#রজনী
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব – ৯
আমি চিন্তা করলাম আমাকে বলি দেওয়ার পূর্বেই আমিই আত্মহত্যা করব। তাহলে তার চাওয়া কোনোদিন পূর্ণ হবে না। আমার ভাবনার গতি তীব্র হওয়ার আগেই একটা তলোয়ার নিয়ে পেটে ঢুকিয়ে দিলাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে তখন আমার কিছুই হলো না। তলোয়ার আমার পেট ভেদ করলেও কোনো রক্তক্ষরণ বা ব্যথার সৃষ্টি হলো না। বিস্মিত হয়ে পেট থেকে তলোয়ার বের করলাম দ্রূত। বের করার সাথে সাথে একদম স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। কোনো জখমের চিন্হ আমার পেটে পরিলক্ষিত হলো না। আমি বুঝতে পারছিলাম না এমন কেন হচ্ছে! এর মধ্যে সুন্দনের হাসি কানে ভেসে আসলো। বিকট চিৎকার আর হাসি দিয়ে বলল
– তুমি চাইলেও মরতে পারবে না। তুমি এসব জানার পর আত্মহত্যার পথেই বেছে নিবে, সেটা আমার ভাবনায় ছিল। তাই আত্মহত্যা যেন করতে না পারো সেজন্য তোমাকে এমনভাবে বশ করেছি যে আত্মহত্যার যত চেষ্টায় করো তুমি তাতে সফল হতে পারবে না।
সুন্দনের কথাটা শুনে আমার আশার প্রদীপ যেন নিভে গেল হুট করে। কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে সাতদিন পর বলি দিবে আর সে সমস্ত শক্তি পাবে সেটা আমি মানতে পারছিলাম না। নিজের চোখে নিজের সন্তানের খুন দেখেও তার সফলতা আমি কামনা করতে পারছিলাম না মোটেও। চিন্তায় আমার সারা শরীর আরও দু্র্বল হয়ে গেল। উঠার শক্তিটাও আমার হচ্ছিল না। নিজের অজান্তেই হুহু করে কেঁদে উঠছিলাম। আমার সন্তানের মুখ দেখার আগেই আমি তাকে হারিয়েছি। কলিজা ফেটে মরভূমির মতো তপ্ত হয়ে গেছিল।
টানা ছয়দিন আমি কিছু খাইনি, এক ফোটা পানিও না। এতেও আমার মৃত্যু হয়নি। শুধু শরীরটা দুর্বল হয়েছে। কালকে আমাকে বলি দেওয়া হবে আর সুন্দন পাবে ক্ষমতা। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না মোটেও। আমার দাসী শিরুমালা আমার পাশে এসে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল
– আপনার এ হাল আমাকে ব্যথিত করছে। আপনার হাতে কী কোনো উপায় নেই এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার। আপনি চিন্তা করুন অবশ্যই কোনো পথ আপনি পাবেন। এ জীবনে নাহয় প্রতিশোধ না নিয়েই উপায় বের করলেন। তবে রাজামশাইয়ের উদ্দেশ্য সফল হতে আপনি দিবেন না দয়াকরে। আমি জানি আপনি বিচক্ষণ এবং তীক্ষ্ণ বু্দ্ধির অধিকারি আপনি চাইলেই এমন কোনো পন্থা অবলম্ববন করতে পারেন যাতে করে রাজা মশাইয়ের নিকৃষ্ট চাওয়া পূর্ণ না হয়।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– তুমি জানলে কী করে এসব?
– সর্বরী মৃত্যুর আগে আমাকে বলে গেছে। আপনি দয়াকরে কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।
শিরুমালার কথায় আমি একটু সাহস পেলাম। অনেকক্ষণ ভাবলাম কীভাবে এর থেকে মুক্তি আমি পাব। ভাবনার শেষ প্রান্তে গিয়ে ফলাফল আসলো যে আমি তো আত্মহত্যা করতে পারব না তবে কেউ আমাকে খুন করলে নিশ্চয় আমি মৃত্যুবরণ করব। আমি কথাটা ভাবার সাথে সাথে জোর গলায় বলে উঠলাম
– শিরুমালা তলোয়ারটা হাতে নিয়ে আমার গলা থেকে মন্ডুটা আলাদা করে দাও।
শিরুমালা ভয় পেয়ে গেল। ভীত গলায় জবাব দিল
– রাণীমা কী বলছেন এসব? আমি আপনাকে কেন খুন করব?
