#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫৬ (১ম অংশ):
৯১।
মাহাথির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সূচনা। তার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। চুলগুলোও এলোমেলো হয়ে আছে। অনেকদিন হলো সে ঠিকমতো ঘুমোতে পারছে না। কিন্তু তবুও তার ঘুম না হওয়ায় কোনো আফসোস নেই। কারণ তার উপর এখন ভারী দায়িত্ব পড়েছে।
কন্সিভ করার পর থেকে সূচনার অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারে না, আবার খেতেও পারে না। আর মাহাথি একাই সূচনার যত্ন নিয়ে যাচ্ছে। এখনও সে বসে বসে সূচনার রিপোর্ট ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সূচনা বিছানা থেকে উঠতেই মাহাথি ফাইলগুলো রেখে সূচনার দিকে তাকালো। আর ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“কি লাগবে তোমার? আমাকে বলো, আমি এনে দিচ্ছি।”
সূচনা মুচকি হেসে মাহাথির দিকে এগিয়ে আসতে যাবে তার আগেই মাহাথি এসে তাকে আবার বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখন শুধু আমাকে ইশারা করবে। আজ এমনিতেই সারাদিন যা হাঁটাহাঁটি করার করেছো। এখন কিন্তু বিশ্রামের সময়।”
“তোমারও তো বিশ্রাম নেওয়া দরকার।”
“আমার বিশ্রাম নিতে হবে না। এখন শুধু পুটুসের আম্মু বিশ্রাম নেবে। আর পুটুসের আব্বু পুটুস আর তার আম্মুর সেবাযত্ন করবে।”
সূচনা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“পুটুস আবার কে?”
মাহাথি দাঁত বের করে হেসে বলল,
“আমাদের বাবু!”
সূচনা চোখ বড় বড় করে বলল,
“তুমি আমাদের বাবুর নাম পুটুস রাখবে?”
“হ্যাঁ, সুন্দর না?”
“একদমই না মাহা। তুমি আমাকেও সারাজীবন উল্টোপাল্টা নামে ডেকে এসেছ, সূচনা বলেও কখনো ঠিকভাবে ডাকো নি। এখন আমাদের বাচ্চাকে কিন্তু এসব উদ্ভট নাম দেওয়া যাবে না!”
“পুটুস নামটা তোমার উদ্ভট লাগছে? আচ্ছা, বেনু নামটা সুন্দর, তাই না?”
সূচনা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“এসব বেনু-টেনু রাখার চেষ্টা করবে না। আমাদের বাবুর নাম হবে সোয়াদ অথবা মায়াদ। মেয়ে হলে সোয়াদ, ছেলে হলে মায়াদ।”
“তুমি ডেকো সোয়াদ আর মায়াদ নামে। আমি তো পুটুস বলেই ডাকবো।”
সূচনা গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই মাহাথি সূচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আচ্ছা, এসব পরে দেখা যাবে। এখন তুমি গাল ফুলিয়ে রাখলে বাবু কিন্তু মনে করবে বাবা মাকে খুব রাগায়।”
“মনে করলে করুক। বাবুর জানা উচিত, তার বাবার পছন্দ কতো ইয়ু।”
মাহাথি কপাল কুঁচকে বলল, “ইয়ু!”
“মানে পঁচা।”
“তাহলে বাবুকে জিজ্ঞেস করো তো, বাবুর মাও কি ইয়ু?”
সূচনা রাগী কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে ইয়ু বলছ?”
“কারণ তুমিও তো আমার পছন্দের ছিলে।”
সূচনা মুচকি হেসে বলল,
“জীবনে শুধু ওই একবারই ভালো কিছু চোখে পড়েছিল। এরপর থেকে তো অন্ধই হয়ে গেছো!”
