রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৪৬:

0
628

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪৬:

৭৪।
মহুয়া বাসায় ঢুকে দেখলো পুরো ঘর এলোমেলো। আর স্বস্তিকা মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মহুয়া স্বস্তিকার কাছে গিয়ে বসে বলল,
“ভাবী, কি হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেন?”

স্বস্তিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি আর এই বাসায় থাকবো না। দুইটা মাস হয়েছে আমি এই বাসায় এসেছি। কিন্তু এখানে কাউকেই আমার আপন মনে হয় নি। সবাই আমাকে অপছন্দ করে। বড় ভাবী তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না।”

মারিয়া বুকে হাত গুঁজে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ সূচনা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে বলল,
“স্বস্তিকা, তুমি অন্তত এই বয়সে এমন ন্যাকামো করো না।”

স্বস্তিকা কথাটি শুনে মহুয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের চুল নিজেই টানতে লাগলো। আর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি ন্যাকামি করছি। হ্যাঁ? আমি ন্যাকামি করছি।”

কথাটি বার-বার আওড়াতে লাগলো আর নিজের গালে নিজেই চড় মারতে লাগলো। মারিয়া মহুয়াকে মেঝে থেকে তুলে চাপা কন্ঠে বলল,
“ভিলেন ভাবী পাগল হয়ে গেছে।”

মহুয়া মারিয়াকে এক পাশে টেনে এনে বলল,
“আগে বলবি কি হয়েছে?”

মারিয়া বলল,
“মাফিন ভাইয়া নাকি স্বস্তিকা ভাবীর জন্য ফ্রিজে চকোলেট রেখেছিল। আর মিষ্টি ভাবী চকোলেটগুলো গলিয়ে কেক বানিয়ে ফেলেছে।”

“কাল যে বানিয়েছে ওই কেকটা?”

“হ্যাঁ।”

“আরেহ ওই চকলেটগুলো তো আমি বড় ভাইয়াকে আনতে বলেছিলাম। ভাবী চকোলেট কেক বানাবে তাই। মাফিন ভাইয়া কবে আনলো?”

“এটাই তো ভাবী বলছিল। কিন্তু ভিলেন ভাবী বলছে তার নাকি প্রাইভেসি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

“এখানে প্রাইভেসি নষ্ট হওয়ার কি আছে?”

“ওই যে মাফিন ভাইয়া ভালোবেসে এটা-সেটা নিয়ে আসে, আর এটা আমাদের সবার চোখের সামনে ঘটছে। এসব নাকি আমাদের সহ্য হয় না। তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে, তাদের নাকি একা থাকা প্রয়োজন। আরো কতো কিছু বলেছে!”

“মা শুনলে তো ছোট ভাবী শেষ!”

“ভাইয়া শুনলেই ভাবী শেষ। একটা চড় মেরে দাঁত সব বের করে ফেলবে। দেখবি কথাও বলতে পারবে না।”

“যাহ, মারিয়া। এভাবে বলিস না। আমাদের ভাবীকে শান্ত করানো উচিত।”

“না বাবা না। তুই যা। আমার পক্ষে বাচ্চা সামলানো সম্ভব না।”

“বাচ্চা?”

“ভিলেন ভাবী বাচ্চার চেয়ে কি কম! মা বলতো আমিই অনেক ইম্যাচিউর। আজ বুঝলাম আমার চেয়ে বয়সে বড়ো ইম্যাচিউরও আছে।”

এদিকে সূচনা শান্ত কন্ঠে বললো,
“দেখো স্বস্তিকা, কয়েকটা চকোলেটের জন্য তুমি এমন করছো!”

স্বস্তিকা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো,
“শুধু চকোলেট না ভাবী। মাফিনের ভালোবাসা ছিল। মাফিনের পক্ষ থেকে না হলে আমি কখনোই এমন করতাম না। আর কথাটা আপনি বাড়িয়েছেন। আপনি আমাকে বলেছেন আমি বাড়াবাড়ি করছি। আমি যখন রান্নাঘরে চকোলেটের প্যাকেট দেখেছি, তখন শুধু জিজ্ঞেস করেছি এই চকোলেটগুলো কে খেয়েছে। আপনি বললেন কেক বানিয়েছি। আমি শুধু এইটুকু বলেছি কার অনুমতি নিয়ে আপনি কেক বানিয়েছেন! তখন আপনি কি বললেন? আমি এভাবে কথা বলছি কেন? তারপর আবার আপনি নিজের দোষ স্বীকার না করে বলছেন, বড় ভাইয়া এনেছে। সোজাসুজি বললেই পারতেন, আমি ফ্রিজে দেখেছি, তাই ভাবলাম কেক বানাবো। এতো মিথ্যে বলার কি দরকার ছিল। যখন আমি সত্য বলতে আপনাকে বাধ্য করেছি, আপনি আমাকে মুখের উপর বলে দিলেন আমি বাড়াবাড়ি করছি, বেয়াদবি করছি। বেয়াদব আমি না। বেয়াদব আপনি। কথা বলার আদব আপনার কাছে নেই। আমার পরিবার তো আমাকে ভালোই শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু ভাইয়া আপনাকেই তুলে এনেছে বাসি গলি থেকে। শুনেছি মাও আপনাকে মেনে নিতে চায় নি। ভাইয়ার কারণে বাধ্য হয়েছিল।”

