#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২০
৩৭।
সূর্য উঠার আগে সূচনা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। মাহাথির রুম পূর্ব দিকে হওয়ায় সূর্যোদয়ের দৃশ্যটি ভালোভাবে দেখা যায়। আর সূচনার অনেক দিনের ইচ্ছে বিয়ের পর এই সৌন্দর্য মাহাথির সাথে বসে উপভোগ করবে। কিন্তু মাহাথিকে এতোবার ডাকার পরও সে ঘুম থেকে উঠছে না। তাই সূচনা একা একাই বারান্দায় চলে এলো৷
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের রক্তিম আভা দেখে সূচনার খুব শান্তি লাগছে। সে চোখ বন্ধ করে সেই শান্তিময় পরিবেশটা অনুভব করতে লাগলো। হঠাৎ সূচনার মনে হলো কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ বন্ধ রেখেই অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,
“তোমাকে অনেকবার ডেকেছি। কিন্তু তোমার ঘুম তো আমাদের প্রথম সকাল দেখা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।”
মাহাথি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
“এই প্রথম একটা শান্তির ঘুম দিয়েছি। নরম বালিশে মাথা রেখেও আমার এতোদিন অসম্পূর্ণ ঘুম হয়েছিলো। আর দেখো, তোমার স্পর্শ কতোটা প্রবলভাবে আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। ঘুমটাও ভাঙছিলো না, আবার রেশটাও এখনো কাটছে না।”
“তুমি তো জানো অপরিচিত জায়গায় আমার ঘুম আসে না। কিন্তু দেখো, আজ এই অপরিচিত জায়গাটা এক রাতেই আমার কাছে পরিচিত হয়ে গেছে। আচ্ছা মাহা, বিয়ের পর কি সব মেয়েদেরই এমন মনে হয়?”
“তা কি করে বলবো? বউ তো আমার একটাই আছে। আরেকটা বউ থাকলে তার অনুভূতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে আসতাম।”
সূচনা ঘাড় ফিরিয়ে মাহাথির দিকে একনজর তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। মাহাথির এলোমেলো চুলগুলো কপালের উপর লেপ্টে আছে। এই প্রথম মাহাথিকে সে এমন রূপে দেখেছে।
এদিকে মাহাথিও বারান্দার গ্রিলে ভার দিয়ে সূচনার দিকে তাকিয়ে রইলো। সূচনার কোনো হেলদোল না দেখে কয়েক সেকেন্ড পর মাহাথি বলে উঠলো,
“স্ট্যাচু হয়ে গেলে যে!”
“এক অপরিচিত ছেলের প্রেমে পড়েছিলাম, তারপর সেই অপরিচিত ছেলে প্রেমিকের জায়গা পেয়েছে। এরপর সেই প্রেমিককে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তারপর সে বরের জায়গা পেয়েছে। আর আজ, আবার সেই বরের প্রেমে পড়েছি, এখন তার জায়গাটা কোথায় হবে?”
“তবে এবার সে তোমার সন্তানদের বাবার জায়গা পেতে যাচ্ছে।”
সূচনা লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বলল,
“চুপ করো তো! আচ্ছা, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। তুমি অফিসে যাবে না?”
“না, আজ কেন অফিসে যাবো? মাত্রই তো বিয়ে হয়েছে আমার। আর অফিস থেকে মোট পাঁচদিনের ছুটি পেয়েছি। তবে আজ বাইরে যেতে হবে। সকালে নিবিড়ের মায়ের জানাজা। আর এখন মাত্র ভোর ছয়টা। আমি আবার ঘুমাবো। আটটায় আমাকে ডেকে দিও।”
“কিন্তু…”
মাহাথি সূচনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“না, টুনির মা, আর কিছু বলো না। আমাকে ঘুমোতে দাও প্লিজ।”
সূচনা অবাক কন্ঠে বললো,
“টুনির মা?”
