#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(১৫+১৬)
হাঁকডাক ছেড়ে আফছার মীর নিজের রাগের জানান দিচ্ছিলো মাছুমাকে। কিন্তু তার সেই রাগের পরোয়া কিছুতেই করছে না মাছুমা। উল্টো পটলকে বকে ধমকে অন্যদেরও যেন শাসনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন৷ এতে অবশ্য মাইশা মোটামুটি তাড়ায় আছে স্কুলে যাওয়ার জন্য । বাড়িতে থাকলেই বাবার সাথে সেও ফ্রীতে বকা খাবে৷ মাইশা চলে যেতেই তুহিনও সুযোগ বুঝে কেটে পড়লো। মধ্যিখানে ফেঁসে গেছে পটল আর আফছার মীর। নুড়ির অবশ্য সেদিকে পাত্তা দেওয়ার সময় নেই সে খাওয়ায় ব্যস্ত। মাছুমার বকা চলতে থাকলো এতে পটল কান্না কান্না ভাব নিয়ে গেইটের দিকে গেল৷ ক্ষেতে যাওয়ার বাহানায় সে বেরিয়ে যেতেই আফছার মীরও ফাঁক বুঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন৷ নিজের রাগ নিজের ভেতরই শান্ত করে রেখে দিলেন৷ বরাবরই তিনি মাছুমাকে রাগ দেখাতে গিয়ে নিজেই বকা খেয়ে নাকাল হন৷ আজও ব্যতিক্রম হয়নি৷ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আজ একজনও সদর দরজাটা টেনে দিয়ে যায় নি৷ এতে করে উঠোন থেকেই মহল্লার রাস্তা দেখা যায়। বিরক্ত হয়ে মাছুমা নিজেই এগিয়ে গিয়ে টিনের গেইট সামনের দিকে টানতেই টের পেল বাইরে থেকে কেউ টেনে ধরেছে। বিষ্ময়ে সে সামনে ঝুঁকে দেখতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। বুকটাও বুঝি হঠাৎ করে ধড়ফড়িয়ে উঠলো! ঘড়িতে তখনো দশটা বাজেনি৷ ছেলের এখন অফিসে থাকার কথা অথচ সেই ছেলে তাঁর দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে! বিষ্ময় প্রকাশ করতেও যেন সন্দেহ হচ্ছে মাছুমার নিজের কাছে। ভুল দেখছে না ঠিক তাতেও সন্দেহ৷ মায়ের অবস্থা টের পেয়ে তাসিন হাসতে হাসতে গেইটের ভেতরে এসে গেইট আটকে দিল৷ এক হাতে মাকে জড়িয়ে অন্যহাতে লাগেজ ধরলো।
“ভয় পেয়েছো?”
“তা নয়ত কি! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে সামনে এসে দাঁড়ালি!সব ঠিক আছে তো? তুই হঠাৎ বাড়িতে যে!”
মাছুমা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে চলেছেন। তাসিন বুঝলো একদম হঠাৎ আসায় মা ভড়কে গেছে। হতে পারে হাতের এত বড় লাগেজ দেখেও ভয় পেয়েছেন তারওপর গাড়িও সাথে নেই।
মাছুমা আবারও প্রশ্ন করলেন, “সব ঠিক আছে?”