স্বস্তিকার কথা শুনে মারিয়া আর মহুয়া অবাক হয়ে গেলো। তাদের দু’জনেরই মুখে হাত। সূচনা ঠাঁই দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে গেলো। কিন্তু কোনো প্রতুত্তর করলো না। শুধু তার চোখ দুটিই ছলছল করে উঠলো। সূচনা চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে ভালোভাবেই জানে আরিয়া ফেরদৌস তাকে মেনে নিতে চান নি। মাহাথির খুশির জন্য তিনি রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর একদিনও সূচনা শাশুড়ির চোখে অসম্মানের ছিল না। আরিয়া ফেরদৌস তাকে অনেক গুরুত্ব দেন। তাই সূচনাও সেই মেনে না নেওয়ার ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু আজ স্বস্তিকা তাকে এভাবে সব কিছু মনে করিয়ে দেবে সে ভাবতেই পারে নি। স্বস্তিকার বলা প্রতিটা শব্দ তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগিয়েছে। সে ভেবেছিল এই ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিতে। কিন্তু না। সূচনা চুপ করে থাকবে না। সে এই কথা মাফিনকে অবশ্যই বলবে।

সন্ধ্যায় আরিয়া ফেরদৌস বাসায় এসে দেখলেন পুরো ঘর এলোমেলো। তিনি চোখের সামনে সবকিছু পরিপাটি দেখতে পছন্দ করেন। বিশৃঙ্খলা তার খুব অপছন্দের ব্যাপার। তার উপর বাইরে থেকে এসেই তিনি ঘরের এই অবস্থা দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেন। ডায়নিং টেবিলের চেয়ারগুলো পুরো ঘরের এক এক জায়গায় রাখা, টেবিলের উপর খাবারের প্লেট বসানো। মেঝেতে পা দিতেই খেয়াল করলেন সব ভাত। তিনি চেঁচিয়ে বললেন,
“মহুয়া, মারিয়া। কোথায় তোমরা?”

মারিয়া রুম থেকে মায়ের কন্ঠ শুনে মুচকি হেসে বলল,
“দুপুরে তুফান হয়েছিল। এখন হবে ভূমিকম্প। আর ভাইয়ারা এলে কেয়ামত শুরু হয়ে যাবে।”

মহুয়া চোখ ছোট করে বললো,
“চুপ কর। তুই ইচ্ছে করে আমাকে সব গুছিয়ে রাখতে দিস নি। মা এখন দেখেই বুঝে যাবে কিছু হয়েছে।”

“আরেহ, চান্দু। আমি তো মাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই তোকে সব ঠিক করে রাখতে দেই নি। ভিলেন ভাবী যে বাসায় তুফান ঘটিয়েছিল শুধু কিছু চকোলেটের জন্য এটা একটা শিরোনামে তো থাকা উচিত।”

কথাটি বলেই মারিয়া খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর গলা ঝেড়ে বলল,
“রিপোর্টার মারিয়া নাওয়াল বলছি, এই মাত্র পাওয়া খবর, দুপুরে দুই জায়ের যুদ্ধের পর এখন শুরু হবে বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কোন জা জয়ী হবে, কার পক্ষে হিটলার শাশুড়ী রায় দেবে তা জানতে হলে চোখ রাখুন ‘আমার চকোলেট খেয়ে ফেলেছে’ চ্যানেলে। সঙ্গে আছি আমি মারিয়া নাওয়াল, আর সাথে আছে নিরপেক্ষ, নিষ্পাপ ও জনদরদী মহুয়া দি গ্রেট।”

মহুয়া মারিয়ার হাত ধরে বলল,
“থামবি এখন, মা ডাকছে।”

মহুয়া কথাটি বলে দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এরপর মারিয়া তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে বিড়বিড় করে বলল,
“আল্লাহ, মা যাতে মিষ্টি ভাবীর পক্ষেই রায়টা দেয়। ওই ভিলেন ভাবীটা তো আবার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে। না জানি বাসায় এখন কি হবে!”

