রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-১৯ (নতুন মোড়)

0
783

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৯ (নতুন মোড়)

৩৬।
মারিয়া পুরো রাস্তায় স্থির হয়ে বসেছিল। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এই প্রথম কোনো একটা বিষয় তাকে খুব কড়াভাবে আঘাত করেছে। অথচ যেই মানুষটির কষ্টে সে এই মুহূর্তে কষ্ট পাচ্ছে, সেই মানুষটিকে মারিয়া মোটেও পছন্দ করে না।
প্রায় দশমিনিট পর সে হাসপাতালের সামনে চলে এলো। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই মারিয়া নিরবকে দেখতে পেলো। সে নিরবের কাছে গিয়ে বলল,
“নিরব, তুমি ঠিক আছো তো?”

নিরব ছলছল চোখে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বুঝালো, সে ঠিক নেই। মারিয়া নিরবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার ভাইয়া কোথায়?”

নিরব ইশারায় নিবিড়কে দেখিয়ে দিলো। মারিয়া নিবিড়ের কাছে যেতেই নিবিড় বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিবিড়ের মলিন মুখ দেখে মারিয়ার কষ্ট যেন দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। নিবিড়কে সে হাসতে দেখেছে, অভিমান করতে দেখেছে, কিন্তু কখনোই বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে নি। তাই এই মুহূর্তে নিবিড়কে দেখে তার মায়া লাগছে।

মারিয়া নিবিড়ের কাছে এসে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আন্টির খবর পেয়েছি! আমার শুনে খুব খারাপ লেগেছে। এই মুহূর্তে তোকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারছি না।”

নিবিড় হুট করে মারিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম আমার মা যাতে সুস্থ হয়ে যায়, কিন্তু আমার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয় নি। এখন তো আমরা একা হয়ে গেলাম। বাবা, নিরব আর আমাকে শাসন করার মতো কেউ নেই। এখন কে দেখবে আমাদের? আমি আমার মনের সব জমানো কথা মাকে গিয়ে বলতাম। মা ছাড়া কেউ আমাকে বুঝতো না। এখন আমি কাকে আমার মনের কথাগুলো বলবো? কে আমাকে মায়ের মতো বুঝবে? আমি সত্যিই একা হয়ে গেছি।”

নিবিড় হুট করে জড়িয়ে ধরায় মারিয়া কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিলো। এর আগে সে কখনো কোনো পুরুষের এতোটা কাছাকাছি আসে নি। আর ছোটবেলা থেকেই মা বুঝিয়েছিলেন, বিয়ের আগে কোনো পুরুষের কাছাকাছি যাওয়া খুবই নোংরা একটা ব্যাপার। আর বিয়ের পর স্বামীর অগোচরে কোনো পুরুষের সাথে যোগাযোগ রাখা আরো জঘন্য ব্যাপার। কোনো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব থাকাটা আরিয়া ফেরদৌসের আপত্তির বিষয় ছিলো না। কিন্তু এই বয়সে আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তাই এসব বন্ধুত্বগুলোও আর চিরকাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে না। তাই আরিয়া ফেরদৌস মেয়েদের আগে থেকেই সতর্ক করে বলেছিলেন,
“যদি কোনো ছেলে বন্ধু থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই বাসায় আনবে। তবে আমার আড়ালে আনতে যেও না। আমার সাথে দেখা করানোর জন্য নিয়ে আসবে। আমি তোমাদের সেই বন্ধুর বাবা-মার সাথেও দেখা করবো। ভালো একটা সম্পর্ক হবে দুই পরিবারের মধ্যে। শুনো, বন্ধু থাকা খারাপ নয়। বিপদে বন্ধুর খুব প্রয়োজন। যেমন রিদ্ধের মতো বন্ধু পেয়ে আমি নিজেকে অবশ্যই ভাগ্যবতী বলবো। কারণ সে আমাকে অনেকবার অনেক বড় বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু বন্ধুকে ভাই ভাবতে যেও না। বন্ধু তোমার আপন ভাই কখনোই হবে না। তুমি তাকে বিশ্বাস করবে, কিন্তু ততোটুকু যতোটুকু বিশ্বাস করা যায়। তাকে বিশ্বাস করে তুমি এক রাত তার সাথে বাইরে কাটাতে পারবে না। কোনো নিরিবিলি পরিবেশে তার সাথে মনের দুঃখ ভাগ করার মতো বিশ্বাসী সে কখনোই হবে না। কারণ সে তোমার আপন ভাই নয়। তার সাথে তোমার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা হবে শালীন ভাষায় শুধু কথা বলার মধ্যে। তুমি তাকে হাত ধরার অনুমতি দিতে যেও না, নয়তো সে একদিন তোমার গলা জড়িয়ে ধরবে। আমি কোনো ছেলেদের চরিত্র খারাপ, তা বলছি না। আমি তোমাদের বোঝাতে চাইছি, চরিত্র নষ্ট হতে বেশি সময় লাগে না। আর আমি চাই না, আমার মেয়েরা কারো ফাঁদে পরে তাদের সম্মান বা আমার সম্মানে কোনো আঘাত দিক।”

মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই মারিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। কিন্তু সে মনে মনে ভাবলো, এই মুহূর্তে নিবিড়কে সরিয়ে দিলে ছেলেটা নিজেকে আরো অসহায় মনে করবে। তাই মারিয়া সান্ত্বনার সুরে নিবিড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“নিবিড়, তুই নিজেকে একা ভাবিস না। আমরা তো সবাই আছি। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে আংকেল আর নিরবকে কে সামলাবে?”

