রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-২১

0
485

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২১

৩৯।
আরিয়া ফেরদৌসকে মাহাথি ও মাফিন বিভিন্নভাবে বোঝাতে লাগলো মারিয়ার এখনো বিয়ের বয়স হয় নি। কিন্তু তিনি কোনো কথায় কানে নিচ্ছেন না। তিনি যেভাবেই হোক মারিয়াকে বিয়ে দিয়ে দেবেন।

এদিকে মারিয়া নিজের ঘরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সে অনেকক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে মারিয়ার জন্য পাত্র খুঁজছে শোনার পর থেকে মহুয়ার মুখটাও অন্ধকার হয়ে আছে। ছোটবেলা থেকেই মারিয়ার সাথেই সে সময় কাটিয়েছিলো। মারিয়াকে ছাড়া একদিনও তার যায় নি। আর আজ হুট করে তার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা চলছে, এটি মহুয়ার কল্পনারও বাইরে। সে মারিয়াকে কিভাবে শান্ত করবে বুঝতে পারছে না। বরং এই মুহূর্তে তার নিজেরই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মাকে তার এই প্রথম নির্দয় মনে হচ্ছে। তবুও ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু আজ মারিয়ার জায়গায় সে নিজে থাকলে, মারিয়া বিয়ে ভাঙার জন্য মায়ের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতো। আর এদিকে মহুয়ার সেই সাহসটুকুও নেই।

সূচনা অবাক দৃষ্টিতে আরিয়া ফেরদৌসের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
“একজন মা কিভাবে পারবেন, তার মেয়েকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে রেখে বিয়ে দিয়ে দিতে? যেই মা নিজেই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি, সেই তিনিই কিনা তার মেয়েকেও অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন?”
সূচনার ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছে। এখানে নিশ্চিত কোনো রহস্য আছে! নয়তো এমনি এমনিই কি তিনি মারিয়াকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাবেন?

মাফিন মায়ের সাথে দুই দফা ঝগড়া বাঁধিয়ে বলে গেল,
“মারিয়া যদি বিয়েতে সম্মতি না দেয়, দেখবো কে এই বিয়ে দেয়! আমার বোনকে যদি মানসিক চাপ দেওয়া হয়, তাহলে আমি এই পুরো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবো। তখন তোমার প্রতিদিনকার ঝামেলা গুলো এক নিমেষেই শেষ হয়ে যাবে।”

মাহাথি মায়ের হাত ধরে অনুরোধে সুরে বলে গেল,
“কয়েক মাস পর মারিয়ার টেস্ট পরীক্ষা। এরপর ফাইনাল। তারপর ভর্তি পরীক্ষা। ওর একটা স্বপ্ন আছে। আমাদের ইচ্ছে বোনকে ভালো জায়গায় পড়াবো। ও নিজের পায়ে দাঁড়াবে এটাই আমাদের চাওয়া। আর তুমি কিনা ওর বিয়ে নিয়ে কথা বলছো? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলবে! মা, তুমিই তো পড়াশোনা করে শিক্ষিত হওয়াটাকে অন্য সবকিছু থেকেই ঊর্ধ্বে রাখতে। আর আজ তুমিই এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?”

আরিয়া ফেরদৌস কিছুই বললেন না। শুধু চুপচাপ বসে সবার কথা হজম করে গেলেন।

রাত দেড়টা ছুঁইছুঁই। আরিয়া ফেরদৌস এখনো ঘুমোতে পারছেন না। চোখের সামনে বারবার নিবিড় আর মারিয়ার কাছে আসার দৃশ্যটা ভাসছে। আরিয়া ফেরদৌস জানেন, মারিয়ার এই কাছে আসায় বিন্দুমাত্র সম্মতি ছিলো না। অথচ তবুও সে নিবিড়কে আটকাতে পারে নি। আর এই আটকাতে না পারার কারণ মায়া৷ মারিয়া নিবিড়ের মায়ায় পড়ে গেছে। সে হয়তো এখনো বুঝতে পারছে না, কিন্তু আরিয়া ফেরদৌস তা বুঝে গেছেন। এই মুহূর্তে মারিয়াকে ছেড়ে দেওয়া মানেই সে তার মায়ের মতোই একটা ভুল সম্পর্কে পা দিতে যাবে।

চোখ বন্ধ করতেই আরিয়া ফেরদৌসের চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি ড্রয়ার থেকে তার বহু বছর আগের সেই পুরোনো ডায়েরীটা বের করলেন। এটি সেই ডায়েরী যেই ডায়েরীতে তার আর মিরাজের প্রেমের গল্প লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

