তুমি_আছো_তুমি_রবে #পর্বঃ২১ #রেহানা_পুতুল

0
343

#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ২১ #রেহানা_পুতুল

জীবনের খেলাঘরটা নিদিষ্ট একটা ছকে আঁকা থাকে। তাই জীবন চলে জীবনের নিয়মে। তার নিজস্ব গতিতে। এর গতি পরিবর্তন করা কিংবা নিজের ইচ্ছেমতো খেলাঘরের ছক বদলে ফেলার চাবি কেবলমাত্র একজনেরই হাতে। তিনি স্বয়ং বিধাতা। তিনি মহান রাব্বুল আলামিন।

আরশাদ গগনবিদারি চিৎকার দিয়ে, আআ…আমি এক্ষুনি আসছি। আপনি কে ভাই?

আমি এখানের কর্তব্যরত পুলিশ। এসব পরে বলা যাবে। দ্রুত আসুন। ব্লাড লাগবে জরুরী।

জ্বি আসছি.. আসছি। প্লিজ আপনার নাম্বারটা অন রাখুন আমি হাসপাতালে আসা পর্যন্ত।

অবশ্যই বলে ওপাশ থেকে লাইন বিচ্ছিন্ন হলো।

আরশাদ ছোট বাচ্চার মতো কাঁদতে কাঁদতে মা, বাবা,সালেহাকে ডাক দিলো। সবাই ছুটে এলো। আরশাদ যতটুকু শুনেছে,ততটুকুই জানালো তাদেরকে।

সালেহা হুহু করে ও..ও ভাবিজানগো বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো। এই বাসায় ভাবিজান না থাকলে আমিও থাকুমনা কইলাম।

জোবেদা বেগমের মুখের দিকে তাকানোর জো নেই। দুচোখের কোন ভিজে চুপসে গেল চোখের পানিতে। আল্লাহর করুণা ভিক্ষা চাইতে থাকলেন ক্রমাগত ।

জামান খান নিজেকে শান্ত রাখলেন। ইন্টারকমে ফোন দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললেন। আরশাদ ট্রাউজারের সাথে একটা টিশার্ট গায়ে দিয়েই নিচে নেমে গেলো। জোবেদা বেগম মুহুর্তেই বোরকা পরে নিলেন। তারাও পিছন দিয়ে নিচে নেমে গেলো। গাড়িতে বসেই জোবেদা বেগম আরিশাকে জানালেন। ঝিনুকের বাবাকে জানালেন। ঝিনুকের ব্লাড় গ্রুপ কি জিজ্ঞেস করলেন।

তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, জানিনা আপা। জেনে জানাচ্ছি।

এরপরই ঝিনুকের বড় বোন জিনিয়া ভেজা গলায় ফোন দিয়ে জানালো ‘এ পজেটিভ ‘ রক্তের গ্রুপ।

রাতের যানজট অতিক্রম করে আরশাদ মা বাবা সহ হাসপাতালে পৌঁছে গেল। সেই নাম্বারে ফোন দিয়ে খুঁজে বের করলো ঝিনুককে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আছে ঝিনুক।

আধ মৃত ঝিনুকের কাছে সবাইকে পৌঁছাতে দিলনা ডাক্তাররা। জোবেদা বেগম ওয়ার্ডের সামনে বারান্দার পুরোনো একটি কাঠের বেঞ্চেতে বসে তসবিহ পড়ছেন।

পুলিশটি বলল আমার ডিউটি আছে। থানায় বাস চালক ও হেলপার আটক রয়েছে। আমি এখন যাই ভাই। বিস্তারিত জানার চেয়ে আগে পেশেন্ট বাঁচানো জরুরী। ওই যে উনার সাথের দুজন বান্ধবী আছে। পরে সব জেনে নিয়েন উনাদের থেকে।

ডাক্তাররা আরশাদকে জানালো চার ব্যাগ রক্ত যোগাড় করার জন্য ইমিডিয়েটলি। আরশাদ শুধু এক পলক ঝিনুককে দেখলো। নির্জীবের মত পড়ে আছে ঝিনুক। আরশাদের কলিজাটা কেউ যেন খুবলে খুবলে খাচ্ছে। যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হৃদয়টা।

মারিয়া শুনে আরিশার সাথে ছুটে এলো রক্ত দেওয়ার জন্য। তার সাথে মিলে গেল রক্তের গ্রুপ। এই ভিতরে ঝিনুকের পরিবারের সবাই উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।
ঝিনুকের মা হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো উন্মাদিনীর বেশে। মায়ের বিলাপ থামানোর সাধ্য কারো নেই৷ মারিয়া,জিনিয়া, তার বাবা পরশ, রক্ত দিলো এক ব্যাগ করে। আরশাদ তোড়জোড় করে আরেক ব্যাগ যোগাড় করলো পরিচিতজন থেকে। এরপর ক্রস ম্যাচিং এর জন্য সিরিয়ালে পড়ে আছে রক্তের ব্যাগ।