– এখন এসব চিন্তা করার সময় না। তুমি দয়াকরে তলোয়ার দিয়ে আমাকে শিরচ্ছেদ করো। এটা আমার আদেশ। আমি জানি আদেশ অমান্য করার মতো বেয়াদবি তুমি করবে না। আমি মৃত্যুর পর ওদের প্রতিশোধ নিব।
শিরুমালা ভয় পাচ্ছিল। তবুও তলোয়ারটা কাঁপা হাতে নিয়ে আমার গলা বরাবর চালিয়ে শিরচ্ছেদ করল। সাথে সাথে আমার মৃত্যু ঘটল। আমার মৃত্যুর পর শিরুমালা এক সাধুকে বলে আমার আত্মা পুনরায় জাগ্রত করে। আমিও প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠি। তবে সে জ্বলন্ত লাভা আমার মধ্যে বেশিদিন ছিল না। সুন্দনের চাওয়া পূরণ হয়নি সেটা ঠিক তবে সে পূর্বের বলির জন্য কিছু ক্ষমতার অধিকারি হয়। ফলে আমার আত্মাকে সে একটা ভাঙা বাড়িতে বন্ধ করে রেখে দেয়। এত বছর আমি সেখানে ধুকে ধুকে মরছিলাম। আজ তোমার একটা ভুলে পুনরায় মুক্তি পেলাম। আমার প্রথম কাজ হলো তাসকিনকে হত্যা করা।
তোহা রজনীর কথাগুলো শুনে ঘাবড়ে গেল। ভীত কন্ঠে বলল
– তাসকিনকে হত্যা কেন করতে চাও?
– কারণ এ তাসকিনেই পূর্বজন্মে সুন্দন ছিল।
– তুমি আমার রুপেই কেন ধরেছো বলো?
– আমি যখন যাকে দিয়ে আমার প্রতিশোধ নিব এবং যার শরীরে প্রবেশ করব তখন সে রূপ নিব। এখন আমাকে সাহায্য করো। তাসকিনকে খুন করলেই আমার আর আমার বাচ্চার আত্মা শান্তি পাবে।
তোহা দ্বিমত পোষণ করে বলল
– এটা আমি কখনই পারব না। তাসকিন আমার ছোট ভাইয়ের মতো।
রজনী তোহার কথা শুনে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল
– তাসকিনকে খুন করতে সাহায্য না করলে আমি তোমায় খুন করে দিব। আমার বাচ্চা তোমার দম আটকে দিবে।
বলেই রজনী তোহার গলা চেপে ধরল। দম নিতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। কিছুটা সাহস করে রজনীর হাত ছাড়িয়ে জোরে জোরে দম নিতে লাগল তোহা। হালকা গলায় বলল
– কী করলে তোমার আত্মা শান্তি পাবে? আর মুক্তি পাবে?
– তাসকিনকে খুন করলে। তাসকিনের রক্ত গায়ে মাখলে।
– কিন্তু পূর্ব জন্মের তাসকিন আর এখনের জন্মের তাসকিনের স্বভাব চরিত্র চাওয়া একদম ভিন্ন। তাহলে কেন সে শাস্তি পাবে?
– আমার শুধু তার রক্ত লাগবে আর কিছু না। আমি তার রক্ত দিয়ে গোসল করল। রক্তের সাথে সুগন্ধি মিশিয়ে গায়ে ঢালব৷ তাহলেই আমি আর আমার বাচ্চা শান্তি পাবে। এ বাসার পেছনে যে বট গাছটা আছে সেখানে একটা প্রদীপ আছে মাটির নীচে পু্ঁতে রাখা। সেটা এনে আমাকে দিতে হবে সটা দিয়ে আমি তাসকিনকে খুন করতে পারব। কোনো আত্মার পক্ষে সে বট গাছের নীচে যাওয়া সম্ভব না। তুমি শুধু আমাকে প্রদীপটা আনতে সাহায্য করো।
তোহা ভীত গলায় বলে উঠল
– আমি কখনই নিজের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে সাহায্য করতে পারব না। আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমি আমার ছোট ভাইকে দিতে পারব না। পূর্ব জন্মে যাইহোক এজন্মে সে নির্দোষ। পূর্ব জন্ম দিয়ে এ জন্ম বিচার করা ঠিক হবে না। এটা অন্যায়। তুমি যেভাবে বলো আমি সাহায্য করব তবে কাউকে খুন করতে সাহায্য করতে পারব না।
তোহার কথা শুনে রজনীর রাগটা বেড়ে গেল। পরক্ষণেই তোহাকে শূন্যে তুলে মাটিতে আঁচড়ে ফেলল সে। দৃঢ় কন্ঠে বলল
