রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-০৮

0
920

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৮

১৬।
গাড়িতে উঠেই মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো মারিয়া। আর মহুয়া তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মারিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর মহুয়ার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। সে ভেবেছে মহুয়া তার পক্ষ নিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু সে উলটো একটা বাঁকা হাসি দিয়ে মুখের উপর উড়না টেনে বাসে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আর মারিয়া এক রাশ আক্ষেপ নিয়ে জানালার বাইরে তাকালো।

দুইদিন আগেই মাফিনের সাথে গিয়ে মারিয়া দোকান থেকে কিছু সুন্দর সুন্দর লং শার্ট কিনে এনেছিল, সাথে কিছু নরমাল শার্ট এবং জিন্স। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই আরিয়া ফেরদৌস সবগুলো শার্ট আর জিন্স ব্যাগ থেকে বের করে ফেললেন। আর সেসবের পরিবর্তে কিছু সালোয়ার-কামিজ মারিয়ার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন।

মারিয়া এসব দেখে আরিয়াকে বলেছিল,
“মা, তুমি এসব কি করছো?”

আরিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাসায় এসব জামা-কাপড় পরো, বারণ করি নি। মাঝে মাঝে কোচিংয়েও এসব পরে যাও, আর বারণ করলেও শুনো না। আমি তো বাসায় থাকি না। সেই সুযোগে ইচ্ছেমতো কাপড় পরে রাস্তায় নেমে পড়ো। কিন্তু ওখানে এসব পরলে আমি তোমাকে আর বাসায় ঢুকতে দেবো না।”

“এসব কাপড়ে কি সমস্যা?”

“এই মারিয়া, খবরদার যদি কোনো প্রশ্ন করিস! আমি যা বুঝি, তা তুই বুঝবি না। আর এর বেশি প্রশ্ন করলে, আমি তোকে আর বাসা থেকেই বেরোতে দেবো না।”

মূলত মারিয়ার মন খারাপের কারণ আরিয়া ফেরদৌস তাকে তার পছন্দের জামাগুলো সাথে করে আনতে দেন নি। এদিকে সে বান্ধবীদের সাথে পরিকল্পনা করেই সেই জামাগুলো কিনেছিল। কিন্তু এখন তার সব পরিকল্পনায় ভেস্তে গেলো।

দুপুরে বান্দরবান পৌঁছে মহুয়া মাকে ফোন করে বলল,
“মা, আমরা বান্দরবান চলে এসেছি।”

আরিয়া বললেন,
“আচ্ছা মা, একটু সতর্ক থেকো। আর মারিয়ার খেয়াল রেখো।”

“আচ্ছা, মা।”

মহুয়ার কথা শেষ হলে মারিয়া তাকে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চান্দু, মা কি বললো? আমার গোয়েন্দাগিরি করতে বলেছে, তাই না?”

মহুয়া মেকি হেসে বলল,
“মা তোর খেয়াল রাখতে বলেছে। তুই তো আর নিজের যত্ন নিস না। তাই আমাকেই এখন সেই দায়িত্ব দিয়েছে।”

মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“আমি নিজের যত্ন ভালোভাবেই নিতে পারি। অন্যরা যদি মারিয়া নাওয়ালকে দুর্বল মনে করে, এটা একান্তই তাদের সমস্যা। আমার নয়।”

কথাটি বলেই মারিয়া জিভ বের করে মহুয়াকে ভেংচি কেটে চলে গেলো। আর এদিকে মহুয়া মারিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,
“মারু, তুই কবে বড় হবি?”

মেঘলা পার্কের সামনে প্রিয়াদের বাস এসে থামলো। ঠিক সেই মুহূর্তেই মারিয়া তার সহপাঠীদের নিয়ে সেই পার্কে ঢুকলো। মারিয়া তার বান্ধবী মিতুর হাতে তার ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে মোবাইলের সাথে তার সেল্ফি স্টিকটা সংযুক্ত করে চারপাশের দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ কর‍তে লাগলো।

এদিকে মহুয়া ধীরে ধীরে হাঁটছে। তার হাতে আছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস চাঁদের পাহাড়। সে শুনেছে বইটিতে প্রাকৃতিক দৃশ্যের খুব সুন্দর বর্ণনা আছে। তাই সে ভেবেছে এমন শান্ত পরিবেশে বসেই সে বইটি পড়বে। সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলো।
তার চারপাশে বড়ো বড়ো গাছের সারি। মাঝখানে ছোট একটা কাঠের বেঞ্চ। সেই বেঞ্চে বসে মহুয়া প্রশান্তচিত্তে বইটি খুলে পড়তে শুরু করলো।

অন্যদিকে মারিয়া চারপাশের দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত। সে পুরো মেঘলা পার্ক ঘুরে দেখার পর মহুয়াকে ফোন করলো। মহুয়া মারিয়ার কল দেখার সাথে সাথেই রিসিভ করে বললো,
“ঘুরাঘুরি শেষ?”

