বৃষ্টির_রাতে #রূবাইবা_মেহউইশ (১৪)

0
261

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(১৪)
(আইডি রেস্ট্রিকটেড থাকায় পোস্ট, কমেন্ট কিছুই করতে পারছিলাম না। অপেক্ষা দীর্ঘই হয়ে যাচ্ছে বারংবার। ভীষণভাবে দুঃখিত আমি চেষ্টা থাকবে এতোটা দেরি না করার। ঈদ মোবারক সবাইকে)

বৈশাখের শেষ সপ্তাহ; মধ্যদুপুরে রোদের প্রখরতায় গা ঝলসানো অবস্থা প্রায়। অথচ কালই তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে শেষ বেলায় শীত শীত আমেজ ছিল বাতাসে। সুপ্রভা ভারাক্রান্ত মনে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে একটা। মেহরিনের মুখে শুনতেই সে সৌহার্দ্যকে আনব্লক করে কল দিয়েছিল সৌহার্দ্য তোলেনি। আজ আবার একটু আগে গরমে যখন সেদ্ধ প্রায় অবস্থা তখন লাঞ্চ সেরে রুমে ফিরেই কল দিলো। কয়েক সেকেন্ডেই কল রিসিভ করেই সে ক্রুর হাসি হেসেছিল তা ফোনের এপাশ থেকেই টের পেয়েছে সুপ্রভা। প্রেমের সম্পর্ক হয়নি তাদের তবুও যতখানি ভালোলাগার প্রকাশ, প্রশ্রয় দিয়েছিলো সুপ্রভা তাতেই যেন সৌহার্দ্য এখন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে৷

“কেন অযথা ব্লক করেছিলে বলো তো!”

“কি চাও তুমি?”
তেজস্বী স্বর সুপ্রভার।

“আমি কি চাইবো? কি ভাবছো বলো তো প্রভা তুমি?”

“কি ভাববো আবার। তোমার সাথে কি আমার কখনো প্রেমের সম্পর্ক ছিলো?”
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে প্রশ্নটা করলো সুপ্রভা কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সৌহার্দ্য সাবলীল ভঙ্গিতে জবাব দিলো, “সব বিয়ে কি প্রেমের হয়? এ্যারেঞ্জ বলেও কোন শব্দ আছে অভিধানে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে চেক করো।”

“ফাইজলামি বন্ধ করো সৌহার্দ্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি না আর না তুমি আমাকে। তবুও কেন তুমি আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছো?”
ধৈর্য্য হারাচ্ছে তবুও কথা আজ স্পষ্টভাবে সে না করে ক্ষান্ত হবে না সুপ্রভা। গরমে এমনিতেই আজ মস্তিষ্ক ফুটছে যেন তারওপর আজ ক্লাসে একগাদা সহপাঠীর সামনে তাকে উল্টো জামা পরে যাওয়ায় সবার হাসির পাত্র হতে হয়েছে। রাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকালে সব ঝাপসা দেখছিল অথচ আজ গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস আছে; তাও কিনা সকাল আটটায়। আটটা মানে সুপ্রভার কাছে ভোররাত। সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে জামা বদলেছে, মুখ হাত ধুয়েছে কিন্তু চুলগুলো হাতে ওলটপালট করে খোঁপা বেঁধেছে। দেয়ালে আটকানো লম্বাটে আয়নায় একটাবার তাকিয়েও দেখেনি নিজেকে। সেভাবেই গিয়েছে সে ক্লাসে। এক পলকের জন্যও যদি সে জামাটার দিকে তাকাতো তবুও এত বড় ভুলটা হতো না। কিন্তু না আজ তার কপালটাই মন্দ। হোস্টেলে ফিরেও স্বস্তি পাচ্ছিলো না কিন্তু পেটের খিদের তাড়ায় প্রথমে খাবারটা খেয়েছে। খাওয়ার পরই এই অসভ্যকে ফোন দিয়ে এখন মেজাজ বিগড়ে মস্তিক গলে যাচ্ছে। এখন একমাত্র গোসলটাই তাকে শীতল করতে পারে ভেবে সে গোসলের জন্য গেল। কিন্তু কি বিপদ, ভরদুপুরে হোস্টেলের পানি ফুটন্ত পানির চেয়ে কম নয়। চিন্তাগ্রস্ত মাথায় আবার ফিরে এলো রুমে। টিয়া আর মুরাদ যখন পালালো এবং তাদের সঙ্গে নিজেও যখন পালিয়ে এসেছে তখনও এতোটা অস্থিরতা কাজ করেনি তার। কিন্তু এই ভিন শহর থেকে সৌহার্দ্যকে নিয়ে কোন কথা বাড়িতে গেলে তার পড়াশোনা আর হবে না। হয়ত না চাইতেও তখন সৌহার্দ্যকে বিয়ে করতে হবে। ভাবতেই গা কাটা দিয়ে উঠলো সুপ্রভার।

