রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৫০:

0
433

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫০:

৮০।
কলিংবেলের শব্দ শুনে সূচনা দরজা খুলে দেখলো প্রহর এসেছে। প্রহরকে দেখে মারিয়া তার ব্যাগ-পত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো। মাহাথি আর মাফিন কিছুটা অবাক হলো। মারিয়া হেসে বলল,
“মা না আসা পর্যন্ত আমি উনার সাথে থাকবো।”

মাহাথি বলল, “কিন্তু কেন?”

গতকালের ঘটনাটা মনে পড়তেই মাফিন প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“গতকাল যা হয়েছিল, ওই বিষয়টা আমি দেখবো। ভবিষ্যতে ওরকম কিছু আর হবে না। কিন্তু এভাবে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আপনি মারিয়াকে নিয়ে গেলে বিষয়টা সুন্দর দেখাবে না।”

মারিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“না, না আমি যাবো উনার সাথে। আমার এখানে ভালো লাগছে না।”

মারিয়ার কথা শুনে মাফিন কিছুটা কষ্ট পেলো। মহুয়া মারিয়ার হাত চেপে ধরে বলল,
“ভাইয়া কি তোকে নিতে আসবে বলেছিল? নাকি তুই নিয়ে যেতে বলেছিস?”

“উনিই বলেছিল।”

“তোর উচিত ছিল বিষয়টা না বাড়িয়ে প্রহর ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলা। কিন্তু তুই উনার কথায় সায় দিয়ে নিতে আসতে বললি। এখন তো ঘটনাটা আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে। এভাবে কিন্তু তুই নিজের ভাইকেই ছোট করলি।”

“এখানে ভাইয়ার ছোট হওয়ার কি আছে! ভিলেন ভাবীরই তো সব দোষ।”

“ভাবী কিন্তু ভাইয়ারই বউ। বাইরের কেউ নয়।”

“হয়েছে, হয়েছে। প্রহরের সামনে তুই-ই কথাটা বলেছিস। আমি কিন্তু বলি নি।”

“কারণ ওইসময় আমার মেজাজ ভালো ছিল না। রাগের মাথায় বলে দিয়েছিলাম। আর সবাই তোকেই ভুল ভাবছিল, তাই আমার কথাটা বলে ফেলায় ঠিক মনে হয়েছিল।”

এদিকে মাফিন প্রহরকে আর কিছু বলতে পারলো না। যেখানে নিজের বোনই চলে যেতে ইচ্ছুক, সেখানে কিছু বলার মতো আর ভাষা নেই। এরপর প্রহর মারিয়াকে নিয়ে চলে গেলো।
মারিয়া চলে যাওয়ার পর মাফিন রুমে এসে স্বস্তিকার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। আকস্মিক চড় খেয়ে স্বস্তিকা মেঝেতে পড়ে গেলো। স্বস্তিকার কান্নার শব্দ শুনে সূচনা আর মহুয়া অনেকক্ষণ ধরেই মাফিনকে ডাকলো। মাহাথি একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার মনে পড়ে গেলো এভাবেই দরজা বন্ধ করে বাবা তাদের মাকে বেধড়ক মারধর করতো।
মাফিন দরজা খুলে বের হওয়ার সাথে সাথেই মাহাথি এসে মাফিনের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলো। মাফিন স্তব্ধ হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাহাথি চিৎকার করে বলল,
“মাকে আমি কষ্ট পেতে দেখেছি, কিন্তু তখন আমি কিছুই করতে পারি নি। কিন্তু এখন আমি আর কোনো নারীকে সেই কষ্ট পেতে দেবো না।”

মাহাথি মাফিনের গায়ে আবার হাত তুলতে গেলে সূচনা এসে মাহাথিকে আটকালো। আর বলল,
“তুমি ওকে না বুঝিয়ে মারছো কেন? মারলে কি কোনো সমাধান হবে?”

