#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
বোনাস পর্ব-০২
৭২।
আরিয়া ফেরদৌস মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছেন। আর নাহিদ হোসেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ আরিয়া ফেরদৌসের চোখ নাহিদ হোসেনের দিকে পড়তেই তিনি বিষয়টি খেয়াল করলেন। বললেন,
“তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
নাহিদ হোসেন আরিয়ার কথায় খানিকটা লজ্জা পেলেন। বললেন,
“মনে হচ্ছে তুমি নতুন নতুন বিয়ে করেছ। তোমায় দেখলে কেউ বলবেই না যে ছেলের বউ ঘরে তুলেছ।”
নাহিদের কথা শুনে আরিয়া ভ্রূ কুঁচকালেন। এরপর পাশে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে একনজর দেখে নিলেন। তারপর বললেন,
“লিপস্টিকের জন্য বলছো? আমি আসলে বুঝি না, ছেলে বিয়ে দিয়ে দিলে কি একজন নারী তার সব ইচ্ছের বিসর্জন দিয়ে দেবে? তার কি সাজগোজ করার কোনো অধিকার থাকবে না?”
নাহিদ ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“আরেহ, আরেহ, তুমি সোজাটা না বুঝে বাঁকাটাই বুঝলে। আমি বলতে চাইছি, তুমি দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছো। মানুষের দিন দিন বয়স বাড়ছে। কিন্তু তোমার বাড়ছে সৌন্দর্য। আর তুমি তো আগে হালকা লিপস্টিক ব্যবহার করতে। ইদানীং গাঢ় রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করো। আসলে কি জানো! তোমাকে গাঢ় জিনিসে খুব মানায়।”
আরিয়া ফেরদৌস চেয়ারে আয়েশ করে বসে গালে হাত দিয়ে বললেন,
“তুমি আমার সাথে ফ্লার্ট করছো? বুড়ো বয়সে তো তোমার স্বভাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
“আরেহ, এখন তো আমরা বন্ধু, তাই না? আর আমি তো আমার বন্ধুর প্রশংসা করতেই পারি।”
আরিয়া ফেরদৌস চোখ ছোট করে বললেন,
“এতো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে না বলে সোজাসুজি বলেই ফেলো, কি চাও তুমি?”
নাহিদ হোসেন গলা ঝেড়ে বললেন,
“চলো, আজ কোথাও ঘুরতে যাই। আমরা দুপুরের খাবারটা না হয় বাইরেই খাবো।”
“তোমার শুধু বাইরে যাওয়ার বাহানা! অফিসে কি তোমার কোনো কাজ নেই?”
“ছিল। শেষ করে ফেলেছি। আর আমি কি তোমার মতো বেশি বেশি কাজ করি?”
“হ্যাঁ, আমি বেশি বেশি কাজ করি। কারণ আমার দায়িত্ব এই কোম্পানির জন্য ভালো কিছু করা।”
“আচ্ছা, বাবা বুঝলাম। এখন আজকে কি বাইরে যাওয়ার অনুমতি পাবো?”
“যাও, তোমাকে বারণ করেছে কে?”
“সাথে যদি আরিয়া ফেরদৌসকেও অনুমতি দেওয়া হতো! মানে একা একা কি কেউ ঘোরাঘুরি করে? কেউ সাথে থাকলে একটু ভালো লাগে আর কি।”
আরিয়া ফেরদৌস ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
“দেখা যাক।”
“কখন দেখবেন, ম্যাম?”
আরিয়া ফেরদৌস মুচকি হেসে বললেন,
“দুপুরের একটু আগেই বুঝবেন। এখন কাজে মনোযোগ দিন।”
নাহিদ হোসেন মুচকি হেসে নিজের কেবিনে চলে গেলেন। ইদানীং তাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। অতীতটা তারা সম্পূর্ণ রূপে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অতীতে তাদের মধ্যে যেই সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সমস্যাটা এখন দূর হয়ে গেছে। আর কতো দিন-ই বা অতীতের জেদটা নিয়ে বসে থাকবেন? তবে মাঝে মাঝে নাহিদ হোসেনের অতীতের সেই খারাপ স্মৃতিটা মনে পড়ে যায়। আর তখন ইচ্ছে করে আরিয়ার সাথে অভিমান করে থাকতে৷ কিন্তু বেশিক্ষণ সেই অভিমান ধরে রাখতে পারেন না। তবে এবার না চাইতেও তার পুরোনো প্রেম সত্যি সত্যিই জেগে উঠেছে। তিনি আবার আরিয়াকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। যদিও এর শেষটা সম্পর্কে তার কোনো ধারণায় নেই৷ তবুও যতো দিন বেঁচে আছেন, অন্তত তিনি কোনো আফসোস রাখতে চান না।
ছোটবেলা থেকেই নাহিদ হোসেন আরিয়াকে পছন্দ করতেন। কিন্তু আরিয়ার পক্ষ থেকে কিছুই ছিলো না। অন্যদিকে আরিয়া ফেরদৌস আর রিদ্ধ সেন খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। আর রিদ্ধ সেন সেই বয়সে আরিয়াকে ভালোবাসতেন। ধর্ম ভিন্ন হওয়ায় তার ভালোবাসাটি কখনো ঠিকানা খুঁজে পায় নি। তবুও তিনি যতোটা সম্ভব আরিয়াকে গ্রামের অন্য ছেলেদের থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। আর সেই আড়ালের মাঝে নাহিদ হোসেনের ভালোবাসাটাও চাপা পড়ে গিয়েছিল।
