বৃষ্টির_রাতে #রূবাইবা_মেহউইশ (২১)

0
236

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২১)

“তুমি কি আমাকে এখনো বাজে ছেলেই ভেবে যাচ্ছো সুপ্রভা?”

প্রথম চামচ স্যুপ মুখে দেওয়ার আগেই কানে এলো অতি পরিচিত কণ্ঠ। যতখানি বিরক্ত সে স্যুপ নিয়ে ছিলো তার চেয়েও অধিক বিরক্ত এখন সৌহার্দ্যের কণ্ঠ শুনে হলো। তার বর্তমান এক অপ্রিয় জীবনকালে সৌহার্দ্য এক অপ্রিয় ব্যক্তি। কোন কুক্ষণে যে সে এই ছেলেকে পাত্তা দিয়ে বন্ধু করেছিল আল্লাহই জানেন। কিন্তু আপাতত এই অসভ্যের কথা নয় স্যুপে মনযোগ দিতে প্রস্তুত হলো সে। সৌহার্দ্য তা টের পেয়ে নিজেই পাশের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। একজন ওয়েটারকে ডেকে আরেকটা স্যুপ অর্ডার দিলো। তারপর নিজের মত করে শুরু করলো কথা, “তোমার বড়দাকে আমি কল করেছিলাম এবং….”

“ইট’স টোটালি ডিসগাজস্টিং টপিক এভার মিস্টার সৌহার্দ্য খান।” স্যুপের বাটিতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রচণ্ডরকম শান্ত গলায় কথাটা বলে আবারও খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সুপ্রভা। গুনে গুনে ঠিক তিনবার সৌহার্দ্য এই একটাই কাজ করেছে। এতে তার সাথে সৌহার্দ্যের কোন সম্পর্কে নতুনত্ব আসার সম্ভাবনা না থাকলেও সুপ্রভার পারিবারিক সম্পর্কটাতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে মায়ের এবং মেহরাব ভাইয়ের নজরে সে এখন হোস্টেলে থাকা বাউন্ডুলে উশৃংখল মেয়ের কাতারে পড়ে। মায়ের চোখে সে বরাবরই বেত কাটার মত ছিলো এখন তা বিষাক্তও হয়ে উঠেছে। তার সকল স্বস্তির আর সুখের এক টুকরো জায়গা বড়দা রয়েছে কিন্তু এই সৌহার্দ্যের কারণে না কবে জানি সেটুকুও হারিয়ে যায়। আজ আর কিছুতেই এই অসভ্য ছেলেটাকে সহ্য করবে না বলে ভেবে নিয়েছে। সৌহার্দ্য পুনরায় বলল, “আমি তোমাকে বন্ধুর মত দেখে এসেছি এতগুলো দিন কিন্তু ওই মেহরিন কি থেকে কি বলল কে জানে আমাকেই তোমার নজরে অশ্লীল করে দিলো।”

“ওহ আর তাই আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে কি প্রকাশ করতে চাইলে?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবার সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো সুপ্রভা। তার এখনো মনে পড়ে ভার্সিটিতে প্রথম দিন ছিলো তার আর সৌহার্দ্য সেদিন প্রথম বর্ষের কোন এক ক্লাসে এসেছিলো তার খালাতো বোনকে নিয়ে। ভার্সিটির সিনিয়র হিসেবে এবং কিছু এক্টিভিটিস আছে তার যেগুলোর জন্য মোটামুটি রকমের পরিচিত মুখ সে ক্যাম্পাসে। না না, কোন ভিসি, এডমিন এমন কোন পজিশন নেই তার পরিবারের শুধু মাত্র নিজ পড়াশোনা আর ওই মিউজিক আর ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে তার পরিচিতি বেড়েছিলো রাজনীতিতে অবশ্য শুরুর দিকেই তাকে ছাড়তে হয়েছে পরিবারের চাপে৷ প্রথম দিনই সুপ্রভা ঝগড়ায় নেমেছিলো সৌহার্দ্যের কাজিনের সাথে আর সেই ঝগড়ায় মূলত পেনাল্টি দিতে আসা সৌহার্দ্যের