“আমার প্রমোশন হয়ে গেছে মা।”
“কি?” চমকে গেলেন বোধহয় কিছুটা৷ তাসিন মিটিমিটি হাসছে মায়ের রিয়াকশন দেখে৷ তার ধারণা মা অবাক হলেও খুব খুশিও হবেন। কিন্তু তার মা খুশির চেয়ে ভয়টাই বেশি পেয়েছেন৷ মামা বাড়িতে পুনরায় বুঝি কোন ঝামেলা করে সে চাকরি,গাড়ি সব ফেলে চলে এসেছে। বছর দুই আগেও তো এমনই কিছু করেছিলো সে৷
সকাল সকাল পিকনিকে যাওয়ার প্ল্যানটা ভেস্তে দিলো সৌহার্দ্য। সৌহার্দ্যকে বখাটে ছেলেদের চেয়ে এখন কোন অংশেই কম লাগে না সুপ্রভার৷ তার কিছুদিন আগের শোনা কথাগুলো সবই সত্যি করতে কোন ত্রুটি রাখছে না ছেলেটা। এই যে একটু আগে, হুট করে ক্লাসে এসে তাকে সবার সামনে অনেকটা ধমকের সুরে বলে গেল, “পিকনিকে যাওয়া ক্যান্সেল তোমার।” তারপর সত্যিই ক্যান্সেল হয়ে গেল। সুপ্রভার ভাইয়ের ফোন নম্বর তো আগেই জোগাড় করেছিল, আজ একেবারে তার বাড়িতে ফোন করে বলেই দিলো সে পিকনিকে যাচ্ছে তাও কিনা ছেলে, মেয়ে একসাথে দু রাত থাকবে বান্দরবানে! ব্যাস, বাড়ি থেকে তাকে পিকনিকের টাকা দিবে তো দূর তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিল মা ফোন করে। মা ফোন করেছে মানে সৌহার্দ্য কলটা তার বড়দা ভাইকেই করেছিল তাই মা জানে৷ মন খারাপ করে হোস্টেলে ফিরে এলো সুপ্রভা৷ মা এও বলেছে সেজদা আসবে সন্ধ্যের মধ্যে তাকে নিয়ে যেতে৷ পিকনিকের দু দিন সে গ্রামেই কাটাবে। মুখ ফুলিয়ে হোস্টেল রুমে বসে ছোট ব্যাগটা গোছাচ্ছে সুপ্রভা। তার বিপরীত পাশের বিছানায় বসে মেহরিনও ব্যাগপ্যাক গোছাচ্ছে। তবে সে বাড়ি নয় পিকনিকে যাবে বলে গোছগাছ করছে৷ সন্ধ্যে নাগাদ মেহরাব এসে পৌঁছুতেই বেরিয়ে গেল সুপ্রভা। রাগে তার গা রি রি করছে। সেজদা আসার পর সে মুখ খোলেনি এমনকি একটিবার জিজ্ঞেসও করেনি তার ভাই কেমন আছে! মেহরাবও কোন কথা বলেনি বোনের মুড বুঝতে পেরে। গাড়ি নিয়ে আসেনি মেহরাব তাই বাসে করেই রওনা হলো তারা।
মীর বাড়িতে পিনপতন নীরবতা চলছে; এই নীরবতা সাময়িক। মাছুমা গম্ভীর হয়ে বসে আছে বলেই এত চুপচাপ সবাই। তাসিন এসে বাড়িতে পা রাখার কিছুটা সময় পরই পটল বাড়ি ফিরেছিল। তাসিনকে দেখতেই সে খুশিতে হৈ হৈ করছিল।সেই খুশি তার বেশিক্ষণ টিকলোনা৷ তাসিন জানালো তার বাড়ি আসার কারণ আর তা শুনেই মাছুমা ঝুম হয়ে বসে রইলো । তাসিন অবশ্য বুঝিয়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে ঢাকা থাকা আর চট্টগ্রাম থাকা একই ব্যাপার। কিন্তু মাছুমার মন মানছে না। চট্টগ্রামে মা, বাবা ছিলো না কিন্তু মামা মামী তো ছিলো। মোদ্দাকথা, ছিলো আপন মানুষদের কাছেই তাই নিশ্চেন্তে থাকতে পারতো তারা। কিন্তু তাসিন অচেনা, অনাত্মীয়দের সাথে থাকলে কেন জানি ভয় হয় মাছুমার। সে জানে এখন সময় ভালো না৷ প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেকে একা থাকতে দেওয়া মানে তার চারপাশে নানা ধরনের ভুল আর বিপদকে আমন্ত্রণ জানানো। তাসিন যথেষ্ট ভালো ছেলে কিন্তু তবুও মায়ের মনের ভয় কমে না। এই তো মাস খানেক আগেই তো মুরাদ এক মেয়েকে নিয়ে পালালো।সেই সাথে অন্য বন্ধুরাও পালালো। মনে হতেই গায়ে কাটা দেয়।নাহ্ সে কিছুতেই ছেলেকে যেতে দিবে না। সারাসন্ধ্যা এই নিয়ে বাড়িটা নীরব, নিস্তব্ধ রইলো। তারপরই আবার শোরগোল শুরু হলো যখন আফছার মীর এসে বললেন তাসিনকে চাকরিটাই করতে হবে না। তিনি একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন৷ বাপ ছেলে মিলে সেই ব্যবসাটাকেই না হয় উন্নত করবেন। তাসিন জানতে চাইলো ব্যবসাটা কিসের?
