রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৪৮:

0
420

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪৮:

৭৮।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে সোজা সূচনার বাবার বাসায় চলে গেলো মাহাথি। ইলিয়াস হকের শরীর তেমন একটা ভালো না। তার চাহনি দেখেই মাহাথি বুঝেছে, তিনি এই মুহূর্তে সূচনাকে নিজের পাশে চান। সূচনা বাবার বিছানার এক পাশে বসে কাঁদছে। আর মারিয়া ভাবীকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে ফৌজিয়া ইসলাম মাহাথি আর মারিয়ার খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করলেন। রাতে থাকার জন্যও খুব জোর করছিলেন। কিন্তু সূচনাদের বাসা ছোট, তার উপর সূচনার বোনরাও এসেছে বাবাকে দেখতে, তাই মাহাথি শ্বশুড়ের সাথে দেখা করার পর রাতে খাওয়া-দাওয়া করে মারিয়াকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। মাহাথি বাসায় এসে সোজা রুমে চলে গেলো। স্বস্তিকা সূচনাকে না দেখে মারিয়াকে জিজ্ঞেস করল,
“ভাবী কোথায়? তোমাদের সাথে আসেন নি?”

“না, ভাবী হয়তো আজ ওখানেই থাকবে।”

স্বস্তিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“দেখেছো, আমিই একমাত্র সবার কথা চিন্তা করি। আমারও তো ইচ্ছে করে বাবার বাড়ি যেতে৷ কিন্তু মাফিন তো আমাকে একবারো বলে নি ঘুরে আসতে৷”

মারিয়া ধরা কন্ঠে বলল,
“ভাবীর বাবা অনেক অসুস্থ। উনার অনেক বয়স হয়েছে। উনি আপনার বাবার চেয়েও বেশি বয়ষ্ক। আপনি হয়তো দেখেন নি, তাই বুঝতে পারছেন না।”

“তুমি সবসময় ভাবীকে সাপোর্ট করেই কথা বলো। কিন্তু তুমি এটা দেখছো না যে মা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন তোমাদের দেখাশোনা করার।”

“ভাবী, আমরা বাচ্চা না যে আমাদের একদম খাইয়ে দিতে হবে, গোসল করিয়ে দিতে হবে। দেখে রাখা বলতে, বাইরে আমরা কোথায় যাই, না যাই এসব দেখে রাখা বুঝিয়েছে। বাসায় আমরা ঠিকই আছি।”

স্বস্তিকা মারিয়াকে আর কিছুই বলল না। মনে মনে ভাবলো,
“মহুয়া মেয়েটাই অনেক ভালো। যা বলবো তাই শুনে থাকবে। আর এই পাঁজি মেয়েটা মুখের উপর কথা বলে।”

এদিকে মাফিন অফিস থেকে এসেই শুয়ে পড়েছিলো। স্বস্তিকা রুমে এসে মাফিনের পাশে বসে তার কপালে হাত রাখলো। তারপর মাফিনের মুখে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল,
“আমি সবসময় চেয়েছি আমার বর আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসবে। আমি তার চোখে আলাদা হতে চেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম সে সবচেয়ে বেশি আমাকে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু না। আমার বরের কাছে আমার চেয়ে বেশি সবাই গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, আমি একটু বেশি বকবক করি। বাসায়ও করতাম। কখনো আম্মিজান আমাকে বকে নি। আব্বাও আমাকে কাঁদান নি। চাচী-ফুফু, মামী-খালা সবাই আমাকে ভালোবাসতেন। তাই আমি সবসময় চেয়েছি আমার বিয়েটা পরিবারের মধ্যেই যাতে হোক। কারণ ওরা আমাকে বুঝতো। কিন্তু এখানে কেউ আমাকে বুঝে না। আমি তো শুধু চেয়েছি, আমার বর আমাকে এতো ভালোবাসা দিবে যা আগে কেউ দেখে নি। আমাদের ভালোবাসা দেখে সবার হিংসে হবে। আমার একটু হাত কেটে গেলেই আমার বর পাগল হয়ে যাবে। আমি একটু ব্যথা পেলেই ছটফট করবে। কিন্তু এই বাসায় সবাই শুধু বড় ভাইয়া আর ভাবীর ভালোবাসার জয়গান গাইতে থাকে। প্রেম করে বিয়ে করি নি তাই বলে কি আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই?”