“ওকে মেরেই বোঝাতে হবে। নয়তো এই ছেলে বুঝবে না।”

মাফিন চুপচাপ মাহাথির দিকে তাকিয়ে রইলো। মহুয়া একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। তার বুদ্ধি হওয়ার পর এই প্রথম সে মাহাথিকে উত্তেজিত হতে দেখেছে। আর এই প্রথমই সে দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা হতে দেখেছে।

এদিকে-
স্বস্তিকা শব্দ শুনে রুমের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো মাহাথি তার পক্ষে কথা বলছে। এটা দেখে স্বস্তিকার চোখের পানি আর বাঁধা মানে নি। সে রুম থেকে বেরিয়ে মাহাথির কাছে এসে বলল,
“ভাইয়া, আমার জন্য আপনারা ঝগড়া করবেন না। এটা আমার ভুলের শাস্তি ছিল। মারিয়া আজ আমার জন্যই এই বাসা ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু ভাইয়া, আমার না সত্যিই কাউকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তবুও সবাই আমার কথায় কষ্ট পায়। ভাইয়া, আমার জন্য আপনি উনার সাথে এমন করবেন না, প্লিজ। উনি আমার বর। উনি হয়তো আমাকে ভালোবাসেন না। কিন্তু আমি তো উনাকে খুব ভালোবাসি।”

মাফিন স্বস্তিকার কথা শুনে বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেলো। মাহাথিও নিজের ঘরে চলে গেলো। মহুয়া স্বস্তিকাকে নিয়ে তার ঘরে চলে এলো, আর স্বস্তিকার মন ভালো করার জন্য বলল,
“ভাবী, আমি একটা গল্প লিখেছি। শুনবেন?”

স্বস্তিকা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। আর মহুয়াও স্বস্তিকার পাশে বসে গল্প শুনাতে লাগলো। অন্যদিকে সূচনা ছাদে উঠে দেখলো মাফিন একপাশে বসে আছে। সূচনা মাফিনের পাশে বসে বলল,
“মাফিন তোমার এমনটা করা উচিত হয় নি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়। কিন্তু স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা কোনো পুরুষত্ব নয়। এটা কাপুরুষের লক্ষণ। এর মাধ্যমে তুমি প্রমাণ করে দিয়েছো যে তোমার স্ত্রীকে বোঝানোর ক্ষমতা তোমার নেই, তাই তুমি বল প্রয়োগ করে তাকে থামাচ্ছো। একটা সম্পর্কে ধৈর্য থাকাটা খুব দরকার। তখনই সম্পর্কটা সুন্দর হয়, একে অপরের প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান বাড়ে।”

“ওকে আমি কখনোই বোঝাতে পারবো না। ও বোঝার মতো মেয়ে নয়।”

“তুমিই ওকে বোঝাতে পারবে। তোমারই দায়িত্ব ওকে সব শিখিয়ে দেওয়া। নয়তো ও কখনোই তোমার মনের মতো হতে পারবে না। স্বস্তিকা ওর বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। তাই ও সেই পরিবেশে বড় হয় নি যেই পরিবেশে আমি বা তোমরা বেড়ে উঠেছো। আমার অনেক ভাই-বোন আছে, বাবা কিছু কিনে আনলে আমরা ভাগ করে নিতাম। তোমাদের মধ্যেও তাই হয়েছে। মা কখনো শুধু মাহাকে একা কিছু দেন নি, তোমাকেও দিয়েছে। কিন্তু স্বস্তিকা সব একাই পেয়েছে। তাই ও নিজের কিছু অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে শিখে নি। তুমি কেন ওর স্বামী হয়েছো? তুমিই ওকে শেখাবে। দেখবে একদিন ও তোমার চেয়ে বেশি তোমার পরিবারকে ভালোবাসবে।”

রাতে ইস্তাম্বুল শহরে খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন আরিয়া ফেরদৌস। পাশে নাহিদ হোসেন বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আরিয়া ফেরদৌস মুচকি হেসে বললেন,
“অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আমার দিকেই তাকিয়ে আছো! তোমার সমস্যাটা কি বলো তো!”

নাহিদ হোসেন মুচকি হেসে বললেন,
“আমার সামনে সৌন্দর্য্যের চমৎকার উদাহরণ বসে আছে। তাই আমি তাকে দেখছি।”

“তোমার সাহস তো দেখছি খুব বেড়ে গেছে?”

