#ইস্ক,১৯,২০
#সাদিয়া
১৯
সূর্যের দেখা আজ তেমন নেই। রশ্মি ঢেকে দিয়েছে মেঘ। মৃদু হাওয়া বইছে চারদিকে। কয়দিন সূর্যে উত্তপ্ত হাওয়া বদলে পরিবেশ শীতল হাওয়া দিতে শুরু করেছে। তবে দিন টা আজ তাক লাগানোর মতো। না আছে রোদ আর না বৃষ্টি। শুধু শরীরে মিষ্টি একটা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।
রেহেলা বেগম তিতিল কে আজ ব্রেকফাস্ট বানাতে দেন নি। তিনি তিতিল কে রেডি হতে বলেছেন। কারণ অনেকটা পথ যেতে হবে। তিতিল নিজের রুমের আয়নার সামনে বসে আছে। বিছানার উপর ব্যাগটার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকাল। এখন পর্যন্ত সে দেখেনি লোকটা কি এনেছে। কি বলবে লোকটা তাকে ওখানে নিয়ে? এই ভাবনা তাকে ঘুরপাক খায়িয়ে দিচ্ছে। লোকটার সাথে তারও সরাসরি কিছু কথা আছে। ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে তিতিল উঠে ব্যাগ টা হাতে নিল।
নেভি ব্লু কালার শার্টের হাতা উল্টিয়ে কনুই পর্যন্ত টেনে নিতে নিতে ইয়াদ পা বাড়াল তিতিলের রুমের দিকে। হাতের স্মার্ট ওয়াচে তাকিয়ে দেখতে পেল ১০ টা ৩৪ বেজে গেছে। সে দ্রুত পা চালাল।
তিতিল মাত্রই চেঞ্জ করে এসে আয়নার সামনে বসেছে। চুল গুলি ঠিক করে সাদা গাজরাটা জড়িয়ে নিল খোঁপায়। এমন দৃশ্য দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে থমকে গেল ইয়াদ। দুনিয়ার সব সৌন্দর্য যেন তার চোখের সামনে এসে লুটিয়ে পরেছে। বিস্ময়কর স্তব্ধতা নিয়ে দেখছে প্রেয়সী কে। হৃদযন্ত্রের স্পন্দন তাকে মুখরিত আবেশে নিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের গভীর থেকে নির্গত হওয়া অনুভূতি গুলি আর শরীরের শোণিত ধারা পর্যন্ত হীম করে দিচ্ছে। আনন্দের শতশত ঢেউ আছড়ে পরছে মনের সীমানায়। এ কেমন অবাধ্যকর মন মাতানো ঢেউ তুলা অনুভূতি?
তিতিল কানের সিলভার টানা ঝুমকা গুলি পড়তে যাবে ওমনি চোখ আটকে গেল দরজায় নিস্তব্ধ রূপে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াদের পানে। নেভিব্লু কালার শার্টে তাকে যে কতটা সুদর্শন লাগছে তা প্রকাশ করার ভাষা নেই তার। ফর্সা গায়ের জাম কালো ঠোঁটের অধিকারী পুরুষটা কে আটশাই হওয়া নেভিব্লু শার্ট একদম যেন লেপ্টে গেছে। তিতিলের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠে। এই রঙে ইয়াদ কে সে আগে দেখেনি। শুভ্র গায়ে যে এই রঙ লেপ্টে থাকে তা হয়তো এই লোকটা কে না দেখলে বুঝতেই পারত না সে। নাকি এটা শুধুমাত্র তার চোখের মুগ্ধতা থেকে? কিছু জানে না সে। এ কারণ জানতেও ইচ্ছা প্রকাশ করছে না। ভেতরের মানুষটা কে ঘিরা অনুভূতি গুলি প্রজাপতির সাথে খেলা করতে লাগছে। আচ্ছা এই সাদা শাড়ীর সাথে নেভিব্লু কালার শার্ট পরা লোকটা কে আয়নার সামনে কতটা মানাবে? একসাথে দাঁড়ালে কি তাদের মেড ফর ইচ আদার বলবে কেউ? ঝিম হয়ে আসছে তিতিলের মাথাটা।