কিন্তু বেশিক্ষণ সে টিকতে পারেনি সুপ্রভার সামনে। এরপর কি করে যেন মাত্র কয়েকদিনেই এটা সেটা নিয়ে দুজন দুজনকে দেখলেই বিভিন্ন বিষয়ে টিপ্পনী কাটা এবং হেনস্তা করতে গিয়েই বন্ধুত্বটা হয়ে যায়। বেশ ভালোই কেটেছে একটা বছর বন্ধুত্বে। ক্যাম্পাসে এসে সুপ্রভাকে প্রায়ই সিনিয়র ব্যাচে আড্ডা দিতে দেখা যেত৷ সুপ্রভার মাধ্যমেই মেহরিনও জুড়ে গেল সেই ব্যাচে। মাস কয়েক আগে তৃতীয় বর্ষের এক মেয়ে সৌহার্দ্যকে প্রপোজ করলো ভরা ক্যাম্পাসে। সৌহার্দ্য প্রেম নিবেদনে সাড়া না দিলেও দেখা গেল কদিন পর মেয়েটার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব এবং তার কিছুদিন পর সৌহার্দ্য আরো এক মেয়ের বন্ধু হলো। সুপ্রভার তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু হুট করেই একদিন সব বন্ধু মিলে গেল বসুন্ধরায় মুভি দেখতে। সেখানে সৌহার্দ্য সবার সামনেই বলে বসলো, “সুপ্রভা আমার না খুব ভালো লাগে আর এই ভালো লাগাটা ভিন্ন, একটু অন্যরকম৷” সেদিন সৌহার্দ্যের কথা বুঝতে পেরেছিলো সুপ্রভা কিন্তু তার মনে গভীর কোন ভাবনা নেই তাকে নিয়ে৷ সেদিন মেহরিনও সাথেই ছিলো তাদের। সৌহার্দ্য সেদিন জবাব পায়নি সুপ্রভার কাছে তাই বলেছিলো সে জবাবের অপেক্ষায় থাকবে৷ কিন্তু এরপর কি থেকে কি হলো হঠাৎ একদিন মেহরিন এসে তার ফোনে দুটো ছবি দেখালো সৌহার্দ্যের। দুই ছবিতে দুটি ভিন্ন মেয়ে তার সাথে। একজন তাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় । অন্য ছবিটিতে পাশে বসে মেয়েটি তার কাঁধে মাথা রেখেছে আর সৌহার্দ্য এক হাতে তাকে জড়িয়ে রেখেছে। ব্যস এতটুকুই নয় মেহরিন আরো বলেছে সৌহার্দ্য প্রায় অনেকগুলো মেয়ের সাথে রুমডেট করেছে এবং সুন্দরী কাউকে পছন্দ হয়ে গেলেই সে মেয়েটিকে পটিয়ে বিছানা অব্দি নিয়ে যায়। তারপরই সে মেয়েগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে অনেকটা টিস্যুর মত৷ বাবার টাকায় হয় মেয়েটিকে চুপ করায় নয়ত অন্য পথ বেছে নেয়। পুরনো কথাগুলো মনে হতেই সুপ্রভার গা ঘিনঘিন করতে লাগলো। স্যুপ আর গলা দিয়ে নামবে না তার ভেবেই সে উঠতে চাইলো। বিল মিটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই সৌহার্দ্য তার হাতটা ধরে ফেলে আর ঠিক তখনি কোন কিছু না ভেবেই এক চড় বসিয়ে দেয় সৌহার্দ্যের গালে। আকস্মিক এই চড়ে সৌহার্দ্য বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ দুপুরের প্রায় আগ মুহূর্ত বলে রেস্টুরেন্টে কিছু কিছু লোক ছিল। সবাই ঘটনাটা দেখে কৌতূহলী হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য কিছু বলবে সেজন্য মুখটাই খুলতে পারছিলো না কিন্তু সুপ্রভাকেও এমনিতেই ছেড়ে দিবে সেটাও হওয়ার নয়। সে এবার জোর করেই সুপ্রভার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। অনেকটা জোর করেই তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসলো ড্রাইভিং সিটে। দিনটা তার সবেই শুরু হয়েছিলো