#রজনী
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১০/শেষ পর্ব
তবে এটা টের পাচ্ছে ভয়ংকর কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে। আচমকা বড় একটা ধাক্কা খেল তূর্ণা। কোনো একটা খাদে সে পড়ে গেল। চার পাশ থেকে বিভৎস দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধে তূর্ণার পেট ফুলে যাচ্ছে। তোহাকে আশে পাশেও খুঁজে সে পাচ্ছিল না। আর আয়েশা কোথায় আছে সেটা তার জানা নেই। তূর্ণা একা একা বেশ ভয় পাচ্ছিল। চোখটা বন্ধ করতেও ভয় পাচ্ছে আবার তাকিয়ে থাকলেও যেন বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে কোনো অন্ধকার কূপে সে পড়ে গেছে। সন্নিকটে কেউ হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছে অনুভব করলেও তার চোখে তা স্পষ্ট হচ্ছে না। এমন সময় জোরালো শব্দ ভেসে আসলো তূর্ণার কানে। আয়েশা তার সামনে দাঁড়িয়ে। তীক্ষ্ণ কর্কশ গলায় বলল
– বটগাছের সে প্রদীপটা আমি চাই।
তূর্ণা বুঝতে পারছে আয়েশার ভেতরে রজনীর আত্মা। কিছুটা ভীত সংকিত সে। এ মুহূর্তে রজনীর কথা না শুনলে হয়তো তার ও প্রাণ যাবে। কিছুটা ভীত গলায় বলল
– বটগাছটা কোথায় আমার তো জানা নেই।
রজনী হাতটা ইশারা করে পেছন দিকে দেখাল। পেছনের দিকে খানিক দূরে একটা বড় প্রকান্ড বট গাছ দাঁড়িয়ে। তূর্ণা ভয়ে ভয়ে বলল
– প্রদীপ টা কোথায় পাব?
কর্কশ কন্ঠে উত্তর আসলো
– বটগাছের বড় শিকরের শেষ প্রান্তের মাটির নীচে পুঁতে রাখা আছে সে প্রদীপ।
তূর্ণা কিছু বুঝে উঠার আগেই রজনীর কথামতো সেই বটগাছের কাছে পৌঁছে গেল। চারপাশ থেকে কতশত কান্নার আওয়াজ তূর্ণার কানে ভেসে আসছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তূর্ণার ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল। হার্টবিটের স্পন্দন দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হতে লাগল। কোনো রকমে সমস্ত সাহস সঞ্চালন করে বটগাছের নীচ থেকে মাটি খুঁড়ে প্রদীপটা বের করল। প্রদীপটা হাতে নিতেই তূর্ণার শরীরটা কেঁপে উঠল। সমস্ত শরীর নাড়া দিয়ে উঠল। চোখ মুখ যেন তার ঝলসে উঠল। আন্ধকার জায়গাটায় আচমকা সূর্যের রশ্নির আগমণ ঘটল। সূর্যের রশ্নি এসে তার মুখে পড়ল । রশ্নির লাভা এতটায় প্রখর যে সে জ্বলে যাচ্ছে। মাথার টাল সামলাতে সে পারছে না। কী হতে কী হচ্ছে সেটা তার অন্তরায়। মাথাটা চরম মাত্রায় ঘুরে গেল। হাত থেকে প্রদীপটা পড়ে গেল। সে সাথে সেও হুঁশ হারাল।
এদিকে প্রদীপটা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মাটিতে একটা বলয় সৃষ্টি হলো। বলয়টা কিছুক্ষণ স্থির থেকে গতিশীল হলো। বলয়ের ঠিক মধ্যবিন্দু থেকে একটা তীব্র আলোক রশ্নি বের হয়ে আসলো। সেখান থেকে তাসকিনের অবয়বের মতো একজন বেরিয়ে আসলো। এ অবয়বটায় হলো সুন্দন। যে তার মায়াবলে নিজেকে এ প্রদীপে আবদ্ধ করেছিল। যেদিন এ প্রদীপ মুক্ত হবে সেদিন সে মুক্তি পাবে। এদিকে আয়েশার ভতেরে উপস্থিত রজনীর চোখে মুখে ফুটে উঠল প্রতিশোধের লাভা। বাচ্চাটাও ভয়ংকর বিভৎস রূপ নিল। চার পাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। মনে হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণ হচ্ছে। এসময়টার অপেক্ষায় ছিল রজনী। আজকে লড়াই হবে দু পক্ষের, এক পক্ষ লড়াই করবে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে অন্য পক্ষ লড়াই করবে নিজের বিলীন হয়ে যাওয়া অস্তিত্ব পুনরায় ফিরে পেতে।