মাহাথি সূচনার কথা শুনে হেসে বলল,
“তোমার সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, তাই এখন আর চোখে ভালো কিছু দেখি না।”
সূচনা মাহাথির কথা শুনে মুচকি হাসলো। আর মাহাথি সূচনার কোলে মাথা রাখলো। তারা এখন তাদের পুটুসকে নিয়েই ভাবছে। একটা সময় তারা একে-অপরকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছিল, এখন তাদের স্বপ্নে নতুন অতিথির আগমন হয়েছে। এখন সেই স্বপ্নে সূচনাকে সাদা শাড়িতে দেখা যায় না, সূচনা এখন সাদা সেলোয়ার-কামিজ পরেছে। তার হাতে এক গুচ্ছ চুড়ির পরিবর্তে একটা কালো ঘড়ি, খোঁপায় বেলী ফুলের পরিবর্তে মোটা ক্লিপ। তবে চোখে হালকা কাজল এখনো আছে। মাহাথির গায়ে পাঞ্জাবির পরিবর্তে সাদা শার্ট। আর তাদের দু’জনের দু’হাত ধরে রেখেছে সাদা ফ্রক পরা একটা ছোট্ট পরী।
সূচনা মাহাথির কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
“মাহা, আমি আমাদের পরীর অপেক্ষায় আছি।”
মাহাথি ঘুম-ঘুম কন্ঠে বললো, “আমিও।”
প্রহরের আলাদা লাইব্রেরি রুম আছে। মারিয়া অনেকবার সেই রুমে গিয়েছিলো, কিন্তু কখনোই জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে নি। মারিয়ার বই পড়ার ব্যাপারে ওতোটা আগ্রহ নেই। তাই সে প্রহরের বইগুলো কখনোই স্পর্শ করে দেখে নি। আজ প্রিয়া আর প্রহর দু’জনই তাদের ফুফুর বাসায় গিয়েছে। আর তাদের ফিরতে ফিরতেও রাত হয়ে যাবে। মারিয়াকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে ইচ্ছে করেই যায় নি। এদিকে খালেদ হোসেন এবং মাসুমা আকতার নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাই মারিয়া সময় কাটাতে প্রহরের লাইব্রেরি রুমটাতে ঢুকলো।
রুমটা তেমন বড় নয়। রুমের চারপাশে তাক, আর প্রতিটি তাকেই বইয়ের সারি। রুমটাতে ফ্যান নেই, শুধু একটা বাতি লাগানো আছে। প্রহর খোলামেলা স্থানে বই পড়তে পছন্দ করে। তাই সে এই ঘরে বসে বই পড়ে না। কারণ ঘরে একটাও জানালা নেই। খালেদ হোসেন বাড়ির তৈরীর সময় আলাদাভাবে এই রুমটি বানিয়েছিলেন। তবে আগে এই ঘরটি অকেজো জিনিসপত্র রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। পরে প্রহর সেটিকে নিজের লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলে। বই সংগ্রহ করা তার নেশা ছিল। স্কুল থেকেই সে বই সংগ্রহ করে এসেছে, আর সব বই জায়গা পেয়েছে এই ছোট কক্ষে।
মারিয়া বইগুলো দেখে মনে মনে বললো,
“এতোগুলো বই পড়ার পর প্রহর এখনো সুস্থ আছে, এটাই অনেক। আমি এতোগুলো বই পড়লে তো আমাকে খুঁজেই পাওয়া যেতো না। হয়তো কোনো মেন্টাল হস্পিটালেই আমাকে ভর্তি করানো হতো।”
বইগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা তাকে একটা নীল মলাটের বই চোখে পড়লো। মারিয়া বইটা হাতে নিয়ে দেখলো, মলাটের উপর রং-তুলি দিয়ে একটা মেয়ের ছবি আঁকা। মেয়েটি বই হাতে চেয়ারে বসে আছে। আর সাদা আকাশের ফাঁকে রংধনু দেখা যাচ্ছে। মারিয়া বইটি খুলতেই চমকে উঠলো। কারণ সেটি কোনো বই ছিলো না। ছিলো একটা ডায়েরী। আর ডায়েরীর প্রথম পৃষ্ঠায় দোয়াতের কালী দিয়ে লেখা, “মায়াবতী।” নিচে ছোট করে কলমের কালী দিয়ে লেখা “প্রহরের মায়াবতী।” তারিখটা ঠিক দুই বছর আগের। হঠাৎ মারিয়ার মনে অজানা আতংক ভীড় করলো। সে ভয়ে ভয়ে পরের পৃষ্ঠা উল্টালো। সেখানে লেখা,
“আজ প্রথম কোনো ললনা, আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে। আমার দৃষ্টি প্রথম কোনো স্নিগ্ধ বেলীফুলের উপর পড়েছে। সাদা রংটি আমার খুব প্রিয় ছিলো। আজ তাকেও সাদা রঙেই দেখেছি। আর এখন এই রং-টি শুধুই আমার প্রিয় নয়, বরং ভীষণ ভালো লাগার মতো রং হয়ে গেছে।”
“অনেকদিন ধরেই ভাবছি তাকে কি নাম দেওয়া যায়! আজ পেয়েই গেলাম, আমার মায়াবতী।”
মারিয়া দুই পৃষ্ঠা পড়েই ঘেমে গেলো। কয়েক ফোঁটা ঘাম কপাল বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। তার গলাটাও শুকিয়ে গেছে, সে শক্ত করে ডায়েরীটা আঁকড়ে ধরে রইলো।
পরের পৃষ্ঠায় লেখা ছিল,
“আকাশে তারার মেলা,
বইঘরে কৃত্রিম আলোর খেলা,
মাঝখানে তুমি জ্যোৎস্না হয়ে দাঁড়িয়ে,
আমি অদ্ভুত তোমার রূপের মাঝে হারিয়ে।”
পরের পাতায় লেখা,
“এক পড়ন্ত বিকেলে নিস্তব্ধতার মাঝে তাকে দেখেছিলাম।
সেই মিষ্টি চাহনির মাঝে সেদিনই ডুবেছিলাম।
তাকে ধীরে ধীরে অনুমতি ছাড়াই মনে বেঁধেছিলাম।”
মারিয়া আর ধৈর্য রাখতে পারছিলো না। সে কয়েক পাতায় এমনিতেই চোখ বুলিয়ে গেলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো, একটি লেখায়।
“চাঁদনি রাতে হঠাৎ দেখা।”
মারিয়া লেখাটি দেখেই চমকে উঠলো। আর মনে মনে বললো,
“মহুয়া সেদিন বলল, প্রহর তাকে কবিতা শুনিয়েছিলো। তাহলে কি এটাই সেই কবিতাটি?”