হঠাৎ অনুভব করল তার পিছন ইয়াদ এসে ঠাই নিয়েছে। আয়নায় দুজনকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। প্রতিবিম্বে ইয়াদ তাকাল। সাদা ঝুম সাড়ীতে তিতিল কে মোহনীয় লাগছে। চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়েছে মেয়েটা। ইয়াদের বুকে কেউ যেন ঘায়েল করেছে। ওই টানা কাজল রাঙ্গানো হরীণ চোখ গুলি কি বুকে বাণ হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করছে দিচ্ছে? নাকি কাজল রাঙ্গা চোখে ডুবে গেছে সে? শরীর শিউড়ে উঠে ইয়াদের। মাথা ঝিম ধরে আসে। তিতিলের সাথে তাকে একদম পারফেক্ট লাগছিল যেন। ইচ্ছা করেই আজ এই রঙ এর শার্ট গায়ে দিয়েছে সে। মুচকি হাসল ইয়াদ। তিতিলের হাত থেকে কানের দুলটা তুলে নিয়ে আয়নার তাকাল। কানে দুল পরিয়ে দিয়ে ইয়াদ ঝুমকায় মৃদু টোকা দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো মেয়েটার। এক গালে মিষ্টি করে হেসে উঠল ইয়াদ। ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে কালো কুচকুচে কাঁচের চুড়ি গুলি নিয়ে একটা একটা করে নরম হাতে পরিয়ে দিল ইয়াদ। আবার আয়নার তিতিলের প্রতিবিম্বে তাকাল। আলতো চুমু খেলো তিতিলের মাথায়।
“আপনার অপেক্ষা করছি বেগম।”
ইয়াদ চলে যেতেই ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ল তিতিল। আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাল। ক্ষনিকের রেশ এখনো তাকে অনুভব করাচ্ছে। এক পলশা শীতল হাওয়া মন কে ছুঁয়ে গেলে আবারও। বুক ধকধক করে আওয়াজ তুলে উঠানামা করছে তার।
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদ। ঘড়ির দিক থেকে চোখ সরাতেই দেখতে পেল তিতিল কে। গাড়ি থেকে হেলান দিয়ে দণ্ডায়মানের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। সাদা শাড়ী, চুলে খোঁপায় সাদা ফুলের গাজরা, সিলভার ঝুমকা, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে কড়া বাঙ্গিকালারের মতো লিপস্টিক। কপালের সামনে দুই পাশে ছোট কিছু চুল। ব্যস ইয়াদের কাছে দুনিয়ার সব সুন্দরীকে হার মানানোর মোহনীয় নারী এই মেয়ে। ঝিম ধরানো চোখে তাকিয়ে আছে তিতিলের দিকে। মাথাটা খানিক নিচে ঝাঁকিয়ে হাসল ইয়াদ। এই হাসির মানে বুঝল না তিতিল। বেশ লজ্জায় মাথা নুয়ে এনেছে লজ্জাবতী গাছের পাতার মতো।
