রজনী #শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব- ৭

0
272

#রজনী
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৭

সেদিন তোহা যখন ভুলক্রমে আতরের পরিবর্তে গোলাপজল দিয়ে দেয় সাথে সাথে সে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। কিছুটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখল এক নববধূ দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার অবয়ব দেখা গেলেও মুখ স্পষ্ট না। তোহা বুঝতে পারছিল না সে কে! এমন কিছু হবে সাধু তো বলেনি। সে কিছুটা ভীত সংকিত। কী থেকে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। হুট করেই ঘরটা কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছিল প্রবল মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে। সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। বুঝতে পারছিল এটা ভূমিকম্প না। তবে কী হতে চলেছে সেটা তার আয়ত্ত্বের বাইরে। ঠিক এমন সময় তার সামনে একটা বাচ্চা আসলো। বাচ্চাটাকে দেখে সে ভয়ে কাঁপতে লাগল। একটা বাচ্চা এত হিংস্র কী করে হয় সে ভাবতে লাগল। বাচ্চাটার দুই ঠোঁট দুদিকে উল্টিয়ে সেলাই করা। দাঁতগুলো কালো বিভৎস। তোহা ভয়ে কু্ঁকড়ে যেতে লাগল। ভয়ে ভয়ে বলল

– আমি তো এমন চাইনি এটা কিসের বাচ্চা! কীভাবে আসলো!

এমন সময় তোহার কানে নববধূর বিকট হাসি ধেয়ে আসলো। হতচকিয়ে তোহা সামনের দিকে তাকাল। নববধূর রূপ এবং অবয়ব স্পষ্ট হলো নিমিষেই। সে খেয়াল করে দেখল নববধূ দাঁড়িয়ে আছে তার রূপ ধরে। সে কিছুটা বিলম্বিত সুরে বলে উঠল

– কে তুমি?

নববধূর কান্নার রোল ভেসে আসলো তোহার কানে। তোহার ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। কান্নাটা এত প্রখর যে তার মাথা ধরে যাচ্ছিল। সহ্যের ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল। এ শব্দ সে মোটেও সহ্য করতে পারতেছিল না। তাই চেঁচিয়ে বলে উঠল

– কান্না থামাও… কে তুমি? কেন আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছো? কী করেছি তোমার।

এমন সময় বাচ্চাটা তোহার শরীরে ঝাপঁটে পড়ল। ঘাড়ের এক পাশ কামড়ে ধরল। সে বাচ্চাটাকে জোর খাটিয়ে ধরে দূরে আঁচড়ে ফেলল। ভয়ংকর এ পরিস্থিতি তার মানসিক শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছিল। হাত পা কাঁপতে লাগল। গলার সুরটাও কেঁপে উঠল৷ ভয় ভয় গলায় বলে উঠল

– কে তুমি? কী চাও? আর এ বাচ্চাটা কার? কী হলো কথা কেন বলছো না!

নববধূর কন্ঠ সুর থেকে উচ্চারিত হলো

– আমি রজনী।

তোহা বিস্মিত গলায় বলল

– আমার রূপ কেন ধরে আছো? তোমার সাথে কী আমার কোনো সম্পর্ক রয়েছে?

– কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তুমি আমাকে আসতে বাধ্য করেছো। তোমার ভুল আমাকে প্রতিশোধের আগুনে জ্বালিয়ে মারছে। তোমার এ ভুলের জন্য আমি আবার জেগে উঠেছি। এতে আমার ভালোই হয়েছে কারণ এ পৃথিবীতে প্রতিশোধ নেওয়ার একটা সুযোগ আমার হয়েছে। আমি এখন পূর্বপুরুষের থেকে প্রাপ্ত সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ নিব।

– আমি তো তোমার পূর্ব পুরুষ না। আমার কাছে কেন এসেছো? কী এমন অন্যায় তোমার সাথে হয়েছিল আর এ বাচ্চাটা কার?

রজনীর তীব্র কান্নার রোল আবারও তোহার কানে আসলো। তোহা জোর গতিতে চেঁচিয়ে বলল

– তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি কান্না থামাও প্লিজ। আমাকে বলো তোমার সাথে কী হয়েছিল।

রজনী কন্নাটা থামিয়ে বলল

– আমি ছিলাম আরাধান বংশের প্রথম মেয়ে। আমার রূপ ছিল না। কালো কুচকুচে বর্ণের গায়ের রঙ হওয়ায় আমাকে নাম দিয়েছিল রজনী। রজনীর সমার্থক অর্থ রাত। রাতের অন্ধকারের সাথে গায়ের রঙয়ের বেশ সামান্জস্য থাকায় আমাকে এ নাম দেওয়া হয়। আমার বাবা ছিলেন সবচেয়ে ধনী রাজা। আমি রূপে ছিলাম না তবে গুণে ছিলাম ভরপুর। যুদ্ধবিদ্যা থেকে শুরু করে সকল অশ্রবিদ্যায় মাত্র ষোল বছর বয়সে নিজেকে পারদর্শী করে তুলি। আমার ভাই বোন না থাকায় উত্তারাধিকার সূত্রে আমিই আমার বাবার রাজ্যের ক্ষমতা পাই একুশ বছর বয়সে। আমার তেজ্বদীপ্ত বুদ্ধিতে রাজ্যের অবস্থা আরও উন্নতি হয়। আমি ছিলাম সে সময়ের প্রথম নারী যে রাজ্য পরিচালনা করত। প্রতিটা যুদ্ধ আমার সুকৌশল দক্ষতায় জয় লাভ হতো। বেশ ভালোই কাটছিল সময়। দেখতে দেখতে চার বছর কেটে যায়। রাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এবার সবার ইচ্ছা আমি যেন বিয়ে করি। আমার সন্তানেই তাহলে হবে এ রাজ্যের আগামি উত্তরাধিকার। সবদিক বিবেচনা করে আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই।