“অল্প একটু সাহস দেখাচ্ছি। এখন তো আর সম্মানহানির ভয় নেই।”

আরিয়া ফেরদৌস মলিন মুখে বললেন,
“পুরোনো কথা কেন মনে করিয়ে দিচ্ছো? আমি অতীতে যা করেছিলাম, ভুল করেছিলাম। বয়স কম ছিল, অনেক কিছুই বুঝি নি।”

“এখন তো বুঝতে পারছো সব।”

“হ্যাঁ, এখন না বোঝার তো কিছুই বাকি নেই।”

“তাহলে কি এখনো তুমি মনে করো, আমার অনুভূতি মিথ্যে ছিল?”

“সত্যটা স্বীকার করে নিলেও বিশ্বাস করতে চাই না। তুমি বরং অতীতের সবটাই ভুলে যাও, ভালো-মন্দ, অনুভূতি, এমনকি আমাকেও। আমার এই সত্যটা মেনে নাও। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“আরিয়া, আমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলতে চাই না। তোমার এই সত্যটাই আমি মেনে নিয়েছি। আমি তো অতীতের সেই আরিয়াকে ভুলেই গিয়েছি। এই নতুন আরিয়াটাই বেশি সুন্দর, খুব চমৎকার একটা মানুষ। তাই ভালোবাসাটাও আর আটকে রাখতে পারছি না।”

“আমার এই সত্য মানার পরও তোমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে? আমার চারটা সন্তান আছে, শুধু সন্তান থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ না। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। মাহাথি, মাফিন কিছুদিন পর বাবা হবে। আমি ওদের বাচ্চার দাদী হবো। আর তুমি, কি বলছো এসব!”

“তোমার জীবনটা কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে? সন্তানদের কথা ভাবতে ভাবতে তো জীবনের অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছো। এখন একটু নিজেকে নিয়ে ভাবো। আর আমি জানি আমাদের সন্তানদের এখানে দ্বিমত থাকবে না। ওরা যথেষ্ট মডার্ন।”

“এসব কথা বাদ দাও। আমি এখন একটু একা একা আকাশটা দেখতে চাই।”

“কি দেখবে আকাশে? চাঁদও উঠে নি। কিছু দেখার আছে?”

“অন্ধকার আকাশটা দেখবো। ওই আকাশটা একদম আমার জীবনের মতো। আমার আকাশে রংধনু উঠে না। সেই আকাশে কোনো চাঁদও উঠে না। শুধু তারা দেখা যায়, যা আমার নাগালেরও বাইরে। দেখতে হলেও চোখে চশমা পড়তে হয়। তুমিই বলো এই ঝাপসা জীবনে তারাগুলো স্পষ্টভাবে দেখার জন্য আমার কি করা উচিত?”

“আমি তোমার জ্যোতিষীমূলক প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দেবো?”

“আমি বলছি। সেই তারাগুলো স্পষ্ট ভাবে দেখতে হলে আমাকে পৃথিবীর বাইরে চলে যেতে হবে। হয়তো এর চেয়েও দূরে। হয়তো কিছুদিন অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে তারাগুলো দেখতে পারবো। কিন্তু আবার তো পৃথিবীতেই ফিরতে হবে। নয়তো আমার মৃত্যু হবে। ঠিক তেমনি আমার জীবনটা এমন জায়গায় এসে গেছে যেখানে এই মুহূর্তে কাউকে কাছে টেনে নেওয়া অনুচিত। নিতান্তই ইচ্ছে করলে দূর থেকে ভালোবাসা যাবে। কিন্তু কাছে টেনে নিতে গেলে সমাজ ছাড়তে হবে। পৃথিবীটা আমার সেই সমাজ। অক্সিজেন মাস্ক আমার মর্ডান সন্তানরা। তারা হয়তো আমাকে সাপোর্ট করবে। কিন্তু ক’দিন সাপোর্ট দেবে? সমাজের লোকেদের কথা শুনতে শুনতে একটা সময় তারা বিরক্ত হয়ে যাবে। ওদের ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। তাই আমাকে দিনশেষে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হলে সমাজের আদি নিয়মগুলোই মানতে হবে। যতোই পৃথিবী উন্নত হোক, যতোই মানুষ শিক্ষিত হোক, জয় সমাজের অনুন্নত চিন্তাধারা মানুষদেরই হয়। কেন জানো?”

