রোদেলা,৩৮,৩৯

0
930

#রোদেলা,৩৮,৩৯
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩৮

আজ রাত আটটায় ছোটমামার ফ্লাইট। বিকাল চারটা অব্দি তা কেও জানতো না। এমনি দূরত্ব দুই ভাইয়ের মধ্যে হয়েছে যে একই বাড়িতে থেকেও তারা কত দূরে।

নোভেল শেষ পর্যন্ত যাবে না বলেই ঠিক করলো। সে নিয়ে বাবা-ছেলে কথা কাটাকাটির সুবাদে জানা যায় যে আজ তারা চলে যাচ্ছে। নোভেল যাবে না কারন এখানে ওর বন্ধু বান্ধব, পরিচিত আত্মীয়, ভালোবাসার মানুষ সব । ঐ বিদেশবিভুঁইয়ে না আছে পরিচিত, না নিজের লোক। তাছাড়া ওর না যাবার ও শক্ত কারণ আছে।

ছোটবেলায় যখন নতুন মাকে বিয়ে করে আনলো ওর বাবা ইদে-চাঁদে, উৎসবে নতুন মায়ের বাবার গ্রামের বাড়িতে প্রতিবছরই তারা যেতেন। গ্রামটা নাকি দেখতে ভীষণ সুন্দর। ওর নতুন মায়ের ঘরে যখন ছোট ভাই পাভেল এলো তাকে নিয়েও তারা গ্রামের বাড়িতে যেতেন। এ বাড়ির নাতাশা, রোদেলা, প্রিসিলা পর্যন্ত গিয়েছে সেই গ্রামে। কিন্তু আজ অবধি নোভেলের সে গ্রামে যাওয়া হয় নি।

ছোট বেলায় ওর নিজের মা চলে যাবার পর নোভেলের দুষ্টামি যেন বেড়েই চলেছিলো দিনের পর দিন। তারপর ওর বাবা বিয়ে করে আনলেন নতুন মাকে। ওর অবাধ্যতা যেন বেড়েই চলেছিলো। ওর এসব সহ্যই করতে পারতো না কেও, শাসন তো করাই যেত না, উল্টো ফুফুর আস্কারা পেয়ে পেয়ে দিন দিন অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে বোডিং স্কুলে দিয়ে দিলো ওর বাবা।

সপ্তাহে একদিন করে দেখতে আসবে এই কথা দিয়েছিলো। কিন্তু প্রথম প্রথম শুক্রবার করে আসলেও, পরে তাও বন্ধ হয়ে যায়। কারন নোভেল বাড়ির কেও এলেই বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে, পিঁছু নেয়। ওকে তখন রেখে আসা মুশকিল হয়ে যায়। তাই সপ্তাহে সপ্তাহে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

তখন পুরো বাড়ি যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো, এক নাসিমা ছাড়া। তারা এদিক সেদিক বেড়াতে যেতো। সবাই সবার স্বাভাবিক জীবনে ব্যাস্ত। নোভেল নামক আপদ ঘর থেকে বিদায়।

এরপর যখন নতুন মায়ের ঘরে পাভেল এলো- তখন ওকে নিয়ে তারা বেড়াতে যেতো, ঘুরতে যেতো। এটাই নিয়ম হয়ে গেলো। একটা সময় যখন বোডিং স্কুল থেকে চলে এলো, তবুও তাদের সাথে যাওয়া হতো না নোভেলের। কারন তার বাবার বাড়ির আত্মীয়রা কেও জানতো না যে ছোটমামার আগে একটা পরিবার ছিলো, সেই ঘরের একটা ছেলে ও আছে।

না বুঝে নোভেল অনেক কাঁদত নানু বাড়ি যাবো বলে। পাভেল যায়, এ বাড়ির সবাই যেতে পারলে ও কেন পারবে না তাই ছিলো ওর ছোট্ট মনের প্রশ্ন। কিন্তু ওকে তারা কখনোই নিতো না। এই কষ্টটা ওর মনে গাঢ় দাগ কেটেছে। আজ ওকে তারাই নিতে চাইছে সাথে করে কিন্তু ও যেতে চায় না। না যেতে চাওয়া দোষের কিছু না। কারন এত বছরে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে বাবা-ছেলের মাঝে, তা এত সহজ ঘোচানো…..!