নাহিদ হোসেনের বাড়িটি আরিয়াদের বাড়ির একদম পাশেই ছিল। আরিয়া যখনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেসুরো গলায় গান করতো, তখনই নাহিদ হোসেন বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কান পেতে সেই গান শুনতেন। আরিয়া গান গাইতে পারতো না। কন্ঠ ভালো হলেও কখনো তার গানের সুর ঠিক হয় নি। তাই তার কন্ঠে যেকেউ গান শুনলে খুব হাসাহাসি করতো। কিন্তু এক সময় সেই বেসুরো গায়িকার ভালোবাসায় জড়িয়ে যান নাহিদ। গ্রামের রক্ষণশীল মেয়েদের স্কুলে যাওয়া আসার সময়টাই ছিল বাড়ির বাইরে বের হওয়ার একটা মোক্ষম সুযোগ। আর সেই সু্যোগে আরিয়া পুরো গ্রাম ঘুরে তবেই বাড়ি ফিরতো। আর সেই মুহূর্তে নাহিদ দূর থেকে আরিয়াকে দেখতেন। তবে রিদ্ধ পাশে না থাকলে তিনি অনেকবার আরিয়ার কাছে এসে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেন নি। আরিয়া রিদ্ধ ছাড়া আর কোনো ছেলেকেই পাত্তা দিতো না, এমনকি কথাও বলতো না।
আরিয়া ফেরদৌস ছোটবেলায় খুব একরোখা ছিলেন। বিয়ে হওয়ার পর তিনি অনেকটা শান্ত ও ধৈর্যশীল হয়ে পড়েন। আর বর্তমানে কঠোর মনের মানুষ। তবে নাহিদ হোসেন যখন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন তিনি ব্যাপারটা খুব উপহাসের সাথে নিয়েছিলেন।
নাহিদ হোসেন দুই বার প্রেমপত্র লিখে পাথরে মুড়িয়ে আরিয়ার বারান্দায় ছুঁড়ে মেরেছিলেন। আরিয়া সেই চিঠি দুটি তার সামনেই ব্যাঙ্গ করে পড়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। নাহিদ হোসেন কষ্ট তো পেয়েছিলেন, সাথে খুব অপমানিত হয়েছিলেন। তবে শেষ একবার আরিয়াকে পাওয়ার ইচ্ছেটা ছাড়তে পারেন নি। সেই মুহূর্তে আরিয়া আর মিরাজের তুমুল প্রেম চলছিল। আর মিরাজ বরাবরই খুব সন্দেহবাতিক ছিল। এর আগে এলাকার বখাটে ছেলেরা আরিয়াকে উত্যক্ত করলে, সে উলটো আরিয়ারকেই বকাঝকা করতো। আর সেই মুহূর্তে নাহিদের বারবার প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া, মিরাজ আর আরিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটার একটা উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারতো। তাই আরিয়া প্রেমিকের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার আগেই, নাহিদকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য একটা পরিকল্পনা করে। আর এই পরিকল্পনায় তাকে পূর্ণ সমর্থন করে রিদ্ধ।
আরিয়া একদিন স্কুল ছুটির পর এলাকার চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে জানায়, নাহিদ হোসেন তাকে বাজে প্রস্তাব দেয়। প্রমাণস্বরূপ প্রেমপত্র দুটি দেখায়। সাক্ষী হিসেবে ছিল রিদ্ধ। এরপর চেয়ারম্যান সাহেব নাহিদের বাবা-মাকে ডেকে আনেন। গ্রামের সবার সামনে সেদিন নাহিদের বাবা খুব অপমানিত হয়েছিলেন। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে হয়ে যদি এমন একটা কাজ করে বসে তাহলে সমাজে মুখ দেখানোর কি কোনো উপায় আছে?
ছেলেকে তিনি সবার সামনে জুতোপেটা করেছিলেন। আর ওইদিন রাতেই নাহিদ গ্রাম থেকে শহরে তার ফুফুর বাসায় চলে যান। এরপর আর কখনোই সেই গ্রামে পা রাখেন নি। শেষ বার গিয়েছিলেন, স্ত্রী রোকেয়ার দাফনের জন্য। কারণ তার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছে ছিলো, তাকে যাতে গ্রামের বাড়িতে দাফন করানো হয়।
আরিয়াকে ভালোবাসা নাহিদের জন্য এতো অপমানজনক হবে, তা তিনি সেই মুহূর্তে ভাবতেই পারেন নি। কাউকে ভালোবাসলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া তার দৃষ্টিতে অন্যায় ছিলো না। তিনি আরিয়াকে জোর করেন নি। তিনি শুধু সুযোগ চেয়েছিলেন। তবে এতোকিছুর পরও আরিয়ার প্রতি ভালোবাসাটা তার মন থেকে কখনোই মুছে যায় নি। হয়তো এক কোণায় বেঁচে ছিল, তাই এতোবছর পর সেই অংশটা জেগে উঠতে চাইছে। কিন্তু এখন কি আর আরিয়াকে পাওয়া সম্ভব? আরিয়ার চারটা সন্তান, তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে। তার নিজেরও দুইটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আছে। তার মধ্যে একজন তো আরিয়ার মেয়েকেই ভালোবেসে বসে আছে। এই জটিল সম্পর্কের মধ্যে কি নাহিদ হোসেন তার ভালোবাসাটা ফিরে পাওয়ার আশা রাখতে পারেন? তার বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে মনে ভাবলেন,
“যদি মিরাজ নামের মানুষটি আরিয়ার জীবনে কখনোই না আসতো!”
হয়তো আরিয়া ফেরদৌসও তাকে দেখলে এটিই ভাবেন। মাঝে মাঝে কিছু ভুল সম্পর্ক অনেকগুলো সুন্দর সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও নষ্ট করে দেয়।
চলবে–