#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
জারিফ বিকেলে ব্যালকনিতে বসে একটা নভেল পড়ছে। ইংরেজি নভেল “ম্যান সার্চ ফর মিনিং”। বইটার রাইটার “ভিক্টর ফ্রাঙ্কল”। বইটি ১৯৪৬ সালে পাবলিশড হয়েছিল। এটি মূলত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ও তার সাইকোথেরাপিউটিক দিকটি নিয়ে বিশদ বিবরণ দেওয়া। যা জীবনের ইতিবাচক অনুভূতির জন্য উদ্দেশ্যকে বুঝায় তারপর সেই ফলাফল কল্পনা করে জীবনকে বুঝে (বইটি সম্পর্কে গুগল থেকে তথ্য নিয়েছি)। বই পড়ার সাথে এক কাপ ধোঁয়া উঠা চা! আহা! শীতের বিকেল, সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো কয়েকটা গাছে আড়ালে আরক্তিম দিবাকর তার দিনের শেষ কিরণ ছড়াচ্ছে। গায়ে হুডি জড়ানো অবস্থায় সময়টা সত্যি মনোমুগ্ধকর।
একটু আগেই জারিফের ভাবি এসে ওকে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে গেছে। জারিফ কফি চেয়েছিল কিন্তু ওর ভাবি মালাই চা ধরিয়ে দিয়ে বলে গিয়েছে,
“শোনো দেবরজি, এই বিকেলবেলা চা খাও। কফি তুমি অন্য যেকোনো সময় খেও। বইয়ের সাথে চা দারুন মানাবে।”
জারিফ আর কথা বাড়ায়নি তখন। মুচকি হেসে ভাবির হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। চায়ের স্বাদ নিয়ে বুঝলো, সত্যি সময়টা সুন্দর ও উপভোগ্য লাগছে।
____________
বাসে লোকজনের ভীড়ের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে প্রিয়া সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছালো। নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পরেছে। বাসে উঠতেই তার দফারফা। ওর বাবা একজন কৃপণ ব্যক্তি। যার কারণে তিনি গাড়ি কিনতে ইচ্ছুক না। তবে প্রিয়ার বড়ো ভাই প্রিয়মের ইচ্ছে আছে কিন্তু সে সবে মাস্টার্স কম্পিলিট করে জবে ঢুকেছে। সে আগে থেকেও পার্ট টাইম জব করতো কারণ মাস্টার্সের ক্লাস তো রাতে হতো। প্রিয়ার মা এসে ওকে এমন ভাবে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বলেন,
“যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। উঠ। মাগরিবের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।”
প্রিয়া আলসেমি ছেড়ে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো। আসরের নামাজের সময় হতেই ভার্সিটিতেই পড়েছিল। নামাজটা পড়ে আবার রেস্ট করবে। প্রিয়ম বাড়ি না ফেরা অব্ধি প্রিয়া ঘুমাবে। প্রিয়ম বাড়ি ফিরলেই শুরু হবে ক্যা*টফা*ইট! নামাজ পড়ার পর ওর মায়ের ডাকে কাঁদো কাঁদো ফেস করে রান্নাঘরে গেলে ওর মা বলে,
“যা চা বানা। তারপর পাকোড়া গুলো ভে*জে নিবি। প্রিয়ম চলে আসবে।”
প্রিয়া চোখ মুখ সংকুচিত করে বলে,
“চা পরে বানাবো। এখন চা খেলে আমি ঘুমাবো কিভাবে? তোমার ছেলের আসতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। তোমার পাকোড়াতো মাখানোও হয়নি। পরো বানাবোনে। একটু মেরিনেট হয়ে থাক এগুলো।”
প্রিয়ার মা প্রিয়া মা*থায় চা*টা মেরে বলে,
“বল*দি কোথাকার! পাকোড়া মেরিনেট করে রাখলে পানি ছেড়ে দিবে। সাথে সাথে ভা*জতে হয়। যা ভাজ।”
প্রিয়া মা*থায় হাত দিয়ে ঠোঁট উলটে মায়ের দিকে তাকালো কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। তিনি চোখ রাঙিয়ে চলে গেছেন। প্রিয়া আর কি করবে! চা বানিয়ে বাবা-মাকে দিয়ে নিজেও খেলো তারপর পাকোড়া মাখিয়ে ভাজতে শুরু করলো।
__________
রাতে জারিফের বাবা খাবার টেবিলে জারিফকে বলেন,
“সন্ধ্যায় তোমাকে খুঁজলাম কিন্তু তুমি নাকি বেরিয়েছিলে। এই দশ-পনেরো দিন তো কোথাও গেলেও না। তা কোথায় গিয়েছিলে?”
