রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৫২:

0
433

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫২:

৮৫।
দেখতে না দেখতেই মারিয়া আর প্রহরের বিয়ের তিন মাস কেটে গেছে। আর কিভাবে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে প্রহর এবং মারিয়ার মনের শান্তি। তারা কেউই মন থেকে সুখী হতে পারে নি। একদিকে প্রহর জোর করে মারিয়াকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে মারিয়া প্রতিদিন স্বামীর কাছে অবহেলিত হয়ে জোর করে হাসিখুশি থাকার অভিনয় করছে।

প্রতিদিন প্রহর অফিস শেষে বাসায় ফিরলে মারিয়ার সাথে তার কোনো না কোনো ব্যাপারে ছোটখাটো কথা কাটাকাটি লেগেই যায়। আর এরপর মারিয়ার অভিমানের শেষ হয় না। কিন্তু প্রহর তার অভিমানও ভাঙাতে যায় না। আর সেই অভিমানগুলো মারিয়াকে দিন দিন পরিবর্তন করে ফেলছে। আক্দের পর মারিয়ার প্রহরকে নিয়ে যেই সন্দেহটা সৃষ্টি হয়েছিলো, কেন যেন তার মনে হচ্ছে সেটি কোনো সন্দেহ ছিলো না। যা সে মনে করেছিলো, সবই সত্য।

তবে এই তিন মাসেও প্রহরের মনে জায়গা না পাওয়া মেয়েটি, প্রহরের বাবা-মা, আর বোনসহ পুরো আত্মীয়দের মনে জায়গা করে ফেলেছে। যেই মেয়ে ঘরের একটা কাজও জানতো না, সে এখন শাশুড়ীকে সাহায্য করে। যার নিজের ঘর গুছিয়ে রাখতে একদিন সময় পার হয়ে যেতো, সে ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগেই স্বামী ও নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলে। শরবত বানানোটাই যার জন্য অনেক বড়ো দায়িত্ব ছিলো, সে এখন স্বামীর পছন্দের সব খাবার রান্না করা শিখে ফেলেছে। উলটো মারিয়ার এখন রান্নাবান্না করতেই খুব ভালো লাগে।
যদিও মানুষের অভ্যাস বদলে যায়, কিন্তু স্বভাব কি ওতো সহজে পরিবর্তন হয়? আর মারিয়ার সেই স্বভাবগুলোই প্রহরের অপছন্দ। তাদের বিয়ের তিনমাসেও তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয় নি, যা মারিয়া মেনে নিতে পারছে না। সে হুটহাট প্রহরের কাছে স্ত্রীর অধিকার চেয়ে বসে, যা প্রহরকে খুব বিরক্ত করে।

মারিয়ার জোর করে প্রহরের কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করতে যাওয়াটাই যেন দিন দিন মারিয়াকে প্রহরের কাছে উপেক্ষিত করে তুলছে।

কোনো এক গুনীজন বলেছেন,
“যা সহজে পাওয়া যায়, তার মূল্য কেউ দেয় না।”

তাই হয়তো মারিয়ার শুদ্ধ ও পবিত্র অনুভূতিগুলোর গুরুত্ব প্রহর দিতে পারছে না। তাছাড়া মারিয়ার চঞ্চল স্বভাব, প্রহরের বন্ধু বা ছেলে কাজিনদের সামনে উচ্চস্বরে হাসা, অনর্থক কথা বলা, এসব ব্যাপারে প্রহর খুব বিরক্ত, কারণ সে মনে করে মেয়েদের একটু গম্ভীর হওয়া উচিত।

এদিকে সকালে মারিয়ার উপস্থিতি টের পেতেই প্রহরের চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেল। প্রতিদিনই এমন হয়। সকালে ঘুম ভাঙার পর মারিয়া ফ্রেশ হয়ে প্রহরের গালে আদর করতে থাকে, আর এভাবেই প্রহরের ঘুমটা ভেঙে যায়।

প্রহর চোখ খুলে মারিয়ার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই মারিয়া হেসে বলল,
“আমার লক্ষী বরটা ঘুম থেকে উঠেছে তাহলে! যাও, যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি আজ আলু-পরোটা বানাবো। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসবে, তারপর আমরা একসাথে নাস্তা করবো। যাও বর, বসে থেকো না।”