– তোকেই শেষ করে দিব। আর নাহয় তোর শরীর থেকে আমি মুক্তি পাব না। তোকে শেষ করে তোর শরীর থেকে মুক্তি পেয়ে অন্য কোনো শরীরে ভর করব। যে আমাকে এ কাজে সাহায্য না করবে তাকেই শেষ করব আমি৷
বলেই তোহার গলাটা চেপে ধরল। বাচ্চাটা তোহার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আঁচড় দিয়ে রক্তাক্ত করে দিল তার পুরো শরীর। একটা দঁড়ি এসে তোহার গলা পেঁচিয়ে ধরল। আর সাথে সাথে সে ফ্যানে ঝুলে গেল। তার জিহ্বা গলা দিয়ে বের হয়ে আসলো। চোখ গুলো উল্টে গেল। ছটফট করতে করতে মরে গেল।
তূর্ণা তোহার বর্ণণা শুনে আরও কাঁপতে লাগল। এদিকে আয়েশার দেহটা শূন্যে ভেসে রয়েছে এখনও। তূর্ণা মৃদু গলায় তোহাকে বলল
– এখন যদি তোহা রজনীকে সাহায্য না করে তাহলে তো সে ও মারা যাবে। আর এ মহলের তৈলচিত্রগুলোতে আয়েশার ছবি কেন? তাহলে কী আয়েশা পূর্ব জন্মে রজনী ছিল?
– এমন কিছু না। আয়েশার সাথে রজনীর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে রজনী এখন আয়েশার ভেতর প্রবেশ করেছে আর তার রূপ আয়েশার মতো ধারণ করেছে। সেজন্য তৈলচিত্রগুলোতেও আয়েশার প্রতিচ্ছবি।
তূর্ণার ভয় আরও বেশি কাজ করতে লাগল। তোহার দিকে তাকিয়ে বলল
– আয়েশারকে বাঁচাবার কী কোনো উপায় নেই। রজনীকে মুক্ত করতে হলে তো তাসকিন ভাইয়ের মৃত্যু ঘটবে এদিকে তাসকিন ভাইকে বাঁচাতে গেলে আয়েশার মৃত্যু ঘটবে৷ এটার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কী কোনো উপায় নেই?
তোহার কন্ঠ বিমর্ষ রূপ নিল। অনিশ্চিত গলায় বলে উঠল
– একটা উপায় আছে তবে সে উপায়ে কার মৃত্যু হবে বলা যায় না। এমনও হতে পারে তাসকিন আয়েশার দুজনের মৃত্যু হতে পারে আবার এমনও হতে পারে যেকোনো একজনের মৃত্যু হতে পারে আবার এমনও হতে পারে দুজনেই জিবীত থাকবে। তবে কাজটা যে করবে তারও মৃত্যু ঝু্ঁকি আছে। এ খেলায় আরও মৃত্যু সংখ্যা বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মৃত্যুর আগে চাইলে শেষ উপায়টা কাজে লাগানো যেতে পারে। তুমি কী পারবে তূর্ণা নিজের জীবন বাজি রেখে কাজটা করতে?
তূর্ণার ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল। পৃথিবীর সবাই নিজের জীবনকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। তূর্ণাও তার ব্যাতিক্রম না। তবু খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে বলল
– এ রহস্যে যখন ডুবেছি শেষ চেষ্টা করা যেতেই পারে। বলো কী কাজ?
তোহা কিছু বলতে নিবে এমন সময় আয়েশার শরীরটা মেঝেতে পড়ে মেঝে চৌচির হয়ে ভেতেরের দিকে প্রবেশ করল। পুরো মহলটায় জোরে একটা ঝাকুঁনির সৃষ্টি হলো। তূর্ণা টাল সামলাতে না পেরে আঁচড়ে পড়ে গেল। ঠিক এমন সময় তূর্ণার পায়ে একটা টান অনুভব করল। টানটা এতই জোরে হলো যে তূর্ণা মেঝে ভেদ করে একটা সুরঙ্গে চলে গেল। সে বুঝতে পারছে না কোথায় যাচ্ছে। তবে এটা টের পাচ্ছে ভয়ংকর কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে।
নোট- পূর্বজন্ম বলতে কিছু নেই গল্পের কাহিনি বর্ণণার প্রয়োজনে এমন প্লট আনা।
(কপি করা নিষেধ)