তূর্ণার মাথা ব্যথা করতে লাগল। হালকা করে চোখটা খুলল। আধো আধো আলোতে সে আয়েশা আর তাসকিনকে দেখল। আয়েশার পরনে লাল বেমারসি শাড়ি। গা ভর্তি রাজকীয় গহনা। তাসকিনের শরীরে রয়েছে রাজাদের সেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক। তূর্ণা বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। আয়েশা তাসকিনের দিকে এগিয়ে যেতেই তাসকিন আয়েশাকে ধরে জোরে উপরে তুলে নীচে থেঁতলে ফেলল। আয়েশার শরীর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। পরক্ষণেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। আয়েশা পুনরায় আগের রূপে আসলো। তাসকিনের দিকে এগিয়ে যেতেই কাটার মতো কিছু একটায় আটকে পড়ে তার শরীর ক্ষত বিক্ষত হতে লাগল। তাসকিন তীব্র কন্ঠে বলে উঠল
– পূর্বজন্মেও তোর জন্য আমার অমরত্ব হাসিলে ব্যাঘাত ঘটেছে এ জন্মে প্রদীপ থেকে মুক্তি পেয়েও তোর সম্মুখীন হতে হয়েছে। পূর্বজন্মে হয়ে যাওয়া সকল অন্যায়ের শাস্তি আমি তোকে দিব।
আয়েশা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল
– পূর্বজন্ম আমার কোল থেকে আমার সন্তান কে কেড়ে নিয়েছো। আমার জীবনটা অকালে শেষ করতে হয়েছে। আমার আত্মাটা জব্দ ছিল বহু বছর। এ জন্মে তোমার শিরশ্ছেদ করে সে রক্ত দিয়ে গোসল করে নিজের সাথে এবং আমার সন্তানের সাথে ঘটে যাওয়া সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ নিব।
বলতেই আয়েশার চারপাশে যে কাঁটাগুলো ছিল সেগুলো ধরে দূরে আঁচড়ে ফেলল। বাচ্চাটা তাসকিনের ঘাড়ে এসে কামড়ে ধরল। আয়েশা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে কী যেন বিড়বিড় করছিল। এমন সময় তার হাতে একটা তলোয়ার উপস্থিত হলো। সে তলোয়ারটা নিয়ে তাসকিনের দিকে এগিয়ে গেল। তাসকিনের কাছে যেতেই সে আয়েশার হাত থেকে তলোয়ারটা নিয়ে বাচ্চাটাকে ধরে দূরে ফেলে দিল। আর আয়েশাকে তলোয়ারের আঘাত করতে লাগল। যখনই তলোয়ারটা আয়েশার গলা বরাবর চালাতে চাইল ঠিক তখনই আয়েশা তলোয়ারের ধারালো অংশটা হাত দিয়ে চেপে ধরল। আয়েশার হাত কেটে, রক্ত নীচে গড়িয়ে পড়ল। চারদিক ভূমিকম্পের মতো কম্পিত হতে লাগল। তূর্ণা শুধু নীরব দর্শক হয়ে সব দেখছিল। আয়েশার শক্তি যেন সব বিলীন হয়ে যেতে লাগল। চন্দ্রগ্রহণের শেষ সময়ে যদি তাসকিনের শিরশ্ছেদ না করতে পারে তাহলে প্রতিশোধ নেওয়া আর হবে না। আয়েশার ভেতরে থাকা রজনী নিজেকে যতই বাঁচাতে চাচ্ছিল ততই বিলীন হওয়ার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছিল। এদিকে তাসকিন বেঁচে গেলে সুন্দনের আচরণ তার মধ্যে আবার জেগে উঠবে। সে পুনরায় কালুজাদুবিদ্যা দিয়ে নিজেকে অমর করতে চাইবে। আর তার অমরত্বের জন্য আরও শত শত মানুষের বলি হবে। আয়েশার দম ভারী হতে লাগল। তীব্র কন্ঠে তূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল
– তূর্ণা আমি রজনী। আমাকে সাহায্য করো। এ যুদ্ধে আমার শিরশ্ছেদ হলে আয়েশার মৃত্যু ঘটবে। আমি জানি তুমি এরকমটা চাও না।
তূর্ণার শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল। রজনীকে সাহায্য না করলে সে আয়েশাকে হারাবে আর রজনীকে সাহায্য করলে তাসকিনকে হারাবে। একেই বলে উভয় সংকটে পড়া। সে কাকে বাঁচবে বুঝে উঠতে পারছে না। পাশেই রজনীর বাচ্চাটা থুবরে পড়ে আছে। তূর্ণার ভাবান্তর হওয়ার আগেই রজনী বলে উঠল
– দয়াকরে আমাকে সাহায্য করো। ভয় নেই আমি এ যুদ্ধে জয়ী হলে তাসকিনের কিছু হবে না। শুধু তার মধ্যে থাকা সুন্দনের আত্মার বিনাশ হবে। তাসকিনও এ চরম অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। তূর্ণা আর চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। আমাকে বিশ্বাস করো। চন্দ্রগ্রহণের শেষ সময়ে তাসকিনের শিরশ্ছেদ করলে সুন্দনের বিনাশ হবে৷ সময় চলে গেল আর সুযোগ পাব না। দয়াকরে তাসকিনকে একটু ধরো। তোমার পাশেই ধারলো তলোয়ার পড়ে আছে সেটা দিয়ে তাসকিনকে আঘাত করো। সময় নষ্ট করো না।