অভাবের সংসারে আরিয়া ফেরদৌসের বাবা ফেরদৌস আলম খুব কষ্ট করেই মেয়ের জন্য একজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। কিন্তু মেয়ে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই শিক্ষকের সাথেই দিনের পর দিন প্রেম করে গেছে। আরিয়া ফেরদৌস ফোনের ওয়ালে লাগানো তার বাবার ছবিটির দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, আর বললেন,
“বাবা, তুমি বেঁচে থাকলে হয়তো তোমার আরু এতোটা শক্ত মনের হতো না। আমি সেই আগের মতোই প্রাণখুলে হাসতাম, বৃষ্টির স্পর্শ আগের মতোই আমার কন্ঠে সুর দিতো। কিন্তু আমি যে আর আগের আরু নেই। বাবা জানো, আমার মারিয়ার মাঝে আমি আমার সেই ছোটবেলার বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পাই। তাই আমার খুব ভয় হয় মারিয়ার জন্য। বারবার মনে হয়, আমার মন্দ ভাগ্যটাও যদি মেয়েটা পেয়ে বসে! এখন আমার যদি কিছু হয়ে যায়, মেয়েটার জীবনটাও কি আমার মতো নষ্ট হয়ে যাবে? বাবা, তুমি যখন আমাদের ফেলে চলে গিয়েছিলে, তখন থেকেই আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। ফায়াজ ভাইয়া, মা, বড় আপা, মেজ আপা, দুলাভাই, কেউই আমাকে মিরাজের হাত থেকে বাঁচাতে পারে নি। আমিও মারিয়ার মতোই মিরাজের মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। উন্মাদের মতো মিরাজের পিছু ছুটেছিলাম। আর ফলস্বরূপ সেই কাপুরুষ আমার গলার কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল। আমি যখন জানতে পেরেছিলাম, মিরাজ আমার উপযুক্ত নয়, তখনই আমি সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু মিরাজ সেই সম্পর্ক কখনোই শেষ হতে দেয় নি। ও জোর করে, বড় ভাইয়া আর আদিবা ভাবীকে টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে কিনে নিয়েছিলো। আমি কিভাবে ভুলে যাবো আমার অতীত? কিভাবে মুক্তি পাবো অতীতের যন্ত্রণা থেকে? হয়তো আজ আমি সুখে আছি। তবে শারীরিকভাবে সুখে আছি, কিন্তু আমার মানসিক সুখ এখনো আসে নি। এখন হয়তো আমাকে আর মিরাজের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় না। কেউ এসে যখন তখন আমার উপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এখন আমি খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে ভয় পাই না। কারণ এখন মিরাজ আমার পাশে নেই। কিন্তু তবুও আমি মানসিক ভাবে এখনো চিন্তামুক্ত হতে পারছি না। শুধু মেয়ে দুইটার চিন্তায় আমার রাতে ঠিকভাবে ঘুম আসে না। কিন্তু দেখো, আমার সব সন্তানরা মনে করে আমি নিষ্ঠুর। আমিই তাদের জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি করি। বাবা, নিবিড় ছেলেটা ভালো না। যেই ছেলে কোনো সম্মতি না নিয়েই আমার মেয়েকে স্পর্শ করার সাহস দেখিয়েছে, সে কিভাবে ভালো ছেলে হবে? হয়তো লোকে বলবে আবেগের বশে এমন করে ফেলেছে। কিন্তু আমি এসব আবেগ মানতে পারি না। মিরাজও এভাবেই আবেগের বশে আমাকে স্পর্শ করেছিলো। সেই স্পর্শ একদিন অধিকারে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। এরপর সে আর বাঁধাও মানে নি। আর আমিও বাঁধা দেই নি। বিয়ের আগে সে আমার হাতটা ধরেছিলো আর দু-একবার জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার প্রকাশ করেছিল। ব্যস, এতেই আমার গায়ে কলঙ্ক লেগে গেলো। তারপর সেই কলঙ্ক মুছে দেওয়ার জন্য মা আর বড় ভাইয়া জোর করে মিরাজকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলো। সেই যুগে এতোটুকুই অনেক গুরুতর ছিলো। আর এই যুগে ভালোবাসার আরো কতো গুরুতর রূপ আছে, তা তো আমার ভাবনারও বাইরে। এই সমাজ মেয়েদের চরিত্রে খুব সহজে দাগ লাগিয়ে দেয়। আর আমি আমার মেয়েদের চরিত্রে কাউকে দাগ লাগানোর সাহসটুকুও দেবো না। এখন আমি যদি আমার সন্তানদের চোখে একজন নিষ্ঠুর মা হয়েও, মারিয়াকে সৎ পাত্রে বিয়ে দিতে পারি, তখনই আমি নিজেকে সার্থক মনে করবো।”

আরিয়া ফেরদৌস সেই রাতেই মনিটরের সামনে বসে মারিয়ার বায়োডাটা তৈরী করে ফেললেন। আগামীকালই তিনি তার কলিগ ও আত্মীয়দের জানাবেন এই ব্যাপারে।

