#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ১৪ #রেহানা_পুতুল
আরশাদ কোন রেসপন্স পাচ্ছেনা। ঝিনুকের দুচোখে নেশালো চাহনিতে অবিকল চেয়ে রইলো । ঝিনুকের পায়ের পাতার উপরে নিজের হাত বোলাতে লাগলো।
তক্ষুনি এমন করছেন কেন বলেই, ঝিনুক আরশাদের হাত থেকে গোলাপের তোড়াটি দুহাত দিয়ে যত্ন করে ধরে ফেললো । পায়ের পাতা দুটোকে একপাশে সরিয়ে নিলো। এবং ফুলগুলোকে গালের একপাশে মোলায়েম করে চেপে ধরে,
ধন্যবাদ আপনাকে। ফুল ভালোবাসি আমি।
আরশাদ এখনো হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। মনে মনে আশা করেছিলো, ‘ লাভ ইউ টু আশু’ এমন কিছু শোনার। কিন্তু শুনতে পেলোনা বলে মন খারাপ হলো বেশ। ঝিনুক খুব সচেতনভাবেই কথাটা যে বলেনি এটা আরশাদ বুঝতে পেরেছে।
ঝিনুকের দুহাতের পাতা নিজের দিকে মেলে ধরলো। নিবেদিত কন্ঠে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
ঝিনুক আমি খুব স্যরি সবকিছুর জন্য। অনুতপ্ত আমি।
গাছের গোড়া কেটে উপর দিয়ে পানি ঢাললে গাছ বাঁচে? দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ঝিনুক।
আরশাদ ঝিনুকের হাত ধরা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল, আলবৎ হয়। কারণ গাছ কাটা হয়নি৷ বিয়ের পরেরদিন সকালে আমাকে বানর বলাতে, আমি কারো গরুর লেজের মতো চুলের মাথা ধরে হালকা টানলাম মাত্র। কিন্তু অপবাদ দেয়া হলো আমাকে। ঘোরতর অন্যায় করা হলো আমার সাথে। আমি নাকি চুলের মুঠি ধরেছি।
আবার গ্রামে আমার ইচ্ছে ছিলো পা টেপার পরে পাশেই ঘুমাতে দিব। কিন্তু অমানুষ শব্দটা বলাতে রাগ চড়ে গেলো আমার। তাহলে আমার ভুলগুলো করার উৎস যার জন্য হয়েছে। সে কি একটু হলেও দোষী নয়?
ঝিনুক একটুক্ষণ কিছু চিন্তা করলো। পরক্ষণেই বলল আমিও খুব সর্যি। আমার চুল গরুর লেজ? নাক লাল করে জিজ্ঞেস করলো ঝিনুক।
স্যরি শব্দটা শুনেই আরশাদ উৎফুল্ল হয়ে গেল। ঝিনুকের দুবাহু ধরে বসা থেকে দাঁড় করালো। এক হাত টেনে ধরলো। হাতের পিঠের উপর নিজের দুঠোঁট ঘষতে লাগলো বিরামহীনভাবে। ঝিনুক গোপনে কেঁপে উঠলো। তার সমস্ত অনুভূতি রোমাঞ্চিত হতে শুরু করলো। তড়াক করেই হাত সরিয়ে নিলো। আমি পড়তে বসব।
আমার কোলে বসে পড়ো। বেশ আরামদায়ক হবে । ঝিনুক লজ্জায় দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেললো। বললো, আপনি এত লুচু কেন?
তোমার জন্য। জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছি। নিজেকে সামলাবো আর কতো। আমার তপ্ত মরুভূমিতে কবে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরবে বধু ?
যেদিন মন চাইবে সেদিন।
মন আনুমানিক কবে চাইতে পারে মিস ঝিনুক?
আমি ভার্সিটিতে উঠার পরে।
ওহ গড! আপাদমস্তক এত ঐশ্বর্য নিয়ে একজন মানুষ এতটা নির্দয় হয় কিভাবে । মাঝে মাঝে টুকটাক কিছু ধনদৌলত দিও এই ফকিরকে।
ঝিনুক কিঞ্চিৎ বিরক্ত নিয়ে,
আমাকে পড়তে দিবেন না?