“আমি কাউকে সামলাতে পারবো না।”

নিবিড় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। এদিকে মাফিন মাহাথিকে বলল,
“ভাই, এখন তোমার যাওয়া উচিত। আমি আপতত নাহিদ আংকেলের সাথে থাকি। শুনলাম ওরা কিছুক্ষণ পর আন্টিকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। আর কাল সকাল এগারোটাই দাফন। আমরা না হয় কাল সকাল সকাল বেরিয়ে যাবো জানাজার জন্য। আর এই মুহূর্তে আমার এখান থেকে চলে যাওয়াটা সুন্দর দেখাবে না। নাহিদ আংকেল শুধুমাত্র মায়ের কলিগ হলেও, অল্প কয়েক দিনেই উনার সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। আর তোমার বিয়ে উপলক্ষেও উনি কতো দায়িত্ব নিয়েছিলেন! মনেও হয় নি, উনি বাইরের কেউ। আর তার এমন অবস্থায়, তাকে এভাবে একা ফেলে যাওয়াটা অনেক বিশ্রী দেখাবে। আমি একদম তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েই ক্লাবে ফিরবো। তুমি এখন যাও।”

“হুম, যাচ্ছি। এখনি আধাঘন্টা দেরী হয়ে গেছে। আমার এই মুহূর্তে যেতেই হবে। এমন একটা অবস্থায় আমার বিয়ে, ভাবতেই কেমন জানি লাগছে।”

“কি আর করার! বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু সবই তো আল্লাহর হাতে। এখন যাও।”

মাফিন আর মাহাথি কথা বলতে বলতে সামনে যাচ্ছিলো, হঠাৎ মারিয়া আর নিবিড়কে একসাথে দেখে তারা থমকে গেলো। মারিয়াকে এভাবে ভরা হাসপাতালে নিবিড়ের সাথে দেখে তাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মাফিন দ্রুত পায়ে তাদের কাছে এসে জোর গলায় বলল,
“মারিয়া, তুই এখানে কি করছিস?”

মাফিনের গলার স্বর শুনে নিবিড় মারিয়াকে ছেড়ে দিলো। মাহাথি মারিয়ার হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“তুই কি কমনসেন্স হারিয়ে ফেলেছিস? এটা কি কোনো সিনেমা হল, নাকি পার্ক!”

মারিয়া কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তুমি ভুল ভাবছো। নিবিড়ই তো আমাকে..”

“চুপ মারিয়া। তোকে এখানে কে আসতে বলেছে?”

“আমি তো আন্টিকে দেখতে এসেছি।”

“তুই কি এতো বড় হয়ে গেছিস যে আন্টিকে দেখতে আসবি? আমাদের কাউকে না জানিয়ে তুই একা একা ক্লাব থেকে এখানে কেন এলি? মাফিনকে তো ফোন দিয়ে জানাতে পারতি। এখন আত্মীয়-স্বজনরা কি মনে করবে? তোকে কি কেউ বের হতে দেখে নি?”

মারিয়া কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“ভাইয়া, আমি কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছি? মা কি জানতে পারলে আমাকে বকবে?”

মাফিন মারিয়ার চুল টেনে ধরে বলল,
“গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ভাইয়ার সাথে তাড়াতাড়ি চলে যা। মা যদি জানতে পারে এসব, তোর পা দুইটা একদম ভেঙে দেবে। যা এখন।”

মারিয়া মলিন মুখে নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড়কে দেখতে এখন আরো অসহায় লাগছে। এমনিতেই মাকে হারিয়ে সে অনেক বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল, তার উপর মারিয়াকে জড়িয়ে ধরায় সে এই মুহূর্তে লজ্জিত ও অনুতপ্ত। তবে ঘটনাটি মাফিন ও মাহাথির দৃষ্টি এড়িয়ে গেলে সে এতোটা লজ্জিত হতো না। কিন্তু এই মুহূর্তে তার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।