এদিকে আরিয়া ফেরদৌস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সূচনা আর মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। আরিয়ার কন্ঠ শুনে সূচনা তার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু স্বস্তিকার বের হওয়ার কোনো খবর নেই। আরিয়া ফেরদৌস বললেন,
“ঘরের এই অবস্থা কেন?”

সূচনা বলল,
“ক্ষমা করবেন, মা। আমার শরীর ভালো ছিল না। তাই গুছিয়ে রাখতে পারি নি।”

“তোমার শরীর না হয় ভালো ছিল না। বাকীদের কি হয়েছিল? দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো ঝামেলা হয়েছে। আর সূচনা, তোমার চোখ ফুলে আছে কেন? তুমি কি কান্না করেছো?”

“না, মা। ঘুমিয়েছিলাম তো তাই।”

মারিয়া সূচনার উত্তর শুনে ভ্রূ কুঁচকে মনে মনে বলল,
“আরেহ, মিষ্টি ভাবী এতো মিষ্টি হচ্ছে কেন? না, আমিই আগুনটা ধরিয়ে দেই। এই নিষ্পাপ বাচ্চাগুলো দিয়ে কিচ্ছু হবে না।”

মারিয়া এবার বলে উঠলো,
“ভাবী হয়তো কান্না করেছে। ভিলে…ওপস!”

মহুয়া চোখ বড় বড় করে মারিয়ার দিকে তাকালো। মারিয়া মুখে হাত দিয়ে নিজের বাক্য শুধরে বলল,
“ছোট ভাবী আজ যা করেছে বড় ভাবীর তো খারাপ লাগারই কথা। আমাকে কেউ ওমন করে বললে আমি তো কাঁদতে কাঁদতে মরেই যেতাম।”

মহুয়া দাঁতে দাঁত চেপে চাপা কন্ঠে বলল,
“মারিয়া, এখনই কেন বলতে হলো? মা তো মাত্র এসেছে।”

মারিয়া চাপা স্বরে বলল,
“তুই চুপ কর। যা হওয়ার হয়ে যাক। আমি কি বসে থাকবো মা কবে ফ্রেশ হয়ে আসবে, তারপর শুনবে।”

আরিয়া ফেরদৌস সূচনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি হয়েছে সূচনা? তোমাকে স্বস্তিকা কি বলেছে?”

সূচনা বলল,
“মা, আগে আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর বলছি।”

আরিয়া ফেরদৌস মাথা নেড়ে মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসার আগেই ঘরটা পরিপাটি চাই। আর স্বস্তিকাকে জানাও আমি ডাকছি।”

এদিকে বিশ মিনিট পর মাহাথি বাসায় ঢুকলো। স্বস্তিকা মাহাথিকে দেখে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“ভাইয়া, বড় ভাবী এটা কি করলো? আমার নামে মায়ের কাছে নালিশ করলো কেন?”

মাহাথি অবাক দৃষ্টিতে স্বস্তিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,
“সূচনা তোমার নামে কেন নালিশ করবে!”

“নয়তো মা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন?”

“তোমাকে ডেকে পাঠানোর সাথে নালিশ করার কি সম্পর্ক? আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

তখনই মাফিন বাসায় ঢুকলো। মাফিনকে দেখে স্বস্তিকা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। মাফিন স্বস্তিকার কান্না দেখে অবাক হয়ে গেলো। মারিয়া রুম থেকে বের হয়ে মাফিন আর মাহাথিকে দেখে আবার দৌঁড়ে রুমে ঢুকে গেলো। মহুয়া মারিয়াকে দেখে বলল,
“মা বের হয়েছে?”

মারিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“আরেহ না। ভাইয়ারা এসেছে। চান্দু, বাসায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। আমার তো রক্ত ছোটাছুটি করছে।”

মহুয়া উড়না ঠিক করে বলল,
“চল তাড়াতাড়ি। ভাবী কি বলে দেখি।”

“তোর খুব মজা লাগছে, তাই না?”

“ধুর, মজা কেন লাগবে? কিন্তু মাফিন ভাইয়া যখন শুনবে এতো সব কাহিনী চকোলেটের জন্য হয়েছে নিশ্চিত ভাবীকে কিছু একটা বলবে।”

“চড় দিয়ে দেবে না তো?”

