রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৪৪:

0
410

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪৪:

৭০।
নীল পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, আর হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট নিয়ে মারিয়ার দিকে এগিয়ে এলো প্রহর। কাল সারারাত মারিয়া কান্নাকাটি করেছিল, তাই ঠিকমতো ঘুমাতে পারে নি। যা তার চোখ-মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মারিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রহরের মনে অপরাধবোধ সৃষ্টি হলো। পরক্ষণেই সে ভাবলো,
“মারিয়াকে বুঝতে দেওয়া যাবে না, সে যা ভাবছে তা সঠিক। ও শুধু অনুমান থেকেই এতোটা ভেঙে পড়েছে, সত্যটা জানলে আরো সমস্যা হবে। আমার এই সম্পর্কটা আজ ঠিক করতেই হবে৷ মারিয়ার মন থেকে এই সন্দেহটা দূর করতেই হবে।”

মারিয়া হাতে থাকা প্যাকেটটির দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল, “কি ওটা?”

প্রহর প্যাকেটটি মারিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার জন্য এনেছি।”

প্রহর লক্ষ্য করলো মুহূর্তেই মারিয়ার চোখের মলিনতা কেটে গেছে, যেন সে এই বাক্যটিই শোনার অপেক্ষায় ছিল। মারিয়া প্যাকেট খুলে দেখলো একটা চমৎকার বাক্স। সে প্রহরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি আছে এখানে?”

“খুলেই দেখো।”

মারিয়া বাক্সটি খুলে দেখলো বাক্সের ভেতর বিভিন্ন ফ্লেভারের চকলেট। চকলেটগুলোর উপরে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন রঙের লিপ্সটিক। মারিয়া বাক্সটি ধপ করে বন্ধ করে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে প্রহরের মুখের দিকে তাকালো। প্রহর মারিয়ার চাহনি দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আর মনে মনে ভাবলো,
“ওর কি পছন্দ হয় নি?”

প্রহর মারিয়ার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে এখনো কিছুই জানে না। কিন্তু এতোটুকু জেনেছে মারিয়ার সাজগোজ করতে বেশি ভালো লাগে। তাই সে বিভিন্ন রঙের লিপস্টিক কিনেছে। যদিও ব্রেন্ড সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। আর কিছুদিন আগে সে মারিয়াকে দুই-তিনটা চকলেট একসাথে খেতে দেখেছিল, তাই সে ভেবেছে, চকলেটও হয়তো ওর পছন্দের। কিন্তু এখন মারিয়ার চাহনি দেখে প্রহর কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো। তবে প্রহরকে আরো অবাক করে দিয়ে মারিয়া বাক্সটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আই লাভ দিজ গিফট। এই বাক্সের সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে কিন্তু এর মূল্য কখনোই শেষ হবে না।”

প্রহর অবাক দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মারিয়া বাচ্চাদের মতো বাক্সটি জড়িয়ে রেখেছে। কি অদ্ভুত আবেগ! প্রহর ভাবছে,
“এই অবুঝ মেয়েটা কি আমায় ভালোবাসে? কিন্তু আমাদের মধ্যে তো এমন কিছুই হয় নি। তাহলে ওর চোখে আমি এতো প্রেম দেখছি কেন? হয়তো এসব আবেগ। যেই আবেগ একদিন কেটে যাবে। কারণ একমাত্র ভালোবাসায় চিরস্থায়ী।”

এবার মারিয়া ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করে বলল,
“এবার কিন্তু ধীরস্থির ভাবে সব কাজ করেছি। খেয়ে দেখুন। আপনার প্রিয় হালিম। মেইড বাই মারিয়া নাওয়াল।”

কথাটি বলেই মারিয়া হাসলো। এই হাসি দেখলে মনেই হবে না গতরাতেই সে তার স্বামীকে সন্দেহ করে বিয়ে ভাঙার কথা বলেছিল।
মেয়েদের মন বড়োই অদ্ভুত। একটু ভালোবাসা পেলেই একদম গলে পানি হয়ে যায়।

প্রহর হালিম খেয়ে মুচকি হেসে বলল,
“সত্যিই তুমি রেঁধেছ?”

মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আমার টেলেন্ট সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই। শুধু এখনো রান্নাবান্না শিখি নি, তাই আমার নামের সাথে মাস্টার শেফ যুক্ত হয় নি। নয়তো পুরো বাংলাদেশে আমার বানানো রেসিপি চলতো।”

প্রহর শব্দ করে হাসলো। মারিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে প্রহরের হাসি দেখছে। আর মনে মনে বলছে,
“একবার রান্না করা শিখে ফেলি, তখনই মিস্টার বর, তুমি আমার গুণের মর্ম বুঝতে পারবে।”

হঠাৎ প্রহরের চোখ আটকে গেল পাশের টেবিলে। দেখলো এক জোড়া নর-নারী তাদের কাটানো মুহূর্তগুলো খুব সুন্দর ভাবেই উপভোগ করছে। মেয়েটি একটা সাদা শাড়ি পরেছে, হাতে কালো চুড়ি, কপালে কালো টিপ, আর খোঁপায় সাদা গাজরা। তার পাশে থাকা ছেলেটি খুব যত্নের সাথে মেয়েটির হাতে একটা বেলি ফুলের মালা বেঁধে দিচ্ছে। আর এরপর ফোন হাতে নিয়ে সেই মুহূর্তগুলো ছবিতে ধারণ করছে। হঠাৎ মেয়েটি ছেলেটিকে বলল,
“তোমার ওইদিনের লেখা কবিতাটা আবার শুনাবে? আমার না বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। কি আছে ওই কবিতায় একটু বলো তো?”

ছেলেটি বলল,
“ভালোবাসা আছে। অনুভূতি আছে। আর বিশেষত তুমি আছো আমার কবিতায়।”

মেয়েটি হাসলো। ছেলেটি সেই কবিতাটি বলা শুরু করলো। মেয়েটির এক হাত ছেলেটির হাতের মুঠোয় আবদ্ধ, আর অন্য হাত গালে। সে মুগ্ধ চোখে গালে হাত দিয়ে কবিতা বলা মানুষটিকে দেখছে।

প্রহরের হঠাৎ মনে হলো মেয়েটির মাঝে সে মহুয়াকে দেখছে। এদিকে মারিয়া প্রহরের দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,
“কি দেখছেন?”

প্রহর মারিয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে নিচের দিকে তাকালো। আর কিছুক্ষণ পর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তোমার সম্পর্কে কিছু বলো। তোমার স্কুল-কলেজ কেমন কেটেছে, ভালো লাগা কোনো মুহূর্ত সম্পর্কেও বলতে পারো।”

মারিয়া হেসে বললো,
“মনে হচ্ছে আপনি আমাকে রচনা বলতে বলছেন, আর রচনার নাম স্মরণীয় দিন।”

প্রহর হাসলো। সে লক্ষ্য করলো, মারিয়া সব ব্যাপারই মজার ছলে নেয়। কোনো কথার যুক্তিসঙ্গত উত্তর দেয় না। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে হাস্যকর উত্তর দেয়। মারিয়াকে যথেষ্ট মজার মানুষ বলা যায়। আর সে মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে শুনে মনে হয়, সে অসম্ভব বোকা মেয়ে। প্রহর মনে মনে বলল,
“বোকা মেয়েগুলোই হয়তো ঠকে যায়। কিন্তু আমি মারিয়াকে ঠকাতে চাই না। মাঝে মাঝে কিছু অনুভূতি সত্যের কাছে হেরে যায়। আর মারিয়া আমার স্ত্রী, এটাই সবচেয়ে বড় সত্য।”

