#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪১
৬৫।
দুই মাস পর-
মাফিন আর স্বস্তিকার বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ পর তাদের বিয়ে। দুই পরিবারেই সাজ সাজ রব। বিয়ের কার্ডও ছাপানো শেষ। এখন শুধু বিয়ের বাজার করাটাই বাকী। আর কালই তারা বিয়ের বাজার করার জন্য বের হবে।
এদিকে মাফিন নাস্তা খেয়ে সোফায় পা তুলে বসলো আর টিভির রিমোটটা হাতে নিলো। তখনই মারিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, তুমি চ্যানেল পাল্টাবে না বলছি। আমাকে এই নাটকটা দেখতে দাও।”
মাফিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এসব কি দেখিস, হ্যাঁ?”
“অভ্রনীল।”
“কি অভ্রনীল?”
“নাটকের নাম অভ্রনীল।”
মাফিন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মেয়েটা এভাবে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছে কেন?”
“মেয়েটার নাম নীলা, আর ছেলেটার নাম অভ্রনীল।”
“আরেহ, এতো নাম-পরিচয় দিচ্ছিস কেন? মেয়েটা কাঁদছে কেন সেটাই বল।”
“আজ ওর বরকে ফাঁসিতে ঝুলাবে।”
“ওরেব্বাবা, এতো দেখছি চোরের বউ।”
“ভাইয়া, অভ্র চোর না। ওর নামে মিথ্যে মামলা হয়েছে।”
“আচ্ছা, তুই তো জানিসই। গিয়ে সমাধান করে দে।”
“তুমি বিরক্ত করছ কেন আমাকে?”
মাফিন বিরক্তির সুরে বলল,
“তো মেয়েটার পাশে পুলিশের পোশাক পরে আছে লোকটা কাঁদছে কেন?”
মারিয়া গম্ভীরমুখে বলল,
“অভ্রের কথা শুনে কাঁদছে। কারণ অভ্র বলেছিল, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, ভয় পাই পৃথিবীতে নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দিয়ে অন্যায়কারীদের মুক্ত ভাবে ঘুরতে দেখে। কারণ একদিন তারা এই পৃথিবীটা ধ্বংস করে দেবে।”
মাফিন মুচকি হেসে বললো,
“এই অভ্রনীল তো দেখছি কেয়ামত বিশেষজ্ঞ।”
মারিয়া চেঁচিয়ে বললো,
“ভাইয়া, এটা শুধু সংলাপ ছিল। তুমি বাস্তবতার সাথে এসবের মিল পাবে না।”
মাফিন কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল,
“বুঝলাম না এই বিশেষ সংলাপ শুনে পুলিশের লোকটা কাঁদছে কেন? মানে এখানে কান্নাকাটি করার মতো কিছু আছে?”
“হ্যাঁ, অভ্রের ফাঁসি হবে, এটাই মূল বিষয়।”
মাফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভাই তোরা মেয়েরা না এসব নাটক দেখে দেখেই ন্যাকামি করা শিখেছিস। ভালো কিছু দেখ। আর আমাকে রিমোট দে। আজকে একটা লাইভ প্রোগ্রাম আছে।”
মারিয়া রিমোট নিয়ে টিভির কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। মাফিন সোফা ছেড়ে উঠে মারিয়ার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“যা একদম টিভির ভেতর ঢুকে যা। তোর না বিয়ে হয়ে গেছে? বসে বসে রান্না-বান্নার অনুষ্ঠান দেখ। এসব আউল-ফাউল নাটক দেখে সময় নষ্ট করিস না।”
মাফিন কথাটি বলে চলেই যাচ্ছিল, তখন মারিয়া চেঁচিয়ে বলল,
“তোমার বউ বসে বসে সারাদিন বাংলা সিনেমা দেখে। দেখবো তখন বউকে কিভাবে এতো কথা বলো। ভাবীর চোখ দেখেই ঠান্ডা হয়ে যাবা। বোন দেখে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছো। হুহ।”
মাহাথি টিভির সুইচ বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“বাগানে পানি দেওয়ার দায়িত্ব কার ছিল?”
মারিয়া মুখ ছোট করে একবার মাহাথি আরেকবার মাফিনের দিকে তাকালো। মাহাথি বলল,
“পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে টিভিতে কখনো নাটক, কখনো বা নাচ-গান, এসবই দেখছিস। মহুয়া কি করছে আর তুই কি করছিস?”
মারিয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,
“মহুয়া সারাদিন বই পড়ছে। কারণ ওর শখ বই পড়া। আর আমার শখ ঘুরাঘুরি করা। যা প্রতিদিন সম্ভব না। তাই আমি যা-ই করি তা তোমাদের চোখে পড়ছে। আমি যে গতকাল হালিম রান্না করা শিখেছি, সেটা তো তোমরা ভুলে গেছো।”
মাফিন হেসে বলল,
“বড় ভাবী রেঁধেছে, আর তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। ব্যস হয়ে গেলেন তিনি রাঁধুনি। শোন, মা তোকে আপতত কিছুই বলছে না। কিন্তু তোর দিকে যেই দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেদিন তোকে ধরবে তুই শেষ। তাই বোন, অন্তত মা অফিস থেকে ফেরার আগে টিভি দেখিস না।”
“কিন্তু মা তো মাত্র অফিসে গেলো। এখন তো দেখলে সমস্যা নেই।”
মহুয়া রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে বলল,
“ভাইয়া আমি বলছি।”
মাহাথি আর মাফিন চলে যাওয়ার পর মহুয়া মারিয়াকে বলল,
“বাসায় বিয়ের তোড়জোড় চলছে। সূচনা ভাবীর স্কুল, মায়ের অফিস, আর ভাইয়ারা তো আর মেয়েলী কাজগুলো করবে না, তাই না? এখন তো আমাদেরই কিছু সাহায্য করা দরকার। আমি না হয় ভারী কাজগুলো করবো। তুই অন্তত রুম পরিষ্কার করে রাখিস। গাছে পানি দেওয়ার কাজটা তো আরো সহজ। ওটাতো অন্তত করতে পারিস।”
মারিয়া মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“চান্দু, আজকে অন্তত তুই করে ফেল। আমি সত্যি বলছি, কাল দেখে সব কাজ আমি করবো। আজকে একটু নাটকটা দেখি। প্লিজ ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলিস, হ্যাঁ?”