“কেন?”

“কারণ মানুষ ঝামেলা পছন্দ করে না। আজ শিক্ষিত মানুষরা যদি সমাজ পাল্টাতে যায়, ঝামেলায় পড়বে। তাই তারা চুপ থাকবে। অন্যদের সঙ্গ দিয়ে হাসবে, নিজের বিবেকের কাছে ভুলেও প্রশ্ন করবে না। কারণ তার কিই বা যায় আসে এতে? কথা শুনিয়ে দিতে পারলেই তাদের শান্তি। মানুষকে ছোট করতে অনেকে পৈশাচিক আনন্দবোধ করে। নিজে না করলেও কাউকে ছোট হতে দেখলে সে মজা পায়। এটাই প্রকৃতিগত স্বভাব। এটা কেউ পাল্টাতে পারবে না। তাই নিজেকেই এই সমাজের সাথে মানিয়ে নিতে চাই। কারণ আমার কাছে আমার আত্মমর্যাদা সব কিছু থেকে ঊর্ধ্বে। অনেক কষ্টে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমি পুরোপুরি শিক্ষিত নই। আমি ইন্টার পাশ করা একজন নারী। তবুও আমি শিক্ষিত মানুষদের সাথে উঠা-বসা করি। আর এটাই আমার পরিচয়। আমার আর নতুন পরিচয়ের প্রয়োজন নেই।”

নাহিদ হোসেন আরিয়ার কথা শুনে উঠে চলে গেলেন। আরিয়া ফেরদৌস মৃদু বাতাসে খোঁপা খুলে দিলেন। চোখ বন্ধ করে রাতটাকে কয়েক মিনিট উপভোগ করলেন। তারপর উঠে নাহিদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“চলো, একা একা এই রাতের আকাশে শূন্য রাস্তায় হাঁটতে থাকি।”

“আমি তোমার সাথে হাজারটা পথ হেঁটে যেতে চাই।”

“হাঁটতে সমস্যা নেই। ভালোবাসতেও বাঁধা নেই।”

“তুমি কি তাহলে আমাকে ভালোবাসতে চাও?”

আরিয়া ফেরদৌস হাসলেন। বললেন,
“ভালোবাসতে বাঁধা নেই। শুধু হাতটা ধরা বারণ!”

নাহিদ হোসেন মুচকি হেসে বললেন,
“সমস্যা নেই। এই অনুমতি খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবো।”

আজকের এই রাতটা আরিয়া আর নাহিদ হোসেনের নতুন অনুভূতির সাক্ষী। হয়তো তাদের জীবনের তারাগুলো তাদের অনুভূতির মতোই অস্পষ্ট। তবুও কিছু কিছু অস্পষ্টতা জীবনকে সুন্দর করে রাঙায়।

দুই দিন পর,
সূচনার ফোনে তার বড় আপার কল এলো। সূচনা কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সূচনার আপা বলল,
“বাবা আর নেই রে। সূচনা, আমাদের বাবা চলে গেছে।”

সূচনা কথাটি শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর মাহাথিকে নিয়ে সেদিনই বাবার বাড়িতে চলে এলো। সেখান থেকে ইলিয়াস হকের দাফনের জন্য তারা গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন।

এদিকে আরিয়া ফেরদৌসও সূচনার বাবার মৃত্যুর খবর শুনে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর পরের দিন আরিয়া ফেরদৌস নাহিদ হোসেনের সাথে দেশে ফিরে এলেন। মায়ের আসার খবর শুনেই মারিয়া বাসায় ফিরে এলো। কারণ এতোদিন যা কিছু হয়েছে, তা যদি মা জানেন তাহলে অনেক বড় ঝামেলা সৃষ্টি হয়ে যাবে।