সুপ্রভার এহেন আচরণ তাকে খুব বাজেভাবে রাগিয়ে দিলো। গাড়ির ডোর লক করে সে গাড়ি স্টার্ট দিতেই যেন সুপ্রভার খেয়াল হলো তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে সৌহার্দ্য! ভয় পাচ্ছে এবার সে আর তাই কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে সৌহার্দ্য? দ্যাখো, বাড়াবাড়ি কোরো না একদম আমাকে নামিয়ে দাও গাড়ি থেকে। ” কান্নাটা ছলকে উঠে আসতে গিয়েও গলায় আটকে আছে৷ ভয়ে হাত-পা শিরশিরিয়ে উঠছে তার এবার৷ গাড়ি তো চলছে তার হোস্টেলের পথেই দেখছি।

ফোনের ওপাশ থেকে ভারিক্কি কণ্ঠস্বর শুনেই চমকে উঠলো তাসিন৷ নাম্বারটাতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দেখলো না নাম্বার তো ঠিকই আছে। সেভ করা নাম্বার ‘তুফান’ নামেই। তবে ফোনটা কে ধরলো! সে আর কয়েক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে কলটা কেটে দিলো। তারপরই মনে পড়লো মেয়েটা বাস থেকে নেমেই ব্যাগে কিছু খুঁজছিল। তবে কি তার ফোনটা চুরি হয়ে গেছে! চুরি হয়ে থাকলে তো সিম চালু থাকতো না কার্ণ বর্তমান চোরেরা দারুণ স্মার্ট। ফোন চুরি করে সাথে সাথেই সিম বের করে ফেলে দেয়। ভুল হয়ে গেছে এভাবে কল দেওয়াটা। আর এ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করলো না তার। সে আবারও নিজের রুমটাতে ঢুকে ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু না সম্ভব হলো না। ফ্ল্যাটের ভেতর কয়েকজন মানুষের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। সকলের মাঝে একটা পরিচিত পুরুষ কণ্ঠও আছে টের পেয়ে দ্রুত উঠে বসলো তাসিন। আবারও রুম ছেড়ে বের হলো এবং তার আসল চমকটা এবার সে পেয়ে মনে মনে প্রচণ্ড খুশি। হাবীব চাচাও এখানে এসেছেন বদলি হয়ে! হাবীব চাচাকে দেখেই তার আনন্দটা হলো পরমুহূর্তেই মনে পড়লো হাবীব চাচার তো এই প্রমোশন হয়নি হয়েছিলো আরমান আর অন্য দুজনের। হাবীব চাচাও তাসিনকে দেখে খুব খুশি হলেন এবং তিনও বোধহয় তাসিনের মত স্বস্তি বোধ করলেন। বলা যায় তাদের দুজনের ভাগ্যটাই বেশ চমৎকার নইলে একই অফিসের আরো অনেক অফিসার এলেও তারা কেউ একই এপার্টমেন্টে রুম পায়নি শুধু সে আর হাবীব চাচাই এদিকে সুযোগ পেয়ে গেছেন। দুপুরের খাবারের আগ পর্যন্ত তাসিন আর হাবীব চাচা গল্পে এবং হাবিব চাচার রুম সাজানোতে ব্যস্ত রইলো। ঠিক দুপুর দুটোয় দুজন পুরুষ এলেন চারটা পলিথিন ব্যাগ নিয়ে এবং প্রতিটিতে প্লাস্টিক টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে টেবিলে চারটি চেয়ার বরাবর খাবার বক্সগুলো সাজিয়ে রাখা তারপরই লোক দুটো বেরিয়ে গেল৷ তাসিন আর হাবিব চাচা টেবিলের কাছে যেতে যেতে দেখলেন ফ্ল্যাটে আরো দুজন এসে উপস্থিত হলো। দুজনের গায়েই ফরমাল পোশাক৷ বুঝতে বাকি নেই এই দুজনও তাদের পথের পথিক। সে দুজন টেবিলের কাছে যেতে যেতে তাসিনদের দেখলো। ভদ্রলোক দুজন নিজেই তাসিনদের দেখে দাঁড়ালেন এবং একজন জিজ্ঞেস করলেন আপনারা দুজন আজ এসেছেন?