মহুয়া মলিন মুখে উঠে চলে গেলো। আর মারিয়া টিভি ছেড়ে নাটক দেখায় মনোযোগ দিলো।
এদিকে মাফিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হঠাৎ ফোনের শব্দে চোখ খুলে দেখলো স্বস্তিকার কল। মাফিন গভীর হাসি হেসে কল রিসিভ করে বলল,
“ডোরেমন, হঠাৎ আমাকে ফোন দিয়েছ?”
স্বস্তিকা আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
“আপনি আমাকে ডোরেমন ডাকা কখন বন্ধ করবেন? এখন তো আমি আপনার বউ হতে যাচ্ছি।”
“তো এতোদিন কি ছিলে?”
“অর্ধেক বউ, অর্ধেক প্রেমিকা।”
মাফিন হাসলো। স্বস্তিকা বলল,
“আচ্ছা, একটা কথা বলার ছিল।”
“হুম, বলো।”
“আমাদের বিয়ের কেনাকাটা আমরাই করবো। ঠিক আছে?”
“আমরাই তো করবো।”
“ওটা না। মানে শুধুই আমরা। আর কেউ যাবে না।”
“কিন্তু মা তো যাবে বললো। নয়তো মহুয়া আর মারিয়া যাবে।”
স্বস্তিকা বলল,
“বিয়ে আমার আর আপনার। ওখানে মা আর বোনরা কেন যাবে? আর আমার পছন্দের ব্যাপারে আমি আপনাকে যতোটা সহজে বলতে পারবো, মাকে ওতো সহজে বলতে পারবো না। আর মহুয়া আর মারিয়ার সামনেও আমার লজ্জা লাগবে। প্লিজ, শুধু আপনি আর আমি। আপনার পক্ষ থেকেও কেউ না, আমার পক্ষ থেকেও কেউ না।”
মাফিন কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“কিন্তু বাসায় বলতে হবে।”
“তো বলুন।”
ফোন রাখার পর মাফিন চিন্তায় পড়ে গেল। স্বস্তিকা এভাবে অনুরোধ করেছে, সে কি ফেলতে পারবে? কিন্তু মাকে সে কিভাবে জানাবে? মা যদি বিষয়টা অন্য ভাবে নেয়? মনে মনে এসবই ভাবছে মাফিন। হঠাৎ তার মাথায় এলো এসব ব্যাপারে মারিয়া খুব চালাক। মারিয়া হয়তো এর কোনো সহজ উপায় বের করে দিতে পারবে। মাফিন সাথে সাথেই চলে এলো বসার ঘরে। দেখলো মারিয়া এখনো টিভি দেখছে। মারিয়া ভাইকে দেখে রিমোট লুকিয়ে ফেললো। মাফিন হেসে বললো,
“সমস্যা নেই, দেখ দেখ। আমি তোকে অন্য একটা কথা বলতে এসেছি।”
মারিয়া গম্ভীরমুখে বলল,
“হুম, বলো।”
“আমি আর স্বস্তিকা কাল বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবো। আর স্বস্তিকা চাইছে, শুধু আমরা দু’জন যাতে যাই। আচ্ছা, মাকে আটকানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায় না?”
“মাকে বলো, শুধু তুমি আর ভাবী যেতে চাও।”
“না, কি না কি ভাববে।”
“ভাবাভাবির কি আছে। আক্দ হয়ে গেছে তোমাদের। তোমরা যেতেই পারো।”
“তুই বুঝতে পারছিস না।”
“কি বুঝছি না?”
“তুই জানিস, মা যা ভুল মনে করে, তা কোনোভাবেই হতে দেয় না। যদি এই কথা বলার পর কোনো কারণে মা বলে দেয় না যেতে, তখন?”
“তো! আমি এখন কি করবো?”
“এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি কর, যাতে মা নিজেই আমাদের একা যেতে বলে।”
মারিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা।”
মারিয়া মহুয়াকে গিয়ে সব বলার পর মহুয়া বলল,
“মা কি আমাদের শত্রু? ইদানীং দেখছি মাকে সবাই ভয় পাচ্ছে। আমাদের কি মায়ের সাথে এতোটা দূরত্ব চলে এসেছে, যে এই সহজ কথাটা মাকে না বলে আমরা এতো দূর পরিকল্পনা করছি? আর স্বস্তিকা ভাবীকে আমি বুঝতে পারি না। আমি তার খুব অদ্ভুত ব্যবহার লক্ষ্য করেছি।”
“তোকে এতো বিশ্লেষণ কে করতে বলেছে। এখন আমাকে বল সাহায্য করবি কি না।”
“করবো। ভাইয়া যেহেতু চাইছে, কেন করবো না? কিন্তু মা যদি জানতে পারে, আমরা তাকে সামান্য এই ব্যাপারে ভরসা করতে পারছি না, তাহলে খুব কষ্ট পাবে।”
চলবে–