অবশেষে ছোটমামা রাগ করে ওকে রেখেই ইংল্যান্ডের পাথে পাড়ি জমালো। ওর কাগজপত্র রেখে গেলো। মামার ধারনা ছিলো না যেয়ে ওর উপায় কই। সব বুঝলে আসবেই সুর সুর করে….

শেষমেশ নোভেলের ঠাঁই হলো রোদেলাদের বাসায়। রোদেলাদের মনে যেন অশান্তি শুরু হলো। ওর জন্য কৃষ্ণচূড়া ছেড়েছে ওরা, ওর বাবা-কাকার জন্য ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শেষে ও এসে জুটলো। রোদেলা মুখে কিছু বলে না ঠিকই, কিন্তু মনে মনে ওর অশান্তির শেষ নেই।

ছোট মামা এসব জেনে নাসিমাকে ফোন করে বলে ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিতে। ঐখানে ওর ভবিষ্যৎ কত উজ্জ্বল তা বলে। নাসিমা নোভেলের ভালো চায়, তাই বলে ঠিকাছে ওকে বুঝিয়ে বলবো, যাক কয়েকদিন। পরে ছোট মামা বলে ওকে বলিস- ” কথা না শুনলে সম্পত্তির কানাকড়ি ও ও পাবে না ”

এভাবেই চলে ওদের দিন। এত বড় ছেলে কাজকর্মের ঠিক নাই। দিনের এগারোটা পর্যন্ত পরে পরে ঘুমায়। কি যে বিশ্রী অবস্থা। পরে নাসিমা বলে তুই এখানে এসে খাওয়া দাওয়া করে যাস, রাতে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমাস। কে শোনে কার কথা। ও বলে আমি তোমাদের সাথে থাকবো। তোমরা যদি যাও তবে তোমাদের সাথে আমিও যাবো ঐ বাড়ি।
চলো না ফুফু, ঘরগুলো তো পরেই আছে।

কিছুদিন পর ছোটমামা ও ফোন করে বলে কৃষ্ণচূড়ায় ফিরে যেতে। তাছাড়া এক রুমের বাসা ওদের, হাঁটার একটু জায়গা সেখানে ঘুমায় নোভেল। বিশ্রী অবস্থা। কিন্তু নাসিমা সে বাড়িতে ফিরে যাবে না। যে কষ্ট ও পেয়েছে সে বাড়ির মানুষের কাছ থেকে তা ও জীবণেও ভুলবে না।

এদিকে বড় মামার শরীর হঠাৎ করে ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
হসপিটালে ভর্তি হ’য়েছে দুদিন। টেস্টের রিপোর্ট দিবে আজ সন্ধ্যায়। ডাক্তাররা চিন্তিত, তাকে অবজারভেশনে রেখেছেন। ডাক্তাররা ক্যান্সারের আশংকা করছে। বড় মামী খুবই চিন্তিত, তার সব কূলই ভেঙে গেছে। ছেলে তো থাকতেও নেই, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। দেবরের ঋণ দিতে গিয়ে বাড়ি হারালেন, ননদের কাছেও ঋণী। এখন যদি খারাপ কিছু হয় তাহলে উপায় কি হবে….! এই স্বামীই তার একমাত্র ভরসা।

সন্ধ্যায় ডাক্তারের রিপোর্ট হাতে পেয়ে সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে। ডাক্তাররা যা আশংকা করছে তাই সত্যি হয়ে দেখা দিলো রিপোর্টে। নাতাশা খুবই ভেঙে পরলো এ খবরে। কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালো। কল্লোল বললো চিন্তা করবেন না মা, অনেক সময় রিপোর্টে ভুল আসে। আমরা বাবাকে অন্য কোথাও টেস্ট গুলো করবো। দেখা গেলো সেখানে এসব কিছুই ধরা পরলো না। কিন্তু তার মন মানে না। মনে যে কু ডাক ডাকছে…. একটার পর একটা বিপদ এসেই যাচ্ছে কোথাও না কোথাও থেকে।

পরপর দুই দফায় টেস্ট করা হলো। রিপোর্ট রিচেকের জন্য। দুই রিপোর্টেই এক রেজাল্ট এল.. এবার সবাই সত্যিই ভেঙে পরলো। ক্যান্সার এখন ২য় স্টেজে রয়েছে। আল্লাহ চাইলো চিকিৎসা করলে সুস্থ হতে পারেন।

এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা টাকা। ভাড়ার দোকান গুলো বিক্রি করে বাড়ির কাজে খরচের পর এমনিতেই তাদের চলতে এখন কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া নাতাশার বিয়েতে মামার সব সঞ্চয় দু-হাতে খরচ করেছেন। ছেলেকে তো গড়েই দিয়েছেন, মেয়ের জন্য তেমন কিছুই করেন নি। তার উপর একমাত্র মেয়ে, তাই কার্পণ্য করেন নি মেয়ের বিয়েতে খরচ করতে।
রিটায়ার্ডের পর যে ব্যাবসা শুরু করেছে তাও তেমন জমাতে পারে নি। শেষ বয়সে এত ধকল শরীর যেন চলেই না। তাই ব্যাবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।

বাড়ি ভাড়া তো লাগে না, তার চাকরী জীবণের পেনশনের টাকায় কোন মতে চলে যায় সংসার। সব কূল হারিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব প্রায়। বোনেরা টেস্টের সময় কিছু টাকা দিয়েছিলো। কিন্তু এই যে লম্বা সময় ধরে তার চিকিৎসা করতে হবে তার খরচ কোত্থেকে আসবে। ভেবেই বড়-মামীর মাথায় হাত।

দেশে এ চিকিৎসা ব্যায়বহুল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মোটামুটি কম খরচে চিকিৎসা করানো যাবে। কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে…

কল্লোল এসব শুনে বড় মামামামীর ভিসা, এবং যাবার ব্যাবস্থা করলো। বললো মা আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আপনারা আমার উপর ভরসা করুন। কিন্তু যতই হোক মেয়ের জামাই। ও এই বিপদে এগিয়ে এসেছে তাই বলে তো ওর আশায় সব ছেড়ে বসে থাকা যায় না। বড় মামী দিনরাত শুধু কাঁদেন। আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। আল্লাহ কেন এমন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের উপর থেকে। তিনি ছাড়া তো আর কেও নাই সাহায্য করার।

অবশেষে তাদের যাবার দিন ঠিক হলো। এদিকে কল্লোলের ও ফ্রান্সে যাবার দিনও এগিয়ে এলো। সবকিছু ঠিক করে কল্লোল চলে গেলো ফ্রন্সে। টিকিটে ডেট পেছানো গেলে ও নিজেও যেতো সাথে। কিন্তু এখন আর সম্ভব না হওয়ায় ও যেতে পারলো না।

নাতাশা খুবই ভেঙে পরলো। একদিকে বাবার এ অবস্থা অন্য দিকে বর চলে গেলো বিদেশে। ওর কাগজপত্র তৈরীতে সময় লাগবে। এতদিন থাকা কল্লোলের সম্ভব না, তাই ও একাই গেলো। বললো সব ঠিক হলে ও নিতে আসবে নাতাশাকে।
এমনি এক অবস্থা সবারই মন ভঙ্গুর। কো কাকে সান্তনা দিবে।

বড় মামী একদিন রোদেলাদের বাসায় গেলেন সন্ধ্যার দিকে। নাসিমা ভয় পেয়ে যান উনাকে দেখে। ভাইয়ের কিছু হলো না তো…! বড় মামী একটু সময় নিয়ে নাসিমাকে বললেন-
বোন যা হইছে সবই তো তুমি জানো। আমাদের যে কি সময় যাচ্ছে তা নতুন করে বলার কিছু নাই। তোমার ভাইয়ের যা অবস্থা , আমি তো যতদ্রুত সম্ভব তোমার ভাইকে নিয়ে রওনা দিবো। তুমি সব ভুলে ফিরে চলো….

নাসিমা কেঁদে দেন। এ কান্নার কারন কেও জানেনা তিনি ছাড়া। কান্না বড্ড ছোঁয়াচে, ঘরে থাকা সবাই কাঁদে। বড় মামী নাসিমার হাত ধরে বলে- না করিও না বোন, তোমার সব ভাইবোনের চেয়ে তোমার যে তোমার ভাইর প্রতি টান সবার চেয়ে বেশী তা আমি জানি। আজ আমি সেই দাবীতেই আসছি । আগামী সপ্তাহের মধ্যে আমরা চলে যাবো। আমি তোমাকে নিতে আসবো কাল…. তুমি সব গুছগাছ করে নাও। বাড়িওয়ালাকে বলে দাও ঘর ছাড়ার কথা….