মাহাথি ধপ করে বিছানায় শুয়ে বলল,
“ঘুম থেকে উঠে এই কনভারসেশন আবার শুরু হবে। এখন এই পর্যন্তই।”
সূচনা মুচকি হেসে রান্নাঘরে চলে গেলো। তারপর নিজ হাতে সবার জন্য বিভিন্ন পদের নাস্তা তৈরি করে ডায়নিংয়ে সাজিয়ে রাখলো। এদিকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই আরিয়া ফেরদৌস রান্নাঘরে এসে দেখলেন সূচনার নাস্তা বানানো প্রায় শেষ। সূচনা শাশুড়ীকে দেখে বলল,
“মা, আজ আপনি অফিসে যাবেন না?”
আরিয়া ফেরদৌস গম্ভীরমুখে বললেন,
“না, আজ বাসায় কাজ আছে।”
সূচনা আরিয়ার মুখের ভাব দেখে বলল,
“মা, আপনি কি কোনো বিষয়ে চিন্তিত?”
“না তো! হঠাৎ এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”
“এমনিই মনে হলো।”
মাফিন হঠাৎ রান্নাঘরে এসে বলল,
“মা, আমাদের বের হতে হবে।”
আরিয়া ফেরদৌস মাথা নেড়ে বললেন,
“আচ্ছা, যাও।”
“কিন্তু ভাইয়া তো এখনো রুম বের হয় নি। ভাইয়া যাবে না?”
“না, একজন গেলেই হয়। আজ এই বাড়িতে সূচনার প্রথম দিন। আর আজই মাহাথি শোকসভায় কেন যাবে? ওর সেখানে যাওয়াটা আমার যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না। আর ওদের সাথে আমাদের তেমন পরিচয়ও নেই।”
“কিন্তু নাহিদ আংকেল..”
আরিয়া ফেরদৌস মাফিনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“এখানে কিন্তু শব্দটা কেন আসছে? তুমি নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ো। আর যেহেতু বাড়িতে যাচ্ছো, একটু নানা-নানুর কবরটাও দেখে এসো। আর তোমার বড় মামার সাথে দেখা করে আসতে পারো।”
“বড় মামার সাথে দেখা করতে পারবো না। আমি নানা-নানুর কবর জিয়ারত করে চলে আসবো।”
কথাটি বলেই মাফিন চলে গেলো। এদিকে সূচনা মনে মনে বললো,
“মাফিন কেন বললো বড় মামার সাথে দেখা করতে পারবে না? আর তিনি আমাদের বিয়েতেও আসেন নি। মাহাথিও কখনো বড় মামার কথা বলেন নি। কিন্তু কেন?”
৩৮।
মারিয়া কলেজে যাওয়ার আগ মুহূর্তেই আরিয়া ফেরদৌস মারিয়া ও মহুয়ার ঘরে এসে মহুয়াকে বললেন,
“মহুয়া, তুমি কলেজে যাচ্ছো না?”
“না, মা। আজ যাওয়ার ইচ্ছে নেই।”
“কেন ইচ্ছে নেই?”
“এমনিতেই।”
“বিয়ে তোমাদের ভাইয়ের হয়েছে, আর এদিকে তোমরা ছুটি কাটাচ্ছো। অদ্ভুত ব্যাপার! যাও, কলেজের জন্য তৈরী হয়ে নাও।”
মহুয়া অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এদিকে মারিয়া ভয়ে ভয়ে ব্যাগে বই খাতা ঢুকাচ্ছে, আর মনে মনে ভাবছে,
“মা কিছু বলার আগে ঘর থেকে বের হতে পারলেই বাঁচি।”
আরিয়া ফেরদৌস গম্ভীর সুরে বললেন, “মারিয়া।”
মারিয়া শান্ত কন্ঠে বললো, “জ্বী, মা।”
“তুমি আজ কলেজে যেও না।”
“কিন্তু আজ..”
“তোমাদের ভাই-বোনদের এতো কিন্তু কেন থাকে?”
“আজ আমার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।”
“একদিনে কিছু যাবে আসবে না।”
মারিয়া আর কিছু বলার সাহস পেলো না। তার মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরছে। আর তা হলো গতকাল যেই দুঃসাহসিক কান্ড ঘটিয়েছে, এটি জানতে পেরে কি মা তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
এদিকে মহুয়া কলেজে চলে যাওয়ার পর আরিয়া ফেরদৌস আবার মারিয়ার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। মাকে দরজা বন্ধ করতে দেখে মারিয়ার গলার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।
সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“মা, কি হয়েছে?”