এক মাস পর মারিয়া ও মহুয়ার ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। প্রথম দুই সপ্তাহ ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হবে, তৃতীয় সপ্তাহে রাজশাহীতে পরীক্ষা, পরের মাসে চট্টগ্রামে পরীক্ষা হবে। আবার সেই মাসেই নোয়াখালী আর কুমিল্লাতেও পরীক্ষা আছে। এর বাইরে আরিয়া ফেরদৌস আর কোথাও পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেন নি। নয়তো মারিয়ার পুরো বাংলাদেশ ঘুরে ফেলার ইচ্ছে ছিল। মূলত ঘুরাঘুরি করার উদ্দেশ্যেই সে এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম পূরণ করেছে। কিন্তু গন্ডগোল বেঁধে গেলো, ওদের সাথে কে যাবে তা নিয়েই। আরিয়া ফেরদৌস বর্তমানে একটা প্রজেক্টের কাজ করছেন। আর দ্বিতীয়ত রাজশাহীতে তিনি কখনোই যান নি। তাই একা দুইটা মেয়েকে নিয়ে তিনি সেখানে যাবেন না। তাই মাহাথি আর মাফিনের উপরই এই দায়িত্ব পড়লো। যেখানে মাহাথি এক মাস আগেই এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছিল, তাই দ্বিতীয়বার ছুটি নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। যদিও প্রহর তার বোনকেও নিয়ে যাচ্ছে, তাই মারিয়ার জন্য কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু আরিয়া ফেরদৌস বললেন, তিনি অন্তত মহুয়াকে অভিভাবক ছাড়া পাঠাতে পারবেন না। তাই শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো মাফিনই মারিয়া আর মহুয়াকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে গন্ডগোল বাঁধালো স্বস্তিকা।
তারা ঘর থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তেই স্বস্তিকা মাফিনের পথ আটকে দিয়ে বললো,
“আপনি চলে গেলে আমি খুব কষ্ট পাবো। আমি একা একা কি করবো!”

মাফিন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“বাসায় আরো অনেকেই আছে। আর বেশি খারাপ লাগলে তুমি কিছুদিনের জন্য তোমার বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসো।”

“না, আমি আপনাকে একা যেতে দেবো না। আমিও যাবো।”

মাফিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি ওইখানে পিকনিক করতে যাচ্ছি না।”

স্বস্তিকা মন খারাপ করে বলল,
“আমাদেরও তো কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত।”

মাফিন হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে রইলো। সেইদিন সূচনার কথাগুলো শুনে সে স্বস্তিকার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। অথচ যতোই স্বাভাবিক হচ্ছে স্বস্তিকার উদ্ভট সব আবদারের পরিমাণ যেন বেড়েই যাচ্ছে। তবুও মাফিন যাওয়ার আগ মুহূর্তে স্বস্তিকার সাথে কোনো ঝগড়া করতে চায় না। তাই সে স্বস্তিকাকে অনেক বুঝিয়ে রুম থেকে বের হলো। কিন্তু এই মেয়ে তো নাছোড়বান্দা! সে মাফিনের ব্যাগ ধরে কাঁদতে লাগলো। স্বস্তিকার এই কান্ড দেখে রীতিমতো সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।

আরিয়া ফেরদৌস স্বস্তিকাকে শান্ত কন্ঠে বললেন,
“ওখান থেকে আসার পর মাফিন তোমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে আসবে। আর তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? দুই সপ্তাহ পর তো আবার চলে আসবে।”

স্বস্তিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“উনি আমাকে নিয়ে কোথাও যান না। সবসময় কাজের বাহানা দেন। কিন্তু মা, দেখুন। এখন তো উনি ঠিকই সুড়সুড় করে চলে যাচ্ছেন।”

৮১।

ঢাকায় আসার পর তারা হোটেলে উঠে গেলো। মারিয়া, মহুয়া আর প্রিয়া একটা রুমে, প্রহর আর মাফিন আরেকটা রুমে উঠলো। সারারাত তিনজন বসে গল্প করেই সময় কাটালো। পরের দিন তারা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বের হলো। আর মারিয়াকে দেখেই প্রহর ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। প্রহরের চোখ অনুসরণ করে মাফিন বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“পরীক্ষার দিনও কি সাজতে হয়?”

