রোদেলা,৪০,৪১

0
699

#রোদেলা,৪০,৪১
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব- ৪০

দিন দিন কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছেন মামা। তার মৃত্যুর প্রহর গুনা ছাড়া কোন উপায় নেই যেন আর। সবাই তা মেনেও নিয়েছে যেন ।

আজও আফজাল হোসেনের কাছে গিয়েছিল বড় মামী । পরপর তিনদিনেও দেখা পাননি তার। আজ যদি খোদা মুখের দিকে চান, দেখা হলেও হতে পারে। কিন্তু তিনি আজও খালি হাতে ফিরে এসেছেন। তিন দিন গিয়েছে কত রকমের কাহিনি দেখে এসেছেন তিনি। আজ যা দেখে এসেছে, মামী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর যাবে না সেখানে।

তার এলাকার এক মেয়ের স্বামী এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। ঘাতক ড্রাইভার ধরা পরছে এলাকাবাসীর হাতে। পুলিশের হাতে তাকে তুলে না দিয়ে টাকার মাধ্যমে মীমাংসা করে দিয়েছেন তিনি। মেয়েটাকে বুঝিয়েছেন তোর স্বামী তো মরেই গেছে, ড্রাইভারকে পুলিশে দিলে তোর স্বামী তো আর ফিরে আসবে না। তারচে ভালো টাকা নিয়ে নে। তুই বিধবা মানুষ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলতে পারবি কিছুদিন।

গাড়ির মালিকের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করে দিয়েছেন তারা। অসহায় বিধবা একটু যেন আশার আলো দেখেন ঐ টাকায়। অথচ আজ একমাস হলো আজ না কাল, কাল না পরশু এমনি করে ঘুরাচ্ছে….

মেয়েটা আজও এসেছিলো। এর আগে ও একদিন দেখা হয়েছিল ওর সাথে, সে সুবাদে ওর ঘটনা জেনেছেন তিনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মেয়েটাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে কি বলেছে কি করেছে আল্লাহ জানে, মেয়েটাকে ছোট বাচ্চা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যেতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করে কাঁদছে কেন…?

মেয়েটা উত্তরে শুধু বলে –

: ওরা মানুষ না খালা, সবগুলো অমানুষ। আমি অসহায় মানুষ আমারে সাহায্য করবো কি, উল্টা আমার এতিম পোলাপানের টাকা মাইরা খাইলো। আল্লাহ… আল্লাহগো কই বইয়্যা এগুলা দেহ তুমি….! আমি সহ্য করলাম আল্লাহ, তুমি সহ্য কইরো না….!

এ কাহিনি দেখে তিনি আর অপেক্ষা করেননি…
এরা এভাবেই বড়লোক হয়েছে। মানুষের হক মেরে, মানুষকে ঠকিয়ে। তারা সানগ্লাস চোখে চলে জীবণে রোদের তাপ কি তারা কিভাবে জানবে৷ এই মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে কিভাবে দিন পার করবে, দেখলেই তো মায়া হয়। অথচ ওদের টাকাটাই কিভাবে গায়েব করে দিলো….

বাড়ি এসে খাবার টেবিলে যখন এসব বলছিলো বড়মামী তার চোখ দুটো ভিজে উঠেছিলো। ঐ মেয়েটার আর নিজের দূর্ভোগের কথা ভেবে। স্বান্তনার ভাষা যেন হারিয়ে গেছে ওদের পৃথিবীতে। কি বলে স্বান্তনা দিবে। নিজেরাও তো নিস্বঃ। কেও সব হারিয়ে, কেও আপনজন হারিয়ে,

হঠাৎ নোভেল বলে মামী জায়গার ব্যাপারটা নিয়ে সুফিয়ান ভাইকে একটু যদি বলে দেখতেন । যদিও ঐ এলাকার না তিনি, তবুও নেতা মানুষ তো হয়তো এর একটা সমাধান করে দিতে পারবেন।