ইয়াদ গাড়ীর সামনে দিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে দিল। তিতিল নিশ্চুপে এসে জায়গায় বসল। ইয়াদ মৃদু হেসে ড্রাইভিং সিটে বসে তিতিলের দিকে ঝুঁকতেই তিতিল সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। ইয়াদ কিছু বলল না। ঠোঁট টিপে হেসে তিতিলের গায়ের উপর দিয়ে সিটবেল বেঁধে নিল। তারপর মুখটা তিতিলের মুখের দিকে কয়েক ইঞ্চি বাড়িয়ে দিয়ে চোখের ঘন পাতার উপর ফু দিয়ে নিজের জায়গায় বসল। এহেন কান্ডে তিতিলের ঠোঁট টিপে হাসি পেলে চোখের সামনের চুল গুলি সড়িয়ে দিয়ে বাহিরে তাকাল। ইয়াদ নিশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।
—-
শহর ছেড়ে তারা অনেকটা দূরে চলে এসেছে। নিস্তব্ধ জনমানব হীন পীচ রাস্তা। যেদিকে চোখ যায় শুধু ধোঁয়াশা। থেমে থেমে কিছু গাছ সাঁইসাঁই করে তাদের মারিয়ে চলে যাচ্ছে। দমকা হাওয়া মন সহ শরীর কে শীতল করে দিচ্ছে। এদিকে ইয়াদ আড়চোখে তিতিল কে দেখছে। সাঁইসাঁই করে আসা বাতাসে মেয়েটা তেমন নিশ্বাস নিতে পারছে না। চোখের পাতা বার বার বুজে আসছে তার। সামনের কপালের দুইপাশের চুল গুলি একদম লাগামছাড়ার মতো খেলা করছে। কানের ঝুমকা গুলিও তালে তাল মিনিয়ে সুরের সাথে নৃত্যে মেতে উঠেছে। এ যেন এক ভয়ংকর শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যময় পরিবেশ। যেতে যেতে হঠাৎ ইয়াদ ব্রেক কষল। তাল সামাল দিতে না পেরে তিতিল খানিক সামনের দিকে ঝুঁকে আবার নিজেকে সামলে নিল। কপাল কুঁচকে তাকাতেই পাশে ইয়াদ কে দেখতে পেল না। তারপর বামে তাকাতেই দেখা গেল ইয়াদ তার পাশের দরজাটা খুলে দিয়েছে। কিছু না বলে তিতিলের দিকে মাথা বাড়িয়ে সিটবেল্ট খুলে দিয়ে বলল,
“নামুন বেগম সাহেবা।”
“….
ইয়াদের কথা ব্যবহার তাকে বড্ড চমকায়। কপাল কুঁচকে থাকলে ইয়াদ নিশ্চুপে তিতিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নামিয়ে আনে তাকে। তিতিল তখনো বিস্ময় নিয়ে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ছিল দেখতে পেয়ে মুচকি হাসল ইয়াদ। কানের কাছে মিনমিনে গলায় বলল,
“প্রেয়সী আমার দিকে নয় সামনে তাকান।”
নিজেকে নিজের অবস্থানে ফিরে এনে তিতিল মাথা নিচু করল। আবার তাকিয়ে দেখল সামনে। চারিদিকে শূন্য জমিতে থাকেথাকে কাশফুল বাতাসে দুল খাচ্ছে। এ যেন শুভ্র এক স্বপ্নের শহর। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তিতিলের মুখে। ইয়াদ ধ্যানধরা নয়নে অপলক দেখল সেই টকটকে লাল রক্তের ন্যায় গোলাপের হাসি।
আচমকা হাতে টান অনুভব করল তিতিল। তাকিয়ে দেখতে পেল ইয়াদ হাত টেনে কাশবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
“কোথায় যাচ্ছেন?”