“কেন কেউ কি সাজগোজ করতে বারণ করেছে?”

“তোকে চিনবেই না কেউ। প্রক্সি দিতে এসেছিস মনে করে হল থেকে বের করে দেবে।”

“ভাইয়া, আমি শুধু লিপস্টিক দিয়েছি। এরপরও আমাকে না চিনলে ওদের চোখের সমস্যা।”

প্রহর মাফিনকে ইশারায় বোঝালো, যাতে আর কথাটা না বাড়ায়। এরপর তাদের পরীক্ষার সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হলো। মানুষের ভীড়ের জন্য সামনে আগানো যাচ্ছে না। প্রিয়া প্রহরের সামনেই ছিল। হঠাৎ সে মারিয়ার হাত ধরতে গিয়ে ভুলে মহুয়ার হাত ধরে সামনে এগুতে লাগলো। মহুয়া একবার তার হাতের দিকে তাকালো, আরেকবার প্রহরের দিকে। এই প্রথম কোনো পুরুষ তার হাত স্পর্শ করেছে। মহুয়ার বুকটা কাঁপতে লাগলো। তার মুখটা অসার হয়ে যাচ্ছে। প্রহর মহুয়ার হাত টেনে তাকে সামনে আনার পরই খেয়াল করলো, সে এতোক্ষণ মহুয়ার হাত ধরেছিলো। মহুয়া প্রহরের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। প্রহর ভীড়ের মধ্যে তাকিয়ে দেখলো, মারিয়া মাফিনের হাত ধরেই এদিকে আসছে। মারিয়া হয়তো বিষয়টা খেয়াল করে নি। নয়তো পরীক্ষার আগে ভুলভাল বুঝে পরীক্ষাটা খারাপ করে আসতো।

প্রহর মহুয়াকে বলল,
“আমি খেয়াল করি নি। ভেবেছি আমার পাশে মারিয়া ছিল। আর তুমি কিছু বললেও না!”

মহুয়া কথাটি শুনে লজ্জা পেয়ে গেলো। তাই তো! সে তো প্রহরকে বলে নি, সে মারিয়া নয়। কিন্তু কেন বলে নি! মহুয়া এসব ভাবতে ভাবতেই পরীক্ষার হলে চলে গেলো। পুরোটা সময় তার বারবার সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়তে লাগলো। কিভাবে প্রহর এতোগুলো মানুষের স্পর্শ থেকে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল! তাকে খুব যত্নের সাথে আগলে রেখেছিল! কিন্তু সে এসব কেন ভাবছে? কেন তার এসব মনে করতে ভালো লাগছে?

এসব ভাবতে ভাবতেই মহুয়ার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। প্রশ্ন অনেক কঠিন আসায় মহুয়ার কোনো আশায় ছিল না। সে নিশ্চিত হয়ে কিছু দাগিয়ে বাকী সব ভুল দাগিয়ে বের হয়ে এলো। তার এই মুহূর্তে ভীড় ভালো লাগছে না। একা কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারলে হয়তো তার ভালো লাগবে। সে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে দেখলো প্রিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খুব ইচ্ছে। কিন্তু সে আজ কিছুই ভালোভাবে দাগিয়ে আসতে পারে নি। এদিকে মারিয়া অনেকক্ষণ ধরেই ননদকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। তার মাথায় ঘুরছে পরীক্ষা শেষ, এবার আশেপাশে কোথাও ঘুরবে। অন্যদিকে মাফিন বোনের হাত থেকে প্রশ্ন নিয়ে দেখতে লাগলো, আর মারিয়াকে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। মারিয়া উত্তর না দিয়ে প্রিয়ার কান্না থামাতে ব্যস্ত। আর প্রহর ব্যস্ত কিভাবে এই ভীড় ঠেলে একটা গাড়িতে উঠবে সেই চিন্তায়।

