অন্যের লেখা। বাহ! আমার বর তো দেখছি কবি মানুষ! আচ্ছা, ও তোকে কোন কবিতাটি শুনিয়েছিল?”

“চাঁদনি রাতে হঠাৎ দেখা। কবিতাটা আসলেই খুব সুন্দর। তুই শুনাতে বলিস।”

“আচ্ছা, বলবো। কিন্তু ও তোকে কবিতা শুনানোর সময় কখন পেয়েছে? তোদের তো তেমন দেখাও হয় নি।”

“হয়েছে তো। কতোবার দেখা হয়েছে। বাতিঘরে তো প্রায়ই দেখা হয়।”

মারিয়ার বুকটা কেঁপে উঠলো। মনে মনে ভাবলো,
“প্রহর মহুয়াকে এতো সময় দেয়! অথচ আমার সাথে ঘুরতে যাওয়ার এতোটুকু সময়ও তার নেই?”

সেদিন মারিয়া রাগ করে আর শ্বশুড়বাড়ি যায় নি। তবে সে শাশুড়ীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি। এদিকে মারিয়াকে অবাক করে দিয়ে প্রহরও তাকে কল দেয় নি। মারিয়া সারারাত ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার মন বলছিল, এখনি প্রহর এসে বলবে, ‘আমি নিচে এসেছি, চলে আমার সাথে। তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না।’
না, প্রহর আর সেই রাতে আসে নি। আর মারিয়ার স্বপ্নগুলোও ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। ভালোবাসা যে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক, তা সে আজ বুঝেছে।

সকালে মারিয়া একটু দেরী করেই ঘুম থেকে উঠল। রুম থেকে বের হয়ে দেখলো সবাই চুপচাপ বসে আছে। সে মহুয়াকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?
কিন্ত মহুয়া কিছু বললো না। হঠাৎ মাহাথি আরিয়া ফেরদৌসকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মা, সূচনার এখন আলাদা যত্ন নিতে হবে। এই অবস্থায় আমার মনে হয় না, প্রতিদিনকার ঝামেলাগুলো ওর জন্য অনুকূল।”

আরিয়া ফেরদৌস কোনো উত্তর না দিয়ে মাফিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাফিন মায়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে স্বস্তিকার দিকে তাকালো। স্বস্তিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আমি কি ভাবীর যত্ন নেই না? আমি তো উনি যা বলেন, তাই-ই করি।”

মাফিন থমথমে কন্ঠে বললো,
“স্বস্তিকা, তুমি চুপ করো। আর রুমে যাও।”

স্বস্তিকা চুপচাপ উঠে চলে গেলো। রুমে এসে সে একমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। সে ইদানীং ঘরের কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। কারণ তার এসবে অভ্যাস নেই। সে আজ রান্নাঘর পরিষ্কার করবে বলে পুরো রান্নাঘরে পানি ফেলে রেখেছে। আর সূচনা অল্পের জন্য পিছলে মাটিতে পড়ে যায় নি। সূচনা কন্সিভ করেছে দুই মাস হচ্ছে। যেখানে প্রথম তিনমাস একটু সাবধানে থাকতে হয়, সেখানে আজ একটা অঘটন ঘটতে ঘটতে বেঁচে গেলো। তবে সমস্যাটা হলো এতো বড় একটা ঘটনা স্বস্তিকার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না। সে বুঝার চেষ্টা করছে না, তার ভুলটা কোথায় ছিল! তবে কেউ তাকে দোষী বলে নি, শুধু বলেছে তাকে একটু সচেতন হওয়া উচিত। উত্তরে স্বস্তিকা বলেছে,
“আমি তো আর প্রেগন্যান্ট নই, তাহলে আমি কেন সচেতন হবো? যার বাচ্চা হবে, তার চোখ-কান খোলা রাখা উচিত।”

এই উত্তরটা কারো পছন্দ হয় নি। প্রথমত স্বস্তিকা ওই মুহূর্তে চুপ থাকলেই হতো, দ্বিতীয়ত তার বলার ধরণটা সুন্দর ছিলো না। তাই আরিয়া ফেরদৌস স্বস্তিকার উত্তরে বললেন,
“তুমি একটু সুন্দর করেই কথা বলতে পারো। বড়দের মুখের উপর এভাবে উত্তর দেওয়া উচিত না।”

স্বস্তিকা সাথে সাথেই কাঁদোকাঁদো মুখে বলল,
“আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি নি। আব্বা আর আম্মিজান আমাকে কখনোই এসব নিয়ে কিছু বলেন নি। আপনারাই বকাঝকা করেন।”

স্বস্তিকার উত্তর শুনে আরিয়া ফেরদৌস আর কিছুই বললেন না। এভাবে কথা বললে আরো কথা বাড়বে, তাই তিনি চুপ হয়ে গেলেন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মাফিন মারিয়াকে প্রহরের বাসায় দিয়ে আসার জন্য বের হলো।

গাড়িতে মাফিন আর মারিয়া পাশাপাশি বসে আছে। মাফিন বলল, “প্রহর আসে নি কেন?”

মারিয়া মলিন মুখে বললো, “ওর কাজ ছিল।”

“তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ?”

