রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-০৪

0
618

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৪

০৯।
খাবারের টেবিলে নিরবতা বিরাজ করছে। একদিকে মাহাথি মাথা নিচু করে বসে আছে। আর তার মুখোমুখি বসে মাফিন মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মায়ের পেছনে মহুয়া পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে মেঝেতে নখ দিয়ে আঁচড় দিচ্ছে। অন্যদিকে মারিয়া বসার ঘরে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ডায়নিং রুমের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে।

আরিয়া মহুয়ার হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে গরম ভাতের উপর ঢেলে দিলেন। এরপর ভাতের উপর এক বাটি লাল মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়ে বললেন,
“আজ সবাই এগুলো দিয়েই ভাত খাবে। আগামী দুইদিন বাসায় কোনো সবজি, মাংস কিছুই জুটবে না। কারো খেতে ইচ্ছে না করলে, নিজের টাকায় বাইরে থেকে খেয়ে নেবে।”

মারিয়া মায়ের কথা শুনে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“প্রেম করেছে ভাইয়া, আর শাস্তি পাচ্ছি আমরা। এখন এই গরম পান্তা আর মরিচ আমি কিভাবে গলধঃকরণ করবো?”

আরিয়া নিজের প্লেটে সেই মরিচ মেশানো ভাত তুলে নিয়ে খেতে যাবে তখনই মাহাথি আরিয়াকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“মা, আমি ভুল করে ফেলেছি। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তোমাকে আমি কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা হুট করে হয়ে গিয়েছিল। মা, তোমার সূচনাকে খুব পছন্দ হবে। ও অনেক ভালো একটা মেয়ে। ও এতো বছর শুধু আমার অপেক্ষায় ছিল। আমি হঠাৎ মাঝপথে এসে ওর হাতটা কিভাবে ছাড়ি, বলো? তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছিলে কারো সাথে যাতে অন্যায় না করি।”

আরিয়া কড়া দৃষ্টিতে মাহাথির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“নিজে অপরাধ করে তুমি আমার শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলছো? মেয়েটা যে-ই হোক, আমি তাকে চিনি না। আমি তোমাকে চিনি, আর আমি তোমাদের সবাইকে আগেই বলে দিয়েছি, আমি কোনো প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেবো না। তবুও আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তুমি প্রেম করে আমাকে বলছ, মেনে নিতে?”

“মা, ভুল করে ফেলেছি..”

মাফিন হুট করে খাবারের প্লেট মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাহাথিকে থামিয়ে দিল। মাফিনের এমন ব্যবহারে আরিয়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। মহুয়া কয়েক পা পিছিয়ে রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর মারিয়া এক দৌঁড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

মারিয়া মনে মনে বলল,
“আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। আজ আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমি কাল সকালে দশ রাকাআত নফল নামাজ পড়বো।”

এদিকে মাহাথি মাফিনের এমন ব্যবহার দেখে বলল,
“কি করলি এটা?”

মাফিন চেঁচিয়ে বললো,
“ঠিক করেছি। একদম ঠিক করেছি। ভাইয়া, তুমি কোনো ভুল করো নি৷ তুমি সূচনা আপুকে ভালোবেসেছ, আর তাকেই বিয়ে করবে। তোমার কাউকে এতো ব্যাখ্যা দিতে হবে না। কেউ নিজে যদি কঠোর হৃদয়ের হয়, বাকীদেরও এমন হতে হবে, এর কোনো যৌক্তিকতা নেই।”

আরিয়া চেঁচিয়ে বললেন,
“আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল। আমাকেই যেহেতু বলছিস, তাহলে আমার দিকেই তাকা।”

মাফিন এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“খারাপ কিছুই বলি নি। আজ পর্যন্ত তোমার কথামতোই সব কিছু হয়েছে। আর এখন তুমি ছেলের একটা কথা শুনতে পারছো না? উলটো এতোগুলো ভাতের মধ্যে তুমি মরিচ মিশিয়ে দিয়েছো! কে খাবে এই ভাত? আমি তো খাবো না।”

মাফিন জোর গলায় বলল,
“মহু, মারু তোদেরও খেতে হবে না।”

আরিয়া ফেরদৌস শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে মরিচ মেশানো ভাতগুলো খেতে লাগলেন। মাহাথি বাঁধা দিতে গেলে তিনি অগ্নি দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। এদিকে মাফিন রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল। আর মহুয়াও ভয়ে তার ঘরে চলে এলো। মারিয়া মহুয়াকে দেখে চাপা স্বরে বলল,
“ভাই, এখন কি তবে আমার বান্দরবান যাওয়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যাবে? যে করেই হোক এই সমস্যাটা এই সপ্তাহের মধ্যেই মিটমাট হওয়া চাই। মহু, আমাকে একটু ভরসা দিয়ে বল, এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”

মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুই এখনো বান্দরবান নিয়েই আছিস। এদিকে মা একা একা মরিচ মেশানো ভাত খাচ্ছে। মেজ ভাইয়া মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলে রুমে চলে গেছে। বড় ভাইয়াও চলে গেছে।”

“আচ্ছা, মহু, আমি গিয়ে মায়ের পাশে বসলে কি মা আমাকে বান্দরবান যাওয়ার অনুমতি দেবে?”

মহুয়া কপাল চাপড়ে বলল,
“অনুমতি কেন, একেবারে পাঠিয়েই দেবে।”

মারিয়া খুশি হয়ে বলল, “সত্যিই!”