একেক জন একেক চিন্তায় ব্যস্ত। কিন্তু এসবের মধ্যে মহুয়া একপাশে দাঁড়িয়ে প্রহরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
“আমার জীবনে প্রহর ভাইয়ার মতো কোনো মানুষ কি আসবে না? উনি মারিয়ার কতো যত্নে নেয়! আমারও কি কেউ এমন যত্ন নেবে না? আজ প্রথম মনে প্রেম জেগেছে। তবে এই প্রেম প্রহর ভাইয়ার জন্য নয়। এমন মানুষের জন্য, যে আমাকে এভাবেই আগলে রাখবে। কারো ভালোবাসা দেখলে মনে ভালোবাসা পাওয়ার বাসনা জন্ম নেয়। এই কথাটা আসলেই সত্য। আমারও এমন মানুষ চাই, যে আমাকে ভালোবাসবে। কিন্তু মা তো প্রেম মানবে না। আর আমাকে হয়তো এখন বিয়েও দেবে না। মারিয়াকে তো নিবিড়ের কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য বিয়ে দিয়েছে। আমার জীবনে তো কোনো নিবিড়ই আসে নি। তাহলে আমার কি একটু গতি হবে না?”

দ্বিতীয় দিন পরীক্ষা শেষে প্রহর একাই মারিয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। আজ প্রিয়ার পরীক্ষা নেই। আর মহুয়ার কেন্দ্র আরেক জায়গায় হওয়ায় মাফিন সেখানেই গিয়েছিলো।

প্রহর হঠাৎ খেয়াল করলো মারিয়া কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলে এদিকে আসছে। সে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো এটা সেই দিনের রেস্তোরাঁর ছেলেটি, যেই ছেলে মারিয়ার সাথে রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল, আর মহুয়া আর তাকে সেখানে দেখে ফেলেছিল। নিবিড়কে মারিয়ার সাথে এভাবে কথা বলতে দেখে প্রহরের খুব রাগ হচ্ছে। তাদের মধ্যে কোনো দূরত্বও বোঝা যাচ্ছে না। অন্তত তাদের কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটা উচিত ছিল। প্রহর একপর্যায়ে নিজেই মারিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। মারিয়া প্রহরকে দেখে এক গাল হেসে বলল,
“আজকে অনেক ভালো পরীক্ষা দিয়েছি।”

নিবিড় হেসে বলল,
“আমাদের দু’জনের তবে এখানেই চান্স হয়ে যাবে।”

প্রহর হালকা হেসে বললো, “দেখা যাক!”

নিবিড় প্রহরের হাবভাব দেখে চলে গেলো। প্রহর মারিয়ার হাত ধরে সামনে এগুতে এগুতে বলল,
“আমার এই ছেলেটাকে তেমন সুবিধের মনে হয় না। তুমি ওর সাথে কথা না বললেই ভালো হবে।”

মারিয়া হেসে বলল,
“ও আমার বন্ধু। কিন্তু গলায় গলায় ভাব নেই। শুধু হালকার উপর ঝাপসা বন্ধুত্ব।”

প্রহর ভ্রূ কুঁচকে মারিয়ার দিকে তাকালো। মারিয়া বলল,
“আপনার কি খুব কষ্ট লাগছে!”

“আমার আবার কিসের কষ্ট লাগবে?”

“আমি ওর সাথে কথা বলছি, আপনার অবশ্যই জেলাস হচ্ছে। নয়তো…”

“এমন কিছুই না।”