ঢাকার আকাশে যখন সরষেরঙা সূর্য ঝিকমিকিয়ে হাসছে চট্টগ্রামের আকাশটা তখন ধূসর মেঘে ছেয়ে যাচ্ছিলো। লাঞ্চ আওয়ার শেষ হতেই শরীরে একটা ম্যাজম্যাজে ভাব আপনাআপনি চলে আসে। কিষাণের বাড়িতে এ বেলা নিশ্চয়ই ভাতঘুমের আয়োজন চলে। অথচ শহুরে ব্যস্ত মানুষদের জানা নেই ভাতঘুমের সময় কখন। তাদের ব্যস্ততা দিনের পরত বদলে রাত করে দেয় চোখের পলকে আর তারা ব্যস্ত থাকে কৃত্রিম আলোয় ভরা বদ্ধঘরে। তাসিনের খাওয়ার পর ঘুম সবসময় না আসলেও আজ আবহাওয়া আবারও কালকের রূপ ধরায় আজ ঘুম ঘুম লাগছে খুব। কিন্তু কোম্পানির নতুন কাজ এসেছে। হাতে প্রচুর কাজ নিয়ে স্বস্তিতে আর দু মিনিট বসাও যাবে না। তার সব কাজই কম্পিউটারে আর সারাদিন সেদিকে তাকিয়ে থেকে আজকাল চোখের সমস্যাও দেখা দিচ্ছে খুব। সময়ের অভাবে হয়ত ডাক্তারও দেখানো হবে না এ মাসে। আজ হাবিব চাচা আসেনি অফিসে। চাচী অসুস্থ; তাসিন খবর নিয়েছিলো ফোন করে। কাজের দিকে মনযোগ দেওয়ার আধঘন্টা বাদে একটা ইমেইল পেল তাসিন। বস তাকে নোটিশ পাঠিয়েছে কাজের জায়গা বদলি হবে জানিয়ে। তাসিন একা নয় তার আরো কয়েকজন সহকর্মীও পেয়েছে এই নোটিশ। কোন কিছু নিজে থেকে ভাববার আগে সে কনফার্ম হতে চাইলো ব্যপারটা কি! নিজের ডেস্ক ছেড়ে উঠে গেল তার অপজিট সারির একজনের কাছে। সে প্রথমেই প্রশ্ন করলো, “আরমান ভাই, আপনিও কি নোটিশ পেয়েছেন কিছু?”

আরমান মুখ গম্ভীর করে বলল, “হ্যাঁ ভাই পেয়েছি কিন্তু আমার তো এখান থেকে গেলে বিপদে পড়তে হবে। তোমার ভাবীর মাত্রই সিজারিয়ান অপারেশন হলো। তাদের ফেলে দূরে যাওয়া…”

আরমান সাহেবের মুখ দেখে খারাপ লাগলো তাসিনের। সে পুনরায় নিজের ডেস্কে গিয়ে চেক করলো তাদের যেতে হবে কোন লোকেশনে! ‘ঢাকা’ নামটা দেখে চমকে গেল। এতদূরে! তারমানে আর মাস খানেকে তার বাড়ি ফেরা হবে না। যাওয়ার তারিখ চেক করে দেখলো হাতে তিনদিন সময় এখনো আছে। বসের সাথে কথা বলে একটা দিন পেলেই হবে বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসবে। অফিস টাইম শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে বস নিজেই পাঁচ জনকে ডাকলো নিজের কেবিনে। সেই পাঁচজনই সিলেক্ট হয়েছে ঢাকার অফিসের জন্য তাও কিনা মাত্র পাঁচ মাস। প্রত্যেক মাসেই ছুটি একটানা চারদিন করে পাবে তবে পাঁচজনের টাইমিং আলাদা হবে৷ থাকা, খাওয়ার উঠলে জানা গেল সব রকম ফ্যাসালিটিস কোম্পানির পক্ষ থেকেই থাকবে তবে এর বিনিময়ে স্যালারি থেকেই একটা ছোট অংশ অফিস রাখবে। তাসিনের এ নিয়ে মাথা ঘামানোর নেই বরং খুশিই সে। একদম নতুন হয়েও তাকে বিশেষভাবে পুরনোদের সাথে রাখা হচ্ছে। তারমানে তার যোগ্যতা নিয়ে অফিস কতৃপক্ষ সন্তুষ্ট। কিন্তু অতদূরে মন টিকবে কিনা এই নিয়ে যত দ্বিধা। এখানে তো মায়ের মত আপন মামী আছে একটা। বড় বোন, মামা সবাই আছে৷ এত বছরেও একদম আলাদা থাকা হয়নি কখনো তবুও সে চেষ্টা করবে। জীবনে উন্নতি করতে গেলে অনেক কিছুই করতে হয়। বসের সাথে আলোচনা শেষ হওয়ার পর সে বাড়ি গেল৷ আরমান সাহেব ঢাকার অফার ক্যান্সেল করিয়েছেন এতে একটা লাভ হলেও আরেকটা লস তার হয়ে গেছে। ঢাকার সুযোগটা খুব বেছে বেছে পাঁচজনকে দিয়েছিলো অফিস এবং পাঁচজনকেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভালো কাজ দেখাতে পারলেই প্রমোশন পেয়ে যেত। তাসিনের পরিবার নিয়ে এখনো দ্বায়িত্ব কাঁধে আসেনি সে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। এচিভমেন্টের প্রতিটি পথ তার জন্য চিন্তাহীন। কিন্তু আরমান সাহেবের মুরুব্বি বলতে মা এবং শ্বাশুড়ি দুজনেই মৃত এ অবস্থায় তার অসুস্থ স্ত্রী আর সন্তানদের রেখে যাওয়াটা বিপদজনক ভেবেই তিনি পিছিয়ে গেছেন। বাকিরা সবাই প্রস্তুত নতুন উন্নতির জন্য। তাসিন ছুটি পেয়ে রাতেই মামীকে সবটা জানালো। তার আবেগ জোয়ারী মামী শুনেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল৷ তারপর নিজেই তাসিনের ব্যাগে কাপড়চোপড় আরও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে দিলো। তাসিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা আর ভাবছে, “মা ছাড়াও মায়ের মত কাউকে পাওয়া সৌভাগ্য তার কি করে হলো! এই মানুষটা তাকে কখনো ভাইয়া, আপুদের চেয়ে আলাদা করে দেখে না। বরং আজকাল একটু বেশিই আহ্লাদ করে। যদি কখনো তাকে একেবারে চলে যেতে হয় বাড়ি তবে এই মানুষটাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে। তার মায়ের ভাই মামারাও এতোটা পাবে না। মামীর কাপড় প্রায় গোছানো শেষ তাসিন এগিয়ে গেল খাটের কাছে। মামীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আলতো স্পর্শে মাথায় হাত রেখে একটু ঝুঁকে চুমো খেলো মাথায়।

