রজনী #শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-৮

0
360

#রজনী
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮

সেখানে উঁকি দিতেই আমার গায়ের লোম শিউরে উঠল। কারণ সুন্দন কুন্দমালাকে শুইয়ে কী যেন বিড়বিড় করছে। কুন্দমালাকে দেখেই মনে হচ্ছিল সে অচেতন। এ অবস্থায় কী হতে চলেছে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। সুন্দনের সামনে একটা আলোকবিন্দু জ্বলে উঠল। আলোকবিন্দুটা জ্বলার সাথে সাথে সব যেন নড়ে উঠল। আমি ভীত হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। কোন এক গায়েবি আওয়াজ বলে উঠল

– আমাকে তুষ্ট করতে পারলে তোকে আমি সমস্ত ক্ষমতা দিব, তুই শুধু এ রাজ্য না বরং পুরো দুনিয়া এ কালোজাদুর বলে পরিচালনা করতে পারবি৷ সে সাথে পাবি অমরত্ব।

সুন্দন নম্র গলায় হাত জোর করে বলে উঠল

– প্রভু আমাকে সে পথ বলুন। কী করলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন বলুন। আপনার জন্য আমি আমার প্রিয়তমাকে বলি দেওয়ার জন্য হাজির করেছি। এর আগেরবার আপনি বলেছিলেন পৃথিবীতে বর্তমানে যাকে আমি ভালোবাসি তাকে বলি দিলে আপনি তুষ্ট হবেন। অনেক ভাবনার পর মনে হলো আমি কুন্দমালাকে ভালোবাসি অনেক। আর তাকে আপনার জন্য বলি দিতে নিয়ে এসেছি। আমি জানি কুমারী বলি দিলে আপনি তুষ্ট বেশি হবেন। এজন্য কুন্দমালার প্রতি সকল ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে আমি ওকে বলি দিতে নিয়ে এসেছি। এর আগে আমি আমার বাবা, মা কে ও আপনার জন্য বলি দিয়েছি। আপনি বলেছেন মোট পাঁচটি বলি দিতে পারলে আমি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হব। আমার চতুর্থ বলি কে বলুন?

বিকট শব্দে বলে উঠল

– আগে আমার সামনে কুন্দমালাকে বলি দে। বলি দেওয়ার পর তোর চতুর্থ বলি কে হবে সেটা বলে দিব।

সুন্দন আর কিছু চিন্তা না করেই একটা ধারালো দা দিয়ে কুন্দমালার গলা বরাবর চালিয়ে দিল। গলাটা দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। সে সাথে রক্ত ছিটকে পড়ল। ঘটনা দেখেই আমার বুক কেঁপে উঠল। নিজের মুখ নিজে চেপে ধরলাম। কারণ কী হবে পরিষ্কার বুঝতে না পারলে আমাকে হয়তো পরবর্তীতে আরও বিপদে পড়তে হবে। আমি শক্ত যেমন তেমনি নরম মনের অধিকারী। অপরাধীকে শাস্তি দিতে আমার বুক কাঁপে না। তবে একটা নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি পেতে দেখে আমার বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠে। কুন্দমালার এ অবস্থা আমাকে যথেষ্ঠ ব্যহত করেছিল। আর যাইহোক এতে তো কুন্দমালার দোষ ছিল না। সুন্দনকে সে ভালোবাসতো আর সে ভালোবাসার মানুষের হাতে বলি হবে সেটা তো সে জানত না। অদৃষ্ট বড়ই নিষ্ঠুর।

আমার বুকের ভেতরটা মুচরে উঠছিল বারবার। এদিকে সুন্দন কু্ন্দমালার গড়িয়ে যাওয়া রক্ত একটা মাটির পাত্রে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কী যেন পাঠ করল। তারপর রক্তটা আলোকবিন্দু বরাবর ছুরে মারল। ছুরে মারার সাথে সাথে গায়েবি আওয়াজটা পুনরায় বলে উঠল

– তোর এ বলিতে আমি তুষ্ট। তোর চতুর্থ বলি হবে তোর ছেলে সন্তান।

সুন্দন কিছুটা অবাক হয়ে বলল

– আমার তো এখনও সন্তান হয়নি। আমার স্ত্রী গর্ভবতী তার সন্তান হয়তো হবে। তবে সে সন্তান ছেলে কী না সে টা তো আমি জানি না। যদি আমার ছেলে সন্তান না হয় তাহলে কী আমি ক্ষমতা পাব না?

সন্তান বলি দেওয়ার কথা শুনে আমার বুকটা আরও কেঁপে উঠল। তার উপর সুন্দনের সহজভঙ্গিতে কথা বলাটা আমাকে আরও ব্যহত করল। তার কথায় বুঝা যাচ্ছে সে এ ক্ষমতার জন্য নিজের সন্তান বলি দিতে পিছ পা হবে না৷ আমার হাত পা তখন কাঁপছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না এখন, যাতে করে আমি বিপদে পড়ি। তাই মনস্থির করে তাদের কথোপকথন শুনতে লাগলাম। গায়েবি আওয়াজটা বলে উঠল

– তোর স্ত্রী এর ছেলে সন্তান হবে। আর সে ছেলে সন্তান যেদিন জন্ম নিবে সেদিন তাকে হত্যা করবি। তার ঠোঁট দুপাশে দুদিকে সেলাই করে দিবি। কালো কিছু পাথর দিব সেগুলো তার দাঁতের পাটিতে লাগিয়ে দিবি তারপর গালে আমার নির্দেশ দেওয়া চিন্হগুলো এঁকে মৃত দেহটাকে পানিতে ভাসিয়ে দিবি।