স্বস্তিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে শেষ কথাগুলো বলে উঠতে যাবে তখনই মাফিন তার হাত ধরে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“ডোরেমন, তুমি কাঁদছো কেন?”

“আপনি ঘুমান নি?”

“হুম, ঘুমিয়েছিলাম তো। কিন্তু তুমি যদি আমার কানের কাছে বসে ভ্যানভ্যান করো, তাহলে আমার ঘুম ভেঙে যাবে না?”

“সরি। আর হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।”

মাফিন স্বস্তিকাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“কি যেন বললে তোমার হাত কেটে গেলে আমাকে পাগল হতে হবে, তুমি ব্যথা পেলে আমাকেই ছটফট করতে হবে! কিন্তু তোমার স্নায়ু কোষগুলোর সাথে তো আমার মস্তিষ্কের কোনো সংযোগ নেই। তাহলে আমি কিভাবে বুঝবো তুমি কি পরিমাণ ব্যথা পেয়েছো? আর তুমি এসব সিনেমা দেখে দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছো। এসব অবাস্তব কাহিনি। বাস্তবে এমন কিছুই হয় না।”

স্বস্তিকা রাগী কন্ঠে বলল,
“তাহলে আমি মারা গেলে আপনি নেচে নেচে আরেকটা বিয়ে করবেন?”

মাফিন হেসে বললো,
“একটা বিয়ে করে আমার জীবনটাই তেজপাতা হয়ে গেছে। তুমি কি ভাবছো দ্বিতীয়বার সেই ভুল করবো? নো ওয়ে।”

“তার মানে আমাকে বিয়ে করে আপনি ভুল করেছেন?”

“ডোরেমন তো আমি তোমাকে এমনিতেই বলি। কিন্তু বুদ্ধিটা তোমার নবিতার চেয়েও কম।”

স্বস্তিকা বিছানায় উঠে মাফিনের পেটের উপর বসে পড়লো। মাফিন লাফিয়ে উঠে বলল,
“আমার ছাব্বিশ বছরের সব চর্বি বের হয়ে যাচ্ছো। নামো বলছি। মেরে ফেলতে চাও আমাকে?”

“ব্যথা পেয়েছেন!”

মাফিন পেট ধরে বলল,
“মানে, তুমি কি দুই বছরের বাচ্চা যে কোলে উঠছো?”

“টিভিতে দেখেন নি, নায়ক কিভাবে নায়িকাকে কোলে নেয়।”

“উফফ! রাগ উঠলে আমি না টিভিটা ভেঙে তোমাকে টিভির ভেতরেই ঢুকিয়ে দেবো। আর শুনো, ওইখানের নায়কগুলোর জিম করা শরীর, আর নায়িকাগুলো এক একটা শুটকি মাছ। আর তুমি ভাবছো আমার মতো একটা অসহায় অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসা ছেলে তোমার মতো একটা পান্ডাকে কোলে নেবে?”

স্বস্তিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো, “আমি পান্ডা!”