মারিয়া ইদানীং নিজ দায়িত্বে প্রহরকে আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন করা শুরু করে দিয়েছে, যা প্রহরের মোটেও পছন্দ নয়। যদিও প্রহর এই সম্পর্কের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে ভেবেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা কখনোই তার মধ্যে দেখা যায় নি। উলটো অজানা কারণেই তার মারিয়াকে দিন দিন উপদ্রব মনে হচ্ছে।

প্রহর চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমে চলে যেতেই মারিয়া মলিন মুখে জানালার বাইরে তাকালো। আর মনে মনে বললো,
“আমি কি করলে আমার বর আমাকে ভালোবাসবে? মাফিন ভাইয়া তো স্বস্তিকা ভাবীকে পছন্দই করতো না। কিন্তু ভাইয়া তো অন্তত ভাবীর অনেক খেয়াল রাখে। যদিও ভাবীর ব্যবহারের জন্য ভাইয়া মাঝে মাঝে রাগ করে, ঝগড়া করে। কিন্তু তবুও তাদের সম্পর্ক যতোটা ভালো, আমারটা তো মোটেও ততোটা ভালো না। শুধু কি বিয়ের আগে নিবিড় আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, তাই প্রহর আমাকে মেনে নিচ্ছে না? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে!”

মারিয়া মনোযোগ দিয়ে আলু-পরোটা বানিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলো। প্রহর এসে চুপচাপ নাস্তা করে চলে গেলো। মাসুমা আকতার ছেলের হাবভাব দেখে বললেন,
“নাস্তাটা মারিয়া বানিয়েছে। কেমন হয়েছে বললি না যে!”

প্রহর বলল, “হুম, ভালো হয়েছে।”

মারিয়া প্রহরের মুখে এতোটুকু প্রশংসা শুনে খুশি হয়ে গেলো। হয়তো প্রহর নিজ থেকে বললে সে আরো খুশি হতো। প্রহর অফিসে চলে যাওয়ার পর মারিয়া রুমে এসে প্রহরের শার্ট জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে রইলো আর বিড়বিড় করে বলল,
“আমাকে একটু জড়িয়েও ধরো নি কখনো। আর আমি ধরলে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে থাকো। আমি তো তোমার বিয়ে করা বউ নাকি! তুমি তো দেখে শুনেই আমাকে বিয়ে করেছো। তবুও এমন একটা ভাব দেখাও, যেন তোমাকে কেউ ধরে-বেঁধে জোর করে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে। বর, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি। আক্দের পর পর তুমি আমাকে খুব অবহেলা করতে। মানুষ নতুন বউদের সাথে কতো রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে, আর তুমি তো তখন সাজেক গিয়েও আমাকে বকেছিলে। কিন্তু আগের চেয়ে ইদানীং আমি অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে হারিয়ে ফেললে, আমি পাগল হয়ে যাবো। ইয়া আল্লাহ, কিছু তো করো। আমার বর আমাকে কেন ভালোবাসছে না? আমি প্রতিদিন নামাজে আমার বরকেই চাইছি। তবুও আমার বর আমার হচ্ছে না। আল্লাহ, তুমি কি আমার দোয়া কবুল করছো না? আমি কিভাবে চাইলে তুমি প্রহরের মনটা আমার প্রতি দুর্বল করে দেবে! তুমি যেভাবেই পছন্দ করো, আমি ওভাবেই চাইবো। আজ থেকে না হয় তাহাজ্জুদও পড়বো। কিন্তু আমার প্রহরকে লাগবেই লাগবে।”

অন্যদিকে, মহুয়া প্রহরের মুখোমুখি বসে আছে। প্রহর চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। মহুয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ভাইয়া, কিছু বলছেন না কেন?”

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি এমন বোকামি করতে গেলে কেন?”