৪০।

আজ আনমনেই বাতিঘরে ঢুকলো প্রহর। সে ভেবে নিয়েছে, আজও তার মায়াবিনীর দেখা পাবে না। কিন্তু বাতিঘরে ঢুকেই সে মায়াবিনীকে তার মুখোমুখি দেখে চমকে উঠলো।
মহুয়া সেই মুহূর্তে তার ব্যাগটা তাকে সাজিয়ে রাখায় ব্যস্ত ছিল। তাই সে প্রহরকে খেয়াল করে নি। এদিকে প্রহরের খুশিতে হাত কাঁপছে। এতোদিন সে আতংকের মধ্যে ছিল। তার মায়াবিনী কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, সে চিন্তায় তার অস্থির অবস্থা। আর এই মুহূর্তে মায়াবিনীকে দেখে তার সব অস্থিরতা নিমেষেই দূর হয়ে গেছে। মহুয়ার পিছু পিছু প্রহর ভেতরে ঢুকে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো, আজ সে মায়াবিনীর সাথে কথা বলেই ছাড়বে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরও সে কিভাবে কথা শুরু করবে, সেটাই ঠিক করতে পারছিলো না।
এদিকে অনেকক্ষণ পর মহুয়া একটা বইয়ের অর্ধেক পড়ে বসা থেকে উঠতে যাবে, তখনই প্রহর তার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রহরকে দেখে মহুয়ার বুকটা কেঁপে উঠলো। এভাবে হুট করে একটা ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা যদি মা জানতে পারে, তবে মারিয়ার মতো তাকেও বিয়ে দিয়ে দেবে।
মহুয়া ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যে-ই অন্য দিকে ফিরতে যাবে তখনই প্রহর বলল,
“আপনার বইটা কেমন লেগেছে?”

প্রহরের কন্ঠ শুনে মহুয়া স্থির হয়ে গেলো। এবার ইতস্তত ভাব নিয়ে প্রহরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আ..আমাকে বলছেন?”

প্রহর মাথা নেড়ে বলল, “জ্বী, আপনাকেই বলছি।”

মহুয়া তার হাতে থাকা বইটি প্রহরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনি পড়লে বুঝতে পারবেন।”

প্রহর হালকা হাসলো। প্রহরের হাসি দেখে মহুয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। সে মনে মনে বলল,
“আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি?”

পরক্ষণেই আবার প্রহরের সেই হাসিটাই মহুয়াকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করলো। মহুয়া মনে মনে ভাবলো,
“পুরুষ মানুষের হাসিও মাঝে মাঝে সুন্দর হয়। একদম দেখে থাকার মতো এই সৌন্দর্য। কবিরা কি শুধু মেয়েদেরই হাসির ব্যাখ্যা দিয়েছেন? পুরুষদের হাসির কি কোনো ব্যাখ্যা দেন নি? হয়তো দিয়েছেন, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা আজও আমার চোখে পড়ে নি। আর আজ সেই ব্যাখ্যা পড়ার আগেই তার বাস্তব রূপ চোখে পড়লো। মানতেই হবে, সামনে থাকা এই পুরুষটা আসলেই খুব সুন্দর করে হাসতে পারেন।”

প্রহরের কথায় মহুয়ার ধ্যান ভাঙলো।
প্রহর বলল,
“বইটি কেমন তা তো পড়লে অবশ্যই বুঝবো। কিন্তু এই মুহূর্তে বইয়ের রিভিউটা শুনতে পারলে ভালো হতো। যদি রিভিউ শুনে আগ্রহ বাড়ে, তখনই বইটি পড়বো। নয়তো আরো দেরীতে পড়বো। কিন্তু পড়বো তো অবশ্যই।”

এরপর প্রহর মনে মনে বললো,
“যেই বইটি মায়াবিনীর স্পর্শ পেয়েছে, সেই বইটি আমি কিভাবে না পড়ে থাকবো? মায়াবিনী, এই মুহূর্তে তোমার সাথে কথা বলার জন্য এর চেয়ে ভালো কারণ আর হতেই পারে না।”

মহুয়া বইটি উল্টেপাল্টে বলল,
“মোটামুটি ভালোই লাগছে। তবে এখনো পুরোপুরি শেষ করি নি। আর এই মুহূর্তে বইয়ের শেষ পাতাটা না পড়ে রিভিউ দিতে পারছি না।”

প্রহর মুচকি হেসে বলল,
“ঠিক আছে। আমি আপনার রিভিউ শুনার অপেক্ষায় থাকবো।”

কথাটি বলেই প্রহর অন্য পাশে চলে এলো। এর চেয়ে বেশি কথাবার্তা বলাটা তার যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না। আজ একটু কথা হয়েছে, আগামীতে আরেকটু হবে। ধীরে ধীরেই না হয় টুকটাক কথাবার্তা হবে। সবে তো মায়াবিনী কলেজে পড়ে। এতো তাড়াতাড়ি কি তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আছে? না, নেই। প্রহরের কোনো ভয় নেই। সে তার মনকে বুঝিয়ে ফেলেছে, মায়াবিনী তারই হবে। তাই তার আর কোনো চিন্তা নেই।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here