মাফিন ব্যস্ত হয়ে স্বস্তিকার গাল টেনে বলল,
“আরেহ আরেহ, আমি তো আদর করে পান্ডা বলছি।”

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ, সত্যি।”

স্বস্তিকা এক গাল হেসে মাফিনকে ঝাপটে ধরলো। আর মাফিন তাল সামলাতে না পেরে স্বস্তিকাকে নিয়ে একেবারে বিছানা থেকেই নিচে পড়ে গেলো। আর মনে মনে বললো,
“আল্লাহ তুমি আমার কপালে এমন পান্ডা বউ কেন রাখলে? এই মেয়ের তো মাথার তার ছেঁড়ায়, সাথে আমারগুলোও ছিঁড়ে ফেলছে।”

পরেরদিন-

দুপুর ১টায় মহুয়া আর মারিয়া ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে ঘরের অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলো। পুরো ঘরে কাগজের টুকরো। ডায়নিং টেবিলে খাবারের অবশিষ্টাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মারিয়া বিরক্ত মাখা সুরে বলল,
“ঘরটাকে যাচ্ছেতাই বানিয়ে রেখেছে।”

তখনই স্বস্তিকা রুম থেকে বেরিয়ে বলল,
“তোমরা এসেছো? বেল দাও নি কেন? আমি এসেই না হয় দরজা খুলে দিতাম!”

“ভাবী সবার কাছেই চাবি আছে। এটা নতুন কিছু না।”

স্বস্তিকা মলিন মুখে বললো,
“আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি একটু ঘুমাবো।”

মারিয়া আর মহুয়া কিছু না বলে ফ্রেশ হয়ে ডায়নিংয়ে এসে বসলো। কিন্তু খাবারের কোনো চিহ্নও নেই। মহুয়া রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো আজ কিছুই রান্না হয় নি।

মারিয়া বলল, “কি হলো, মহু।”

“কিছুই তো রান্না করা নেই। ভাবী কি খেয়েছে তাহলে?”

“জিজ্ঞেস করে আয়। হয়তো ফ্রিজে রেখে দিয়েছে।”

মহুয়া ফ্রিজ খুলে দেখলো ফ্রিজেও কিছু নেই। এবার স্বস্তিকার রুমের দরজায় কড়া নাড়লো। স্বস্তিকা দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবে!”

মহুয়া বলল,
“ভাবী, রান্না তো এখনো হয় নি। বাসায় তো কিছুই নেই।”

“হুম, সেটাই তো। বাজার করার দায়িত্ব তো আর আমার না। আর আমি তো রান্না করতেই পারি না। তাই বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করেছিলাম।”

“ওহ আচ্ছা, আমাদের খাবারগুলো কোথায় রেখেছেন? ফ্রিজেও পাই নি।”

“তোমাদের জন্য তো অর্ডার করি নি। ভেবেছি তোমরা খাবে না।”

“ওহ আচ্ছা।”

“আচ্ছা, আমার খুব ক্লান্ত লাগছে আমি একটু ঘুমাবো। তুমি একটু রান্নাঘর আর ড্রয়িংরুমটা পরিষ্কার করে রেখো। আমি আসলে একটা প্রজেক্টের কাজ করছিলাম তো তাই ঘরে এতো কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটু ঘরটা পরিপাটি করে রেখো। তোমার ভাইয়া এলোমেলো দেখলে আবার বকাঝকা করবে।”

কথাটি বলে স্বস্তিকা মহুয়ার মুখের উপর দরজা আটকে দিলো। মহুয়া ডায়নিংয়ের চেয়ার টেনে বসে পড়লো। মারিয়া মহুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মহুয়ার চোখে পানি টলমল করছে। মারিয়া মহুয়ার পাশে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“কেন কাঁদছিস?”

মহুয়া কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“মাকে খুব মনে পড়ছে।”

“মহু, প্লিজ। ভাবী তো এমনিই।”

“হ্যাঁ, জানি। কিন্তু এই প্রথম আমার মনে হয়েছে আমরা অনাথ। মনে হয়েছে, মা ছাড়া আমাদের কেউ নেই। ভাবী অন্তত আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতেন। আমরা দুপুরে কি খাবো সেটা তো উনার ভাবনাতেই নেই, আর আমি ক্লান্ত, সারাদিন ক্লাস করে এসেছি, রাতে আবার পড়তেও হবে, তবুও উনি আমাকে বলছেন ঘর পরিষ্কার করতে। ভাবীর কথায় কোনো আবদার ছিলো না। একটা অবহেলা ছিল। আমি ঘরের কাজে সাহায্য করি, তাই বলে কি আমাকে যখন ইচ্ছা তখন ব্যবহার করবেন, যা ইচ্ছে তাই বলবেন?”