“হ্যাঁ, সত্যি। এমন একটা চড় বসাবে, তুই একেবারে বান্দরবান গিয়ে পড়বি।”

মারিয়া চোখ ছোট করে বলল,
“আমার হয়তো এবার একটা নফল রোজা রাখতে হবে।”

“মারু, তুই পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়ার আশায় যদি এভাবে আল্লাহকে ডাকতি, তাহলে নির্ঘাত ফার্স্ট হতি।”

“দেখ চান্দু, ভালো ফল করা অনেকাংশই আমার হাতে, কারণ আমি পড়লেই ভালো করতে পারবো। কিন্তু মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করা আল্লাহর হাতে, তাই আমি এভাবে পবিত্র মনে আল্লাহকে ডাকছি।”

১০।

আরিয়া ফেরদৌস খাওয়া শেষ করে মেঝে থেকে প্লেটের ভাঙা টুকরোগুলো উঠাতে লাগলেন। তারপর সব পরিষ্কার করে তিনি রান্না করা সবজি আর মাংসগুলো গরম করে চুলায় ভাত বসিয়ে দিলেন। ভাত রান্না করে চারটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে তিনি মহুয়া আর মারিয়াকে ডাকলেন। মহুয়া আর মারিয়া রুম থেকে বের হাওয়ার পর তিনি বললেন,
“তোমাদের ভাইয়াদের ডেকে খাইয়ে দিও। আর মাহাথিকে বলবে, আগামীকাল মেয়েটাকে বাসায় নিয়ে আসতে।”

কথাটি শুনে মারিয়া আর মহুয়া একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। আর আরিয়া চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলেন।

মারিয়া ডায়নিংয়ে সাজানো প্লেট দেখে অবাক হয়ে বলল,
“মেজ ভাইয়ার এক চিৎকারে মা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। মাফিন ভাইয়া, ইউ আর গ্রেট।”

মহুয়া রাগী কন্ঠে বলল,
“শাট আপ মারিয়া। মা ঠান্ডা হয়ে যায় নি, অনেক কষ্ট পেয়েছে। ভাইয়া আজ মায়ের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছে। এভাবে চেঁচিয়ে কথা বলা তার উচিত হয় নি। আজ না হয় কাল, মা এই সম্পর্ক মেনে নিতোই। আর আজই মা এসব জেনেছে, স্বাভাবিক ভাবে রাগ তো দেখাবেই। আর মায়ের রাগ সম্পর্কে আমাদের সবারই ধারণা আছে। কিন্তু মেজ ভাইয়া তো মায়ের রাগ কমার সময়টাও দেয় নি।”

মারিয়া চুপ করে রইল। মহুয়া আবার বলল,
“তুই সবসময় নিজেরটাই বুঝিস। আর এটা কিন্তু খুব খারাপ স্বভাব।”

মারিয়া মুখটা কালো করে বলল,
“আমার ক্ষিধে লেগেছে।”

“আগে মেজ ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আয়। আমি বড় ভাইয়াকে ডেকে আনছি।”

মারিয়া মাফিনের কাছে গিয়ে বলল,
“ভাইয়া, মা সবাইকে খেয়ে নিতে বলেছে।”

মাফিন রাগী কন্ঠে বললো,
“আমি খাবো না। তুই যা এখান থেকে।”

“মা, আবার ভাত রেঁধেছে। আর রুমে যাওয়ার আগে আগামীকাল মিষ্টি আপুকে বাসায় নিয়ে আসার জন্য বড় ভাইয়াকে বলতে বলেছে।”

মাফিন কথাটি শুনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মা এতো তাড়াতাড়ি মেনে নিয়েছে, এটা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

এদিকে আরিয়া ফেরদৌস বারান্দার মেঝেতে বসে আছেন। তিনি চোখ বন্ধ করে অতীতের কালো অধ্যায়টি মনে করার চেষ্টা করছেন। চৌদ্দ বছর আগেই তিনি তার ভয়ংকর জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। তিনি চাইলে আরো আগেই সেই ভয়ংকর জীবন থেকে মুক্তি নিতে পারতেন। কিন্তু চার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে গেছেন। এমনও হয়েছে তিনি এক সপ্তাহ সাদা ভাত ছাড়া আর কিছুই খান নি। কিন্তু সন্তানদের চুরি করে ভালো খাবার খাইয়েছিলেন।

মিরাজ জামান অনেক সময় অবেলায় ঘরে এসে আরিয়াকে মারধোর শুরু করে দিতেন। আর মাঝে মাঝে গরম ভাতের উপর পানি ঢেলে দিয়ে তার উপর শুকনো মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে জোর করে আরিয়াকে খেতে বাধ্য করতেন। মূলত তখন থেকেই আরিয়া রাগ উঠলে এভাবেই গরম ভাতে পানি ঢেলে মরিচ দিয়ে খেতো। তার দৃষ্টিতে অতীতের ভয়ংকর স্মৃতি সামনে এলে মানুষের সুখ স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অতি সুখ স্বপ্ন মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে।

আরিয়া ফেরদৌস আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“এই সন্তানদের জন্য এতোদিন বেঁচে ছিলাম, আর আজ এরাই আমাকে অপমান করে আমার মনটাকে মেরে ফেলেছে। লোকে বলতো, আরিয়া তুই কিভাবে এই চারটা সন্তান মানুষ করবি? তারা বলেছিল, আমার সন্তানদের রক্ত খারাপ। তাদের দাদা-বাবা ভালো মানুষ ছিলো না, তাই আমারগুলোও অমানুষ হবে। কিন্তু আমি তখন খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলাম, এরা মানুষও হবে, আবার আমার মনের মতোও হবে। কিন্তু আজ মাফিনের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে আমি দ্বিতীয় মিরাজ জন্ম দিয়েছি।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here