জারিফ মুখের খাবারটা গিলে বলে,
“এই একটু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। এই কয়দিন অনেক কাজের কারণে বেরোনো হয়নি। আজ ভাবলাম বেরোই।”
জারিফের বাবা বলেন,
“আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি দেশে এসে খুশি না। তাই হয়তো ঘর থেকে বেরোতে না।”
জারিফ খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তোমাদেরই ইচ্ছে ছিল আমি বাহিরে গিয়ে পড়ি। বুয়েটে ‘ওয়াটার রিসোর্সেস’ পেয়েছিলাম তারপর আমায় তুমি কানাডাতে পাঠিয়ে দিলে সিএসসি পড়তে। এখন আমি সেখান থেকে পিএইচডির অফার রিজেক্ট করে এসেছি তাও তুমি এই কথা বলো?
জারিফের বাবা জাবেদ সাহেব হতাশ স্বরে বলেন,
“কানাডাতে পড়তে গেছো ঠিক আছে কিন্তু আমি চাই না আমার ছেলে সারাজীবন দূরে থাকুক। পিএইচডি কয়েক বছর পরে করলেও তো হবে। স্টাডি লিভে গেলেও পারবে। কিছুদিন দেশে থাকো।”
জারিফ কিছু বলল না তখন। খাওয়া শেষে জারিফ বলে যায়,
“আসলে তোমরা ভেবেছিলে, আমি মারিয়াকে বিয়ে করে কানাডা সেটেল হবো! মারিয়া আমার গুড ফ্রেন্ড। নাথিং এলস। সেটেল হওয়াল হলে আমি এমনিতেই হতে পারব।”
জারিফ নিজের রুমে চলে যায়। জাবেদ সাহেব চুপচাপ খেয়ে উঠে পরেন। সত্যি সে এবং বাকিরা ভেবেছিল মারিয়াকে বিয়ে করবে জারিফ। জারিফের ফেসবুকে প্রায় সব পোস্টেই মারিয়া থাকেই। তাই তারা ছেলেকে ডেকে আনেন।
কিছুক্ষণ পর জারিফের রুমের দরজায় খটখট শব্দ হয়। জারিফ দরজা খুলে দেখে ছোটো তুতুল তার বই নিয়ে এসেছে। জারিফকে দেখে ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে হেসে বলে,
“চাচ্চু, আমাকে একটু পড়াবে? আমি খুব ভালো পড়তে পারি জানো?”