আফছার মীরও অতি উৎসাহী হয়ে বললেন, ” বয়লার মুরগির খামার দিবো।”
সেই মুহুর্তে পরিবারের সবাই মিলে সন্ধ্যার নাশতা নিয়ে বসেছিলো। মাছুমা গরম গরম সিঙ্গারা বানিয়ে মাত্রই ছেলে মেয়ের সামনে রেখেছিলেন। তাসিনের হাতে চায়ের কাপ, মাইশার হাতে সিঙ্গারা ছিল৷ বাবার মুখের কথা শুনতেই দু ভাই বোনের হাতের বস্তু পড়তে পড়তে কোনমতে বাঁচল। তুহিন এ ব্যাপারে নির্বিকার এ মুহুর্তে তার খাবারটাই গুরুত্বপূর্ণ৷ আব্বা যা খুশি বলুক ভাইকে বলছে তার কি! তাসিন ক্ষোভ নিয়ে তাকালো বাবার দিকে৷ চায়ের কাপ রেখে দিয়ে বলল, “আব্বা! মাথা ঠিক আছে আপনার? এত ভালো চাকরি ছেড়ে আমি মুরগির ব্যাবসা করবো? তাহলে আর আমার অত ডিগ্রি, সার্টিফিকেট কি কাজের পুড়িয়ে ফেলি!”
“এত্ত চেতলে কেমনে হইবো? পড়ালেখা জানেন বইলা তো আরো ভালো হইবো ব্যবসা।”
তাসিন আর কিছু বলার মুডে নেই। সে বসা থেকে উঠে চলে গেল। চায়ের কাপে চা পড়ে রইলো যেমনটা ছিল। আর সবটাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো মাছুমা। সে অপেক্ষা করতে লাগলো বাকি দুই ছেলে মেয়ে উঠে পড়ার তারপর একটা ব্যবস্থা করবে সে এই মীর সাহেবের। আফছার মীরের চোখ পড়লো স্ত্রীর দিকে আর তাতেই তার গলা, বুক শুকিয়ে গেল। ছেলে মেয়েরা উঠার আগে নিজেই উঠে পড়লো, “ওহহো আমার না একটু হাঁটে যাইতে হইবো!”
যেন হঠাৎ মনে পড়লো কথাটা এমন ভাব করে বেরিয়ে গেলেন আফছার মীর।
কয়েক ঘন্টার জার্নি শেষে বাড়ি পৌঁছুতেই সুপ্রভা মুখ ভার করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিল। সুপ্রভার বাড়ি পৌছানোটা শুধু মিরা আর তার মা দেখেছে৷ বড় ভাই আর বাবা যার যার কক্ষে ছিলেন। রাত তখন এগারোটা পেরিয়ে গেছে। মেজো ভাই তৈয়াব এখনো বাড়ি ফেরেনি এই নিয়েই কথা হচ্ছিলো মিরা আর তার শ্বাশুড়ির মধ্যে কিন্তু সুপ্রভার আগমনে দুজনেই নীরব হলেন। হয়ত, সুপ্রভার সাথে কথা বলতেন কিন্তু মেয়েটা রাগ দেখিয়ে ফিরেও তাকালো না। মেহরাবের হাতে সুপ্রভার ব্যাগ৷ মরিয়ম শিকদার তাকেই প্রশ্ন করলো, “ওর কি হলো?”