আটটার দিকে তিনি ফিরে যান বাড়িতে। রাতে নাসিমার দুচোখ এক হয় না চিন্তায়। তাদের থেকে পাওয়া কষ্টের কথা ভেবে দুচোখ ভিজে যায় ওর। হাজার কারন থাক কৃষ্ণচূড়া ছাড়ার, তবুও সে যে ফিরে যাবে সেখানে, তার জন্য একটা কারনই যথেষ্ট। বাবর মতো বড় ভাইকে সে অনেক ভালোবাসে…

বাবা মারা যাবার পর মানুষটা কিভাবে সংসারের হাল ধরেছেন তা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। বাকী ভাইবোন তো কত ছোট। ওরা তো বড় হয়েই সব পেয়েছে। কোত্থেকে আসছে তার উৎস খুঁজে নি। নিজের বিয়ের খবরটা ছিলো না মানুষটার ভাইবোনের কথা ভেবে। একমাত্র নাসিমাই সব কাছ থেকে দেখেছে এবং মনেও রেখেছে।

অনেক ভেবে উপায়ন্তর না দেখে মনে মনে নাসিমা ঠিক করে ফিরে যাবে তার বাবার বাড়ি “কৃষ্ণচূড়ায়” …

চলবে…..

#রোদেলা
লেখা : #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব : ৩৯

রোদেলারা “কৃষ্ণচূড়া” তে এসেছে তিনদিন। আসার পর থেকে ঘর গুছানোই যেন শেষ হয় না। সব কিছু আগের মতো গুছগাছ করা হলো। তবুও কিছুই যেন আগের মতো নেই। কিছু একটা মিসিং এ বাড়ি থেকে। সবাই তা বুঝতে পারছে, কিন্তু কেও বলছে না, বলতে পারছে না। সবাই সবার মতো করে ব্যাস্ত। তবুও যেন ঐ মিসিং জিনিসটা সবার চলাচলের ছন্দ পতন করছে প্রতিনিয়ত।

সেদিন বড় মামী বললো নাসিমার বড় ভাইয়ের প্রতি টানের কথা, সত্যি বলতে নাসিমার মনে সবার জন্যই টান।

নোভেল ইস্যুতে ছোটভাই এর সাথে নাসিমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। দু-এক দিন পর পরই ঝগড়া হতো ওকে নিয়ে..

তবুও তার মনে লুকানো কষ্ট তিনি বাড়ি এসেছেন কিন্তু তার ভাই নেই। খেতে বসে কোন একটা পদ রান্না হলো যা ছোট ভাইয়ের পছন্দের তা নিয়ে আলোচনা। বিকেলে ছাদে গেলো তো ছোটনের হাতে লাগানো গাছ গুলো ছুঁয়ে বলতো সেই গাছ লাগানোর গল্প। কোথায় নেই সেই ভাইয়ের গল্প, রান্নাঘরে বাসন মাজা থেকে শুরু করে নামাজের বিছানা…
সবখানে ভাইয়ের কথা মনে পরে তাঁর।

সবাই রাগী নাসিমাকে দেখে, কিন্তু তার ভিতরের কোমল যে মেয়ে রয়েছে একটা, যা আটকা পরে আছে জীবণ নামক গোলকধাঁধায় তার খবর কেও রাখে না….

যার সবচেয়ে বেশী জানার কথা ছিলো তার সম্পর্কে, সেই বোধহয় সবচেয়ে কম জানে। বিয়ের বয়স ২৬ হলেও সব মিলিয়ে ২৬ মাসও স্বামীকে কাছে পেয়েছেন কিনা তাও নাসিমা জানে না। সেই জীবণের শুরু থেকেই এমনি লুকোচুরি খেলেছে সে তাঁর সঙ্গে।

সংসার চলছে ভালোই…
আগের মতো এক ছাদের নিচে, এক রান্নায় পুরো পরিবার। এদিকে বড় মামার যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। বড় মামী মোটে দুই লক্ষ টাকা জোগাড় করেছে। সেটা নিয়েই রওনা দিবেন তাঁরা।

দেখতে দেখতে বড় মামা-মামী চলে গেলো ভারতের চেন্নাইতে। সেখানেই মামার চিকিৎসা শুরু হবে।একদিকে কল্লোলের অনুপস্থিতি আরেকদিকে বাবা মায়ের চিন্তায় নাতাশার শরীর অসুস্থ হয়ে পরলো। খাওয়া দাওয়া বন্ধ প্রায়, সারাদিন কাঁদে।