– আপনি যা বলবেন তাই হবে। এ ক্ষমতার জন্য আমার সন্তান বলি দিতেও আমি পিছ পা হব না। প্রভু আপনার দেখা আমি কবে পাব? আপনাকে কবে সামনাসামনি দেখতে পারব। আমি যে আপনাকে দেখতে চাই। আপনার দর্শন চাই।

– আমাকে তুই পঞ্চম বলির পর দেখতে পারবি। যেদিন তোকে আমি সমস্ত ক্ষমতা দিব সে সাথে অমরত্ব দিব সেদিন।

– আমার পঞ্চম বলি কে সেটা কী আমাকে জানানো যাবে? দীর্ঘ তিন বছর আপনার আরাধনা করেছি। আপনার কথা মতো নিজের মা বাবাকে বলি দিয়েছি সে সাথে বলি দিয়েছি নিজের প্রিয়তমাকে। আপনি বলেছেন রজনীকে বিয়ে করতে আমি সেটাও করেছি। আপনি বলছেন আমি যেন আমার সন্তানকে বলি দিই আমি সেটাও করব। তবে এ বলি দেওয়ার কয়দিন পর আমাকে পঞ্চম বলি দিতে হবে এবং আমি আমার ক্ষমতা পাব। প্রভু দয়াকরে আমাকে বলুন।

– এত অস্থির হওয়া ঠিক না। তবে এতটুকু তোকে জানিয়ে রাখি। তোর নিকট ক্ষমতা আসতে চলেছে অতি শীঘ্রই। কারণ তোর ছেলেকে বলি দেওয়ার সাতদিন পর তোর স্ত্রী রজনীকে বলি দিতে হবে। তারপর তোর কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতা তোর হাতে আসবে। সাবধান কাজে যেন কোনো ভুল নাহয়।

– আপনি যা বলবেন তাই হবে। আমাকে শক্তি দিন আমি যেন আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারি।

বলার সাথে সাথে আলোকবিন্দুটা মিলিয়ে গেল। সুন্দন কুন্দমালার লাশটা কেটে টুকরো টুকরো করে একটা লাল কাপড়ে পেঁচিয়ে নিল। আমি এসব দেখার পর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। তবুও অনেকটা সামলে স্থির হয়ে ঘরে এসে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজছিলাম। সুন্দনকে কোনো মতেই দমানো যাবে না। তবে কৌশলে ওর হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে হবে। আমি আমার ঘরে এসে এসবেই ভাবতে লাগলাম। সারা শরীরে আমার অস্থিরতা। এ সমস্যার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিলাম। ভাবনার শেষ প্রান্তে একটা ফয়সালায় আসে সেটা হলো সুন্দনকে খুন করা। কারণ সুন্দনকে খুন করলেই আমার সন্তান আর আমি মুক্তি পাব। সে সাথে মুক্তি পাবে এ দুনিয়া। আর এখন এ রাজ্যের ক্ষমতা আমার হাতে নেই তাই চাইলেও সুন্দনকে আমি মৃত্যুদন্ড দিতে পারব না। কারণ প্রজারা সুন্দনের আদেশ শুনবে আমার আদেশ শুনবে না। আমি অনেকটা মনস্থির করলাম সুন্দনকে খুন করার জন্য। কিন্তু আমার অদৃষ্টে লেখা ছিল ভিন্ন। সেদিনেই আমার প্রসব ব্যথা শুরু হয় তীব্র হয়ে। আমি ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠি। দাসীরা আমাকে এসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। দায় আসলো আমার সন্তান প্রসবে সাহায্য করতে। আমার বুকটা কেঁপে উঠছিল। সন্তান জন্ম দেওয়ার আনন্দের চেয়ে সন্তান বাঁচাবার জন্য চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। আমি আমার সবচেয়ে কাছের দাসী সর্ববীরে বললাম

– আমার সন্তান জন্ম হওয়ার সাথে সাথে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেও। আমার এ সন্তানকে আমার স্বামী খুন করে দিবে। এ মুহুর্তে সুন্দনকে মৃত্যুদন্ড বা খুন করার আদেশ দিতে পারছি না। আমার হয়ে তুমি রাজ্যে আদেশ দিলেও সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমার সন্তানকে তুমি দয়াকরে লুকিয়ে রেখো।

সর্বরী আমার হাত ধরে বলল

– আমি জানি না রাণীমা আপনি কেন একথা বলছেন। তবে আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। আপনার চাওয়ার বাইরে কিছু হবে না। আপনার সন্তানকে আমি আগলে রাখার চেষ্টা করব। সন্তান জন্ম হওয়ার পরপরই আমি তাকে নিয়ে পেছন কপাট দিয়ে পালিয়ে যাব।

আমি ব্যথায় কুকরাতে লাগলাম। দীর্ঘ ১ ঘন্টা ব্যথার পর আমার কানে আমার ছেলের কান্নার আওয়াজ আসলো। আমি নিস্তেজ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার বাচ্চাটা রক্ষা পেল না সুন্দনের হাত থেকে। আমার ছেলেটাকে সে বলি দিয়ে দিয়েছে সেদিনেই। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর আমি নড়তে পারছিলাম না। এ মুহুর্তে নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তিও তাকে দিতে পারছিলাম না। আমি জানি সে আমাকে সাতদিন পর বলি দিবে। এর মধ্যে সে আমাকে মারবে না নিজের স্বার্থের জন্যই। এদিকে আমার শরীর ক্লান্ত। সন্তান হারানোর বিয়োগ যন্ত্রণা আমাকে আরও ক্লান্ত করে ফেলল। অবশেষে আমি না পেরে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here