মারিয়া নিজেকে সামলে বলল,
“হুম, তোমাদের সংসারের ঝামেলাগুলো দেখে খারাপ লাগছে।”

“এ আর নতুন কি! সব ঝামেলা আমার বউয়ের কারণেই হচ্ছে। তবে পরোক্ষভাবে মায়েরই দোষ। মা আমাকে বিয়ে না দিলে এতোকিছু হতো না।”

“ঠিক বলেছো ভাইয়া। মায়ের কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে।”

মাফিন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমাদের বলছিস কেন? শুধু আমার।”

মারিয়া মলিন হাসি দিলো। আর মনে মনে বলল,
“আমার বিয়েটাও তো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কেন যেন বিয়ে নামক সম্পর্কের প্রতি বিরক্ত চলে এসেছে। বিয়ে না হলে কোনো আশা থাকতো না, কোনো ভয় থাকতো না। আর এখন প্রহরকে পাওয়ার আশা, আর হারানোর ভয় দু’টিই আমাকে মানসিকভাবে পাগল করে দিচ্ছে। এর চেয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণা আর কি হতে পারে?”

মারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ভাইয়া, মা কিন্তু মিষ্টি ভাবীকে নিয়ে সন্দেহের মধ্যে ছিল। মা ভাবতো ভাবী আমাদের সংসারটা ভেঙে দেবে। কিন্তু দেখো মায়ের ধারণটা ভুল হয়েছে। আমার এই মুহূর্তে মায়ের উপর খুব রাগ হচ্ছে জানো? খুব রাগ হচ্ছে!”

মারিয়া কথাগুলো বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠলো। মাফিন গাড়ি থামিয়ে মারিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোর? তোকে কেউ কিছু বলেছে? প্রহরের সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?”

মারিয়া মাফিনের হাত ধরে বলল,
“ভাইয়া, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমাকে একটু শান্তি খুঁজে দাও।”

“কি হয়েছে বলবি তো আগে!”

“মা তো বলেছিল প্রেমে কোনো সুখ নেই, পারিবারিকভাবে যেই সম্পর্কগুলো হয়, ওগুলোই খুব সুন্দর। বলো, ভাইয়া। মা তো এটাই বলেছিলো, তাই না?”

“হ্যাঁ, কিন্তু কি হয়েছে!”

“প্রহর আমাকে হয়তো পছন্দ করে না।”

“তোর এমন কেন মনে হচ্ছে?”

মারিয়া মাফিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর মনে মনে ভাবলো,
“না, ভাইয়াকে বলে দিলে যদি প্রহরকে কিছু বলে দেয়? তখন তো প্রহর আমার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যাবে।”

মাফিন বলল, “বলবি কি হয়েছে?”

“ও একটু বকাঝকা করে, এই আর কি। কিন্তু আমার অনেক যত্ন নেয়, জানো? আমাকে ভাত খাইয়ে দেয়, আমার সাথে কত্তো গল্প করে। কিন্তু বকাঝকা করলে একটু তো খারাপ লাগবে, তাই না?”

“সত্যি বলছিস তো! নাকি কথা ঘুরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিস?”

“সত্যি ভাইয়া।”

মাফিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বড়ো হয়ে গেছিস তুই। খুব বড় হয়ে গেছিস।”

মারিয়া অবাক কন্ঠে বললো,
“কিভাবে বুঝলে!”

“মিথ্যে কথা বলা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলা শিখে ফেলেছিস।”

এরপর প্রহরদের বাসার সামনে আসার পর মারিয়া মাফিনের হাত ধরে বলল,
“প্রহর বাবার মতো না। হয়তো আমি মায়ের মতো সংসারে মনোযোগ দিচ্ছি না। হয়তো আমার মধ্যেই কমতি আছে।”

মারিয়া কথাটি বলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। মাফিন গাড়ি থেকে নেমে বলল,
“আর আমি আর ভাইয়াও কিন্তু বড় মামার মতো না। আমাদের সব কিছু বলবি। তোর পাশে আমরা সবসময় থাকবো।”

মারিয়া মুচকি হেসে বললো,
“ভাইয়া, আমি ভালো আছি। শুধু তুমি ভালো থেকো। তোমার জন্য অনেক খারাপ লাগছে। সাংসারিক ঝামেলাগুলো পুরুষদের কতোটা আঘাত করে, সেটা তোমাকে না দেখলে বুঝতাম না। ছোট ভাবীর ভুলের জন্য তুমি মানসিক চাপে আছো। কখনো মা, কখনো বউ, কার পক্ষ নেবে এই দ্বিধায় তোমার হয়তো ঘুমও হয় না। অনেক শুকিয়ে যাচ্ছো, ভাইয়া। এমন কিছু করো, যাতে সবার ভুলগুলোও ভেঙে যায়, আবার সম্পর্কটাও সুন্দর হয়।”

মারিয়াকে বিদায় দেওয়ার পর মাফিন মনে মনে ভাবতে লাগলো তাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে মায়ের ভুলটাও ভাঙবে, সাথে স্বস্তিকার মধ্যেও অনুশোচনা সৃষ্টি হবে। কারণ কাউকে ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শেষমেশ মাফিন একটা উপায়ও খুঁজে পেলো। এখন শুধু এই উপায়কে কাজে রূপান্তর করতে হবে।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here