মারিয়া মনে মনে খুশি হলো।

এদিকে, বাসায় বুয়া না থাকায় এবার স্বস্তিকাকে বাধ্য হয়েই নিজের কাজগুলো করতে হলো। বিয়ের পর যৌতুক নিতে না চাইলেও স্বস্তিকার বাবা মেয়ের জন্য ওয়াশিং মেশিন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ওই মেশিন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আর সেই মেশিনটাও সে ঠিক করানোর কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল। তাই এবার কাপড় জমিয়ে স্তুপ করে ফেলেছে। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন? আরিয়া ফেরদৌসকে জানানোর পর তিনি সোজাসুজি বলে দিলেন, নিজেই যাতে ধুয়ে ফেলে। মাফিন আসলে বাকীটা দেখবে। কেউ বাসায় থাকে না, ওই মুহূর্তে বাসায় অপরিচিত কেউ আসবে এটা তিনি চান না। তাই শেষমেশ স্বস্তিকা বাধ্য হয়ে নিজ হাতেই সব কাপড় ধুয়ে নিলো। এরপর ছাদে উঠে দেখলো পুরো ছাদ জুড়ে মাহাথি আর সূচনার কাপড়। স্বস্তিকা সবগুলো কাপড় সরিয়ে দিয়ে নিজের কাপড় দিয়ে দিলো। বিকেলে ছাদ থেকে নেমে সূচনা স্বস্তিকাকে বলল,
“তুমি কি করলে এটা?”

স্বস্তিকা বোকা বোকা কন্ঠে বললো,
“আমি আবার কি করলাম?”

“আমি সব ভেজা কাপড় দিয়ে এসেছি। তুমি সব নিচে ফেলে দিলে?”

স্বস্তিকা বলল,
“ভাবী আমার ধরতে ইচ্ছে করছিলো না। অন্যের কাপড় ধরার অভ্যাস আমার নেই।”

“তাহলে কি ফেলে দেওয়ার অভ্যাসটা ছিলো? ফেলার সময় কি ধরে দেখো নি!”

“না, ওইখানে একটা লাঠি ছিল, ওটা দিয়ে ফেলেছিলাম।”

“তুমি আমাকে ডাকতে পারতে।”

“আমি আবার নিচে নেমে আপনাকে ডাকবো?”

“লিফট দিয়েই নামতে। তোমাকে তো সিঁড়ি ভাঙতে হতো না।”

“মনে ছিল না।”

আরিয়া ফেরদৌস বাসায় থাকায় সব শুনে স্বস্তিকাকে বকলেন। স্বস্তিকা কান্নাকাটি করে সূচনার কাছে ক্ষমা চাইলো। আবার আরিয়া ফেরদৌসের পায়ের কাছে বসে নিজের গালে নিজেই চড় খেলো। স্বস্তিকার এমন পাগলামো দেখে আরিয়া ফেরদৌস উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

এদিকে স্বস্তিকা সাথে সাথেই মাফিনকে কল দিলো। মাফিন কল ধরতেই বলল,
“কোথায় আপনি? তাড়াতাড়ি আসেন৷ নয়তো বউ হারাবেন। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। আজ নিজ হাতে কাপড় ধুয়েছি। কেউ আমার প্রশংসা তো করেই নি উলটো আমাকে বকেছে। মা আমাকে বেয়াদব মেয়ে বলেছে। ভাবী আমাকে পাগল বলেছে।”

মাফিন মনে মনে বললো,
“ভুল তো আর বলে নি।”

তবুও মাফিন স্বস্তিকাকে আপতত শান্ত করালো। আর স্বস্তিকাও চুপচাপ আরিয়া ফেরদৌসকে না বলেই নিজের বাবার বাড়ি চলে গেলো। স্বস্তিকা অনুমতি না নিয়ে চলে যাওয়ায় আরিয়া ফেরদৌস খুব রাগ করলেন। ছেলেকে ফোন করে বললেন,
“স্বস্তিকা আমাকে না বলে চলে গেলো কেন? তোমাকে কি বলেছিল?”

“না, বলে নি তো!”

“এটা কি উচিত হয়েছে! ও আমাদের দায়িত্বে আছে এভাবে হুট করে না বলে যাওয়াটা তো ভালো না। অনুমতি চাইলে বা অন্তত জানিয়ে গেলে তো পারতো। আমি তো কখনোই বারণ করতাম না।”

“মা, এসব আমার ভাবার বিষয় না। তুমি নিজের পছন্দেই এই রাজকুমারী খুঁজে এনেছো। এখন সেই তোমার ছেলের বউ। আমাকে এসব বলতে এসো না।”

আরিয়া ফেরদৌস চুপ হয়ে গেলেন। এখন তার কিছু বলার উপায় নেই।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here