তবু মনে রেখো (৬ম পর্ব) .

0
272

তবু মনে রেখো (৬ম পর্ব)
.
পুষ্পিতাকে রেডি হতে বলার জন্য ইমাদ একটু তাড়াতাড়ি গোসল করে এলো। এসে দেখে পুষ্পিতা বাথরুমে। একবার ভাবলো দরজার কাছে গিয়ে ডেকে বলবে, ‘আজ তোমাদের বাসায় যাব, বাবা তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলেছেন।’

কিন্তু বলতে গিয়েও বললো না সে। ব্যাপারটা অশোভন দেখায়৷ বাথরুমে তো কাপড় রাখার আলনা বা আলমারি জাতীয় কিছু থাকে না যে সে বলবে আর পুষ্পিতা বাথরুমের জরুরি কাজটা সেরে একেবারে রেডি হয়েই বেরুবে। এর থেকে জোহরের নামাজটা পড়ে নেয়া যাক। লুঙ্গির উপরে একটা গেঞ্জি চাপিয়ে সে চলে গেল ইমার রুমে। ওর রুমে এখন কেউ নেই। ইমা হেতিমগঞ্জ কলেজে। সে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ইমাদ নামাজ শেষ করে এসে দেখে পুষ্পিতা আয়নার সামনে বসা। গায়ে নতুন পোশাক। বাবা কি তাহলে তাকে রেডি হতে বলে গিয়েছিলেন? বিভ্রান্ত হয়ে বললো,

– ‘তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাবা রেডি হতে বলে গেছেন।’

– ‘হ্যাঁ তাইতো রেডি হচ্ছি।’

‘ও আচ্ছা’ বলে ইমাদ আলনা থেকে প্যান্ট এনে পরে নিল। তারপর শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,

– ‘লিপস্টিক দিয়ে দিচ্ছ যে, ভাত খাবে না?’

– ‘না, আমার ভালো লাগছে না। তোমাকে দিচ্ছি ভাত।’

– ‘আমাকে কেউ দিতে হয় না। আমার হাত আছে।’

পুষ্পিতা কোনো জবাব দিল না। ইমাদ রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই প্লেটে ভাত-তরকারি নিয়ে টেবিলে এলো। খাওয়ার শেষদিকে উঠোনে সিএনজির ডাক শোনা গেল। বুঝতে পারে, বাবা নিশ্চয় ফিরেছেন। খানিক পর হায়দার সাহেব এসে বললেন,

– ‘এই সিএনজি নিয়েই চলে যাও। মিষ্টি-মাষ্টি গাড়িতেই আছে।’

– ‘আচ্ছা বাবা, ড্রাইভারকে বারান্দায় বসতে বলো। আমরা রেডি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

ইমাদ খেয়ে প্লেট রেখে পুষ্পিতাকে তাড়া দিতে এসে দরজা খুলে মুগ্ধ হয়ে যায়। পুষ্পিতা আয়নার সামনে থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পুষ্পিতা যেন পুষ্পের মতোই মায়াবিনী। পুষ্পকে দেখলে যেমন তার ঘ্রাণ নিতে, ছুঁয়ে দিতে ‘মন কেমন করা’ এক অনুভূতি হয়। সেরকমই হচ্ছে তার। পরনে পাতলা নীলচে লং ড্রেস। একপাশের চুল কাঁধ বেয়ে এসে বুকে পড়েছে। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। হাতে একগোছা চুড়ি। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। এই লাল সচরাচর দেখা যায় না। ঠোঁটে একদম মিশে গেছে। গোলাপি ঠোঁটের ভেতরের যেন রক্ত এগুলো৷ পায়ে কালো জুতো৷ পাতার উপরের সাদা ধবধবে নগ্ন অংশ দেখা যাচ্ছে। ফিক করে হেঁসে ঈষৎ মাথা নুইয়ে মুখে হাত দিল পুষ্পিতা। সামনের চুলগুলো আরও সামনে এলো ওর। বুঁদ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে ইমাদ।

– ‘কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো যে? খাওয়া শেষ?’