মারিয়া মহুয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“কে কি বলেছে আমার তাতে কিছুই যাই-আসে না। তুই আছিস, মা আছে, ভাইয়ারা আছে এতেই হবে।”

“মা বলেছিলো, বড় মামা যখন সাহেদা মামীকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, তখন মা ঢাকায় পড়াশোনা করার জন্য উনাদের বাসায় থাকতে গিয়েছিল। কিন্তু উনি মাকে কলেজে যেতে দিতো না, ঘরের কাজে ব্যস্ত রাখতো। মাকে অনেক শাসন করতো, বড় মামাও মাকে পছন্দ করতো না। মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল।”

মারিয়া শান্ত কন্ঠে বললো,
“কিন্তু বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া তো বড় মামার মতো না। ভাইয়ারা আমাদের অনেক ভালোবাসে।”

“মা, বলেছিল ভালোবেসে বিয়ে করলেই সংসারে সব ঝামেলা হয়। কিন্তু ছোট ভাবী তো মায়ের পছন্দের ছিল, তাহলে উনি এমন কেন? উনি কেন আমাদের বোনের মতো ভালোবাসে না? উলটো বড় ভাবীকে ভাইয়া ভালোবেসে বিয়ে করে এনেছে। আর উনিই আমাদের কত্তো পছন্দ করে। একদম মায়ের মতো যত্ন নেয়।”

“দেখ মহু, আমি ছোট ভাবীকে এমনি এমনিই ভিলেন ভাবী বলি না। উনি আসলেই ভিলেন। আমার ভয় হয়, ছোট ভাইয়াকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে না তো?”

এরপর মহুয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও পুরো ঘর গুছিয়ে রাখলো। যদিও মারিয়া বারণ করেছিল। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে দু’জন স্বস্তিকাকে না বলেই বাইরে চলে গেলো। এদিকে সন্ধ্যায় বাসায় এসে মাহাথি আর মাফিন দেখলো বাসায় কেউ নেই। মাফিন স্বস্তিকাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
“মহুয়া-মারিয়া কোথায়?”

স্বস্তিকা ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বলল,
“বাসায় তো ছিল।”

মাফিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বাসায় থাকলে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি?”

স্বস্তিকা রুম থেকে বের হয়ে দেখলো ঘরদোর গুছিয়ে রাখা। সে মনে মনে ভয় পেলো। মাহাথি চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“মেয়ে দুইটার ফোন বন্ধ।”

মাফিন বলল,
“ভাইয়া, তুমি প্রহরকে ফোন দিয়ে দেখো।”

প্রহরকে ফোন দেওয়ার পর সে নিজেও চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ মারিয়া তাকে কিছুই জানায় নি। তারা মারিয়া আর মহুয়াকে খুঁজতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে মাফিন স্বস্তিকাকে বলল,
“ওদের যদি কিছু হয়, আমি তোমাকে ছাড়বো না। ওরা বাসায় আসার পর তোমাকে না বলে বাসা থেকে কেন বের হবে? তুমি বাসায় কেন ছিলে? সারাদিন টিভি আর ঘুম। আমাকে বিয়ে না করে তোমার ওই টিভিকে বিয়ে করা উচিত ছিল।”

এদিকে মারিয়া আর মহুয়া রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে হাত ধরে হাঁটছে। দুইজনের হাতে আইসক্রিম। মহুয়া হেসে বলল,
“এই প্রথম আমি সন্ধ্যার পর কাউকে না বলে তোর সাথে একা একা রাস্তায় হাঁটছি। মা জানলে মেরে চ্যাপ্টা করে ফেলবে।”

