রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-০৯

0
555

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৯

১৮।
আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে বাস ছুটে চলছে নীলাচলের উদ্দেশ্যে। মহুয়া জানালার বাইরে তার চোখদুটি ব্যস্ত রেখেছে। আর তার ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আজ এই আঁকাবাঁকা রাস্তা তাকে হাসাচ্ছে। এতোদিন তার হাসির বিষয়বস্তু ছিল বইয়ের পাতায়। আর আজ সেই বিষয়বস্তু সে প্রকৃতির রূপের মাঝে খুঁজে পেয়েছে।

মহুয়া মনে মনে ভাবছে,
“মারিয়ার শখ মোটেও খারাপ নয়। চার দেয়ালের মাঝে বসে কিছু বইয়ের পাতা উল্টিয়ে এতো সুন্দর প্রকৃতিকে ভালোভাবে অনুভব করা যায় না। এই অনুভূতি চাক্ষুষ অবলোকনের জন্য। এটি আত্নার বিনোদন। এ অনুভূতি মনকে শান্ত করে দেয়।”

নীলাচল পৌঁছে তারা হোটেলে উঠলো। এখানে তারা দুই দিন থাকবে। আজ নীলাচল ঘুরে দেখবে, আর আগামীকাল চিম্বুক পাহাড় ও নীলগিরি। আর শেষের দিন যাবে দেবতাখুম। যদিও বান্দরবানে ঘোরার মতো আরো অনেক স্থান রয়েছে, যেমন কেওক্রাডং, সাকা হাফং, সাঙ্গু নদী, বগালেক, রেমাক্রি, নাফাখুম ঝর্ণা, আমিয়াখুম জলপ্রপাতসহ আরো ছোটখাটো স্থান। কিন্তু মারিয়ার কলেজ থেকে শুধু কয়েকটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।

দুই বেডের একটা রুমে মারিয়া ও মহুয়ার সাথে থাকবে মারিয়ার দু’জন বান্ধবী মিতু ও সিয়া। রুমে ঢুকেই মারিয়া ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। আর মহুয়া ছোট একটা টেবিলের উপর তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে লাগলো।

মহুয়ার নিয়ে আসা জিনিসপত্র দেখে মিতু মারিয়ার পাশে বসে চাপা কন্ঠে বললো,
“তোর বোন কি এখানেই থেকে যাবে নাকি?”

মারিয়া এক চোখ খুলে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা তুলে বালিশটি কোলের উপর রাখলো। তারপর দুই গালে দুই হাত রেখে গম্ভীর সুরে মহুয়াকে বলল,
“চান্দু, তুই এতোগুলো বই কেন এনেছিস?”

মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এতোগুলো কোথায়? মাত্র তো পাঁচটা এনেছি। বাসায় থাকলে সময়গুলো কলেজের পড়া শেষ করতে করতেই চলে যায়। আবার কোচিংয়ের পড়াও শেষ করতে হয়। তাই ভেবেছি এখানে এসেই বইগুলো পড়বো। এখানে তো যথেষ্ট সময় আছে।”

মিতু অবাক হয়ে বললো,
“তুমি এতোগুলো বই দুইদিনে শেষ করতে পারবে?”

“হুম, মনোযোগ দিয়ে পড়লে বেশিক্ষণ লাগবে না। আর এখানে তো কোনো চাপ নেই।”

মিতু মুখ চেপে হাসলো। সিয়া হঠাৎ মহুয়াকে বলে উঠলো,
“আমি যখন মারিয়াকে সেলোয়ার-কামিজে দেখেছি, তখন ভেবেছিলাম হয়তো তুমিই হবে। কারণ ও তো বলেছে তুমি সাথে আসছো। আবার যখন তোমাকে বাসে বই পড়তে দেখেছি, তখন ভেবেছি, আরেহ, মারিয়া আবার বই পড়ুয়া হলো কবে থেকে? তোমাদের দুজনের চেহারায় এতো মিল। বাসায় কেউ বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় না?”

মারিয়া হেসে বলল,
“অবশ্যই না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের চেহারায় মিল রাখলেও, স্বভাবে মিল রাখেন নি। আমার সাথে কেউ পাঁচ মিনিট কথা বললেই আমার প্রেমে পড়ে যাবে। আর মহুয়ার জন্য তো এসব স্বপ্ন!”

মহুয়া মলিন হেসে বলল,
“স্বভাব নিজের সৃষ্টি। কেউ চাইলে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে, আবার না চাইলে সারাদিন নিষ্ক্রিয় মানুষের মতোও বসে থাকতে পারে।”

মারিয়া কপাল কুঁচকে বললো,
“আমি নিষ্ক্রিয় মানুষ?”