“পিকনিক নিয়েই মুখ ফুলিয়ে আছে। সারারাস্তা একটা কথাও বলেনি৷” মেহরাব ব্যাগটা সোফায় ফেলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। যেতে যেতে ভাবীকে বলে গেল খাবার দিতে সে মুখহাত ধুয়ে আসছে। মিরাও ঝটপট খাবার বাড়তে লাগলো। মরিয়ম শিকদার মেয়ের প্রতি সবসময়ই বিরক্ত থাকেন কিন্তু কেন এ কথা বাড়ির কেউ জানে না আজও। বাড়িতে চার ভাই এবং বাবার থেকে ছোট থেকেই আদর পেয়েছে অসীম কিন্তু মা জননীর কাছে আদরের চেয়ে অবহেলাটাই ছিল বেশি সুপ্রভার প্রতি। তবে মায়ের অবহেলা ঘুচে গিয়েছে বড় ভাবীকে পাওয়ার পর। মিরার আদরে কখনো কোন ত্রুটি ছিল না৷ সে ভাবী কম মায়ের স্থানটাই বেশি নিয়েছে সুপ্রভার জীবনে তবুও দিনশেষে কমতি তো থাকেই কিছুটা। রাতটা সুপ্রভা না খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। ভাবী খুব করে ডাকলেও সে জবাব দেয়নি। সকালে ঘুম ভাঙতেই বড়দা ভাই নাশতার টেবিলে ডাকলেন। সুপ্রভা সবেই মুখ হাত ধুয়ে বসেছিল। বড়দার ডাকে নিচে এসে চমকে গেল এহসানকে বসা দেখে। রাতের মন খারাপ ভাবটা এখন আর একটুও নেই। ঝকঝকে সকালের মত মনটা ঝকঝক করছে। এহসান ভাইয়া মানের চমৎকার সময় কাটবে কিন্তু সেখানে আবার একটু মেঘাচ্ছন্ন ভাব এহসান ভাইয়ার পোশাক। দ্রুত পায়ে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই এহসান পকেট থেকে দুটো ডেইরি মিল্ক এগিয়ে দিলো। ঝকমকে হাসিতে প্রশ্ন করলো, “কতদিনের জন্য এসেছিস?”
প্রশ্নটা শুনতেই মুড অফ হয়ে গেল সুপ্রভার। আজ নিশ্চয়ই সবাই খুব ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সে বসে আছে বাড়িতে। এখন তো কষ্টে কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব। এহসান তার মুখ খেয়াল করে বলল, “কি হলো?”
সুপ্রভা জবাব দিচ্ছে না তা দেখে সোহরাব বলল, “দু’দিন এর জন্য আনিয়েছি জোর করে।”
“এজন্য মন খারাপ? ”
“এজন্যই বলা যায়। ওর ব্যাচমেটরা পিকনিকে গিয়েছে কাল রাতে। ওকে যেতে বারণ করেছে বলে এমন রেগে আছে। কথা বাদ দাও ভাই এবার নাশতাটা করো।” এবারের জবাবটা মিরা দিলো। তার হাতে মাংসের বাটি। সকাল সকাল ছোট দেবরের আবদারে গরুর মাংসা কষাতে হলো পরোটার জন্য। এহসানও চমৎকার সময়ে এসে হাজির হয়েছে৷ পরিবারের প্রায় সবাই উপস্থিত শুধু মেহরাব ছাড়া। সবাইকে একসাথে পেয়েই সোহরাব ভাবল কাল মায়ের বলা কথাটা সবাইকে জানানোর এটাই ভালো সময়। তৈয়াব মাত্রই শার্টের হাতা গুটিয়ে ব্যস্ত হাতে পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছিলো আর তখনি সোহরাব বলল, “আমরা ঠিক করেছি তৈয়াবের বিয়ের কথাটা এবার পাকা করে তারিখ ঠিক করে আসবো। কি বলো তোমরা সবাই; তুই কি বলিস তৈয়াব?” বড়দার কথা মুখ থেকে নিঃসৃত হতেই তৈয়াবের হাতের পরোটা প্লেটেই পড়ে গেল। খালি গলায় শুকনো কাশি শুরু হলো। তার বিয়ে মানে