“আমি তখন বুঝতে পারি নি এমন কিছু হবে। কিন্তু ব্যাপারটা অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে যাচ্ছে। মা আর ভাইয়ারা জানলে আমাকে মেরেই ফেলবে। মারিয়াকে বলেও লাভ হবে না। একমাত্র আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। ছেলেগুলো আমার পিছুই ছাড়ছে না। এখানে আমারও দোষ আছে। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে বই পড়ার জন্য ছাদে চলে যেতাম। তখন ছাদেও ওই ছেলেগুলো উঠতো। আমার ওদের দেখে নেমে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি ওখানে বসেই বই পড়তাম। আর এখন ওরা তো আমার পিছুই ছাড়ছে না। একই ফ্ল্যাটে থাকি, যদি মা জেনে যায়, তাহলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।”

প্রহর বলল,
“তুমি আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছ। আমি কিছু বলার পর, ওরা যদি আরো ক্ষেপে যায়? তোমার যেহেতু দোষ নেই, অন্তত মাফিনকে বিষয়টা জানাও।”

“না, ভাইয়া। অনেক বকা দেবে।”

এদিকে নিবিড় তার বন্ধুদের নিয়ে আজ সেই রেস্টুরেন্টেই গেলো, যেখানে প্রহর মহুয়াকে নিয়ে বসেছিল। নিবিড়ের তো তাদের দু’জনকে একসাথে দেখেই রাগ উঠে গেলো। সে সাথে সাথেই দু’জনের ছবি উঠিয়ে মারিয়াকে পাঠালো। মারিয়া হোয়াটসঅ্যাপে অপরিচিত নম্বর দেখে বিড়বিড় করে বলল,
“এই নম্বরটাও হয়তো ওই নিবিড়ের বাচ্চার! ওই ব্যাটাকে তিন মাস আগেই ব্লক করে দিয়েছিলাম। কিন্তু খচ্চরটা অন্য নম্বর থেকেও আমাকে মেসেজ দিয়ে বিরক্ত করে।”

এসব বলতে বলতে মারিয়া নম্বরটা ব্লক করতে যাবে তখনই আরেকটা মেসেজ এলো।
লেখা,
“ব্লক করার আগে একবার ছবিটি দেখে নিও।”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে ছবিটির দিকে তাকালো। নেটওয়ার্ক কম, তাই এখনো ব্লার হয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর ছবিটি ডাউনলোড হলে মারিয়া দেখলো, একটা রেস্টুরেন্টে প্রহর আর মহুয়া বসে আছে। ছবিটি দেখেই মারিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। সে নিবিড়কে সাথে সাথেই কল করলো। নিবিড় ভিডিও কল দিয়ে মারিয়াকে তাদের দেখালো। মারিয়া সাথে সাথেই কল কেটে প্রহরকে ফোন করলো। অনেকবার রিং হওয়ার পরও প্রহর ফোন ধরছে না। এবার সে মহুয়াকে কল করলো। মহুয়া মারিয়ার কল দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সে প্রহরকে বলল,
“ভাইয়া, ও আপনাকেও কল করেছে। এখন আমাকেও করছে। ও কি কিছু বুঝে ফেলেছে?”

প্রহর বলল,
“বুঝলেও বা কি হবে। তুমি সত্যটা বলে দেবে। এখানে তো তোমার দোষ নেই।”

মহুয়া মনে মনে বললো,
“আমারই তো দোষ। ভাইয়াকে তো আমি পুরো সত্যটা বলিই নি। কিন্তু মারিয়া তো দেখেছে, আমি ইচ্ছে করে সেজেগুজে ছাদে যেতাম। কারণ আমার ওই ছেলেগুলোর মধ্যে আফ্রিদিকে খুব ভালো লাগতো। তাই ওর সামনে পরিপাটি হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি তো তখন জানতাম না আফ্রিদি দেখতে যতোটা ভদ্র, তার চরিত্র ততোটাই জঘন্য। ও যে ড্রাগ নেয়, তা তো আমি মাত্র জেনেছি। মারিয়া এসব জানলে ভাইয়াকে বলে দেবে। ভাইয়া তখন আমাকে একদমই সাহায্য করবে না। আর মারিয়ার কথায় যদিও বা সাহায্য করবে, কিন্তু আমি উনার চোখে খারাপ হয়ে যাবো। কিন্তু আমার তো দোষ নেই। হুট করে যদি আমার একটা ছেলের প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হয়, এখানে দোষের কি আছে!”

মহুয়া মারিয়ার কল রিসিভ করে বলল, এই মুহূর্তে সে ক্লাসে আছে। এদিকে মহুয়ার কথা শুনে মারিয়ার রাগ আরো বেড়ে গেলো। সে তার বোনকে অবিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু মিথ্যে বলার পেছনে একটা কারণ তো অবশ্যই আছে। মারিয়াকে সেই কারণটাই এখন জানতে হবে।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here