বড় মামী নাসিমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন নারে ওকে দিয়ে কাজ হবে না। এ এলাকায় হতো তাও চেষ্টা করতাম। ওরা অনেক খারাপ লোক। রোদেলা বলে – মামী আমরা শেষ একটা চেষ্টা করে দেখি না। চেষ্টা করতে তো দোষ নাই। যদি উনি পারে কিছু করতে। নোভেল তুই এক কাজ কর তাকে ফোন করে মার সাথে কথা বলিয়ে দে। মা তুমি বলো বাসায় আসতে। ফোনে বলার চেয়ে সামনাসামনিই বললে ভালো হবে।

যে কথা সে কাজ, সুফিয়ানকে ফোন করা হলো। সুফিয়ান এলো পরদিন বিকেলে। অনেকদিন পর দেখা হলো সবার সাথে। কেমন যেন দিশেহারা ভাব তার মধ্যে। তবুও জোড়াতালি দিয়ে কোনমতে চেষ্টা করছে সেটাকে ঢেকে রাখতে। কে কতটুকু বুঝেছে তা বোঝা যাচ্ছে না, তবে রোদেলার চোখে ফাঁকি দিতে পারে নি সে দিশেহারা ভাব। ফিরে যাওয়ার সময় এগিয়ে দিতে গিয়ে সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করে রোদেলা – কি ব্যাপার বলুন তো, আপনাকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে…
মুচকি হেসে তিনি বললেন-
– আরে নাহ্…! তেমন কিছু না, আমার মা ও অসুস্থ, তাই মনটা একটু খারাপ। দোয়া করো আমার মায়ের জন্য।
– হায় খোদা, এতক্ষণে এ কথা বলছেন আপনি…?
কি হয়েছে তার…!
– হার্টে দুটো ব্লক ধরা পরছে, ঔষধ চলছে, কাজ না হলে অপারেশন করাতে হবে।
– আহারে…! আচ্ছা আমরা যাবো আপনাদের বাসায়, ঠিকানাটা দিন তো…
– নোভেল চিনে আমাদের বাড়ি, যদি যাও ও নিয়ে যেতে পারবে।
– আচ্ছা ঠিকাছে, খেয়াল রাখিয়েন তার, আর হ্যা নিজের খেয়াল ও রাখবেন। আপনি সুস্থ না থাকলে শক্ত না থাকলে আপনার মাকে নিয়ে হসপিটালে দৌঁড়াবেন কি করে…! আপনার মায়ের জন্য হলেও আপনাকে শক্ত থাকতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে। আপনি না বড়…!
– মলিন হাসি হেসে বলে, এভাবে ভাবি নি তো…
আসলে মা ছাড়া আর কেউ নাই আমাদের, তাই তাকে হারানোর ভয় মনে জেঁকে বসেছে।
– ভয়ের কিছু নেই, আল্লাহ ভরসা। দোয়া রইলো…
– আচ্ছা, আসি তাহলে…..

রোদেলা দাঁড়িয়ে থেকে সুফিয়ানের চলে যাওয়া দেখলো। যে পর্যন্ত দেখা গেলো তাকে সে পর্যন্ত। কলাপসিবল গেইটে তালা লাগাতেই একটা গাড়ি এলো ওদের বাড়ির গাড়ি বারান্দায়। চিনতে সমস্যা হলো না রোদেলার এটা নাতাশার শ্বশুরবাড়ির গাড়ি। তাদেরকে দেখেই দৌড়ে উপরে উঠে গেলো রোদেলা। কারন গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে শোভন বসা। ও কোন মতেই শোভনের সামনে পরতে চায় না। তাই ও এভাবে উপরে উঠে গেলো। খুব সম্ভবত বড় মামাকে দেখতে এসেছেন তারা।

রোদেলা তিনতলায় ওর নানুর ঘরে চলে গেলো। মেহমান এলো, মামাকে দেখলো, নাশতা খেলো। কয়েক ঘন্টা হয়েছে তারা এসেছে। এখনো গিয়েছে কি না তা জানতে বারান্দা থেকে উঁকি দেয় নিচে। তিন তলার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওদের কালো রঙের গাড়িটা। আটটা বাজতে চললো গাড়ি এখনো গাড়িবারান্দায় দাড় করা। তার মানে তারা এখনো যায় নি। ভাবতেই হুড়মুড় করে একদল মানুষ ঢুকলো রোদেলার নানীর ঘরে। তার সাথে দেখা করতে এসেছে তারা।