তো সেই ঢঙ্গী মেয়েটাকে সারাজীবনের জন্য মাথায় চড়ানো! অনেকদিন ধরেই তৈয়াব ভুলে বসেছিল তার যে একটা এনগেজমেন্ট করিয়ে এসেছে মা আর ভাই মিলে। এখন মনে পড়তেই বুকটা পানিশূন্য হয়ে গেল। বড় ভাবীর ফুপাতো বোনটাকে সে শুরু থেকেই পছন্দ করে না। মেয়েটা অতি মাত্রায় বেয়াদব তার সাথে কথায় কথায় ঝগড়া করেছিলো ভাবীর বোনের বিয়ের সময়। কিন্তু কি করে যেন সেই মেয়েটাকেই সুপ্রভা আর বড়দার পছন্দ হয়ে গেল তার জন্য। আর তৈয়াব তো বড়দা আর বোনের পছন্দের বিরোধিতা কিছুতেই করতে পারে না এটাই সমস্যা। মেয়েটা পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করবে না বলেছিল আর সেই সুবাদে এনগেজমেন্ট ঝুলে ছিল তিন বছর। সেই তিন বছরে পরিবার থেকে অনেক রকম ফরমালিটি পূরণ করলেও পাত্র-পাত্রী কোন প্রকার ফরমালিটির ধার ধারেনি৷ এমনকি কেউ কারো ফোন নম্বরটা পর্যন্ত নিজেদের সংগ্রহে রাখেনি। মূলত এ কারণেই তৈয়াবের মনে হয়েছিল কোনভাবে এ সম্পর্কটা বাদ দেওয়া যাবে। কিন্তু এতগুলো বছর পরেও যে আবার সেই কালনাগিনীর কথা উঠবে ভাবতেই তৈয়াবের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এমনিতেও মেয়েটা বয়সে তার তুলনায় অনেকটা ছোট। সে হিসেবেও তো মানাবে না তাদের। খাবার টেবিলের কোন কথার জবাব তৈয়াব দিতে পারছিলো না৷ কিন্তু তৈয়াবের এ বেলার বিপদ কাটিয়ে দিলো মেহজাব, সুপ্রভা আর এহসানের হৈ হল্লা। মেজদার বিয়ে মানে বাড়িতে একটা ধুমধাম ব্যাপার হবে৷ তাদের শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠানে কি করবে, কি করবে না। তৈয়াবও ফাঁক বুঝে খাওয়া শেষ করে চুপচাপ উঠে গেল৷ ঘরে ঢুকে খুঁজে বের করলো তার এনগেজমেন্ট এর ফটো এলবাম। খুব বেশি নয় হাতো গুণে মাত্রই দশ বারোটা ফটো তুলে এনেছিলো সুপ্রভা আর মেহজাব মিলে। এনগেজমেন্ট বলতে বাড়ির সবাই গিয়ে মেয়েকে আংটি পরিয়ে এসেছিল৷ সেই ছবি গুলোই তৈয়াব বের করে একবার চোখ বুলালো। নিজের হবু বউ, বাগদত্তা অথচ তার চেহারাটাই মনে নেই তৈয়াবের৷ এলবামে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। পুরো তিন বছর পর আজ প্রয়োজন পড়লো এই ঝগড়াটে মুখটা দেখার। এতদিন সে মনেই করেনি তার জীবনে এই মেয়েটা জড়িত। কালেভদ্রে ভাবী বাপের বাড়ি থেকে ফিরে দু একবার কথা তুলতেন ওই মেয়ের নাম নিয়ে। তখন সে শুনেও এড়িয়ে যেত৷ বাড়ির সবাইও কেমন নির্লিপ্ত ছিল এ ব্যাপারে৷ তৈয়াব আরেকবার ভালো করে দেখে নিলো ছবিগুলো। দেখতে সুন্দরী এই মেয়ে পড়াশোনায় তার উর্ধ্বে৷ একে বিয়ে করা তো বিপদজনক ভেবেই মুখটা আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেল তৈয়াবের।
নিচে নাশতার টেবিলে প্রত্যেকের নাশতা প্রায় শেষ। মেজদার বিয়ে নিয়ে হৈ চৈ করে এবার সুপ্রভা মনযোগ দিল এহসান ভাইয়ার দিকে।
“ভাইয়া তুমি এখন কোথায় থাকো?”