তাসিন আর হাবীব চাচা দুজনেই ‘হ্যা’ বলে এগিয়ে এসে হাত বাড়ালেন৷ চারজনে পরিচয় বিনিময় এবং হ্যান্ডশেক করলেন। সে দুজনও নতুন তবে তারা আরো দু দিন আগেই জয়েন করেছে। চারজনের মধ্যে তাসিনই একমাত্র অল্পবয়সী আর অবিবাহিত বাকিরা সবাই ফ্যামিলি ম্যান৷ টুকটাক গল্প, আড্ডায় চারজনে লাঞ্চ কমপ্লিট করলো৷ বাকি দিনটা হাবীব পুরো বিল্ডিংয়ের ওপর নিচ চষে বেড়ালেন। প্রথম দিনেই অনেক লোকের সাথে পরিচিত হলেন এমনকি ম্যানেজারি করা শফিক সাহেবের সাথে বাজারঘাটও ঘুরে এলেন। আর তাসিন লাঞ্চের পর একটু ঘুমিয়ে সন্ধ্যের আগ মুহূর্তে বের হয়ে গেল নিজে নিজেই একটু রাস্তাঘাট দেখতে। অনেকটা পথ হাটাহাটি করে যতটুকু বুঝলো এলাকার অর্ধেকের বেশি জায়গা তাদের কোম্পানির আর এখানে শুধু তাদের মত সিঙ্গেল এমপ্লয়ি নয় ফ্যামিলিসহ আছে অনেকে। তাদের বিল্ডিংয়ের পাশেরটা ফ্যামিলি কোয়ার্টার। হাটতে হাটতেই সে এলাকার বাইরে গেল। বাজার খুঁজে পেল, বিভিন্ন গ্রোসারি সুপারশপ থেকে ধরে ছোট খাটো কিছু রেস্টুরেন্ট আর এক পাশে ছোট খাটো চায়ের দোকানও চোখে পড়লো। একা একা হাটতেও মন্দ লাগেনি খুব একটা তার। সন্ধ্যার পর যখন রুমে ফিরে এলো তখন দেখলো গ্যারেজের ভেতর থেকে কিছু লোকের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। বিষ্মিত হয়ে সে দারোয়ানকে প্রশ্ন করতেই মধ্যবয়সী দারোয়ান পান চিবুতে চিবুতে বলল, স্যারেরা কেরাম খেলতাছে আমনেও যান সময় ভালা কাটবো।

রুমে ফিরে করার মত তার কোন কাজই তো নেই এখন তাই সেদিকেই গেল। গ্যারেজে ঢুকে তার হতচকিত অবস্থা৷ কম করে হলে বিশ থেকে বাইশ জন লোক উপস্থিত খোলা জায়গাটাতে একসাথে দাঁড়িয়ে আর চারজন বসে আছে বোর্ডের সামনে। বসা অবস্থার ক্যারাম বলেই সবাই ভালোভাবে দেখতে পারছে খেলাটা। তাসিন খেয়াল কর চারজন খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন হাবীব চাচাও। দেখেই হাসি পেলো তার লোকটা যেখানেই যায় সবাইকে মাতিয়ে রাখে। খেলা দেখতেই দেখতেই আরো কিছু লোকের সাথে পরিচয় হয়ে গেল তাসিনের। নয়টার আগেই খেলার আসর ভাঙলো এবং নয়টায় রাতের খাবার খেয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। কিছুটা সময় নিয়ে বাড়িতে ফোন করে কথা বলে নিলো। এভাবে সময় কাটানো বড্ড মুশকিল মনে হচ্ছে তাসিনের। যতোই চেষ্টা করুক রাতের এই সময়টা তার মামী আর নুর আপার সাথে গল্প হতো রোজ আবার দুলাভাইয়ের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়তো কখনো কখনো৷ এখানে তেমন কোন সুযোগ নেই, কাছের মানুষগুলো নেই৷ একটা দিনেই কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে তাসিন এখানে ছয়টা মাস কাটাতে গিয়ে তো দমবন্ধ হয়ে যাবে তার। ভাবতে ভাবতেই ঘরের ছোট্ট বেলকোনিটাতে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরে অন্ধকারের ছিটেফোঁটাও নেই। আকাশে পূর্ণচাঁদের ঝলমলে আলো নিচে রাস্তা এবং