এরমধ্যেই একদিন খবর আসে মাথা ঘুরে বাথরুমের সামনে পরে গেছে নাতাশা। নাসিমা তার বোনদেরকে নিয়ে দৌড়ে যায় ভাতিজির শ্বশুর বাড়িতে ওকে দেখতে। তাদের কপালে চিন্তার ভাজ। কি না কি হলো মেয়েটার…! গিয়ে দেখে বাড়ি ভর্তি মেহমান। নাতাশার খালা শ্বাশুড়ি, মামী শ্বাশুড়ি, সবাই ওকে ঘিরে বসে আছে। গিয়ে তারা যা শুনলেন খুশিতে চোখ ভিজে গেলো সবার। এত দুঃখের মাঝে একটা খুশির খবর। মা হতে চলেছে নাতাশা। উত্যপ্ত মরুভূমিতে যেন এক পাশলা বৃষ্টির মতো মনে হলো সবার এই খবরটাকে। খুশি যেন বাঁধন হারা। ওদের পরিবারের সবার বড় কল্লোল, তার সন্তান মানে এ পরিবারের প্রথম নাতি নাতনি আসতে চলেছে। তাই খুশী সবারই একটু বেশী।

নাতাশার বাবা-মা ও ভীষণ খুশি এ খবরে। তাদের আদরের ছোট্ট নাতাশা মা হতে চলেছে…. নাসিমা নাতাশাকে তাদের সাথে নিয়ে আসতে চায়, রাখতে চায় তাদের কাছে।
নাতাশার শ্বাশুড়ি দেন না, বলেন আমরা কত লোক রয়েছি, চিন্তা করবেন না। ও তো আমাদের ঘরের বৌ না, আমার ঘরের মেয়ে। ওর সেবাযত্নে কোন ত্রুটি হবে না। কথা অবশ্য তারা মিথ্যে বলেন নি…! নাতাশাকে তারা মেয়ের মতোই ট্রিট করে। অবশেষে তারা ফিরে এলো ওকে না নিয়েই।

কল্লোল ভালোভাবেই পৌঁছে গেছে। দুইদিন রেস্ট করে, সব গুছগাছ করে নিয়ে অফিসে জয়েন করেছে তিনদিন হলো।

কল্লোলও ভীষণ খুশি এ খবরে। বাবা হতে যাচ্ছে ও। এ অনুভূতি মায়েরা কত ভাবে প্রকাশ করে, কত কত মায়েদের কত গল্প রয়েছে এ অনুভূতি নিয়ে, কিন্তু একজন ছেলের বাবা হওয়ার অনুভূতির গল্প কজন জানে….?!

মায়েদের কত আয়োজন নতুনকে নিয়ে, কিন্তু বাবাও যে অধীর অপেক্ষায় থাকে তাকে ছুঁয়ে দেখবার জন্য, আদর করবার জন্য জীবণের দৌড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তা প্রকাশিত করতে পারে না বেশীরভাগেই।

টুকটুক করে চলছে মামার ট্রিটমেন্ট। মামীর হাতের টাকা শেষের দিকে। এদিকের অবস্থা ও নাজুক। আর মামা…! তিনি এ বয়সে কেমোথেরাপির ধকল নিতে পারছেন না। আর কত ধকল নিবে শরীর। একটার পর একটা বড় বড় ধাক্কা যেন দড়জায় অপেক্ষা করছে।

২য় কেমোথেরাপির পর মামাকে আর চেনাই যাচ্ছে না। চুল, ভ্রু সব পরে গেছে। মনে হচ্ছে মানুষটা দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেন। সবাই তা জানে তবুও কেও যেন জানেই না। সবার আপ্রান চেষ্টা তাকে বাঁচিয়ে রাখার।

বোনেরা কিছু টাকা দিলেন। নাসিমা তার মায়ের দেয়া বল চেইনটাও বিক্রি করে টাকা দেয়। রোদেলা কিছুই বলে না। সবই তো গেলো। এটা থেকে আর লাভ কি। মামার যা পরিস্থিতি এখন এসব হিসাব নিকাশের সময় না। সব মিলিয়ে লাখ দুয়েক টাকা পাঠানো হলো চেন্নাইতে। সেটা দিয়ে চললো আরো কিছুদিন। ঔষধ, টেস্ট, থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে কোনমতে চললো।

বড় মামা বলেন চলো আমরা ফিরে যাই, যে কটাদিন বাঁচি একসাথে থাকি সবাই। এভাবে চলতে থাকলে আমি তো মরবোই সাথে সবাইকে নিয়ে মরবো। কথাটা বলে হাসতে চেষ্টা করেন মামা। হাসির দমকে তার কাশি শুরু হয়।