“নয়াগঞ্জ।” টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে জবাব দিলো এহসান।
“ওহ, ওই পাশের গ্রামে? আমার বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি সেখানে।” কথাটা বলেই চুপসে গেল সুপ্রভা। আঁড়চোখে টেবিলের অন্যদের দিকে দেখলো৷ যেচেই নিজের পায়ে কুড়াল মারলো সে! এখন না আবার সেই পালানো নিয়ে কিছু বলে সবাই। কিন্তু না বাকিরা কিছু বলল না শুধু এহসান হেসে বলল, “হ্যা, জানি তো সকল কীর্তিকলাপ।”
গুটিয়ে গেল সুপ্রভা। এবার নিশ্চয়ই সবাই ধরবে তাকে। কিন্তু না এবারও কিছু হলো না। ছোট ভাই, বাবা আর বড়দা তিনজনই উঠে গেছে। মা এখনও পাশেই আছেন তবে মনযোগে ভাতিজার জন্য রসগোল্লা তুলছেন বাটিতে। এহসান খেয়াল করেছে সুপ্রভার মুখটা তাই হাসতে হাসতেই বলল, “তোরা পারিসও বটে! যা হাঙ্গামা ঘটেছিলি একবারও কি মনে হয়নি এতে তোর বদনাম হবে!”
“তাদের কি এত সময় আছে নাকি ভাবার? শুধু বাপ, ভাইয়ের মুখে চুনকালি কি করে লেপা যায় সেই আন্দাজটাই আছে। বাপের হোটেলে খাবে আর দুনিয়ার আ”কাম-কু’কাম করে বেড়াবে।” কথাটা সম্পূর্ণ কটাক্ষ করে সুপ্রভাকেই বলেছে তার মা। কিন্তু সুপ্রভা সেদিকে পাত্তা দিলো না। সে এহসানকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া গাড়ি এনেছো সাথে?”
“বাইক এনেছি। অফিসের গাড়ি সবজায়গায় ব্যবহার করি না।”
“সত্যি! আমাকে একটু বসাবে প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
সুপ্রভা বায়না ধরলো বাইকে চড়ার। পাশ থেকে তার মা রসগোল্লার বাটি এহসানের দিকে দিতে দিতেই সুপ্রভাকে ধমকে উঠলো, “ফাইজলামি বন্ধ কর বেয়াদম মাইয়া৷ বড় হইছে লাজ-লজ্জা এখনো কিছু হয় নাই।”
সুপ্রভা মায়ের কথা কানে নিলো না। সে বারবার বলতে লাগলো বাইকে উঠবে। এহসানও বলল ঠিক আছে সে একটু ঘুরিয়ে আনবে৷ সোহরাব অফিসের কাজে বের হচ্ছিলো৷ সুপ্রভার জেদ দেখে সে নিজেই বলে গেল, “হাতে সময় থাকলে একটু ঘুরিয়ে আনিস।”
ব্যস, আর কারো অনুমতির দরকার পড়ে না সুপ্রভার। বড়দা বলেছে মানে আর কেউ বারণ করবে না৷ এহসান এর সাথে বের হওয়ার সময় সুপ্রভা একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু লুকিয়েই মুখ বাঁকালো। এহসান বাইক স্টার্ট দিয়েই বলল আশপাশটা ঘুরিয়ে আনবে। সুপ্রভা সুযোগ পেয়ে বলল, “টিয়ার বাড়ি যাবো।”
“কোথায় যাবি!” এহসান বুঝতে পারেনি কথাটা। সুপ্রভা আবার বলল, “আমার বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি যাবো।”
“সেটা তে নয়াগঞ্জ!” অবাক হয়ে বলল এহসান৷ সুপ্রভা হি হি করতে করতে বলল, “হ্যাঁ, বাইকে তো পাঁচ মিনিটেই যেতে পারবো৷ তুমি তো সেখানেই যাবে আমাকে শুধু তাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিবে।”