মারিয়া কবিতাটি পড়তে লাগলো।
“চাঁদনি রাতে হঠাৎ দেখা,
তুমি সাদা শাড়িতে শুভ্র মেঘা,
চাঁদনি রাতে হঠাৎ দেখা,
তুমি এঁকে দিয়েছো প্রেমের রেখা,
চাঁদনি রাতে হঠাৎ তুমি
এসেছো মন-দুয়ারে,
চাঁদনি রাতে দেখছি আমি
তুমি নেই কোনো আড়ালে।
ছড়িয়ে দিয়েছি প্রতিটি রং নীল আকাশের মাঝে,
চাঁদনি রাতে রংগুলো সব লুকালো তারার ফাঁকে।”
কবিতাটি পড়তে পড়তেই মারিয়ার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এই কবিতা প্রহর মহুয়াকে কেন শুনিয়েছে? এমন কবিতা শুনার অধিকার তো মারিয়ার! তাহলে এসব মহুয়া কেন শুনবে! মারিয়া কাঁপা হাতে কয়েক পাতা উল্টাতেই বাতিঘর শব্দটি দেখে চমকে উঠলো।
সেই লেখা পড়ে মারিয়া বুঝলো, প্রহর এই ডায়েরীতে যা লিখেছে, সব সেই বাতিঘরে দেখা মেয়েটির জন্য লিখেছে। এরপর বান্দরবান থেকে এসে প্রিয়ার দেওয়া ভুল তথ্য, প্রহরের তার মায়াবতীকে মেসেজ দেওয়া, এরপর বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো। তারপর ভুল মানুষের সাথে বিয়ে এসব নিয়ে বিস্তর লেখা। এরপর বিয়ের পর সাজেকে গিয়েও সে তার মায়াবতীকে নিয়ে লিখেছে। মাফিনের হলুদের দিনও প্রহর তার মায়াবতীর হলুদ সাজের বর্ণনা লিখেছে, কাব্যিক ভাষায়।
“তুমি সূর্যমুখী ফুলের মতোই শান্ত,
তোমার খোঁপায় মুগ্ধতার গন্ধ।
তোমার হাসিতে ছেয়ে গেছে স্নিগ্ধতা,
আমি নিজেকে আটকে রেখেছি, কারণ তোমাকে পাওয়া দুঃসাধ্য।”
মারিয়া ডায়েরীটা বন্ধ করে ফেললো। ওটাই প্রহরের শেষ লেখা ছিল। এরপর সে আর কিছুই লেখে নি। মারিয়া কাঁপা শরীরে নিজের ঘরে চলে এলো। রুমে এসে চুপচাপ মেঝেতে বসে রইলো। চোখ বন্ধ করতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মনে মনে বললো,
“আমি তো কখনোই প্রহরের পছন্দের ছিলাম না। প্রহর তো আমাকে বিয়েই করতে চায় নি। ও তো মহুয়াকেই ভালোবাসতো। আর এখনো তো মহুয়াকেই ভালোবাসে। তাহলে কি মহুয়াও প্রহরকে পছন্দ করে? ওরা কি আমাকে মিথ্যে বলছে? ওরা দু’জন কি আমাকে ঠকাচ্ছে? আমার চান্দু, কিভাবে আমাকে ঠকাবে? না, না, ও তো আমাকে খুব ভালোবাসে। মহু, আমার সাথে এমন করবে না। কিন্তু যদি সত্যিই মহুয়াও প্রহরকে ভালোবেসে ফেলে! তখন আমার কি হবে? আমি একা একা কিভাবে থাকবো? মায়ের মতো আমাকেও কি সারাজীবন একা থাকতে হবে? আমি তো মায়ের মতো শক্ত না। আমি তো ভেঙে যাবো। আমার সাথেই বা কেন এমন হলো! আমি তো ভালোবেসে বিয়ে করি নি। বরং বিয়ের পরই তাকে ভালোবেসেছি।”
চলবে-