উত্তর দিল না ইয়াদ। একপাশে তিতিল কে দাঁড় করিয়ে সামনে গেল সে। ফোনের ক্যামেরা বের করে তিতিলের কোমর টেনে কাছ আনতেই শিউড়ে উঠে তিতিল। ঢোক গিলে তাকায় ইয়াদের দিকে। ইয়াদও তার দিকে সমান তালে তাকিয়ে মুঠোহাতে বন্ধি করে নিল সেই দৃশ্য। নাকে ফু ছুড়ে দিয়ে বলল,
“আমার দিকে না ফোনের দিকে তাকাও।”
তিতিল বেশ লজ্জা পেয়ে মাথা নুয়ে আনল। ইয়াদও মুচকি হাসল। একের পর এক মুহূর্ত বন্ধি করে নিচ্ছে ইয়াদ। তারপর যখন চেক করল পিক গুলি তখন দেখতে পেল তিতিলের হাসি মাখা একটা পিক। আনমনে হাসি পেল ইয়াদের। বড্ড মায়াবী লাগছে সেখানে তিতিল কে। আর একটা ছবিতে তিতিল নিজের অবাধ্য এলোমেলো চুল গুলি আনমনে অন্যদিকে তাকিয়ে সরানোর চেষ্টা করছিল। এই ছবিটা সাথে সাথে ইয়াদ নিজের ওয়ালপেপারের সেট করে নিয়েই আবারো ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।
“আমরা বাগান বাড়িতে না গিয়ে এখানে কথা বলতে পারি।”
তিতিলের কথায় তাকাল ইয়াদ। কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে দেখে পরখ করল তাকে। তিতিলও এতে বেশ ইতস্তত বোধে পড়ে গেল। মাথা নিচু করে আনল অস্বস্তিতে। আবার তাকালে দেখতে পেল ইয়াদ তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হকচকিয়ে গেল খানিকটা। ইয়াদ তার কোমরের পাশে হাত নিয়ে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। লজ্জায় তিতিল তাকাতে পারছিল না মুখের দিকে। ইয়াদ তর্জনী দিয়ে তিতিলের কপাল থেকে চুল গুলি সরিয়ে দিয়ে বলল,
“বেগম আপনার সাথে ওখানে যা হবে তা এখানেই হয়ে গেলে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু এতে পরিবেশ নষ্ট হবে। আর আমি সেটা চাইছিও না। বুঝলেন?”
তিতিল থম মেরে গেল এহেন কথায়। কি বুঝাতে চাইছে লোকটা? শুকনো গলায় ঢোক গিলল তিতিল। এতে ইয়াদ বাঁকা ঠোঁটে হাসল। তারপর আবার তিতিল নিজের হাতে টান অনুভব করল।
চলবে♥
#ইস্ক
#সাদিয়া
২০
আকাশে সোনার থালার মতো চকচক করছে সূর্য টা। নিজের চাকচিক্য রশ্মির কারণে তাকাতে পর্যন্ত পারা যাচ্ছে না। যোহরের আজান দিতে আর কিছুক্ষণ। একটু আগের মৃদু হাওয়া বয়ে যাওয়া আবহাওয়া মুহূর্তে বদলে রোদের দেখা মিলেছে। ইয়াদের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তিতিল মেয়েটার নাকে বিন্দুবিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের উপরপাটিতেও ঘাম জমে আছে। ইয়াদ ব্রেক কষে সেই যে তাকিয়েছিল তার দিকে। হঠাৎ ইয়াদের মুুচকি হাসি দেখে তিতিলের কপাল কুঁচকে এলো। কৌতূহল বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি আপনি এভাবে হাসছেন কেন।
“জিজ্ঞেস করবে না হাসছি কেন?”
ইয়াদের মুখ থেকেই কথা চলে এলো। তিতিল মুখ কালো করে ফিরিয়ে নিয়েছে। ইয়াদ সিটবেল্ট খুলে তার দিকে ঝুঁকল কি মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে। ইয়াদ ফের হেসে মিনমিন গলায় আওয়াজ তুলল,
“শুনেছিলাম যে মেয়ের নাক ঘামে তার স্বামী নাকি তাকে বেশ আদর করে?”
এহেন কথায় তিতিল তার দিকে ফিরল। সাথে সাথে তার অবাধ্য চুল আর ঝুমকা নড়ে উঠল। তার সঙ্গে চওড়া হয়ে হলো ইয়াদের হাসি।
“আদর না ছাই।”
“কিছু বললে?”
