রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৪৫:

0
410

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪৫:

৭৩।
স্বস্তিকা ও মাফিনের বিয়ের দু’মাস কেটে গেলো। স্বস্তিকা নতুন বাড়িতে ভালোই দিন কাটাচ্ছে। মাফিন সকালে উঠে অফিসে চলে যায়, আর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে। মাফিন বাসায় না থাকলে সে সারাদিন রুম আটকে বসে থাকে। আর বাসায় ফিরলে মাফিনকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বাসায় যে আরো অনেকে থাকে, সেটি তার মনেই থাকে না। সূচনা প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রেখে যায়। এমনকি স্বস্তিকা আর মাফিনের নাস্তাটাও তার তুলে রাখতে হয়।
স্বস্তিকা ঘরের বউ হিসেবে কোনো দায়িত্ব পালন তো করেই না, এমনকি স্বামীর নাস্তাটাও নিজের হাতে বানিয়ে রাখে না।
আরিয়া ফেরদৌস ছুটির দিনে নিজের হাতে রান্না করতে পছন্দ করেন৷ কিন্তু অফিসে থাকলে বেশিরভাগই বাইরে খেয়ে নেন। অন্যদিকে মাহাথি আর মাফিন দু’জনেই দুপুরে অফিসেই খেয়ে নেয়। কিন্তু ইদানীং সমস্যাটা হয়ে যাচ্ছে সূচনার জন্য। স্বস্তিকা ও মাফিনের বিয়ের আগে সূচনা স্কুল থেকে ফিরে নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো কিছু রান্না করে খেয়ে নিতো। আর মারিয়া ও মহুয়ার জন্য আলাদাভাবে রান্না করে রেখে দিতো। কিন্তু এখন স্বস্তিকার জন্য যেটা-সেটা রান্না করা যায় না। কারণ সে বাছাই করা খাবার খায়।

এদিকে মারিয়া আর মহুয়া দু’জনেই এখন ভর্তির জন্য কোচিং করছে। তারা সকালেই বের হয়, আর দুপুরের দিকে বাসায় আসে৷ তাই একা পুরো বাসায় স্বস্তিকাই থাকে। কিন্তু ঘরে সে শুধু শুয়ে-বসেই সময় কাটায়। একটা কাজেও সে সূচনাকে সাহায্য করে না। সূচনা কখনো বলেও নি। কারণ তার সাথে স্বস্তিকার এতোটা জমে উঠে নি। স্বস্তিকা সূচনার সাথে খুব কমই কথা বলে। কেমন যেন একটা দূরত্ব রাখে! যেই দূরত্বের কারণ সূচনা কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না।

সকালে সূচনা খুব সংকোচ নিয়েই মাফিন আর স্বস্তিকার রুমের দরজায় কড়া নাড়লো। স্বস্তিকা ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে চাপা স্বরে বলল,
“ভাবী, আপনি? আমি ভাবলাম মারিয়া বা মহুয়া এসেছে। ওরা দরজায় আঘাত করলে না হয় বুঝতাম ওদের কমনসেন্স নেই, তাই এমন করেছে। কিন্তু আপনি এমনটা করেছেন, অবাক লাগছে!”

সূচনা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি কি বলতে চাইছো, স্বস্তিকা?”

“ভাবী, আপনি আর ভাইয়া যখন রুমে থাকেন, তখন যদি আমি আপনাদের রুমের দরজায় কড়া দিয়ে আসি, আপনাদের ভালো লাগবে?”

সূচনা শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমি তো তোমাদের ডাকতে এলাম। মাফিনের অফিসে যেতে হবে। আর আমার স্কুলেও যেতে হবে। প্রতিদিন তাড়াতাড়ি নাস্তা বানিয়ে দিয়ে যাই, তাই ঠান্ডা হয়ে যায়। আর তুমি তো বলো আমি নাকি সবাইকে ভালো খাবার দেই, শুধু তোমাকেই বাসি খাওয়ায়।”

“কে বলেছে এটা আপনাকে?”

“এই বাসায় আর ক’জনই বা আছে? কেউ একজন বলেছে হয়তো। তাই এখন তোমার সমস্যা সমাধানের একটাই উপায় আছে। মাফিনের সাথে উঠেই নাস্তা করে নিও। তারপর আবার ঘুমোতে ইচ্ছে করলে, ঘুমোতে পারো।”

স্বস্তিকা কিছুটা বিরক্ত হলো, বিড়বিড় করে বলল,
“মহুয়া খুব বোকাসোকা মেয়ে, ও এসব কথা ভাবীকে কখনোই বলবে না। নিশ্চয় ওই মারিয়াটাই বলেছে।”

সবাই যার যার কাজে বাইরে চলে যাওয়ার পর স্বস্তিকা মহুয়া আর মারিয়ার ঘরে ঢুকলো। মহুয়া তখন কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো, আর মারিয়া তখনো বিছানায় শুয়ে মোবাইল দেখছে। স্বস্তিকা মারিয়াকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
“গতদিন যে আমি বলেছিলাম, ভাবী আমার জন্য বাসি খাবার রেখে যান, এই কথা ভাবীকে কে বলেছে?”