জারিফ মুচকি হেসে চার বছরের তুতুলকে কোলে তুলে নেয়। তারপর বিছানায় বসিয়ে বলে,
“কী পড়বে বলো? আমি তো জানি তুতুল সোনা সব পারে।”
“হুম হুম। পারি তো। কিন্তু এখন যুক্তবর্ণ শিখবো।”
জারিফ হালকা ঢোক গিলে। বাংলা তার প্র্যাকটিস নেই। এখন ভাইপোকে পড়াতে হবে। জারিফ ভয়ে ভয়ে পড়াচ্ছে যাতে ভুল না হয়।
__________
পরেরদিন,,
প্রিয়া আজকে বোরখা পরে ভার্সিটিতে এসেছে। ওকে দেখে এক দেখায় চেনার উপায় নেই। ক্যাম্পাসে গিয়ে অর্ষার পাশে গা ঘেষে ধ*পাস করে বসে পরলে অর্ষা হকচকিয়ে উঠে। অর্ষা বলে উঠে,
“এই কে আপনি? আমার গা ঘেষে বসলেন কেনো? ওইদিকে তো আরও জায়গা আছে। সেখানে বসেন।”
প্রিয়া এবার অর্ষাকে ঠু*য়া মে*রে মাস্ক নামিয়ে বলে,
“আমি প্রিয়া। চিনতে পারলি না ব*ল*দি!”
প্রিয়ার কথায় অর্ষা তো অবাক হয়েছেই সেই সাথে বাকিরাও। মিম নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে অবাক কন্ঠে বলে,
“এই তোরে জ্বি*নে ধরছে? রাতারাতি বোরখা! বোরখা পরা ভালো কিন্তু এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো?”
প্রিয়া বিরক্তি নিয়ে বলে,
“স্যারের হাত থেকে বাঁচার উপায়। এটা ইশা আপুর বোরখা। কালকে ভাইয়াকে ব্ল্যা*কমেইল করে ইশা আপুর থেকে বোরখা নিয়েছি। আমি তো বোরখা পড়ি না। বাসায় যাওয়ার পথে ফিরিয়ে দিবো আবার।”
আয়ান বলে,
“ধা’র করার থেকে একটা কিনেই নিতি। তোকে যদি স্যারের থেকে এভাবে লুকিয়ে থাকতে হয় তবে কতোদিন এভাবে বোরখা ধা’র করবি?”
“দেখি কতোদিন।”
নিশি এবার হাসতে হাসতে বলে,
“কিন্তু আজ তো জারিফ স্যারের ক্লাস নেই! বোরখাটা তোর কালকে লাগবে। কালকে আবার সকাল সাড়ে আটটায় ক্লাস। অতো সকালে বোরখা নিতে ইশা আপুর বাড়িতে যাবি?”
প্রিয়া এবার ঠোঁট উলটে তাকিয়ে আছে। পরে হতাশ স্বরে বলে,
“যাহ! পরবো না। এমনেও আমি বোরখাতে কম্ফোর্টেবল না।”
বন্ধুরা প্রিয়ার অসহায় চাহনিতে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে ক্লাসে চলে যায়।
ক্লাস শেষে করিডোর দিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল তখন জারিফকে আসতে দেখে প্রিয়া ওয়াশরুমের ভিতর ঢুকে পরে। আজকে যেহেতু ক্লাস নেই তো সে জারিফের সামনে পরতে ইচ্ছুক না। জারিফ ওর মতো ক্লাসে চলে গেছে। প্রিয়ার এসব লুকোচুরি দেখে এবার ওরা বিরক্ত। এতো ভয়ের মতো কাজও তো করেনি। প্রিয়া ওদের চেহারর ভাবগতি দেখে আমতা আমতা করে বলে,
“আসলে আমার ভয় না। অনেকটা আনইজি লাগতেছে। আমি শুধু শুধু সেদিন বিরক্তি প্রকাশ করেছিলাম। আমার উচিত হয়নি ওভাবে বলা। এখন তো উনি স্যার। তাই।”
মিম হতাশ কন্ঠে বলে,
“থাক যতোদিন এভাবে চলতে পারিস। তবে পরে জানলে স্যার তোকে অন্যকিছুও ভাবতে পারে।”
প্রিয়া মুখ ভাড় করে ওদের সাথে ক্যান্টিনে যেতে থাকে। সব ক্লাস শেষে আজ বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরে প্রিয়া। বাড়ি ফিরে ওর মামাতো বোনকে দেখে আরেকদফা বিরক্ত হয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।