“না। কষ্ট ছাড়া দিয়েছেন টা কি হিসাব করবেন।”
এই বলে তিতিল নেমে গেল। ইয়াদ মাথা ঝাকিয়ে বাঁকা ঠোঁটে হাসল। মনে মনে বিড়বিড় করল,
“এজন্যেই তো আপনাকে এখানে এনেছি ম্যাম।”
তিতিল ফেলে সামনে চুল ঠিক করে দৃষ্টি ফেলল। বাগান বাড়ি যেমন হয় এটা যেন তারচেয়েও বেশি। এখানে বোধহয় প্রকৃতিরা খেলা করে। প্রাণভরে নিশ্বাস জমা করা যাবে এখান থেকে। বিস্ময়ে হতবাকে তিতিলের চোখ নেঁচে উঠল। যেখানে চোখ যাচ্ছে শুধু সবুজ গাছেদের সমাহার দেখতে পাচ্ছে। সরু একটা পাকা রাস্তা তাার পাশে ছোটছোট নানা ফুলের মেলা। রাস্তার সোজাসোজি ছোট্ট একটা সাদারং এর নীড় দেখা যাচ্ছে। বাড়ির দুই পাশেই শুধু গাছ দেখতে পাচ্ছে। এখানে যেন সব গাছের হাট বসেছে। আনমনে হৃদয় মন হেসে উঠল মেয়েটার। মুখে তৃপ্তির হাসি টেনে একপা একপা করে হাটছে তিতিল। সাথে পিছন পিছন আসছে ইয়াদ। অনেকদিন পর এখানে এসেছে। ব্যস্ত শহরের ধুলোবালির রেশ ঝেড়ে ফেলে প্রশান্তির এক নিশ্বাস টেনে নেয় বুকের ভেতর। এখানে শ্বাস নিলেও যেন তৃপ্তি পাওয়া যায়। ইয়াদ মুচকি হেসে তাকাল তিতিলের দিকে। মেয়েটা চোখ ভর্তি মুগ্ধতা ঠেসে নিয়ে হাটছে। বাড়ির যত কাছে যাচ্ছে ততই যেন মুগ্ধতায় মিলিয়ে যাচ্ছে সে। এক তলা বাড়ির কোণ ঘেষে টিনের চালে বেয়ে উঠছে পাতা ফুলের গাছ। তিতিলের মাথা থেকে সব কিছু যেন ছুটি নিয়েছে। নতুন একটা জগতে সে যেন বিরাজ করছে। আপাদত এই মুগ্ধতার বিস্ময়ের রেশে সে ডুবে গিয়েছে। বাড়ির টার দিকে তাকালে অদ্ভুত কিছু প্রশান্তির হাওয়া দুল খেয়ে যায়।
“এটা আমার দাদাভাই বানিয়েছিল দাদুকে নিয়ে অবসর সময় কাটানোর জন্যে।”
হঠাৎ ইয়াদের কথায় তিতিল তেমন চমকাল না। তবে তার দিকে না ফিরেই জিজ্ঞেস করল,
“মা ইনা আপু হিমা এখানে কেন থাকে না?”
“এটা শহর থেকে অনেক দূর তাই।”
তিতিল আর কিছু বলল না। নির্মল হাওয়া শরীরে বয়ে যাচ্ছে বলে তিতিল একদম নির্বিকার। ইয়াদ একেবারে তার কাছাকাছি চলে এসেছে। পিছন থেকে তিতিলের বাহু টেনে সামনের দিকে ফিরাল। মেয়েটাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ দেওয়ার আগেই সেকেন্ডের মাঝে কোমর পেঁচিয়ে আরো কাছে টেনে আনল। নেশাক্ত এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাতাল করা কন্ঠে বলল,
“দাদাভাই এটা বানিয়েছিল দাদুর জন্যে। তবে এখন এটা আমার আর আপনার কাটানোর সময়ের জন্যে।”
“….