কথা শুনে কেঁদে দেন বড় মামী। তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে চান। নাতাশা টাকাপয়সার খোঁজ করে। কল্লোলকে বলে টাকা পাঠাতে চায়। কিন্তু বড় মামী না বলে। জানায় তার হাতে এখনো টাকা রয়েছে। দরকার হলে তিনি জানাবেন নাতাশাকে। আসলে ওদের কাছ থেকে আর নিতে চান নি কিছু। তাই তার এই লুকোচুরি মেয়ের সাথে। উপায়ন্তর না দেখে বড় মামী নোভেলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করে ছোট মামাকে। কুশলাদি বিনিময়ের পরপরই ছোটমামা তার সমস্যার কথা বলতে থাকেন বড় মামীকে। এখানে এসে কি সমস্যায় আছে, টাকার জন্য পছন্দের বাড়িতে উঠতে পারে নি, আপাততঃ ভাড়ার এপার্টমেন্টে উঠেছে। তার নিজেরই টাকার দরকার, কিন্তু বড় মামার এ অবস্থা তাই তিনি চাচ্ছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি….

বড় মামী নিজে বোকা বনে গেলেন। ফোন করলেন নিজের দুঃখের কথা বলতে, আর উল্টো দেবরই মনে করিয়ে দিলেন পাওনা টাকার কথা। দুঃখে তার কলিজা যেন ফেটে যায়, পছন্দের বাড়ির কথা বলছিলো ও… আর ওর ভাই যে দুনিয়া থেকেই বিদায় হতে যাচ্ছে টাকার অভাবে তা একটা বার শুনলোও না.. কৌশলে এড়িয়ে গেলো।

এসব ভেবে যখন হসপিটালের বারান্দায় দাড়িয়ে কাঁদছেন নাতাশার মা, তখন নাতাশার বাবা পিছনে এসে দাঁড়ায় চুপিসারে। বৌকে বলে- চলো আমরা ফিরে যাই….
মরতে তো একদিন হবেই, দুদিন পর যেতাম একটু আগেই নাহয় যাবো, তাই বলে আমি তোমাকে মানুষের কাছে ছোট করতে পারবো না। ছোট তো কম করলাম না তোমায় জীবণে। চলো বৌ…
আমরা ফিরে যাই….

আড়াই মাস চিকিৎসার পর একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেন তারা। কেওই কিছু জানে না। কাওকেই বলে নি তারা কিছু। কি আর বলবে…?

দেশে ফিরে পূর্বাচলের বাড়ি যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তাদের সাথে দেখা করতে চান। যদি তাদের মনে একটু দয়া হয়…। পরপর তিনদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেও ঐ লোকের সাথে তিনি দেখা করতে পারেন না। শেষ ভরসাও যখন হারিয়ে যায় তখন বেঁচে থাকা কষ্টের হয়ে পরে।

কষ্টে তার কলিজা ফেটে যায়। শেষ বয়সে এমন দিন দেখতে হবে তারা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন এমনটি…?!
ভাবেন নি… অথচ জীবণ তাদের কোথায় এনে দাঁড় করায়।

মামার অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। খাবার খেয়ে কিছুই রাখতে পারছে না। শরীর কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে। নাসিমা বড় ভাবিকে বলেন, ভাবী একটা কথা বলি…?
যদি কিছু মনে না করেন….

বড় মামী এক পলকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ নাসিমার দিকে। যেন তাকে পড়তে কিছুটা সময় নিচ্ছেন তিনি, একটু সময় পর মৌনতা ভেঙে তিনি নাসিমাকে বলেন-
: নিশাদের ব্যাপার বাদে যদি কিছু বলতে চাও তো বলো….

নাসিমা অবাক হয়ে যায় এ কথায়। তিনি মনে মনে তাদের একমাত্র পুত্র নিশাদের সাথে ওর বাবার ব্যাপারে কথা বলতে চায়। যদি ও ছেলে হয়ে বাবার জন্য কিছু একটা ব্যাবস্থা করে….

নাসিমা উঠে চলে যায়, বড় মামী আপন মনে সবজিই কাটতে থাকে টেবিলে বসে। কাটতে কাটতে ছয়জনের জন্য আলুভাজা তৈরীতে দেড় কেজি আলু কেটে ফেলেন তিনি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here