” আমার এই মেয়ে বোকা মেয়েটা এত কান্না করলে আমি কিন্তু চাকরি ছেড়ে দেব।” তাসিন মজা করে বলল মামীকে। মিষ্টি এই থ্রেটে মামী কান্নামুখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

“চাকরি ছাড়লে মাইয়া পালবেন কেমনে আব্বা?”

তাসিনও এবার হেসে উঠলো। আরেকটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ছুটিতো আমার সপ্তাহে সপ্তাহে থাকবে না। বস বলেছে সাপ্তাহিক ছুটি একসাথে দিবে মান্থলি। তাই ঠিক করেছি এক মাসে মাকে দেখে আসবে আরেক মাসে এই মাকে দেখবো।” তাসিনের কথাটায় মামি প্রসন্ন হলো যেন। রাতের খাবার খেয়ে মামাকে জানালো তাসিন তার নতুন অপোরচুনিটির কথা। মামা খুব খুশি হলেন এই নিয়ে; খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলো সে বাড়ি কখন যাবে? তাসিন জানিয়ে দিলো খুব ভোরে বেরিয়ে পড়বে। এরপরই সবাই ঘুমাতে চলে গিয়েছিলো। তাসিন যখন চারটার দিকে এলার্ম শুনে উঠলো তখন সে খেয়াল করলো তার ঘরের বাইরে আলো। তার মনে হলো মামী তার জন্যই এত ভোরে উঠে পড়েছেন৷ এমনিতেও বেরিয়ে পড়ার সময় মামীকে ডেকে বিদায় নিতো। কিন্তু ধারণার থেকে চৌগুণ বেশি হয়ে গেল। তাসিন যখন তৈরি হয়ে ব্যাগ আর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হলো তখন ডাইনিং স্পেসে দেখা গেল মামা-মামী, নুর আপু আর দুলাভাইকে। তাসিন অবাক হতেও ভুলে গেল যেন! এত ভোরে সবার ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে তার চলে যাওয়া। হঠাৎ করে মনে হলো সে বোধহয় দেশান্তরি হতে যাচ্ছে। হাসি মুখে সবার কাছে বিদায় নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো৷ এলাকার সড়ক ছেড়ে হাইওয়েতে উঠতে মিনিট পাঁচেক লাগলো। তারপরই গাড়ির গতি বাড়ালো তাসিন ততক্ষণে অন্ধকার আকাশটা ধোঁয়াশার মত হয়ে ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করেছে। সূয্যিমামার ঘুম ভাঙতে এখনো কিছু সময় বাকি। স্বতঃস্ফূর্ত মেজাজে তাসিন ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দিলো৷ এত ভোরে বেরিয়েও বাড়ি পৌঁছে নাশতার সুযোগ হবে কিনা কে জানে! বাড়িতে এখনো কিছুই জানানো হয়নি এমনকি সে আজ যাচ্ছে সে কথাটাও না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here