মারিয়া বললো,
“চান্দু, তুই আমার সাথে কেন এসেছিস বলতো? তোকে তো দেখায় যাচ্ছে না।”

“আমি আছি একটা জায়গায়। আমার জন্য চিন্তা করিস না। তোদের কলেজের দু’জন ম্যামও আছেন এখানে। তাদের হয়তো পাহাড় বাওয়ার অভ্যাস নেই।”

“ওহ হ্যাঁ, রাহেলা ম্যাম। উনি কেন যে এসেছেন! রাহেলা ম্যাম তো অল্প একটু হাঁটলেই ক্লান্ত হয়ে যান। আর শারমিন ম্যাম হয়তো উনাকে সঙ্গ দিতেই বসে আছেন। থাক তোর জন্য তো ভালোই হয়েছে। আজ তারা না থাকলে তোকে তোর বেশ ফেলে আমার বেশ ধারণ করতে হতো।”

“তা ঠিক। আচ্ছা, তোদের ঘুরাঘুরি শেষ হয় নি?”

“না, আমরা মাত্র ক্যাবল কার থেকে নামলাম। আচ্ছা, আমি এখন কাইকিং করবো ভাবছি। বাকীটা দেখা হলে বলবো।”

এদিকে প্রিয়া তার ফোনে চারপাশের দৃশ্য ধারণ করতে করতে সামনে হাঁটছিল। হঠাৎ সে থমকে গেলো। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে তার সামনে তাকালো। তার সামনে বসা মেয়েটিকে দেখে তার চোখে বিষ্ময় ফুটে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি তার ফোন বন্ধ করে আরো কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে ভালোভাবে দেখার পর তার চোখমুখের বিষ্ময় ভাব কেটে গেলো। সেই চোখে এখন বিষ্ময়ের পরিবর্তে উত্তেজনা ভীড় করেছে। প্রিয়া আর দেরী না করে দ্রুত প্রহরকে ফোন করলো। কয়েক বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো প্রহর।

কল ধরতেই প্রিয়া চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“ভাইয়া, আমি তোর মায়াবিনীকে পেয়ে গেছি।”

প্রহর অনেকটা অবাক হয়ে বলল,
“কি বলছিস? কোথায় পেয়েছিস?”

“ভাইয়া, ভাবী আমার সামনে।”

প্রহর ওই সময় বিছানায় শুয়ে ছিল। সে প্রিয়ার কথাটি শুনার পর মুহূর্তেই বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে গেলো। তারপর বলল,
“তুই নিশ্চিত হয়েই বলছিস তো!”

“হ্যাঁ, ভাইয়া। হ্যাঁ।”

প্রহর কিছু একটা ভেবে বললো,
“কিন্তু ও হঠাৎ বান্দরবান কি করছে?”

“কি অদ্ভুত প্রশ্ন করলি তুই! বান্দরবান মানুষ কেন আসে? ঘুরতেই এসেছে হয়তো।”

প্রহর নিজের প্রশ্নে নিজেই লজ্জিত হলো। অতিরিক্ত উত্তেজনায় সে সব কথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। তাই কি বলতে কি বলছে সেটাই সে খেয়াল করে নি।

প্রিয়া ভাইকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,
“আচ্ছা, তুই আমাকে সেই ছবিটা আবার পাঠা তো। আমি ভাবীকে আরেকবার দেখি, তারপর তোকে জানাচ্ছি।”

প্রহর কল কেটে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছবিটি প্রিয়াকে পাঠিয়ে দিলো। প্রিয়া ছবির মেয়ে ও তার সামনে বসা মেয়েটিকে দেখে নিশ্চিত হয়ে আবার প্রহরকে ফোন দিয়ে বললো, এইটাই সেই মেয়ে, যার প্রেমের সাগরে প্রহর ডুবে গেছে।

প্রহর নিশ্চিত হয়ে এবার প্রশান্তির হাসি হাসলো। তারপর টুস-টুসির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। আর খাঁচার দিকে ঝুঁকে বলল,
“এই টুসটুস একটা কথা শুনবি? তোর কাছে যেমন একটা টুসটুসি আছে, তেমনি খুব শীঘ্রই আমিও আমার টুসটুসিকে কাছে পাবো। আচ্ছা একটা কথা বল না, আমার সবকিছু যতোটা সহজ মনে হচ্ছে, সবটাই কি আদৌ সহজ হবে? আমি মায়াবিনীকে যতোটা ভালোবাসি, সেও কি আমাকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসবে?”