গ্রাউন্ডের এদিকটায় বাগান আর সেখানেও আছে বৈদ্যুতিক আলো। কিছুটা সময় নিয়ে নিজের থাকার ব্যপারেই ভাবতে লাগলো এই ছোট্ট ঘরটাতে তার প্রয়োজনীয় কি কি লাগবে সেগুলো নিয়ে ভাবলো। বারান্দার জন্য একটা ছোট্ট টুল কিংবা চেয়ার, রুমের জন্য পর্দা, কাপড়চোপড় রাখতে একটা সিঙ্গেল কাবার্ড এমন আরো কিছু জিনিস ভেবে নিলো। তবুও সময় খুব একটা কাটলো না। মাত্র দশটা বেজেছে এখনই ঘুম চোখে আসবে না তাই হেডফোন কানে দিয়ে গান প্লে করলো তাসিন। চুপচাপ বিছানায় চোখ বুঁজে পড়ে রইলো৷ হুট করেই মনে পড়তে লাগলো কক্সবাজারের সময়টুকু। সুপ্রভার সাথে হওয়া প্রথম সাক্ষাৎ এবং ধীরে ধীরে আজ সকাল পর্যন্ত হওয়া প্রায় প্রতিটি ঘটনা সে পরতে পরতে একবার করে মনে করলো। বুকের কাছটায় উষ্ণাভ এক অনুভূতি হঠাৎ করেই ভীষণ উত্তেজিত করে দিলো তাকে। আর এই উষ্ণ উত্তেজনারাই একটা সময় পর নিস্তেজ হয়ে তাসিনের চোখে ঘুম হয়ে নেমে এলো।

সারাদিনের জার্নি শেষে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে তৈয়াব এসে উপস্থিত হলো সুপ্রভার হোস্টেলে। হাতে তার জিলাপি, কিছু ফল আর সুপ্রভার প্রিয় চিকেন ফ্রাই । ওয়েটিং রুমে সে বসেছিল অনেকক্ষণ কিন্তু সুপ্রভা তখনও আসছিলো না নিচে। নিজের রুমে বসে সে এক প্রকার চাপা যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল মেহরিনের সাথে। সকালেই সৌহার্দ্য তাকে জোর করে হোস্টেলে নিয়ে এসেছিলো। তারপরই মেহরিনকে ডেকে অনেকটা ধমকি -ধামকির জোরেই কথা বলে সত্যিটা বের করিয়েছে। শুধু ধমক নয় হোস্টেল থেকে বের করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েই বের হয়েছে সকল সত্য। মেহরিন ভালোবাসে সৌহার্দ্যকে অনেক আগে থেকেই কিন্তু হঠাৎ করে সুপ্রভার সাথে তার বন্ধুত্ব দেখে খারাপ লাগতো। সৌহার্দ্য কারো সাথে রিলেশনে ছিলো না তাও জানতো মেহরিন তাই দূর থেকেই তাকে ভালোবেসে সুখী ছিল। কিন্তু যেদিন মুভি দেখতে গিয়ে আনঅফিশিয়াল একটা প্রপোজাল দিলো সেদিন থেকে ভেতরে ভেতরে গুমরে গেল মেহরিন। ধীরে ধীরে কষ্ট দানা বাঁধলো মনে তবে সে এও জানতো সৌহার্দ্যকে সে তার মনের কথা বলতে পারবে না। সেই চাপা কষ্ট আর প্রিয় বান্ধবীর সাথে পছন্দের মানুষটির বন্ধুত্ব তাকে দিনকে দিন হিংসা পরায়ণ করে তুলল। হিংসা মানুষকে ঠিক কতখানি বিপদজনক করে তোলে তা মেহরিনকে না দেখলে জানা হতো না সুপ্রভা আর সৌহার্দ্যের। মেহরিন স্বীকার করছে ছবিগুলো সে তার পরিচিত এক ছেলেকে দিয়ে এডিট করিয়েছে। সৌহার্দ্য রাগের মাথায় হোস্টেলে সকলের সামনেই চড় মারে মেহরিনকে এবং হোস্টেলে ঘটনাটা যেহেতু সবাই দেখেছে সেহেতু কতৃপক্ষ তাকে নোটিশ দিয়েছে দু দিনের মধ্যে অভিভাবক আনার জন্য । কিন্তু সুপ্রভার কারণে ঝামেলা অনেকটাই নিঃশব্দে মিটে গিয়েছে বলা যায় সৌহার্দ্যকে দিয়ে মিটিয়েছে৷ হোস্টেল থেকে বিতাড়িত হওয়া না আটকাতে পারলেও অভিভাবক ডাকার ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। আর সেই নিয়েই একটু আগে মেহরিন কথা শোনাচ্ছিলো তাকে এত দরদ দেখানোর দরকার নেই। আর হোস্টেল সে আজই ছেড়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ মেজদার আগমন তার চাপা যুদ্ধে জল ঢেলে দিলো৷ নিচে এসে মেজদা তাকে দেখতেই এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বারবার জানতে চাইছে চোখ মুখ এমন কেন হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কান্নাকাটি করেছে৷ সত্যিই সে কেঁদেছিলো একটু আগে এত দিনের পরিচিত বান্ধবীটির এহেন পরিবর্তনের জন্য৷ খারাপ লাগছিলো সৌহার্দ্যকে মারা থাপ্পড়ের জন্য আবার মাকেও মিস করছিলো৷ মেজদার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলতেই মেজদা তার ফোনটা দিলো এগিয়ে।

” রাত বিরাতে একা ফিরে এলি জেদ ধরে তার ওপর ফোনটাও ফেলে এসেছিস জানিস সবাই কত চিন্তা করছিলো বাড়িতে! এমন করলে তো তোকে আর এখানে থাকার অনুমতিই দেওয়া হবে না। এত জেদ করলে কি করে হবে বল তো!”
তৈয়াবের কণ্ঠে চিন্তা স্পষ্ট। বাড়িতেও প্রত্যেকের অবস্থা তেমনই। সুপ্রভা ভাইকে জড়িয়ে ধরে এবার ফুপিয়ে উঠলো। আসলেই সে জেদ করে সবার কথা ভাবতে ভুলে গেছে। তার এত রাগ এত জেদ সবসময়ই তাকে ভুল করতে বাধ্য করে। এই যে সৌহার্দ্যের ব্যাপারটাতেও কেমন দু চার কথায় ওভাররিয়াক্ট করলো এরপর রাগ করে তাকে ইগনোর করলো বলেই তো ছেলেটা তার বাড়ির ঠিকানা, বড়দার ফোন নম্বর জোগাড় করে বাড়িতে প্রস্তাব পাঠালো। এখন তো মায়ের চোখে এটাও বিশ্রীরকম হয়ে উঠেছে। অথচ সে যদি একটু শান্ত মাথায় ভেবে সৌহার্দ্যকে বুঝিয়ে বলতো সুন্দর করিয়ে বুঝিয়ে তার প্রস্তাবটা ফিরিয়ে বন্ধুত্বটা জিইয়ে রাখতো তাহলে হয়ত মেহরিন সুযোগ নিতে পারতো না, সৌহার্দ্যও উগ্র চিত্তে তার বাড়ি পর্যন্ত যেতো না। সব ঘেঁটে গেল তার এই রাগের কারণেই। সুপ্রভা মেজদা পাশে থাকতেই বড়দাকে ফোন করে স্যরি বলল তার ওভাবে জেদ ধরে বাড়ি থেকে চলে আসার জন্য, ভাবীর কাছেও প্রমিস করলো আর কখনো হুটহাট ভুল কোন কাজ করবে না আর যদি করে তাহলে সে এবার নিজেই হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি গিয়ে উঠবে। ভাইয়ের সাথে আরো কিছু সময় কাটিয়ে ভাইকে বিদায় জানালো। আরো একবার প্রমিস করলো আর কখনো রাগের বশে না ভেবে কোন কাজ করবে না।

মেজদা চলে যেতেই সুপ্রভা নিজের রুমে গেল। ততক্ষণে মেহরিন ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। কোথায় গেছে হোস্টেলেও জানায়নি শুধু আর একবার আসবে তার কিছু জিনিস রয়ে গেছে সেগুলোর জন্য এইটুকুই বলেছে। ঘরে ঢুকে সুপ্রভা তার ফোন নিয়ে প্রথমেই মেসেঞ্জারে ঢুকলো। সৌহার্দ্যের অনেকগুলো মেসেজ দেখা যাচ্ছে কিন্তু তা আর দেখতে ইচ্ছে করছে না এখন৷ ফোনটা হাতে নিয়েই উপুর হয়ে শুলো বিছানায়। একে একে হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুক একটানা