চেতনা যেন ফিরে পেল সে। পলকে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

– ‘তাকিয়ে আছি রঙঢঙ দেখে। দশ মিনিটের রাস্তা না আর কত সাজগোজ।’

পুষ্পিতার হাসিখুশি মুখ নিভে গেল। ইমাদ পুনরায় বললো,

– ‘ঢং কি শেষ? বের হও তাহলে।’

পুষ্পিতা ভ্যানিটিব্যাগ বাঁ হাতে নিয়ে বের হয়ে যায়৷ হায়দার সাহেব তাদেরকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে বললেন,

– ‘যাও মা, আমি সন্ধ্যায় একবার আসবো।’

সিএনজি চলতে শুরু করে। মিনিট দশেকের ভেতরেই সারি সারি গাছের মাঝদিয়ে ছোট্ট রাস্তায় সিএনজি এসে ঢুকে। পাশে বিশাল পুকুর। সাঁকো দিয়ে পুকুরের মাঝখানে টিনের ঘর। মাছ পাহারাদার ঘুমায় এখানে। খান বাড়ির উঠানে চলে এলো সিএনজি। সাবিনা বেগম মেইন গেইট খুলে তাড়াতাড়ি উঠোনে বেরিয়ে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন৷ মহসিন সাহেব এলেন খানিক পর। ইমাদ দু’জনকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। ড্রাইভার ব্যাগগুলো দিয়ে এলো বারান্দায়। মহসিন সাহেব ইমাদকে ড্রয়েনিং রুমে নিয়ে গিয়ে বসলেন। ইমাদ এবাড়িতে সব সময়ই আসা-যাওয়া করেছে৷ তবে এবারের আসাটা ভিন্ন। সে বিব্রতবোধ করছে৷ সন্ধ্যায় এলেন হায়দার সাহেব। গল্প-গুজব করে চলে গেলেন দশটার দিকে। রাতের খাবার শেষে পুষ্পিতা এসে মায়ের পাশে শুয়ে পড়লো।

– ‘মা, আজ আমি তোমার কাছে ঘুমাবো।’

সুযোগ পেয়ে সাবিন বেগম মেয়ের গাল টেনে বললেন,

– ‘কেন? জামাইর কাছে থাকবি এখানে কেন?’

– ‘এমনিই মা।’

– ‘পাগলামি করবি না, প্রথমদিনই না কত বোঝালাম ভালোভাবে চলতে। মিলেমিশে থাকতে। এখন দেখি তুই নিজেই জামাইর কাছে যেতে চাচ্ছিস না। এরকম এই দু’দিনও করেছিস না-কি? এত অনিহা কেন?’

– ‘কি যে বলো মা। আমি অনিহা দেখাতে যাব কেন। আমি চেষ্টা করি মিলে-মিশে থাকতে। কিন্তু একা তো চাইলেই একটা সম্পর্ক ভালো হয় না।’

হায়দার সাহেবের কথাগুলো মনে আছে সাবিনা বেগমের। তিনি মেয়ের কাছ থেকে সবকিছু জানতে চান। কিভাবে কথাগুলো বলবেন বুঝতে পারছেন না৷ হায়দার সাহেবের মতোই তিনি বললেন,

– ‘কেন, কি হয়েছে? তোদের মাঝে কি মায়া-মহব্বত কিছু হয়নি?’

পুষ্পিতা ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে বললো,

– ‘কারও উপর আমাকে চাপিয়ে দেয়া থেকে বিয়েটা না হলেই বরং ভালো হতো মা।’

– ‘কি যে বলিস মা, চাপানো মানে? এক সঙ্গে থাকতে থাকতে সবই ঠিক হয়ে যাবে৷ একটা ফুটফুটে বাচ্চা হোক দেখবি সব ঠিক।’

পুষ্পিতা হা-হা-হা করে হেঁসে উঠলো। হাসি দেখে সাবিনা বেগমের বুক কাঁপে।

– ‘কিরে মা, হাসিস কেন? একটা বাচ্চা হোক দেখবি সব ঠিক।’

– ‘বাচ্চা কি মা গায়েবি হয়ে যাবে। সেটা হতে হলেও তো সম্পর্ক ভালো হতে হয়।’

– ‘বলিস কি? দেখ মা, তোর বিষয়টা এখন কাহিনির মতো এলাকাজুড়ে সকলের মুখে মুখে। কাহিনি যখন লোকের মুখে চলে যায় তখন আরও রসালো করার জন্য মানুষ নিজেই তিলকে তাল করে রটায়। শুনেছি মা ইমাদের রিলেশন আছে। তাই একটা সন্তান হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত হতাম।’