আরিয়া ফেরদৌস শক্ত মুখে বললেন,
“নিবিড়ের সাথে তোর এতো কিসের ঘনিষ্ঠতা?”
মারিয়া বিস্ফোরিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরিয়া ফেরদৌস আবার বললেন,
“ভাগ্যিস গতকাল আমি একটু দেরীতে হাসপাতাল থেকে বের হয়েছিলাম। তোকে দেখেই আমি বুঝে ফেলেছি, কিছু একটা চলছে। আর এরপর ঠিকই ওই ছেলেটার সাথে তোকে দেখেছি।”
মারিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরিয়া ফেরদৌস চেঁচিয়ে বললেন,
“তোর লজ্জা করে নি এমন নোংরা একটা কাজ করতে? মাহাথি আর মাফিন সেখানে না থাকলে তুই গতকালই আমার ভয়ংকর রূপটা দেখতি।”
মারিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“মা, তুমি যা ভাবছো ওরকম কিছুই নেই। নিবিড় শুধুই আমার ক্লাসমেট।”
“চুপ।”
আরিয়া ফেরদৌসের চিৎকারে মারিয়া কেঁপে উঠলো। সে আরিয়ার কাছে এসে বলল,
“সত্যি বলছি, আমি শুধু আন্টিকে দেখতেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমার নিবিড়ের জন্য মায়া লেগেছিল, তাই আমি ওকে আটকাতে পারি নি। কিন্তু মা, আমি নিবিড়কে নিয়ে ওভাবে কখনোই চিন্তা করি নি। বিশ্বাস করো।”
আরিয়া ফেরদৌস কিছু একটা ভেবে বললেন,
“ঠিক আছে। বিশ্বাস করবো, যদি তুমি আমার শর্তে রাজী হও।”
মারিয়া অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “শর্ত!”
“হ্যাঁ, তোমাকে আমি বিশ্বাস করবো, যদি তুমি আমার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করার জন্য রাজী হও।”
“আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি রাজী আছি। আমি তোমার পছন্দ করা ছেলেকেই তো বিয়ে করবো। আমি কখনোই এসব সম্পর্কে জড়াবো না।”
“তোমাকে সেই সময়ও দেওয়া হবে না।”
“মানে?”
“মানে আমি তোমাকে মাফিন আর স্বস্তিকার বিয়ের আগেই বিয়ে দিয়ে দেবো।”
“মা, আমি তো এখনো পড়াশোনা শেষ করি নি।”
“বিয়ের পরও পড়াশোনা করা যায়।”
“কিন্তু, তুমি তো বিয়ের পর পড়াশোনা করতে পারো নি।”
“হ্যাঁ, পারি নি। কারণ আমার কপালে তোদের বাবা জুটেছিল। আর তাই আমি আমার জায়গায় তোকে দেখতে চাই না।”
“কিন্তু মা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি এখনো কলেজ শেষ করি নি। আমি পড়াশোনা শেষ করে আগে চাকরিতে যাবো, তারপর..”
“বললাম তো আমি সব ঠিক করে দেবো। বিয়েও হবে, পড়াশুনাও হবে।”
মারিয়া গাল ফুলিয়ে বলল,
“সবাই আমাকে আন্টি বলবে। ক্লাসে বিবাহিতদের সাথে সবাই এমনই করে।”
“যারা আন্টি বলবে, তাদের কষে একটা চড় লাগিয়ে দিবি। যখন চড় মারার কারণ জিজ্ঞেস করবে তখন বলিস, আন্টির সাথে বেয়াদবি করার শাস্তি।”
কথাটি বলে আরিয়া ফেরদৌস রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন। এদিকে মারিয়া ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। সে মনে মনে বলল,
“বাসায় তো মাফিন ভাইয়া মাকে পটিয়ে আমাকে ট্যুরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়! এখন শ্বশুড় ঘরে কি বর শাশুড়িকে পটাতে পারবে? নাকি আমার জীবনের ভ্রমণ গল্প বান্দরবানেই সমাপ্ত থেকে যাবে?”
চলবে-