প্রহরের মনে ভালোলাগা, উত্তেজনা ও ভীতির সমাবেশে এক মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। এই অনুভূতি কোন তীরে আছড়ে পড়বে, তার কোনো উত্তর নেই।

১৭।

কাইকিং করার পর মারিয়া একটা ছাউনিতে এসে বসলো, আর মনোযোগ দিয়ে তার ফোনে তোলা ছবিগুলো দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ বসার পর তারা আবার বাসে ফিরে এলো। মহুয়া বাসে বসে মারিয়ার ফোনে তোলা ছবিগুলো দেখতে লাগলো।

মারিয়া বলল,
“মহু, তুই আসলেই কি মানুষ?”

মহুয়া অবাক হয়ে বললো,
“হঠাৎ এভাবে কেন বলছিস?”

“কি অদ্ভুত! এতো সুন্দর জায়গায় এসেছিস, কিন্তু ঘুরে দেখলি না? বইটা তো ঘরে বসেও পড়তে পারতি।”

মহুয়া মুচকি হেসে বললো,
“তা তো পারতাম। কিন্তু এমন পরিবেশে বই পড়ার যে আলাদা আনন্দ আছে, তা আজ বুঝেছি। আমি বাসায় থাকলে বারান্দা বা ছাদ বা স্বল্প পরিসরে আকাশটাকে সাক্ষী রেখে বই পড়েছি। আশেপাশে পাতাবাহার বা একটা-দুইটা গাছ ছিল। আর এখানে তো অরণ্যই অরণ্য। আজ গাছের সারির মাঝে বসে বই পড়াই আমার আলাদা অনুভূতি হয়েছে। সত্যি তোর সাথে এসে খুব ভালো হয়েছে।”

মারিয়া অবাক দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

মহুয়া আবার বললো,
“আর জানিস, এই প্রকৃতির হাওয়াটা খুব মিষ্টি। তুই কি কখনো হাওয়ার গন্ধ পেয়েছিস?”

“হাওয়ার আবার গন্ধ থাকে নাকি?”

“হ্যাঁ, আজ এখানে এসে বুঝেছি, হাওয়ার গন্ধ অনেক মিষ্টি।”

মারিয়া এবার হাসতে হাসতে বললো,
“এতোদিন কি তেতো ছিল?”

মহুয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“প্লিজ, তুই কারো অনুভূতি নিয়ে মজা করিস না। আজ তুই অন্যের অনুভূতি নিয়ে মজা করছিস। দেখবি, একদিন তোর অনুভূতি অন্যের কাছে তামাশার বিষয় হবে।”

মারিয়া অবাক হয়ে বললো,
“চান্দু, তুই আমাকে অভিশাপ দিচ্ছিস?”

মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি তোকে কেন অভিশাপ দেবো, মারু? তুই তো আমার বোন। আমি তোকে বোঝাতে চাইছি।”

মারিয়া মহুয়াকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা, চান্দু তুই যা বোঝানোর আমাকে বাসায় গিয়ে বোঝাস। এখন একটু চুপ কর। আমাকে ছবিগুলো আপলোড দিতে দে।”

মারিয়া কিছু ছবি বাছাই করে মহুয়াকে বললো,
“আচ্ছা, দেখ, এই ছবিগুলোর ক্যাপশন কি দিলে ভালো হবে?”

মহুয়া ছবিগুলো দেখে বলল,
“মেঘলা রাজ্যে নেই আকাশে মেঘ,
গাছের ফাঁকে যেথায় মিষ্টি হাওয়ার রেশ।
পাহাড়ে ঢালুর বেয়ে নেমেছি এক অচিনপুরে,
মিষ্টি হাওয়ার তালে আমি ভেসে যাবো অজানা দেশে।”

মহুয়ার ছোটখাটো কবিতাটি শুনে মারিয়া চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
মহুয়া বললো, “ভালো হয় নি?”

মারিয়া বলল,
“ভালো হয়েছে। কিন্তু এসব সাহিত্যিক ভাষা আমার সাথে যাচ্ছে না। দেখা যাবে, এই ক্যাপশন দেখে সবাই হাসির রিয়েক্ট দেবে। তখন তোর কবিতাটাও জলে যাবে, সাথে আমার ছবিগুলোও।”

এদিকে ভাইয়ের সাথে কথা বলার পর প্রিয়া এসে দেখলো সেই মেয়েটি আর নেই। আশেপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরও সে মেয়েটিকে আর দেখলো না। সে হতাশ হয়ে পড়লো আর মনে মনে বললো,
“আল্লাহ, এই মেয়েটিকে খুঁজে দাও। আমি তো ভাইয়াকে আশা দিয়ে ফেলেছি। এখনও তো তার নাম, ঠিকানা কিছুই জানলাম না। আর এর আগেই হারিয়ে ফেললাম?”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here