অনেকটা সময় সোশ্যালে ঘুরে কাটিয়ে রাত নয়টা পার করলো। রাতের খাবারের সময় হতেই সে খাবার খেয়ে এলো অন্য মেয়েদের সাথে গিয়ে। দশটার পর যখন সে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো তখন থেকে তার খারাপ লাগতে শুরু করলো। আজ সকাল পর্যন্তও এই রুমটায় তার পাশের বিছানায় মেহরিন ছিলো আর এখন রুমটাতে সে একা। তিন দিন আগে পর্যন্তও এ ঘরটাতে মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের দুজনের কতশত আড্ডা আর গল্প জমে শূন্যতার ঘর পূরণ হতো আজ এই মুহুর্তে সেগুলো অতীত৷ খারাপ লাগছে তার এখন মেহরিনের জন্য কিন্তু মেয়েটা একটু যদি নিজের দোষ স্বীকার করতো তবুও সে জোর করে রাখতো এখানে৷ কিন্তু না, সে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও সুপ্রভাকে ভালোমন্দ কতরকম কথা যে শুনিয়ে গেল! নাহ সেও আর ভাববে না এমন বন্ধুদের কথা। রুমের লাইট অফ করে আবার বিছানায় শুয়ে ফোনটা হাতে নিলো। কি মনে করে কললিস্টে ঢুকলো সে এবং শুরতেই ঝটকা খেলো তাসিনের নম্বরটা দেখে৷ কল হিস্ট্রি দেখে আরও চমকে গেছে যখন দেখলো এক মিনিট বারো সেকেন্ড! ফোনটা তো আজ মেজদার কাছে ছিলো আর মেজদাও তো বলল না তার ফোনে কল এসেছিলো! ফোনের স্ক্রীণে সময়টা দেখলো রাত বাজে এগারোটার ওপরে। এত রাতে কি কল করাটা ঠিক হবে? লোকটা কি কিছু বাজে ভাববে না! কিন্তু মনটাও তো মানছে না আর কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই সুপ্রভা ছোট্ট একটা বার্তা লিখলো, “আপনি আজ কল করেছিলেন?” মেসেজটা সেন্ড করবে না করবে না করেও শেষে মনকে মানাতে না পেরেই সেন্ড করে দিলো। মেসেজটা সেন্ট হতেই কেমন লজ্জা লাগলো সুপ্রভার। এতরাতে এভাবে মেসেজ করাটা কি হ্যাংলামি হয়ে গেলো না! ঘরের দরজা জানালা বন্ধ তবুও হঠাৎ হঠাৎ বিজলি চমকানোর আলো জানালার কাঁচ ভেদ করেই ঘরে প্রবেশ করছিলো। আজ রাতেও বৃষ্টি হবে বুঝি! এই বৃষ্টি আর তাসিনের মধ্যে কি কোন যোগসূত্র আছে! ভেবে ঠিক মিলিয়ে উঠতে পারে না সুপ্রভা। আজ অব্দি লোকটার সাথে তার দেখা হওয়ার প্রায় প্রত্যেকটা দিনই ঝড়, বৃষ্টি একটুও হলেও হয়েছে। এই যেমন কাল শেষ রাতে সুপ্রভার যখন ঘুম ভেঙেছিলো তখনও সে খেয়াল করেছিলো হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছে । ফোঁটায় ফোঁটায় তার মুখ আর গলা একটুখানি ভিজে উঠেছিলো। তার আগে কক্সবাজার, ঢাকায় আসার পথ আর বাড়ি ফেরার পথে প্রত্যেকবারই মাঝারি কিংবা ভারী বর্ষণ লেগেই ছিলো। সুপ্রভার ঘুমে চোখ ভারী হয়ে উঠলো তাই ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিলো আর তখনই ফোনটার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠে মৃদু আওয়াজে জানান দিলো একটা মেসেজ এসেছে। ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা হাতে নিলেও মেসেজটা চোখে স্পষ্ট হলো না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here