রোদেলা ভুত দেখার মতো চমকে গিয়ে, দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে। কল্লোলের মা, শোভনের মা আর ফুফু এসেছেন ঘরে।
সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে, নাতাশার খোঁজ খবর নিয়ে কোন এক ছুতায় বের হয়ে যায় ঘর থেকে। ঘর থেকে বের হতেই আবার চমকে উঠে রোদেলা ৷ ঘরের দেয়াল ঘেঁষে শোভন দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না ও। হন হন করে নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে দোতালায়…

রোদেলার খুব ইচ্ছে হয় একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে শোভনকে। কিন্তু সব সময় সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। করা ঠিক ও না। এ পিছন ফিরে তাকানোর নতুন কোন অর্থ ও বের করুক তা ও চায় না। যদিও মায়া হয় ওর জন্য,
কিন্তু পেছনের ঘটনা মনে পরলে ওর ঘৃণা হয় ওর প্রতি। যে অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে ও রোদেলাকে, তাতে…..

ও জানে ভালোবেসেই এসব করেছে ও। কিন্তু ও কেন বুঝে না ভালোবাসার আরেক নাম অপেক্ষা… একটা সম্পর্কে দুজন দুজনকে চিনলোই না ভালো করে, হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। এত সহজ এ সিদ্ধান্ত নেয়া। যেখানে জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তর একটি এটি….! কেন ওর এত তাড়াহুড়ো। তাড়াহুড়ো কোন কাজই যে ভালো না তা ওর চেয়ে ভালো কে জানে….

আঁকিব ও তাড়াহুড়ো করে হারিয়েছিলো রোদেলাকে। শোভন ও একই কারনে হারাতে বসেছে ওকে। যে ঝড় ওর উপর দিয়ে গিয়েছে এই ঘটনার পর তাতে ওর কষ্টটা একটু বেশীই ছিলো । আঁকিবের বেলায় ও অপরাধ করেছিলো আঁকিবকে ভালোবেসে। কিন্তু এবার…! কোন কথা নাই, বার্তা নাই, এমনকি ছোট্ট কোন ইঙ্গিত ও নাই ভালোবাসার । তার পরও
কোন দোষ না করেই দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে রোদেলাকে। এসব কষ্টই ওকে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। যে ছেলে হুট করে ভালোবাসতে পারে সে যে হুট করে ভুলে ও যাবে না তা কে বলতে পারে….

সেখান থেকে এসে ওর ঘরে দড়জা ভিড়িয়ে বসে থাকে রোদেলা। তারা না যাওয়া পর্যন্ত বের হবে না ঘর থেকে। তারা ফিরবার সময় রোদেলাকে খুঁজে ওর ঘরের দড়জায় উঁকি দিয়ে বিদয়া নেয় । রোদেলা ঘরের ভিতরে থেকেই সালাম দেয়, আবার আসতে বলে, তারাও বলে নাতাশাকে দেখতে যেতে। রোদেলা বলে জলদিই যাবে ও…
নিচে কলাপসিবল গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় নাসিমা।

শোভনের একটা ক্ষীণ আশা ছিলো রোদেলা আসবে নিচ পর্যন্ত। কিন্তু না আসায় একটু কষ্ট পেলো ও। ছোট্ট একটা চিরকুট এনেছিলো সাথে করে। ফিরলোও সেটা সাথে করেই…

রাতে খেতে বসে সবাইকে বললো সুফিয়ানের মায়ের অসুখের কথা। সবাই ভীষণ আফসোস করলো, বললো সময় করে যাবে সবাই তাকে দেখতে। বড় মামী একটু সুর তুলতে চাইলেন শোভনের ব্যাপারে। ওর ফুফু আজ এসেছে রোদেলাকে দেখতে। রোদেলা চোখমুখ শক্ত করে বলে মামী এ বিষয়ে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। এ বিষয়ে আর কোন কথা হোক তা আমি চাই না….