মহুয়া কথাটি শুনে স্বস্তিকার দিকে তাকালো। মারিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। স্বস্তিকা আবার বললো,
“কি হলো, উত্তর দাও!”

মহুয়া এবার মারিয়ার দিকে তাকালো। মারিয়া ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“আমিই বলেছি। মিষ্টি ভাবী প্রতিদিন সকালে উঠেই নাস্তা বানিয়ে রাখে, অথচ কেউ যদি বলে উনি বাসি খাবার রেখে যায়, তাহলে তা কি উনাকে জানানো উচিত না? অন্তত ভুল ধারণাগুলো তো ভাঙবে।”

“তুমি তো দেখছি খুব বেয়াদব মেয়ে!”

মহুয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“ছোট ভাবী, আপনি ভুল ভাবছেন। মারিয়ার অন্য কোনো ইনটেনশন ছিল না। ও শুধু…”

স্বস্তিকা মহুয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি অন্তত ওকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করো না।”

মারিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, আর মলিন মুখে বলল,
“ভাবী, দুঃখিত যদি ভুল কিছু করে থাকি। আমি তো আপনাকে তাজা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছি। ঠান্ডা খেলে আপনারই পাকস্থলীতে সমস্যা হবে। আপনার কষ্ট দেখে আমারও কষ্ট হয়। আমারও আগে দেরীতে ঘুম ভাঙতো, তাই তখন ঠান্ডা ঠান্ডাই খেতাম। কতো কষ্ট লাগতো ভাবী! কিন্তু আপনাকে তো প্রতিদিন খেতে হয়। আমি বুঝি আপনার কষ্টটা। আর বাসায় তো একটা ওভেনও আছে, ওইটাও তো আর কষ্ট করে চালাতে ইচ্ছে করে না। তাই আমি ঠান্ডায় খেয়ে নিতাম, এরপর রাতে আমার কি যে পেট ব্যথা হতো। আমি চাই নি, আপনারও পেট ব্যথা হোক। আমি কি ভুল কিছু করেছি?”

স্বস্তিকা মারিয়ার বলার ধরণ দেখে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
“আরেহ না। বলে ঠিকই করেছ।”

স্বস্তিকা যাওয়ার পর মারিয়া মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বললো,
“দেখেছিস কেমন পটিয়েছি ভিলেন ভাবীকে!”

মহুয়া দৌঁড়ে এসে মারিয়ার মুখ চেপে ধরে বলল,
“আস্তে বল। ভাবী শুনবে।”

“হু কেয়া’র?”

এদিকে-
এগারোটায় কোচিং ক্লাস শেষ করে মহুয়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে খুব অস্বস্তি। সে একবার ডানে তাকাচ্ছে, আরেকবার বামে। হঠাৎ একটা বাইক তার সামনে এসে থামলো। মহুয়া কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সে পেছনে যাবে তখনই প্রহর হেলমেট খুলে বলল,
“পালাচ্ছো কেন? কি হয়েছে?”

মহুয়া অবাক হয়ে বলল,
“ভাইয়া, আপনি?”

“হুম, তুমি এতো ভয় পেয়ে আছো কেন? কিছু হয়েছে!”

মহুয়া তার ডান দিকে একনজর তাকালো। প্রহরও তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো। দেখলো দুইটা মাঝবয়সী যুবক সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এখন আমাকে বলবে কি হয়েছে?”

মহুয়া আমতা-আমতা করে বললো,
“কয়েকদিন ধরে ওই ছেলে দুইটা আমাকে প্রচন্ড বিরক্ত করছে।”

“বাসায় কাউকে বলো নি?”

“না।”

“কেন বলো নি?”

“সাহস পাই নি।”

“এখানে সাহস না পাওয়ার কি আছে?”

“মা যদি বিয়ে দিয়ে দেয়?”

প্রহর হাসলো। ইশারা করে বলল,
“বাইকে উঠো, তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”

“না, ভাইয়া। আমার বাইকে চড়ার অভ্যাস নেই। আমি পড়ে যাবো।”

“আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো।”

মহুয়া কিছুটা লজ্জা পেলো। তবুও সে প্রহরের বাইকে উঠলো। এই মুহূর্তে সে ছেলে দুইটার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেই বাঁচবে। প্রহর বাইক চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলো,
“মারিয়া কোথায়?”