কয়েক রাজ্য থেকে আমার জন্য রাজকুমার আসতো বিয়ের জন্য তবে তাদের পছন্দের প্রথম তালিকায় আমি কালো হওয়ায় বাদ পড়ে যেতাম। কেন জানি না সে সময়টায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এ হতাশায় আমাকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং বিচক্ষণ চোখকে অন্ধ করে তুলে।

সে সময়ে তাম্র শাসিত এক রাজার ছেলে নাম সুন্দন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। ছেলেটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম আবেগের উত্তাল যৌবনে যেন আমি পিছলে পড়েছিলাম। এত সুন্দর ছেলের গড়ন তার উপর তার সুমিষ্ট কথার ভঙ্গি নিমিষেই আমাকে ভালোবাসার নদীতে ডুবিয়ে দেয়। তাকে পরখ করার প্রয়োজন অনুভব করেনি। কেন সে আমাকে বিয়ে করতে চায় সেটাও আমার মনে আসেনি। বিচক্ষণ চোখ দিয়ে কোনোকিছু যাচাই না করেই বিয়েতে রাজি হয়ে পড়ি।

বেশ ধুমধামে আমার সাথে সুন্দনের বিয়ে হয়। সংসারটা আমার বেশ ভালোই কাটছিল। বিয়ের তিনমাসের মাথায় আমি গর্ভবতী হই। সে সুবাধে আমি আমার স্বামী সুন্দনকে রাজ্যের দায়িত্ব পদার্পণ করি। তারপর থেকে তার খোলস খুলতে থাকে। সে মূলত আমাকে বিয়ে করেছিল রাজ্যের দায়িত্ব পাবার জন্য। সে সাথে তার একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল নাম কুন্দমালা। তখন আমি সাত মাসের গর্ভবতী ছিলাম। বেশ সুকৌশল অবলম্বন করে সুন্দন আর কুন্দমালার সম্পর্ক টের পাই। দিনকে দিন সব সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল। স্বামী ছিল সে,তার উপর তার প্রতি ছিল আমার অগাধ দূর্বলতা সব মিলিয়ে পারছিলাম না সহ্য করতে। তাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই। নিজেকে সামলে নিই। কারণ এভাবে চললে আমারেই ক্ষতি, এ আবেগ আমাকে আরও কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করবে। তাই চিন্তা করি সুন্দনের হাত থেকে রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। এ ক্ষমতার বলেই সে আমার সাথে এত জঘন্য কাজ করছে। আমি মনোবল স্থির করে সুন্দনকে বললাম এখন থেকে এ রাজ্য আমি পরিচালনা করব। যেহেতু তাকে আমি সাময়িক দায়িত্ব দিয়েছিলাম সেহেতু সেটা কেড়ে নিতে আমার সমস্যা হবে না। আমার কথা শুনে সুন্দন কী যেন ভাবলো। তার কথার সুর পাল্টে গেল। আমার প্রতি থাকা রুক্ষ কন্ঠ ক্রমশেই নরম হয়ে গেল৷ আমাকে বলল সে এমন ভুল আর করবে না। বাচ্চার সাত মাস চলে এ সময় আমার প্রেসার নিলে দুজনের ক্ষতি হবে। তাই সে চাচ্ছিল না আমি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করি৷

তার মোলায়েম কন্ঠে আমি গলে গেলাম। তখন তার গুটির চাল আমি বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পেরেছিলাম তখন বেশ দেরি হয়ে যায়। তখন আমার নয় মাস চলে। ডেলিভারির আর কিছুদিন বাকি। সুন্দনের আচরণও বেশ সুমিষ্ট। তবে এ সুমিষ্ট আচরণের বাইরে ছিল এক ভয়ংকর রূপ যেটা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। সেদিন রাতে আমি চুপ হয়ে বসে ছিলাম পালঙ্কে। সুন্দন এসে জড়িয়ে ধরে আমার কাপলে চুমু টেনে ঘুম পাড়িয়ে দিল। শেষ রাত্রিতে আমার ঘুম ভাঙে। পাশ ফিরে দেখলাম সুন্দন নেই। কী একটা আওয়াজ যেন আসছিল। লক্ষ্য করলাম কারও ফিসফিসের আওয়াজ। আমার বেশ সন্দেহ হলো তার উপর। উঠতে কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পালঙ্ক থেকে নামলাম। আস্তে পায়ে ফিসফিসের উৎস খুঁজতে লাগলাম। আওয়াজটা পাশের পরিত্যাক্ত রুম থেকে আসছিল। আমি আস্তে পায়ে সেখানে গেলাম। সেখানে উঁকি দিতেই আমার গায়ের লোম শিউরে উঠল।

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here