চলবে…

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৪১

নাসিমা রাতে রোদেলার ঘরে গিয়ে ওর সাথে রাগারাগি করে। মুখের উপর কথা বলার সাহস ও কোথায় পেলো তা জানতে চায়। রোদেলা কোন উত্তর দেয় না। নাসিমা যেন তা আগের রূপে ফিরে এসেছে। এতদিন সব ঠিকঠাক থায় রোদেলা ভাবে ওর মা হয়তো সব ব্যাপার সামনে আসার পর অনুতপ্ত। কিন্তু না, তিনি এতদিন এক ভাইয়ের চলে যাওয়া আর আরেক ভাইয়ের অসুখে চুপচাপ ছিলেন কিছুটা। এখন যেন আবার আগের রূপে ফিরে এসেছেন।

ভালো ঘর, ভালো বর, নিজের দিকে দেখছস একবার, তোর বাবার এতসব কাহিনী, চাল নাই চুলা নাই, জেনে কে নিবে তোরে….? কত বড় সাহস মেহমান গুলারে দেখে সে উপরে উঠে গেলো। কিসের এত দেমাগ তোর। কি আছে তোর….

অথচ এই তিনিই ফোন দিয়ে কিসব বলেছিলো রোদেলাকে সেন্টমার্টিনের ঐ দিনটাতে। আর এখন…! বড় মামী কিছু বুঝিয়েছেন হয়তো। একটা মানুষের কয়টা রূপ থাকে….? নিজের মাথায় কিচ্ছু নেই, যে যা বলে তাই ঠিক, নিজের বিচার বিবেচনা বলতে যে একটা জিনিস পৃথিবীতে রয়েছে তা তার নেই। কেউ যদি বলে- আরে আপা আপনার মেয়েকে দেখলাম এক ছেলের সাথে হাত ধরাধরি করে যেতে। সে তা-ই বিশ্বাস করবেন। নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করবেন না যে আমার মেয়েটা কি এমন…?
নিজের মেয়েকেই চিনলো নাআজ পর্যন্ত। চিলে কান নিয়েছে, চিলের পিছনে ছুটা পাবলিক এরা।
অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে তিনি যখন চলে যেতে পা বাড়ালেন তখন রোদেলা সহ্য করতে না পেরে উঠে তার কথার জবাব দিল-

– বিয়ের জন্য যে এত লাফালাফি করছো, আমার বিয়ে হয়ে গেলো তোমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে হিসেব করে দেখেছো। ঘরে বসেই তো সব পেয়ে যাও, সে চিন্তা তো তোমার মাথায় নেই। আর কি বললা….

আমার এত দেমাগ কিসের….
ঐটা আমার দেমাগ না, আমার পরিবারের জন্য চিন্তা, যে আমি চলে গেলে আমার মা বোনের কি হবে…?

ভালো ঘর ভালো বরের চিন্তা আমি করি না….
আমি চিন্তা করি রাত পোহালে পরদিন চলবে কিভাবে … তোমার আছে সেই চিন্তা…? সেই ছোট্ট বেলা থেকেই তো এই চিন্তা মাথায় দিয়ে দিছো, নিজে পটের বিবি সেজে পরের সংসার সামলেছো। সবই তো খুইয়েছো, দুই দিন পর যে এই বাড়ি থেকে ও চলে যেতে হবে তখন…. আমি চলে গেলে চলবে কিভাবে ভেবে দেখেছো…?