তূর্ণা নিজেকে সামলে নিল। তেমন কিছু ভাবার সময় সে পাচ্ছে না। আয়েশাকে তার বাঁচাতে হবে। তলোয়ার টা হাতে নিয়ে তাসকিনের হাত বরাবর আঘাত করল। হাতে আঘাত করতেই তাসকিনের হাত থেকে তলোয়ারটা পড়ে গেল। আয়েশা তলোয়ারটা তুলল। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। চন্দ্র গ্রহণের শেষ সময় শুরু হয়েছে। ভূমির কম্পন বাড়তে লাগে। বিদঘুটে আওয়াজ চারপাশ থেকে আসতে লাগল। তূর্ণার মথাটা আবারও ঘুরে গেল। সে মাটিতে পড়ে গেল। আর আয়েশা তলোয়ারটা দিয়ে তাসকিনের গলা বরাবর আঘাত করল। তাসকিনের গলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে ছিটকে পড়ল। রক্ত এসে আয়েশার শরীর লেপ্টে গেল। চন্দ্রগ্রহণের ইতি ঘটল। পাশে পড়ে থাকা বাচ্চাটা মিলিয়ে গেল। আয়েশাও মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল। তার ভেতর থেকে যেন কিছু একটা বের হয়ে আসলো।
চারপাশ বেশ আলোকিত। তূর্ণা আর আয়েশার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কোনো রকম চোখটা মেলে দেখল তারা মাটিতে শুয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখল তাসকিনদের বাসার পাশের রাস্তায় শুয়ে রয়েছে। তাসকিন পাশে বসে আছে। আয়েশা তাসকিনের দিকে তাকাতেই যেন স্বস্তি পেল। শুয়া থেকে উঠে বলল
– তুমি বেঁচে আছো?
তাসকিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল
– এখনও বেঁচে আছি। তবে যা ধকল গেছে মনে হয় এটার রেশ বছর খানেক থাকবে। বাড়ির সবাই মৃত তাসকিনকে জিবীত দেখে কী করবে কে জানে।
তূর্ণা পাশে বসেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার মানে সব ঠিক আছে। কিন্তু তোহা? তোহার কথা মনে হতেই তূর্ণা বলে উঠল
– তোহা কী বেঁচে আছে?
তাসকিন মৃদু সুরে উত্তর দিল
– তোহার ভুল তোহাকে চিরবিদায় নিতে সাহায্য করেছে। সে বেঁচে নেই আর ফিরেও আসবে না।
তারা তিনজনেই উঠে দাঁড়াল। তাসকিনের বাঁচার বিষয়টা আশেপাশের মানুষের কাছে যেন একটা রহস্য বয়ে আনল। প্রায় মাস খানেন তাসকিনকে নিয়ে হৈচৈ ঘটল। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক ও হয়ে গেল।
কেটে গেল তিনমাস। আজকে তাসকিনের সাথে আয়েশার বিয়ে পূর্ণ হলো। তূর্ণার মন থেকে ঘটনার রেশ এখনও যায়নি। মাঝে মাঝে সে ঘটনা মনে করলে যেন তার বুক কেঁপে উঠে।
কেটে গেল আরও দু মাস। রাত তখন তিনটা আয়েশার চোখেমুখে ভয়ার্ত ছাপ নিয়ে উঠে বসল। তাসকিন আয়েশাকে উঠতে দেখে তাকে ধরে বলল
– কী হয়েছে?
আয়েশা দম নিয়ে বলল
– সে বাচ্চাটাকে স্বপ্ন দেখেছি।
তাসকিন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
– কিছু হবে না ঘুমাও।
আয়েশা নিজেকে সামলে শুয়ে পড়ল।।তবে তার অস্থিরতা কেন জানি কমছিল না। রাত পার হয়ে সকাল হলো। সকাল বেলায় রান্না ঘরে যেতেই সে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তাসকিন আয়েশাকে পাজাকোলা করে ঘরে এনে শুয়ালো। ডাক্তার এসে চেক আপ করে জানাল আয়েশা মা হতে চলেছে। আয়েশা কথাটা শুনেও খুশি হতে পারছিল না। তার মলিন মুখের আড়ালে একটায় কথা কানে বাজছে তাহলে কী স্বপ্নটা সত্যি হতে চলল? বাচ্চাটা কী আবার আসতে চলল। রজনীর সমাপ্তি হয়েও কী আবার শুরু হলো?
তাসকিনের কথায় আয়েশার ভাবনায় ছেদ পড়ল। তাসকিন বলে উঠল
– এত মলিন মুখে কী ভাবছো?
আয়েশা সাবলীল কন্ঠে জবাব দিল
– হয়তো যেখানে ঘটনার সমাপ্তি হয় সেখান থেকেই নতুন ঘটনার শুরু হয়।
আয়েশার কথার মানে তাসকিন বুঝে উঠতে পারে নি৷ পুনরায় বলল
– কী হয়েছে?
– কিছু না। সবসময় ভাবনার আড়ালেই কিছু কথা রেখে দেওয়া ভালো।
আচ্ছা ঘটনার কী পুনরাবৃত্তি ঘটবে নাকি সমাপ্তি হবে এ রজনীর অসমাপ্ত কাহিনি।
(কপি করা নিষেধ)