মহুয়া হেসে বললো,
“কোনো পুরুষ অন্তত পাঁচ মিনিট কথা বলে কোনো নিস্ক্রিয় মানুষের প্রেমে পড়বে না। আর তুমি যেহেতু বলছো, যে কেউ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তোমার প্রেমে পড়বে। তাহলে তো তুমি নিস্ক্রিয় নও। তুমি তো অন্যকিছু।”

সিয়া মহুয়া আর মারিয়ার মিষ্টি ঝগড়া দেখে হাসতে হাসতে বলল,
“আচ্ছা বাবা, এখন চুপ করো তো তোমরা। তোমাদের দেখে আমার বড় আপুর কথা মনে পড়েছে। আপু বিয়ের আগে আমার সাথে এভাবেই ঝগড়া করতো।”

মিতু আক্ষেপ করে বলল,
“ইশ! আজ কোনো বোন নেই বলে আমাকে এখন চুপচাপ বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হলো।”

মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“মহুর মতো বোন পেলে, জীবনটাও পানসে মনে হবে।”

কথাটি বলে মারিয়া কিছুক্ষণ বাঁকা চোখে মহুয়ার দিকে তাকালো। তারপর বিছানা ছেড়ে মহুয়ার কাছে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“এই পানসে জীবনটাই কিন্তু আমার খুব প্রিয়। আই লাভ ইউ চান্দু। তোর বিয়েতে তোকে আমি একটা লাইব্রেরি উপহার দেবো।”

মহুয়া হেসে বলল,
“আই লাভ ইউ টু। আর আমি তোর বিয়েতে তোকে সুইজারল্যান্ডের টিকেট কিনে দেবো।”

মারিয়া মহুয়ার গাল টেনে বলল,
“ওয়াও। আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বিয়ে করতে।”

“তবে এখন বিয়ে করলে বাসার পাশের রেস্টুরেন্টের বিলটাই দেবো শুধু।”

ভোরে ঘুম ভাঙতেই মারিয়া লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। জানালার বাইরে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে মহুয়াকে কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু মহুয়া ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। এবার সে সিয়া ও মিতুকে একপ্রকার টেনে বিছানা থেকে তুললো।

সিয়া ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
“মারিয়া, কি হয়েছে তোর?”

মারিয়া উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“এখন যদি আমরা নীলাচল না যাই, তাহলে এইখানে আসাটাই মিথ্যে হয়ে যাবে। প্লিজ তোরা তাড়াতাড়ি আয়।”

মারিয়ার ঠেলাঠেলিতে সিয়া আর মিতু মুখ ধুয়ে তার সাথে বেরিয়ে পড়লো। এদিকে মারিয়ার অনুরোধে তাদের সঙ্গ দিলো চারজন ছেলে সহপাঠী ও একজন শিক্ষক।

ভোরে নীলাচল যে এতো সুন্দর হয়, তা এই মুহূর্তে এখানে না আসলে তারা কখনোই বুঝতো না। মারিয়া অপলক দৃষ্টিতে পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘের ভেলা দেখছিলো। হঠাৎ মহুয়ার কথা মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি ফোন বের করে দৃশ্যটি ভিডিওতে ধারণ করে ফেললো।

মিতু মারিয়ার কাছে এসে বললো,
“মারিয়া, তুই কিভাবে জানলি ভোরে নীলাচল এতো সুন্দর দেখায়?”

“এখানে আসার আগে আমি সব জেনে এসেছি।”

“কিভাবে?”

“এইটাও জিজ্ঞেস করতে হয়?”

কথাটি বলে মারিয়া তার ফোনের দিকে ইশারা করে বললো,
“আমার প্রেমিক আমাকে জানিয়েছে।”

সিয়া বললো,
“আমরা তো কাল বিকেলে এই জায়গায় এসে ভেবেছিলাম জায়গাটা মেঘলার মতো ওতো সুন্দর না। কিন্তু এই মুহূর্তে এখানে না আসলে আমরা আসল সৌন্দর্যটাই মিস করে ফেলতাম, তাই না মিতু?”

মিতু বললো, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।”

সূর্য উঠার কিছুক্ষণ পর তারা হোটেলে ফিরে এলো। এদিকে মহুয়া মারিয়ার ফোনে ধারণ করা ভিডিওটা দেখে মুচকি হেসে বলল,
“আসলেই অনেক সুন্দর!”

মিতু বলল,
“মহুয়া, তোমার আফসোস লাগছে না?”

“আফসোস কেন লাগবে?”

“এই যে মিস করে ফেললে?”

“না, মিস তো করি নি। মারিয়া তো ভিডিও করে এনেছে। ও যেখানেই যায় সবসময় আমার জন্য ভিডিও করে আনে। আসলে আমার বেশি ঘুরতে ভালো লাগে না। আমি ঘরে একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করি। বাইরে কতো মানুষ! আমার ভিড়ভাড় একদম অসহ্য লাগে।”

মিতু বাঁকা চোখে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসলো। তারপর মারিয়ার কাছে এসে চাপা কন্ঠে বললো,
“ভাবছি তোর বোনের বান্ধবীগুলো কেমন!”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কেন?”