দুইদিন আগেই তো খুব কথা শুনালো, আর এখন আসছো বিয়ের স্বপ্ন দেখাতে। কি পাইছো তুমি আমারে…. যখন যা মন চায় তাইই জোড় করে চাপায়া দিবে….
যাও তুমি…
বিয়েই করবো না আমি…
আমার জন্য এত দরদ দেখানো লাগবে না কারো…
বলে দড়জা আটকে দেয় রোদেলা।

রোদেলা কিংবা নাসিমা দু-জনেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। রোদেলার বিশ্বাস হচ্ছে নাও এসব বলেছে…
বলেছে সে এসব তার মাকে….
সেই সেন্টমার্টিন থেকে মনে মনে যুদ্ধ চলছে তার নিজের সাথে। ও কি বুঝে না ওর ভালো…? ওর কি স্বপ্ন নেই ভালো ঘর ভালো বরের…. শোভনের ভালোবাসা যে কতটুকু ওর প্রতি তা ওর চেয়ে ভালো কে জানে। এত ভালোবাসা অবজ্ঞায় ঠেলে দেয়া কি কম সাহসের কাজ। এটা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা, যা দিতে হচ্ছে ওর মা আর বোনের কথা ভেবে। ঐ পরিবারে গেলে সবসময় ওকে ছোট হয়ে থাকতে হবে। তার উপর মা বোনের জন্য যে চাকরী বাকরী কিছু করবে তাও পারবে না। কারন তারা খুবই রক্ষণশীল পরিবার। সেট কেও দেখেছে ভেবে…

তার মানে এই না যে বিয়ে ও করবে না। তবে আপাততঃ এসব নিয়ে ভাবতে চায় না ও। আবদ্ধ ঘরে অঝোরে কাঁদছে রোদেলা। জীবণ কেন ওকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করায় বার বার….
ইশ্বর আর কত পরীক্ষা নিবে ওর…?!

আর নাসিমার বিশ্বাস হচ্ছে না তিনি কি শুনেছে।
নাসিমা যেন স্বাক্ষাত অগ্নি মূর্তি। দড়জায় কড়াঘাতে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে যেন। হৈচৈ চেচামেচি শুনে বড় মামী দৌড়ে আসে…

বড় মামী নাসিমাকে শান্ত হতে বলেন। নাসিমা ব্যাঘ্র কণ্ঠে বলে-
: ভাবী, আপনি শুনলেন কি বললো ও, আমার নাকি কোন চিন্তাই নাই, আমি পটের বিবি সেজে থাকি, সব চিন্তা ওর।
: নাসিমা ও সেভাবে বলে নাই, তুমি নিজের মতো করে ভাবছো কেন…
: না ভাবি, আপনি আমাকে ছাড়েন, অনেক চিন্তা করে ফেলেছে ও, আর না, ওরে বলেন এক্ষুনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আমি দরকার হলে ভিক্ষা করে খাবো তবুও ওর রোজগার করা ফুটা পাইও আর আমি স্পর্শ করবো না। ছাড়েন আপনি আমাকে, আমি শুধু ওকে এ কথাটাই বলবো। ছাড়েন…!

বড় মামী কিন্তু নাসিমাকে ছাড়ে না। তবুও তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নাসিমা, দৌড়ে গিয়ে দড়জায় ধাক্কা দেয় অনবরত। রোদেলার কান্না এখন ভয়ে পরিনত হয়, কারন ও ওর মা’কে ভালো করে চিনে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি যে কতটা হিংস্র হন তার অনেক সাক্ষী রোদেলার সারা শরীরে রয়েছে।

রাত সাড়ে দশটা বাজে। পুরো বাড়ি থমথমে, যেন কোন ভুতুড়ে বাড়ি…। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলো কি না বোঝা গেলো না। রোদেলা রুমে বসে কাঁদছেই সেই তখন থেকেই।

প্রিসিলা দড়জায় নক দিলো,
আপা…
দড়জা খোল…
দড়জা খোল আপা…!
দড়জা খোলে রোদেলা। খাবার নিয়ে রুমে ঢুকে ও। এ বাড়িতে আটটার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া হয়ে যায়, আসলে প্রিসিলা যতটা না খাবার দিতে এসেছে তার চেয়ে বেশী এসেছে ওর বোন কোন অঘটন করছে কি না তা জানতে। ওর ভিতরে এ ভয় কেন ঢুকলো ও জানে না। প্রিসিলাকে রুমে ঢুকতে দেখে কোত্থেকে দৌড়ে ঘরে ঢুকে নাসিমা। খপ করে রোদেলার চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে ঘর থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রিসিলার হাত থেকে খাবারের প্লেট পরে গিয়ে পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পরে ভাত, ভাজি আর বাটিতে করে আনা শোল মাছ আর আলু ফুলকপির তরকারি।

অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে নাসিমা। নোভেল, বড় মামী কেওই তাকে ছাড়াতে পারছে না এত অসুরের মতো শক্তি এসেছে তার শরীরে। প্রিসিলা কাঁদতে থাকে ভয়ে। ও এমন হবে জানলে দড়জা খুলতে বলতো না।

চুলের মুঠি তখনো তার হাতেই, ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিচতলা অবধি টেনে নামায় রোদেলাকে নাসিমা। রোদেলা ও অনেক চেষ্টা করছে ওর চুল ছাড়াতে। কিন্তু পারছে না। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে ও, কান্না যেন ভুলেই গেছে। খোলা কলাপসিবল গেইটের বাইরে বের করে আরেক দফা গালমন্দ করে। বলে-
: মা*গী তোদের কারনে আমার জীবন শেষ, আর তোরাই আমারে খোটা দেস, জুতা কামড় দিয়ে বের হয়ে যাবি, আর এই চেহারা দেখাবি না আমাকে। রোদেলার তখনি যেন কান্না নামক অনুভূতিটার কথা মনে হলো , শক্ত মাটির উঠোনটায় বসে পরে কান্না করতে শুরু করে ও। প্রিসিলা বড় মামার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখে এসব। যদিও কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে সব দেখা যাচ্ছে না।

প্রিসিলা দৌড়ে যায় নিচে যেতে । কিন্তু বাড়ির মেইন গেইটে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে নাসিমা। কি করবে কেও বুঝে না যেন। বড় মামী জানালা দিয়ে ডাকতে থাকে রোদেলাকে। ওর মা চাবি নিয়ে দড়জা আটকে রেখেছে তা বলে নোভেল, বলে তুই একটু অপেক্ষা কর আপা, আরেক সেট চাবি আছে আলমারীতে বড়-আম্মা তা খুঁজছে।

কোন উত্তর দেয় না রোদেলা। কিছু সময় পর প্রিসিলা ওর নানীর ঘরের বারান্দার জানালা দিয়ে নিচে একটা কিছু ছুঁড়ে দিলো। প্রিসিলার মোহাচ্ছন্ন ভাব কাটলো জিনিসটা পরার শব্দে। সেখানে তাকিয়ে দেখে ব্যাগ। কোন মতে চোখ মুছে উপরে তাকায় ও। প্রিসিলাকে দেখা না গেলেও ও যে এটা ফেলেছে তা বুঝলো রোদেলা। একটু এগিয়ে দেখলো, ব্যাগে একজোড়া জুতা, ওর টাকার পার্স, আর ফোনটা টাকার পার্সে ঢুকিয়ে দিয়েছে প্রিসিলা যাতে ভেঙে না যায় । এগুলে দেখে কান্না যেন আরো বেড়ে যায় ওর। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না ও।

এমন জীবণ নিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানেই খুঁজে পায় না রোদেলা। ভাবে ওর বন্ধু সিমিকে বলা সেই কথাটা- আমি যদি কোন দিন আ*ত্ন*হ*ত্যা করি তাহলে জানবি আমার আ*ত্ন*হ*ত্যার জন্য আমার মা দায়ী। কথাটা রেদেলার মাথার মধ্যে যেন পোকার মতো ভনভন করে। হঠাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওর।
চোখ মোছে ও, হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও।
চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে জুতো জোড়া পরে রোদেলা। তারপর বাড়ির মেইন গেট দিয়ে সোজা হাঁটা দেয় ও। নোভেল তা দেখে চিৎকার করতে থাকে…
আপা….!
আপা………..!
যাস না আপা…

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here