পড়ো। গেলাম বলে আরশাদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ঝিনুক দরজা ভিতর থেকে আটকে দিলো। উড়ুউড়ু মন নিয়ে পড়তে বসলো।
ঝিনুকের হৃদয়ের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে একটা অদৃশ্য চাপা কষ্ট এখনো লেপ্টে আছে আরশাদকে নিয়ে। তাই নিজ থেকে এখনো আরশাদকে ভালোবাসি বলতে পারেনি। বরং আরশাদকে বোঝাতে চায় তার মনে কোন ফিলিংস নেই তাকে নিয়ে। তাই পড়া শেষ করার বাহানায় প্রতিরাতে আরশাদের পরেই ঘুমাতে যায়।
ঝিনুকের এমন শক্ত আচরণে আরশাদ ও বেঁকে গেলো এবার। ঝিনুক তাকে ভালোবাসে কিনা এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। সময় লাগছে লাগুক। সে আর নিজেকে বেহায়া করে তুলবেনা ঝিনুকের কাছে।
আরশাদ ঝিনুকের আবেগে টলটলে গড়িয়ে পড়া আঁখিপল্লব ভরা অশ্রুকণা দেখতে চায়। অধরের কাঁপুনি অবলোকন করতে চায়। বিরহে পোড়া অন্তরের আকুলিবিকুলি করা অব্যক্ত কথাগুলো শুনতে চায়। কাছে থেকেও না পাওয়ার যন্ত্রণা কেমন তা উপলব্ধি করাতে চায়।
আজ শুক্রবার। বাসা খালি। আরিশা রুমে অপেক্ষা করছে ঝিনুকের জন্য। ঝিনুক আরিশার রুমে গিয়ে বোঝালো,
বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ডের সাথে রুমডেটে যাওয়া একেবারেই অনুচিত। বাইরে দেখা করতে পারে তারা।
আরিশা রাগ হয়ে গেল তড়িতেই। বেয়াড়া আচরণ করে বসলো।
তোমার কি। পাও তো রোজ রাতেই।
ঝিনুক রাগ হয়ে গেল। তুমি কি দেখেছো পাচ্ছি কি পাচ্ছিনা? আর পেলেও কি। আমরা স্বামী স্ত্রী।
তাহলে বের হই? মন ছুটে গিয়েছে।
আমি জানিনা এ বিষয়ে। জানালো ঝিনুক। তুমি এক কাজ করো। নিলমকে বল তোমাদের বাসায় তার বাসা থেকে যেন প্রস্তাব পাঠায়। আমি বাবা মাকে বুঝিয়ে বলব আজই। তোমার ভাইয়াকেও জানাচ্ছি। কাবিন হয়ে গেলে তখন না হয় মাখামাখি করো।
আচ্ছা বলে আরিশা গোমড়া মুখে বসে রইলো। ঝিনুক বের হয়ে এলো।
ঝিনুক রুমে গিয়ে দেখে আরশাদ বিছানা ছাড়েনি এখনো। অলস ভঙ্গিতে কাত হয়ে আছে। ঝিনুক টেবিলের সাথে চেয়ার টেনে বসলো। আপনার কি মেজাজ ভালো এখন?
হুম ভালো। হঠাৎ আমার মেজাজের তলব কেন?
একটা জরুরী বিষয় আলাপ ছিলো।
বলতে পারো।
ঝিনুক আরিশার বিষয়ে সব ধীরস্থিরভাবে আরশাদকে বুঝিয়ে বলল।
আরশাদ মোবাইল স্কিনে কিছু দেখতে দেখতে ভারি গলায় জানালো,
যে নিজের গুলোই ঠিক করতে পারেনা,সে এসেছে অন্যের ঘটকালি করতে। হুহু! হাউ ফানি!
নিজের কোনটা পারিনি? সবিতো ঠিকাছে।
ঠিক থাকলেত বেশ। শুভকামনা রইলো কারো অনাগত জীবনের জন্য।
কারো শুভকামনার নিকুচি করি আমি বলে ঝিনুক উঠে গেলো।
আরশাদ তৃষিত নয়নে ঝিনুকের পিছন পানে চেয়ে রইলো। এতটা কাছ থেকে এমন করে কোন যুবতীকে এর আগে আর দেখা হয়নি। কি কমনীয়! কি লাসময়ী! তার পদধ্বনি যেন স্রোতস্বিনীর কলকল করে বয়ে চলা অবিরাম স্রোতধারা।
দুপুরে ঝিনুক ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হলো। চুল থেকে তোয়ালে খুলে নিলো। মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে লম্বা চুলগুলোর পানি ঝাড়তে লাগলো তাওয়েল দিয়ে। ঝাড়া শেষ করে মাথা তুলতেই দেখে আরশাদ সামনে দাঁড়িয়ে। তার গায়ে থাকা সাদা পাতলা পাঞ্জাবী স্থানে স্থানে ভিজে গিয়েছে। ঝিনুক অপ্রস্তত হয়ে গেলো।
আপনি না মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন? কখন এলেন?
অতশত জানিনা। কারো চুলের ভেজা পানি যেন আমার পাঞ্জাবি থেকে এক্ষুনি শুকিয়ে নেওয়া হয়। নতুন পাঞ্জাবি আমার। শাসনের সুরে বলল আরশাদ।
ঝিনুক ওড়না খুঁজে নিজের বুকের উপর মেলে দিলো। শুকনো পাতলা অন্য একটা তোয়ালে হাতে নিলো। বাধ্য স্ত্রীর মতো আরশাদের সামনে গেলো। আরশাদ দাঁড়িয়ে আছে। ঝিনুক পাঞ্জাবীর উপরে তাওয়েল চেপে চেপে পানিগুলো শুকিয়ে নিচ্ছে। আরশাদ দুচোখ বন্ধ করে ঝিনুকের চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলো।
মনে মনে বলল, কি স্নিগ্ধ আর পবিত্র দেখাচ্ছে ঝিনুককে। যেন গাছ থেকে টুপ করে ঝরে পড়া একটি গোলাপ। রোজ যদি গোসলের পরের ঝিনুককে দেখতে পেতাম। উফফস!