“এই যে এতো বোরিং। তারাও কি এতো বোরিং নাকি?”

মারিয়ার দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমিই মহুয়ার বান্ধবী। ওর একমাত্র বেস্টু বই আর মারিয়া।”

“সিরিয়াসলি? ও এতো বোরিং! বিয়ের পর দেখিস ওর বর খুব বিরক্ত হবে।”

মারিয়া রাগী চোখে মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“অবশ্যই না। আমার চান্দু বিয়ের পর অনেক সুখী হবে। ছেলেরা যেমন মেয়ে বউ হিসেবে পছন্দ করে তার সব গুণ মহুর মধ্যে আছে। আর ও মোটেও বোরিং নয়। ও আছে তাই আমি বাসায় একদম বিরক্ত হই না। জানিস, ও অনেক ভালো শ্রোতা৷ ও আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। আর মানুষ ভেদে ব্যক্তিত্ব অবশ্যই ভিন্ন হবে। তোর আর আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, তাই তোর মনে হচ্ছে ও খুব বোরিং। যখন একই দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের সাথে ওর মিল হবে, তখন দেখবি তার কাছে মহুয়া খুবই প্রিয় একজন হবে। কারণ মানুষ হিসেবে আমার চান্দু বেস্ট।”

১৯।
নাস্তা করেই সবাই রওনা দিলো নীলগিরির উদ্দেশ্যে। নীলগিরির যাওয়ার পথেই শৈলপ্রপাত ও চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। তবে তাদের বাস একবার মিলনছড়ি এসে থামলো। তারা আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর আবার যাত্রা শুরু করলো। তারপর তারা দুপুরে শৈলপ্রপাত এসে পৌঁছালো।

বর্ষার মৌসুমে শৈলপ্রপাতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। কিন্তু এখন বর্ষার মৌসুম না হওয়ায় পানির পরিমাণ কম।

মারিয়া তার ফোন বের করে কয়েকটা ছবি উঠালো। তারপর ভিডিও ধারণ করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। সে একটা শিলার উপর বসে অল্প পানিতেই তার পা ডুবিয়ে রাখলো। ঠান্ডা পানির স্রোত ধীরে ধীরে তার পায়ের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে সেই শীতল পানির স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো। হঠাৎ তার মনে হলো তার পাশে কেউ এসে বসেছে। চোখ খুলে পাশ ফিরে দেখলো নিবিড়।

নিবিড় একদৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মারিয়া তার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“কি সমস্যা?”

“তোমাকে দেখছি।”

“অদ্ভুত তো। তুই আমাকে এভাবে কেন দেখবি?”

“তুমি আমাকে আবার তুই করে বলছো?”

মারিয়া ব্যাঙ্গ করে হেসে বললো,
“তুই আমার কাছ থেকে এতো সম্মান আশা করিস কেন বলতো?”

নিবিড় মারিয়ার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বললো,
“তোমার কাছে সম্মানিত হওয়া আমার বহুদিনের স্বপ্ন।”

“তুই আমার ক্লাসমেট। আর আমি সবাইকেই তুই করে বলি। তোকে আলাদা ভাবে এতো সম্মান দিতে পারবো না।”

“কেন?”

“কারণ তুই আমার ভাইয়ের মতো।”

“মারিয়া!”

“কি?”

“মারিয়া!”

“হ্যাঁ, বল না।”

“মারিয়া!”

মারিয়া এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই প্লিজ এসব ন্যাকামো বন্ধ কর।”

“ভালোবাসি।”

“তুই কি পাগল!”

“হুম, সেই স্কুল থেকেই।”

“আমার মা আর ভাইরা জানলে তোকে এখানেই ভাসিয়ে দেবে।”

“সমস্যা নেই। তোমাকে নিয়ে ভেসে যাবো।”

মারিয়া দাঁতে দাঁত চেপে দুই হাত মুঠো করে চেঁচিয়ে বললো,
“আল্লাহ, একটু শান্তিতে ঘুরতেও পারি না এই ব্যাটার জন্য। আমার মা যদি জানতে পারে তুই আমাকে বিরক্ত করিস, তাহলে আমাকে আর কলেজেই যেতে দেবে না। ভাই রে ভাই, তুই আমাকে শিক্ষা অর্জন করা থেকে বঞ্চিত করিস না। আমার পিছু ছেড়ে দে। নয়তো আমার অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাবে।”

কথাটি বলেই মারিয়া উঠে চলে গেলো। আর নিবিড় সেখানেই বসে মারিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“তুমি কি আমার জন্য একটু অপেক্ষা করতে পারবে না? আমি কি সেই ভাগ্যবান হতে পারি না যার সাথে তোমার বিয়ে হবে!”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here