“কি বলছিস প্রভা! ভাইয়া কি বলে গেছে ভুলে গেছিস?” উত্তেজিত হলো এহসান কিন্তু তা সুপ্রভার দেখার মত ব্যাপার নয়। সে বলল, “তুমি পৌঁছে দিলে কিচ্ছু বলবে না কেউ ভাইয়া প্লিজ নিয়ে যাও।”
এহসান জানে এই পাগলকে এখন শত বুঝ দিলেও বুঝবে না। তাই আর সময় নষ্ট না করে নিয়ে গেল৷ বিপত্তি সৃষ্টি হলো তখনই যখন সুপ্রভা বলতে পারলো না টিয়ার শ্বশুরবাড়িটা আসলে কোথায়। ভাগ্যিস সাথে ফোন ছিলো বিধায় টিয়াকে ফোন করলো। সুপ্রভারা বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়েছিল তাসিনদেরই বাড়ির সামনে। সুপ্রভা একবার উঁকিও মেরেছিলো টিনের গেইট ঠেলে কাউকে জিজ্ঞেস করতে মুরাদের বাড়িটা কোনদিকে। কিন্তু উঠোনে কিংবা দরজার আশপাশে কাউকে দেখা যায়নি৷ মিনিট তিনেকের মাথায় একটা সাত, আট বছর বয়সী ছেলে এসে জিজ্ঞেস করলো, “মুরাদ ভাইদের বাড়ির মেহমান আপনারাই?”
সুপ্রভা মাথা নেড়ে উচ্চস্বরে জবাব দিলো, “হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই এসেছি।” পাশ থেকে এহসান মাথায় ঠোকা মারলো সুপ্রভার।
“ভাবী পাঠাইছে আমাকে।”
“আচ্ছা চলো ” বলেই এহসান বাইকে বসছিলো। সুপ্রভা বলল, “তোমার দেরি হয়ে যাবে ভাইয়া চলে যাও।”
“চলেই যাবো। আগে দেখি তোর বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি কোনটা?”
এহসান মূলত দেখে যেতে চাইছে সুপ্রভাকে সে কার কাছে রেখে যাচ্ছে৷ বাচ্চা ছেলেটা হাত বাড়ি একটা বাঁশের ঝাড়ের পেছনে একটা বাড়ি দেখালো। সামনেই বাড়িটা আর সেখান থেকে একটা মেয়েকেও দেখা গেল উঁকি মেরে এদিকেই তাকিয়ে আছে। সুপ্রভাও মেয়েটাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠলো, “টিয়াপাখি কেমন আছিস?”
সুপ্রভা আর কোন দিকে না তাকিয়েই ঝটপট সেদিকে এগিয়ে গেল৷ এদিকে এহসান এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে সেদিকে খেয়াল নেই। এহসানও হেসে ফেলল পাগলের কারবার দেখে৷ সে বুকপকেট থেকে সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে বাইকে বসলো। রোদ ঝলমলে খুব চোখে লাগছে৷ তখনি আবার চোখে পড়লো যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেই বাড়ির ভেতর থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে এলো। এ তো সেই মেয়েটা না! বিড়বিড় করেই বলল এহসান যেন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে। সেদিন বাজারে ওই ছেলেটার সাথে ছিল! তারপরই এহসান বাইক স্টার্ট দিলো৷ এমন এক বাড়ির মেয়ে অথচ পথেঘাটে অমন বখাটে ছেলের সাথে ঘোরে! বিরক্তি এসে জমাট বাঁধলো এহসানের ভ্রু’র মধ্যিখানে। যেন সেদিন বাজারে এই মেয়েটাই কোন ভুল করে এসেছিল৷ আর এ বাড়ি আফছার মীরের এবং আফছার মীর যথেষ্ট সরল মানুষ তা এহসানের জানা হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। এই এলাকায় থাকার সুবাদে মোটামুটি অনেকের সাথেই পরিচয় হয়ে গেছে। সে আর সময় নষ্ট না করে বাইক নিয়ে চলে গেল।