এদিকে প্রহর বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। টুসটুসিকে খাবার দেওয়ার পর প্রহর বলল,
“আচ্ছা টুসটুস, টুসি তো তোর বউ। তুই ওর সাথেই থাকিস। এখন যদি তোদের আলাদা করে দেয়, তোর তো খুব কষ্ট হবে, তাই না? কিন্তু আমি যদি তোর জন্য একটা টুনি নিয়ে আসি, তখন তুই খুশি হবি না? নাকি টুসির মায়ায় আটকে থাকবি? টুসটুস, আমার মহুয়াকে খুব ভালো লাগে। মেয়েটা সত্যিই চমৎকার। আর মারিয়াও ওর জায়গা থেকে চমৎকার। কিন্তু আমার মনটা মহুয়ার দিকে যতোটা আকৃষ্ট হয়েছিল, এখন মারিয়ার দিকে ওতোটা হচ্ছে না কেন? দুজনের চেহারা এক, শুধু স্বভাব ভিন্ন। তাহলে কি এই স্বভাবটাই আমার কাছে অনুভূতি। আমি না সত্যিই আমার অনুভূতি বুঝতে পারছি না। আমার এখন মারিয়াকেই ভালোবাসতে হবে। আমার ভুলে যাওয়া উচিত আমি কোনো এক অবেলায় বাতিঘরে এক উজ্জ্বল আলোর পরিবেশে বই হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়েকে দেখেছিলাম। একবার নয়, তাকে বার-বার দেখেছিলাম। সেই চোখ দুটিকে ভুলতে হবে। সেই মুহূর্তটা ভুলতে হবে। একটু তো সময় লাগবে। কিন্তু আমি ভুলে যাবো। মানুষ কাউকে বেশিদিন মনে রাখে না। দূরে চলে গেলে স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে যায়। আর একদিন ধুলোবালিতে ঢাকা পড়ে যায়। হয়তো মায়াবিনীও একদিন ধুলোবালিতে ঢাকা পড়ে যাবে। শুধু বেঁচে থাকবে মহুয়া, আমার শালিকার পরিচয়ে।”

প্রিয়া প্রহরের রুমে এসে দেখলো সে বারান্দায় বসে টুসটুসির সাথে গল্প করছে। প্রিয়া তার পাশে বসে বলল,
“ভাইয়া একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয় নি।”

প্রহর প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, “বল।”

“তুই কি ভাবীকে ইগনোর করছিস?”

“মানে?”

“দেখছি তো। ভাবীর ভাইয়ের মেহেদিতে ভাবী ক্লাবে এলো না, অথচ তুই ভাবীর না আসা নিয়ে কিছুই বললি না। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার! ঘটনাটা কিন্তু চোখে পড়ার মতো ছিল। মা-বাবাও বলাবলি করছে, তোর শ্বশুড়বাড়ির কেউ কি বলবে না ভাবছিস?”

“ওর তো শরীর ভালো ছিল না।”

“কিন্তু সেটা শুনেও তো তোর কোনো হেলদোল দেখি নি। এমন একটা ভাব করে রেখেছিস যেন তোর বউ বলতে কেউই নেই।”

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। প্রিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ভাইয়া, তুই কি এখনো মহুয়া আপুকেই পছন্দ করিস?”

প্রহর বোনের কথায় কিছুটা বিরক্ত হলো। প্রিয়া আবার বলল,
“মহুয়া আপু কিন্তু অনেক ভালো মেয়ে। তবে মারিয়া ভাবীর চেয়ে কখনোই না।”

প্রহর ভ্রূ কুঁচকে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রিয়া বলল,
“মহুয়া আপু খুব চাপা স্বভাবের। তার চোখ দেখলে বোঝায় যায় না তার কোন বিষয়টা ভালো লাগছে, আর কোন বিষয়টা খারাপ লাগছে। কিন্তু মারিয়া ভাবী যা সত্য তা মুখের উপর বলে ফেলে। যদিও আমাদের সমাজে এদের অভদ্র বলে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তারাই সঠিক। তাদের মধ্যে কোনো লুকোচুরি নেই। মহুয়া আপুর মতো মেয়েরা কারো খারাপ দেখলেও চুপচাপ মেনে নিয়ে সহ্য করে যায়, তাই তারা আপাত দৃষ্টিতে ভদ্র, শান্ত, আদর্শ মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পায়।”

প্রহর এবার প্রিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই কি এখানে মারিয়ার পক্ষে, মহুয়ার বিপক্ষে ওকালতি করতে এসেছিস?”

প্রিয়া বলল,
“মহুয়া আপুর বিপক্ষে বলছি দেখেই কি তোমার এতো খারাপ লাগছে?”

প্রহর বলল,
“আমার খারাপ লাগছে কারণ তুই আমাকে অসময়ে বিরক্ত করছিস। এখন যা।”

প্রিয়াকে এক প্রকার ঠেলেই রুম থেকে বের করে দিলো প্রহর।

চলবে-

(আগামী দুইদিন বোনাস পর্ব আসবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here