“ভাইয়ার যে মেজাজ! বলা যায় না কি করে। আমাদের ভাবীকে দূরে দূরে রাখতে হবে।”

“তুই এখনো ওই ভিলেন ভাবীর কথায় চিন্তা করছিস? তুই আসলেই মাথা মোটা। চল।”

আরিয়া ফেরদৌস ফ্রেশ হয়ে এসে মাহাথি ও মাফিনকে দেখে বললেন,
“তোমরা ফ্রেশ হয়ে এসো। এদের কথা শুনতে হবে না।”

দুই ভাই মায়ের কথামতো নিজেদের রুমে চলে গেলো। স্বস্তিকা মাফিনের পিছু পিছু যেতে নিলে আরিয়া ফেরদৌস বললেন,
“স্বস্তিকা, তুমি বসার ঘরে যাও। আর মহুয়া, তোমার বড় ভাবীকে ডেকে আনো।”

এরপর আরিয়া ফেরদৌস সূচনা ও স্বস্তিকা উভয়ের কথা শুনলেন। স্বস্তিকা সূচনাকে কি কি বলেছে তাও শুনলেন। এদিকে তিনি মহুয়া আর মারিয়াকে বসার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন, যাতে মাহাথি আর মাফিন ভেতরে আসতে না পারে।

মাফিন মায়ের এই নিষেধাজ্ঞা শুনে বলল,
“কি হচ্ছে সেটাই তো বুঝলাম না।”

মারিয়া বলল,
“মহিলা সভা হচ্ছে। পুরুষের প্রবেশ নিষেধ।”

“ফাজলামো বন্ধ কর। বল কি হয়েছে?”

“আগে তুমি বলো, ছোট ভাবীর জন্য তুমি কোনো চকোলেট এনেছিলে?”

মাফিন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“চকোলেট! না তো? কেন?”

মারিয়া চেঁচিয়ে বললো,
“তুমি যাও ভেতরে। একমাত্র তোমার উপস্থিতিতে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। তুমিই একমাত্র সাক্ষী।”

মারিয়া মাহাথি আর মাফিনকে বসার ঘরে ঢুকতে দিলো। মহুয়া বলল,
“মা কিন্তু বারণ করেছিল তবুও তুই…”

মারিয়া বুকে হাত গুঁজে বলল,
“ভূমিকম্প দেখে মজা পাচ্ছিলাম না। তাই একটু সুনামি দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

৭৫।

সবাই চুপচাপ বসে আছে। স্বস্তিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়া ফেরদৌস মাফিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার বউকে একটু বুঝিয়ে দিও। আমি সংসারে অশান্তি দেখতে চাই না। সূচনা এই বাড়ির বড় বউ। ভাবী হিসেবে সূচনাকে সম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত ছিল। অতীতের কথা তুলে, অন্যকে মানসিক আঘাত করে যদি কেউ নিজেকে উচ্চ বংশের মানুষ বলে দাবী করে, তাহলে সেটা নিতান্তই তার ভুল ধারণা। কারণ ব্যবহারই বংশের পরিচয়।”

আরিয়া ফেরদৌস কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। এবার মাহাথি স্বস্তিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“যা হওয়ার হয়েছে। স্বস্তিকা, তুমি ছোট মানুষ, হয়তো ভুল হয়ে গেছে। এখন আমরা এই ঘটনাটা ভুলে গেলেই ভালো হবে।”

সূচনা বলল,
“স্বস্তিকা, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু মাফিনের সামনে একটা কথা তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই। আমি হয়তো খুব ধনীর মেয়ে নই, কিন্তু মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো যোগ্যতা আমি নিজেই অর্জন করেছি, আর আমার পরিবারও আমাকে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলার শিক্ষা দিয়েছে। তাই পরের বার এমন কিছু হলে আমি তোমাকে সহজে ক্ষমা করতে পারবো না। একবার কেউ মনে আঘাত করলে সারাজীবন সেই দাগ থেকে যায়। বারবার করার স্পর্ধা করলে মানুষটার প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয়। আর যাই-হোক আমরা যাকে ঘৃণা করা শুরু করি, তার সাথে একই ছাদের নিচে অন্তত থাকা সম্ভব হয় না।”

মাফিন কথাটি শুনে বলল,
“ভাবী, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি এভাবে বলো না, প্লিজ। দোষ হয়তো আমারই। মেয়েটাকে আমি বোঝাতে পারি নি আমার কাছে তোমরা কতো গুরুত্বপূর্ণ।”

স্বস্তিকা ছলছল চোখে মাফিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাফিন স্বস্তিকার বাহু চেপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় মহুয়া বলল,
“ভাইয়া, ভাবীকে কিছু বলো না।”

মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বললো,
“আসছে, মহুয়া দি গ্রেট, মহিয়সী বালিকা। কিছু বলবে না তো কি চকোলেট খাওয়াবে আদর করে?”