দেখুন ভাইয়া আপনার পাঞ্জাবীতে আর আমার চুলের ভেজা পানির ছিঁটেফোঁটাও নেই। মোটা গলায় বলল ঝিনুক।
থ্যাংকস আপুটা। এমন করে সবসময় আমার সব আদেশ যেন মানতে পারেন। সেই প্রার্থনাই রইলো।
ঝিনুক নিরবে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তার কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। কেন লাগছে সে যেন বুঝেও বুঝেনা।
ঝিনুককে এক দুপুরে জোবেদা বেগম বললেন,
মা তোমার স্বশুর গতকাল তোমার কোরান তেলওয়াত শুনেছে। আমাকে বলছে তোমাকে বলার জন্য। যদি পারো মাঝে মাঝে ভোরে আমাদের রুমে এসে কোরান তেলওয়াত করো।
ঝিনুক খুশিমনে রাজী হয়ে হয়ে গেলো। প্রায়ই স্বশুর শাশুড়ীর রুমে গিয়ে মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে কোরান তেলওয়াত করতে থাকে। কয় পাতা পড়ে আস্তে করে চলে আসে।
ঝিনুকের কোরান তেলওয়াতের মিহি সুর শুনলে জামান খানের চোখ ভিজে যায়। নিবিড় চিত্তে আকুল হয়ে শুনতে থাকে। তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর ও সংগীত হলো কোরান পড়ার সুর। কি সুমধুর করে নরম কন্ঠে পড়তে পারে তার বৌমা।
কলিজাটা শীতল হয়ে যায়। একসকালে ঝিনুককে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
এত সুন্দর সহী করে কোরান শরীফ পড়া কার কাছে শিখেছ মা?
ঝিনুক নমনীয়ভাবে বলল,
বাবা আমরা আগে গ্রামেই ছিলাম। আমাদের বাড়ির অদূরেই নামকরা একটা কওমি মাদ্রাসা আছে। আমি আরবি শিক্ষাটা ওই মাদ্রাসায় শিখেছি।
মাশাল্লাহ। বেঁচে থাকো মা। আল্লাহ তোমাকে নেক হায়াত দান করুক।
সময় গড়িয়ে যায় সময়ের নিয়মে।তিনমাস পরে ঝিনুকের বাবা চাকরি থেকে ইস্তফা নিলো। দুইদিন আগেই গ্রামে চলে গেলো জমি বিক্রির জন্য। রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়ে সব ফাইনাল করল ।
তার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী ঢাকা থেকে জামান খান, তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ এলো। জামান খান সবাইকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে নিয়ে এসেছে।
পুরো জমি রেজিষ্ট্রি হলো ফারজানা আখতার ঝিনুকের নামে। পরশসহ উপস্থিতি সবাই চকিতে বিষম খেলো।
এত কঠিন সারপ্রাইজড বাবা আমাদের দিলো। যা কল্পনার ও ত্রিসীমানায় ছিলনা। মনে মনে বলল আরশাদ।
কেউ মুখে কিছুই বলছেনা। কারণ রেজিষ্ট্রি অফিসের সামনে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনাও রয়েছে।
পরশ অবাক চোখে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,
ভাইসাহেব আমার থেকে জমি কিনে নিলেন আমার মেয়ের নামে? এতটা মহান হওয়া আদৌ প্রয়োজন ছিল কি আপনার?
জামান খান স্বস্তির দম ফেললেন। পরশের কাঁধে নির্ভরতার হাত রাখলেন।
যদি বলি মহান তো আপনি । আমি নই পরশ ভাই। আসুন আমরা কোন একটা হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে নিই।
পাশেই ঝিনুকের বাবা তাদের নিয়ে একটা নিরিবিলি হোটেলে ঢুকলো।
জোবেদা বেগম, আরশাদ, আরিশা এক পৃথিবী কৌতুহল নিয়ে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
জামান খান পরিবারের লোকজনদের উদ্দেশ্য বললো, জানি তোমরা কি ভাবছ। ভাবাটা অমূলক ও নয়। প্রতিটি মানুষ জীবন সমুদ্র পাড়ি দিতে দিতে অজস্র ভালো মন্দ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। তেমনি একটা ছোট্ট ইতিহাস আজ তোমাদের শোনাব । যা তোমাদের অজানা। তবে জানা দরকার। ঝিনুকের বাবা পরশ চেয়ারে বিনম্রভাবে মাথানত করে বসে আছে। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে খাবার টেবিলের উপরে।
কেউই আঁচটুকু করতে পারছেনা কি সেই অজানা ইতিহাস। শোনার অধীর আগ্রহ নিয়ে জামান খানের মুখপানে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে হয়ে আছে।
চলবে ঃ ১৪ ( উপযুক্ত মন্তব্য করে ও শেয়ার দিয়ে অনুপ্রাণিত করার বিশেষ প্রত্যাশা রইলো। ভালোবাসা অবিরাম। 💗)