মারিয়া হেসে বলল,
“অল ক্রেডিট গৌজ টু ভিলেন ভাবী। কিছু বললেই বলে দেবো ভাবীর দোষ।”

“যাহ! আমরা বলবো খিদে লেগেছে, তাই বাইরে খেতে এসেছি। অনেকদিন বাইরে খাই না। আর ভাবী ঘুম ছিল, তাই উনাকে বিরক্ত করি নি।”

“আসছে ভাবী দরদী। আমি তো ভাইয়াকে বলবোই। এরপর ভাবী আর জীবনেও আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করবে না।”

আধাঘন্টা পর তার হাঁটতে হাঁটতে বাসার সামনে এলো। এসেই দেখলো মাহাথি, মাফিন আর প্রহর দাঁড়িয়ে আছে। মহুয়া আর মারিয়াকে দেখেই তাদের মেজাজ বিগড়ে গেলো। কিন্তু মাহাথি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। প্রহর কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মাফিন এসে মারিয়ার গালে চড় বসিয়ে দিলো। মারিয়া গালে হাত দিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। মহুয়া মারিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাফিন চেঁচিয়ে বললো,
“তোদের দুইজনের কি কোনো কমনসেন্স আছে? এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলি? ফোন বন্ধ কেন তোদের? এদিকে আমাদের চিন্তায় অস্থির অবস্থা আর তোরা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে আইসক্রিম খাচ্ছিস?”

এরপর মাফিন মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই নিশ্চিত ওর কথা মতো গিয়েছিস। তুই তো অন্তত আমাদের জানাতে পারতি। মারিয়া না হয় বোকা, ওর মধ্যে না হয় কান্ড জ্ঞান নেই। তোর জ্ঞান কোথায় ছিল?”

তখন প্রহর মারিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার এসব স্বভাব আমার মোটেও পছন্দ না। মেয়েদের একটু রিজার্ভ থাকা ভালো।”

মাফিনের চড় খেয়ে যতোটা না খারাপ লেগেছে প্রহরের মুখে এমন কথা শুনে মারিয়ার আরো বেশি খারাপ লেগেছে। প্রহরের তার স্বভাব, উঠা-বসা পছন্দ না এই বিষয়টা অন্য কেউ জানুক সেটা মারিয়া চায় নি। মারিয়া সবাইকে বুঝিয়েছে, প্রহর তার সব স্বভাবই পছন্দ করে। কিন্তু এখন সবার সামনেই সে অপমানিত হয়েছে। আর এদিকে আজ পর্যন্ত কোনো ভাই-ই তার গায়ে হাত তুলে নি, কিন্তু আজ তার স্বামীর সামনেই তার ভাইয়া তাকে চড় মারলো, এটাও তার জন্য ভীষণ অপমানজনক ছিল। মারিয়ার এই মুহূর্তে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে কারো সামনে কাঁদবে না। সে দৌঁড়ে বিল্ডিংয়ের গেইটে ঢুকে গেলো। বিল্ডিংয়ে ঢুকতেই সে খেয়াল করলো, আশেপাশের অনেকেই তাকে চড় খেতে দেখেছে। বাইরের লোকেদের দেখে সে আর চোখের পানি আটকাতে পারলো না। লিফটে উঠেই কেঁদে দিলো।

মাফিন মহুয়াকে কিছু বলবে তার আগেই মহুয়া বলল,
“কিছু না জেনে তোমার এভাবে মারিয়াকে সবার সামনে চড় মারা উচিত হয় নি।”

“তুই আমাকে উচিত-অনুচিত শিখাচ্ছিস?”