পুষ্পিতা মা’কে অকপটে বলে,

– ‘একা তো আর সন্তান জন্ম দেয়া যায় না মা। এই বিয়ে না হলেই বরং ভালো হতো। ইমাদ শুধু বিয়েটাই করেছে আর কিছু না। তোমরা সবাই বলেছো বিয়ে করে ইজ্জৎ বাঁচাতে। সে এটাই করেছে। আমাদের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর কোনো সম্পর্কই নেই।’

– ‘সম্পর্ক নেই, সেটা কর।’

পুষ্পিতা এই আলাপ আর না বাড়িয়ে উঠে চলে গেল। সাবিনা বেগম দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলেন। খানিক পর মহসিন সাহেব এসে শুলেন। সাবিনা বেগম আমতা-আমতা করে বললেন,

– ‘বিয়ে তো হুট করে হলো। ছেলেকে কিছু দিবে না? আসবাবপত্রের বিষয়ে কথা বলেছিলে?’

– ‘তা হয়নি, বানানোটা ঝামেলা, কিনে দিয়ে দেবো। হায়দারকে একদিন সঙ্গে নিয়ে গেলেই হবে।’

– ‘আমার একটা কথা শুনবে।’

– ‘কি?’

– ‘ইমাদ ছেলেটাকে তো আমরা আগে থেকেই চিনি। ভালো ছেলে। নামাজ-কালাম পড়ে। কিন্তু জোর করে বিয়ে করালে কার না খারাপ লাগে বলো।’

– ‘তা তো একটু লাগবেই।’

– ‘দেখো আমাদের আর সন্তান নেই। এক সময় সবকিছু ওরাই পাবে। আর মেয়ে যদি সুখী না হয় এগুলো দিয়ে কি করবো আমরা? আমার মনে হয় সিলেটের বাসাটা বিক্রি না করে ইমাদের নামে দিয়ে দাও।’

– ‘কি বলো, ওর বাবার থেকে যত জমি কিনেছি সেগুলোর এখনও কাগজপত্র করিনি৷ তাহলে শহরের বাসা দিব কেন?’

– ‘এগুলো বাদ দাও, আগে বলো ওই বাসা ইমাদকে দিলে কত খুশি হবে তাই না?’

– ‘তা তো হবেই। কত বড়ো বাসা। ভাড়া দিয়েই জীবন চলে যাবে।’

– ‘তাহলে ওই বাসা বিক্রি করার দরকার নেই। তাকে দিয়ে দাও। ছেলেটার সংসারে মন বসুক। বলবো আমরা শুধু মেয়ের সুখ-শান্তি চাই। সে যা চায় তাই পাবে। আচ্ছা ওকে না হায়দার ভাই ইতালি পাঠাবে একবার বলেছিল।’

– ‘হ্যাঁ টাকার জন্য পাঠায়নি।’

– ‘তাহলে টাকা দাও, না হয় ইতালি যাক।’

– ‘কি হয়েছে বলো তো? মেয়ের সঙ্গে এতক্ষণ কি নিয়ে কথা হয়েছিল?’

সাবিনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর সবকিছু খুলে বললেন স্বামীকে। হায়দার সাহেব বিছানা থেকে উঠে বসলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন,

– ‘কিন্তু এগুলো দিলেই যে মেয়ের সঙ্গে ভালো চলবে তারই বা নিশ্চয়তা কি?’

– ‘একরোখার মতো চিন্তা করবে না। এখন এগুলো পেলে সাময়িক সময়ের জন্য খুশি হলে। পুষ্পিতার সঙ্গে মিলে-মিশে থাকলে সন্তান হবে৷ তার মাথারও আজেবাজে চিন্তা দূর হবে।’

তিনি সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বললেন,

– ‘আর এতো জোড়াতালি দিয়ে সংসার টিকিয়ে না রেখে মেয়েকে বাড়িতে রেখে দিলে কি হবে?’

সাবিনা বেগম বিছানায় উঠে ক্রোধান্বিত গলায় বললেন,

– ‘অলক্ষণে কথা বলবে না একদম।’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here