মাফিন রুমে এসে স্বস্তিকাকে এক ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। স্বস্তিকা ফুঁপিয়ে উঠলো। সে কিছু বলতে যাবে মাফিন তার গাল চেপে ধরে বলল,
“আরেকবার যদি তুই আমার পরিবারের কারো সাথে বাজে ব্যবহার করেছিস, আমি তোকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমার বাসা থেকে বের করে দেবো।”

স্বস্তিকা মাফিনের হাত ধরে বলল,
“মাফিন, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি ভাবীকে কষ্ট দিতে চাই নি। আমি একটু রেগে গিয়েছিলাম। মাফিন, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।”

“তোর মতো মেয়েকে ভুল না বুঝে কি করবো! তোকে বিয়ে করেই ভুল করেছি। সামান্য চকোলেটের জন্য তুই এতো বড় কান্ড করলি। ছি! তুই একটা সাইকো। দাঁড়া আজ তোকে চকোলেট খাইয়ে আমার শান্তি হবে।”

মাফিন হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। স্বস্তিকা ভয়ে কুঁকড়ে মেঝেতে বসে আছে। আর বিড়বিড় করে বলছে,
“আল্লাহ, আমি রাগ করে বলে ফেলেছি। আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। ভাবী তো আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। মাফিন আমার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন?”

প্রায় ত্রিশ মিনিট পর মাফিন রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। এরপর একটা প্যাকেট থেকে এক গাদা চকোলেট বের করে বিছানার উপর ফেললো। স্বস্তিকার হাত চেপে ধরে বলল,
“তুই এখনি এই সব চকোলেট এখানে বসে খাবি।”

স্বস্তিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“সরি। সরি বলছি তো। আর হবে না। আমি ভাবীকে কষ্ট দিতে চাই নি। আমি তো আপনি এনেছেন মনে করে…”

“চুপ অসভ্য মেয়ে। তুই এখন খাবি? নাকি আমি জোর করে খাওয়াবো?”

স্বস্তিকা মাফিনের রাগী দৃষ্টি দেখে ভয়ে ভয়ে এক পাশে বসে একটার পর একটা চকোলেট খেতে লাগলো। চারটা খাওয়ার পরই সে থেমে গিয়ে বলল,
“আর করবো না আমি।”

মাফিন এবার স্বস্তিকার গাল চেপে ধরে তাকে জোর করেই সব মুখে ঢুকিয়ে দিতে লাগলো। শেষমেশ সে আর হজম করতে না পেরে গলগল করে বমি করে দিলো। এরপর মাফিন নিজেই স্বস্তিকাকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে তার মাথার উপর পানি ঢেলে দিয়ে বলল,
“এসব অভিনয় করে তুমি যদি আমার সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করো, তাহলে তুমি সেটা কখনোই পারবে না। বিয়ে করে তুমি আমার বস হয়ে যাও নি। বউ হয়ে এসেছো, বউয়ের সম্মান নিয়ে চলবে।”

কথাটি বলেই মাফিন রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। সারারাত সে ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে বসে রাত কাটিয়েছে। এদিকে স্বস্তিকা সারারাত কেঁদেছে। শুধুমাত্র বড় ভাবীর জন্য মাফিন তাকে এতো কষ্ট দিয়েছে, তা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। এই ঘটনার পর স্বস্তিকার মনে সূচনার প্রতি ক্ষোভ আরো বেশি বেড়ে উঠেছে। সে মনে মনে ভাবছে,
“মাফিন কি আমার চেয়ে বেশি সূচনা ভাবীকে ভালোবাসে? কি এমন করেছে ওই মহিলা আমার স্বামীকে! ভাবীর প্রতি এতো ভালোবাসা? আমি দোষী হলেও মাফিনের আমার পক্ষে থাকা উচিত ছিল। কারণ আমি ওর স্ত্রী।”

স্বস্তিকার নেতিবাচক মানসিকতা যেন তাকে আঁকড়ে ধরে ফেলেছে। এই প্রভাবটা আজ শুধু একটা বীজ বোনে দিয়েছে। এর শিকড় কতোটুকু গিয়ে সমাপ্তি ঘটায় তার কোনো ধারণায় হয়তো কারো কাছে নেই। নেতিবাচক মনোভাব আসলেই ভয়ংকর। আলবার্ট আইনস্টাইনের একটা উক্তি আছে,
“নেতিবাচক লোকেদের কাছ থেকে দূরে থাকা উচিত, তাদের প্রতিটি সমাধানের জন্যই একটি সমস্যা রয়েছে।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here