মাহাথি ও মারিয়া গাড়িতে চুপচাপ বসে রইলো। মারিয়ার বুকটা ঢিপঢিপ করছে। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“ভাইয়ারা কি ভাবছে নিবিড়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে? আল্লাহ, বাঁচাও আমাকে। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমার নিবিড়ের বাচ্চাটাকে তখনই কিক মেরে দূরে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মা মরা একটা ছেলের সাথে কি কেউ খারাপ ব্যবহার করে? আজ আমি প্রথম নিবিড়কে পাত্তা দিয়েছি, আর আজই আমার কপালে দুর্ভোগ নেমেছে। আমি এই নিবিড়ের বাচ্চাকে আর কখনোই পাত্তা দেবো না। শুধু এই ঘটনাটা মায়ের কান পর্যন্ত না গেলেই হয়। মা জানতে পারলে, আমাকে কখনোই ট্যুরে যেতে দেবে না, কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দেবে।”

মারিয়া মাহাথির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া, মাকে এসব বলো না, প্লিজ।”

মাহাথি বলল,
“আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে আমি মাকে এসব জানাবো? মা কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছিল। এসব যদি মা দেখে ফেলতো, তখন কি হতো? আর তোর সাথে নিবিড়ের কোনো সম্পর্ক থাকলে এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।”

“বিলিভ করো ভাইয়া। কসম বলছি। আল্লাহর কসম। মিথ্যে বললে আমার সব চুল পড়ে যাবে। আমার নিবিড়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।”

মাহাথি চোখ বড় বড় করে ইশারায় ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিয়ে মারিয়াকে চুপ থাকতে বললো। মারিয়াও বাকী রাস্তা চুপ করে রইলো। এরপর ক্লাবে এসে সে দৌঁড়ে মহুয়ার কাছে চলে এলো।

মহুয়া মারিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি অবস্থা এখন?”

“নিবিড়ের মন খারাপ।”

“হুম, স্বাভাবিক।”

“আচ্ছা চান্দু, মা কি আমাকে খুঁজেছিল?”

“না তো। মা তো এসে মেহমানদের সাথে কথা বলতেই ব্যস্ত হয়ে গেলো।”

মারিয়া প্রশান্তির হাসি হেসে বলল,
“আল্লাহ তাহলে আমাকে বাঁচিয়েছে।”

“হুম, তা তো বাঁচিয়েছেই।”

এদিকে আরিয়া ফেরদৌস দূর থেকে মারিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মারিয়া মায়ের চাহনি দেখে ভয়ে চুপসে গেলো।

শেষমেশ মাহাথি ও সূচনার আনুষ্ঠানিক বিয়ের পর্বের সমাপ্তি ঘটলো। সূচনার বাবা-মা মাহাথির হাতে তাদের মেয়েকে তুলে দিয়ে বিদায় জানালেন।

অন্যদিকে মহুয়া আর মারিয়া ঘরে এসে মাহাথি ও সূচনার বাসর সাজাতে লাগলো। মারিয়া ঘরে ফুল ছিটিয়ে দিতে দিতে বলল,
“চান্দু, তুই কিন্তু আমার বাসর ঘর সাজাবি।”

“আমি কেন সাজাবো? তোর বরের ভাবীরা বা বোনরা সাজাবে। এসব আমার দায়িত্ব নয়।”

“ইশ, তুই-ই যদি আমার বরের ভাবী হয়ে যাস, তাহলে অনেক মজা হবে।”

“দেখিস, তোর বরের কোনো ভাই থাকবে না। তুই হবি ঘরের একমাত্র বউ। তারপর ঘরের সব দায়িত্ব তোর মাথায় এসে পড়বে। এরপর বুঝবি সুখী জীবন কেমন হয়! একটা কাজও তো পারিস না। বিয়ের পর কি করবি তুই?”

“তোকে সতিন বানিয়ে নিয়ে যাবো।”

“এসব মুখের কথা।”

“না চান্দু, আমি সত্যিই তোকে আমার সতিন বানিয়ে নিয়ে যাবো।”

মহুয়া মারিয়ার গাল টেনে ধরে বলল,
“পৃথিবীতে সব ভাগ দেওয়া যায়, কিন্তু বরের ভাগ কোনো মেয়েরাই দিতে পারে না। আর আমাদের মিষ্টি সম্পর্কটা এসব ভাগাভাগির কারণে কখনোই নষ্ট হবে না। তাই তোর বর তোরই থাকবে। আর আমার বর আমারই থাকবে। তবে তারা দু’জন ভালো বন্ধু হলে তো কথায় নেই। অনেক মজা হবে।”

“হ্যাঁ, আমরা প্রতিদিন দেখা করবো, ট্যুর দেবো। অনেক মজা হবে, তাই না?”

দুই বোন তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যস্ত। তাদের কাছে হয়তো সবই এখন রঙিন লাগছে। তাদের কাছে জীবনের আকাশটা রংধনুর মতো। যেই আকাশে রংধনু বিলীন হয়ে যায় না। আর সেই রংধনুর আকাশের নিচে তারা স্বপ্ন দেখায় ব্যস্ত।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here