অনেকক্ষণ ধরে তাসিন বিরিয়ানির প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে। বিরিয়ানি তার কত্তো প্রিয় খাবার অথচ আজ এই খাবার মুখে তোলার পর্যন্ত রুচি হচ্ছে না। খারাপ লাগছে খুব আয়নার জন্য। তাসিন এসেছে শুনে আজ সে নিজেই বিরিয়ানি রেঁধেছে। বিরিয়ানি রান্নাটা সে শিখেছিলো মামীর কাছে তাও কিনা তাসিন ভাইয়ের জন্যই। কিন্তু যে শখে এই রান্না শেখা তা হয়ত কোনদিনও পূরণ হবে না। তাসিনের ঘরনী হয়ে সে কোনদিন বিরিয়ানি তুলে দিতে পারবে না তাসিনের পাতে। তাই অন্তত এবার ক্ষমা চাওয়ার জন্যই নিয়ে এসেছে। মা অবশ্য সকালে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলো এত সকালে বিরিয়ানি কে খাবে দুপুরে রান্না করিস। কিন্তু সে শোনেনি সকালেই রেঁধে এখন নিজেই নিয়ে এলো। তাসিনের সামনে প্লেটে বিরিয়ানি বেড়ে রেখে ক্ষীণ স্বরে বলে গেল, “আমাকে ক্ষমা করে দিও আমি আর কোনদিন ভালোবাসার কথা বলে জ্বালাতে আসবো না। পারলে আমার আগের করা ভুলগুলো ক্ষমা করে দিও।”
তাসিন তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু আয়না তাকে কোন সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। তাসিন খেয়াল করেছে কথাগুলো বলার সময় আয়নার চোখ দুটো জলে ছলছল, কণ্ঠস্বরে কান্না চাপা আর্তনাদ৷ কিন্তু তারই কি করার আছে। সে কিছুতেই পারে না আয়নাকে নিয়ে ভাবতে৷ চেষ্টা করেছিল একটু আয়নাকে নিয়ে ভাবার কিন্তু মন কুঠুরিতে সে আয়নাকে কখনোই কাজিনের বাইরের কোন পদে আসীন করতে পারেনি। এই বিরিয়ানি আর গলা দিয়ে নামবে না। সকালের নাশতাটা আর হবে না বুঝতে পেরে তাসিন বসা থেকে উঠলো। ফোন বের করে রিমনকে কল দিলো সে বাড়ি নেই। তারপর ফোন দিলো সুমনকে সেও আজ ব্যস্ত সর্বশেষ কল দিলো মুরাদকে। হাস্যকর ব্যাপার হলো মুরাদ কে কল দিয়েছে তা খেয়াল না করেই ফোন রিসিভ করে কানে তুলেই বলল, “জান আমি নিয়ে আসছি তো সব আর কল দিও না। আমি সব নিয়ে আসছি আর দু মিনিট।”
“জান, সোনা, বাবু বাহ্ বাহ্ মুরাদ হাউ রোমান্টিক! শালা বিয়ে করে তুই তো দেখি বিবি কা গো’লাম বান গ্যায়া! হা হা হা।”
মুরাদ ফোন কান থেকে নামিয়ে নামটা দেখলো। সে পুনরায় কানে ফোন কানে দিয়য়ে বলল, “আর বলিস না ভাই। বউদের যা ডিমান্ড! উঠতে বসতে ফাইফরমাশ চলেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তার কেনা গোলাম আর সে আমার বাড়ির রাণীমা!”
কাঁদো কাঁদো কন্ঠ মুরাদের৷ তাসিন হাসতে হাসতে বলল, “এখন কোথায় আছিস? অফিসে যাসনি?”
“আজ কি বার শালা ক্যালেন্ডার দেখ। বিয়ে করে পাগল আমি হইছি আর আউলফাউল তুই বকতাছিস। বউয়ের বান্ধবী আসছে তাই বউ ফোন দিয়ে অর্ডার দিলো আইসক্রিম আর মুরগি কিনে আনতে৷ দুপুরে চিকেন বিরিয়ানি খাবে।”
“আবারও বিরিয়ানি!” বিড়বিড় করে ফোন কেটে দিলো তাসিন।
চলবে