তিতিল ভয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলল। ইয়াদ আবার এক গালে হাসল। মুখ বাড়িয়ে দিল তিতিলের দিকে। তা দেখে মেয়েটা মুখ পিছিয়ে নিতে চাইলে ইয়াদ এক হাতে তিতিলের পিঠ ঠেলে তার দিকে নিয়ে এলো। ঠোঁট টিপে হেসে মুখ কানের কাছে এনে বিড়বিড় করে বলল,
“এখানে দাদুভাই আর দাদুর মতো আপনাকে নিয়ে আমি সময় কাটাব। একদম নিজেস্ব কিছু সময়। আপনার নাক ঘামার বিষয়টা একদম হাড়ে হাড়ে অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিব মিসেস ইয়াদ মাহাবুব।”
ইয়াদ ঝটপট নিজের জায়গায় এসে দাঁড়াল। ওদিকে ভয়ে মেয়েটা একদম গুটিয়ে গেছে। দাঁতে দাঁতে চেঁপে ভয়টাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করছে মনেপ্রাণে। হঠাৎ ইয়াদ তাকে বুকের সাথে চেঁপে ধরল। গলার খুব কাছে নিজের ভিজে ঠোঁট লাগিয়ে দিতেই মেয়েটা শিহরণে সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠল। বিষয়টা ধারণা করতে পেরে ইয়াদ কোমল করে হাসল। একচুল না সরে নেশাময় গলায় ফিসফিস করে বলল,,
“তুমি যখন এভাবে ভয় পাওয়া না তখন আমার ঠিক এইভাবেই তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে মনটা হিসপিস করে রে তিতিল পাখি। আরো অনেককক কিছু ইচ্ছা জাগে মনে। মন বলে তোমাকে নিয়ে একলা ঘরে..”
কথা শেষ করার আগেই তিতিল তাকে ঠেলে নিজের থেকে দুরে সরাল। ইয়াদও এটা নিয়ে আর নাড়াচাড়া করল না। হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওদিকে লজ্জায় কান আর গাল দিয়ে যেন গরম ধোয়া বের হচ্ছি। এক্ষনি প্রেশারকুকারের মত সিটি বেজে সামনের লোকটাকে জানান দিবে।
“জানো তিতিল পাখি দাদাভাই আর দাদু নিজেদের শেষ সময় টা এখানে কাটিয়েছে।”
আচমকা তিতিল তাকাল ইয়াদের দিকে। মুখ দেখে তার বুঝতে দেরি হলো না লোকটা কষ্ট পাচ্ছে। ঠোঁটের কোণার হাসির আড়ালো লোকটার কষ্টভরা মুখটা যেন চাঁদের মতো ভেসে উঠছে।
ইয়াদ আবার বলে উঠল,
“দাদাভাই চলে যাওয়ার পর দাদু এখান থেকে আর শহরে যায়নি। এখানেই থেকেছে। দাদুর শেষ নিশ্বাস টা দাদাভাইয়ের মতো এখানেই কেটেছে তিতিল।”
ইয়াদ ঠিকভাবে বলতে পারছিল না লেগে আসছিল তার গলা।
“তিতিল স্বামীর স্ত্রীর মাঝের সম্পর্ক টা হলো ভালোবাসার সম্পর্ক। এখানে ভালোবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে নীড় তৈরি করা হয়। কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়, আর জীবনের শেষ নিশ্বাস টা পর্যন্ত শক্তহাতে পাশে থাকতে হয়।”
একটু থামল ইয়াদ। আবার বলতে লাগল, “যা দাদাভাই আর দাদুর মাঝে ছিল। দাদাভাই চলে যাওয়ার পর দাদু একদম একলা হয়ে গিয়েছিল। এখান থেকে আর বের হয়নি তিনি। আমি দেখেছি জীবনের শেষ নিশ্বাসটা পর্যন্ত দাদুর মুখে মনে দাদাভাই ছিল। প্রতিটাদিন বিকেল বেলায় তিনি আমাদের সবাই কে ছেড়ে একলা কিছু সময় কাটাতেন দাদাভাই কে নীরবে মনে করবেন বলে। উনার সমস্ত জীবন জুড়েই যেন ছিল দাদাভাই। আমি দেখেছি দাদাভাই চলে যাওয়ার পর দাদু কতটা কষ্টে থাকতেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতে তিনিও চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। এটা ভালোবাসা তিতিল। ভালোবাসার মাঝে দুইটা মানুষ থেকে একটাও যদি হারিয়ে কিংবা চলে যায় তখন ঠিক অপর মানুষটা বুঝে ভালোবাসার মর্ম কতটা গভীর হয়। ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দিতে নেই। তিতিল ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দিও না। ভালোবাসা..”
ইয়াদ আর বলতে পারছিল না। তিতিল খেয়াল করল লোকটা চোখের কোণার পানি টা আড়াল করে দৌড়ে পালাল।
চলবে♥