“ও মিতুর সাথে সিয়ার বাসায় গেছে। আজকে সিয়ার জন্মদিন তো, তাই।”

“তুমি যাও নি কেন?”

“আমি তো মারিয়ার বান্ধবীদের তেমন চিনি না। ওদের মধ্যে আমি খুব অস্বস্তিবোধ করবো। তাই আর যাই নি। আপনি এখানে?”

“আমি একটা কাজে এসেছিলাম। হঠাৎ তোমাকে দেখলাম জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছো, তাই এলাম।”

হঠাৎ রাস্তার পাশে একটা দোকান দেখিয়ে মহুয়া বলল,
“ওখানে একটু দাঁড়াবেন?”

প্রহর বাইক থামানোর পর মহুয়া দোকানটিতে ঢুকলো। দোকানে বিভিন্ন রঙের চুড়ি। মহুয়া চুড়িগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে। প্রহর মহুয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার চুড়ি পরতে ভালো লাগে?”

“হুম খুব।”

মহুয়া মনোযোগ দিয়ে চুড়ি দেখছে। হঠাৎ প্রহর চারটা কালো রঙের কাচের চুড়ি মহুয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার হাতে মানাবে।”

মহুয়া মুচকি হেসে চুড়ি চারটা হাতে পরে বলল,
“আসলেই তো, ভালো লাগছে। কিন্তু আমার অন্য রঙের চুড়ি লাগবে। এটা জামার রঙের সাথে যাচ্ছে না।”

“কালো রঙ সব রঙের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়। কালো, সাদা, লাল, নীল, বেগুনী সব রঙের সাথেই মানাবে।”

“রংধনুর সাথেও?”

“রংধনুর সাথে তো আরো বেশি মানাবে। কালো টিপ অন্য যে-কোনো টিপের চেয়ে বেশি মানানসই, ঠিক তেমনি কালো রঙও।”

“আপনার কালো রং খুব প্রিয় তাই না?”

“হুম, ভীষণ। তবে সাদা রঙের প্রতিও দুর্বলতা আছে। তোমার?”

“আমার সব রং ভালো লাগে। মারিয়ার কিন্তু নীল রং প্রিয়।”

“বলেছিল।”

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হুম, করো।”

“আপনার কালো মেয়েদের ভালো লাগে?”

“কালো মেয়ে বলছো কেন? কেউ-ই কালো হয় না। কালো রং এমন একটা রং যার নিচে কিছুই বোঝা যায় না। কেউ যদি কালোই হতো তাহলে তুমি তার নাক-চোখ মুখ চিহ্নিত করতে পারতে না।”

“তাহলে কি বলবো তাদের?”

“শ্যামলাবতী বলবে। আমার জন্য তারা শ্যামলাবতী নারী। শ্যাম অর্থ অস্পষ্টতা। কেউ ফর্সা, কেউ কাচা হলুদ, কেউ লাল-কাচা হলুদের মিশ্রণে অনন্যা। আর এসব আভার মধ্যে যদি একটু অস্পষ্ট রং সৃষ্টি হয় ওইটাই শ্যাম। আর অস্পষ্ট রঙের নারীরা অনেক সুন্দর হয়। কারণ তাদের রং ছাড়া সব সৌন্দর্যই স্পষ্ট মনে হয়।”

মহুয়া হেসে বলল,
“আপনি দেখেছেন? তাহলে কি আপনি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকেন?”

প্রহর হাসলো। বলল,
“সব সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয় নি৷ কিছু সৌন্দর্য পড়ে অনুভব করা যায়।”

“চমৎকার আপনার অনুভবটা।”

মহুয়া এক গুচ্ছ কালো-সাদা চুড়ি নিয়ে বাসায় ফিরলো। বাইক থেকে নামার সময় প্রহর একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এইটা মারিয়ার জন্য। ওকে দিয়ে দিও।”

“আচ্ছা। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি প্রিয়ার জন্য নিচ্ছিলেন। আর মারিয়া তো চুড়ি পরে না। কেন আপনি কি সেটা জানতেন না?”

“ওহ, না আমি তো জানতাম না। আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে তুমিই রেখে দিও।”

“আপনি দিয়েছেন শুনলে ও আমাকে কখনোই দেবে না।”

প্রহর হাসলো। মহুয়া বাসায় চলে এলো। বেল দেওয়ার সাথে সাথেই মারিয়া দরজা খুলে দিলো। মারিয়াকে দেখেই মহুয়া অবাক কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে? তুই এতো তাড়াতাড়ি এলি যে!”

“পরে বলছি। আগে বাসায় এসে দেখ কি হয়েছে! ভিলেন ভাবীর কর্মকান্ড দেখে তোর মাথায় বাজ পড়বে। ভেতরে শীতল যুদ্ধ চলছে। আমি তোর আসার অপেক্ষায় ছিলাম।”

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here