মহুয়া ভেবেছিল স্বস্তিকার ব্যাপারে কিছুই বলবে না। আর বলার প্রয়োজন হলেও আলাদা ভাবে মাফিনকে বলবে। কিন্তু মাফিনের এমন প্রতিক্রিয়া মহুয়ার মোটেও পছন্দ হয় নি, তার উপর শুধু প্রহরের সামনে নয়, বাইরের মানুষদের সামনেও।

মহুয়া বলেই ফেললো,
“ভাইয়া, দোষ আমাদের না। আমরা বাসায় এসে দেখেছি ভাবী বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে খেয়ে নিয়েছে। আর পুরো ঘর এলোমেলো করে রেখেছে। আমাকে বলেছে আমি যাতে পরিষ্কার করি। তোমাদের এলোমেলো ঘর ভালো লাগে না তাই। এরপর আমি আগে ঘর পরিস্কার করলাম, তারপর ফ্রেশ হয়ে আমরা খেতে বের হয়েছি। কাজ করতে করতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। দুপুরের খাবারটাও আমরা সন্ধ্যায় খেয়েছি। এখানে আশেপাশে তো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, তাই জিইসি গিয়েছিলাম। ওখান থেকে খেয়ে-দেয়ে বাসায় ফেরার পথে আইসক্রিম কিনেছি। হাতে আর টাকা ছিল না, তাই জিইসি থেকে হেঁটে হেঁটেই আসছিলাম।”

মহুয়ার কথা শুনে মাফিন চুপ হয়ে গেলো। মহুয়া আবার বলল,
“মা থাকলে আজ এমন হতো না। কখনো হয়ও নি। আজ মা আমাদের ফেলে একটু দেশের বাইরেই গিয়েছে, ব্যস তুমি মারিয়ার গায়ে হাত উঠালে? আমি তো ভেবেছি কাজ শেষ করে ভাত রান্না করবো। একটাই ডিম ছিল ফ্রিজে। আরেকটা কেনার জন্য বাইরে যেতে হবে। দারোয়ানকে ফোন করতে যাবো, মারিয়া বললো অর্ধেক ভাগ করেও খাওয়া যাবে। তুমি তো জানোই ওর রান্না ঘরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। ডিম ভাজতে গিয়ে ও হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। ডিমটাও নিচে ফেলে দিয়েছিল। তাই আমরা শেষমেশ বাইরে এসেই খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর এমনিতেই একবেলা না খেলে তো আমরা মারা যাবো না। কিন্তু আমরা ক্ষুধার্ত ছিলাম। সকালেও নাস্তা করি নি। ভাবী তো সকালে ঘুম থেকেই উঠে নি। যদিও আমাদের হাতে টাকা ছিলো। কিন্তু খাওয়ার সময় পাই নি। ভেবেছি বাসায় এসে একেবারে লাঞ্চ করবো। কিন্তু এখানে এসে এমন ঘটনা ঘটবে তা তো জানাই ছিলো না। আর তুমি কিছু না শুনেই মারিয়াকে মারলে?”

মাহাথি শান্ত কন্ঠে বললো,
“বাসায় চল সবাই। প্রহর তুমি!”

“সমস্যা নেই ভাইয়া। আমি কাল সকালে আসবো। এখন হয়তো আমার বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না।”

কথাটি বলে প্রহর চলে গেলো। যেতে যেতেই সে মারিয়াকে টেক্সট করলো,
“সরি, আমি জানতাম না এতোকিছু হয়েছে। আমি কাল সকালে তোমাকে নিতে আসবো। আন্টি যতোদিন আসবেন না তুমি আমার সাথে থেকো। আমার বন্ধুর ফ্ল্যাট খালি আছে। ও এখন ঢাকায় গেছে। আমরা ওখানে কিছুদিন থাকতে পারবো, সমস্যা হবে না। আর তুমি হ্যাঁ বললে আমি সব ব্যবস্থা করবো। অনুষ্ঠান হয়ে গেলে তোমাকে বাসায় নিয়ে আসতে পারতাম৷ কিন্তু এখন আমাদের তো সমস্যা নেই, কিন্তু প্রতিবেশীদের জন্য তোমাকে বাসায় নিয়ে আসা সম্ভব না। আচ্ছা, কাল তৈরী থেকো কিন্তু।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here