জামান খান অস্থির হয়ে বলছেন স্ত্রীকে, সরকারি হাসপাতালে এসব প্রসেসিং এ রোগী মারা যায় কত। নাকি ল্যাবএইডে নিয়ে যাব। কি করবো বলে হায়হুতাশ করতে লাগলেন তিনি। তারপর তাদের ঘনিষ্ঠজন পারিবারিক ডাক্তারের কথা মনে পড়লো। তিনি ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার। জামান খান অসহায়ের মতো তার কাছে সাহায্য চাইলেন। সেই ডাক্তার হাসপাতালে ফোন করে অনুরোধ করলেন, ঝিনুকের চিকিৎসার যেন বিন্দুমাত্র ত্রুটি বা গাফলতি না হয়।

তার কথা ম্যাজিকের মত কাজ করলো। নয়তো এতক্ষণ ঢিলেঢালা ভাবে চলছে অন্য সাধারণ রোগীদের মতই।

ওয়ার্ডের টেবিলে দায়িত্বরত ডাক্তাররা বারবার ডেকে যাচ্ছে। আপনাদের ব্লাড ম্যানেজ হয়েছে? চার ব্যাগ জরুরী।

আরশাদ গর্জন করে উঠলো ধরা গলায়,
আপনারা এদিকে রক্ত রক্ত করে চিল্লাছেন, আর ওদিকে ব্লাড দিতে গিয়ে সিরিয়াল। সিট খালি নেই। পরিক্ষা করতে গিয়ে সিরিয়াল,সিরিয়ালের শেষ নেই। হাসপাতাল থেকে কেনা রক্তগুলোওতো ভালোনা। এখানে চিকিৎসা ভালো বলেই আমাদের মত সচ্ছল পরিবারের পেশেন্টরা ও আসে। কিন্তু হাসপাতালের সিস্টেমে নানা ভুল। অসংখ্য অসঙ্গতি।

তারা আরশাদের কথা কানে নিলোনা। ঝিনুকের সুচিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কারণ মৃত্যুশয্যায় পতিত মানুষের প্রিয়জনদের এমন ক্ষোভ রোজ তাদের শুনতে হয়। তারা অভ্যস্ত এতে।

সব কিছু মিলিয়ে কয়েক ঘন্টা কেটে গেলো। রাত ও অনেক গভীর হলো। হাসপাতালে লাগোয়া ওয়ার্ডগুলো থেকে শোনা যাচ্ছে চিরচেনা বুকফাটা আহাজারি। ব্যথায় কাতর রোগীদের গোঙানি আর স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে হাসপাতালের গোটা আঙিনা।

ঝিনুকের দুচোখের পাতা মেলার ও শক্তি নেই। নিস্তেজ হয়ে হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। বুকের একপাশে জামা কেটে ছিদ্র করে জমাট বাঁধা প্রচুর রক্তগুলো বের করে নিলো আস্তে আস্তে। নয়তো অল্পসময়ের মধ্যেই ঝিনুক মারা যেতো। তারপরেই এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হলো । কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাগ রক্ত তেমন যাচ্ছেনা শরীরে। পালস উঠানামা করছে অনবরত। কারণ সব প্রসেসিং এ অনেক সময় লেগে গিয়েছে। কারোই কিছু করার ছিলনা।

সবাই বারান্দায় বসে হাত তোলে ঝিনুকের প্রাণ ভিক্ষা চাইছে স্রস্টার কাছে। ফরিয়াদ করছে শুধু ঝিনুক বেঁচে থাকুক। আর কিছুরই দরকার নেই। ঝিনুকের সিটের চারপাশ ঘিরে রয়েছে সব সিনিয়র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডাক্তারগণ। কেউ ভিতরে যেতে পারছেনা। ডাক্তারদের কড়া নির্দেশ তাই।

জামান সাহেব পুত্রকে ভিতরে যেতে দিচ্ছেন না। একটু পরপর নিজে গিয়ে ডাক্তারদের পিছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে তার প্রাণপ্রিয় একমাত্র পুত্রবধুকে।

একব্যাগ রক্ত শেষ হতেই বহু সময় লেগে যাচ্ছে। তৃতীয় ব্যাগ রক্ত দেওয়া শুরু হলো।

ঝিনুকের জ্ঞান আছে এখন পর্যন্ত। কিন্তু দুচোখ দিয়ে এ পৃথিবী দেখার ও মুখ ফুটে কিছু বলার সামর্থ্য নেই তার।

তার শুধু মনে পড়ছে মা পারুলের কথা। তার শিশুবেলার কথা। তখন তারা গ্রামে ছিলো। গরিব ছিল। বেকার বাবা কর্মের সন্ধ্যানে এই শহরে চলে এসেছে। একদুপুরে সে রাগ করে ভাত খায়নি। তরকারি পছন্দ হয়নি বলে। টিনের ভাতের থালাটা উঠানে ছুঁড়ে মেরেছে। তা দেখে মা পারুল তাকে বকেছে আর মেরেছে খুব। তারপর মা ও খুব কেঁদেছে তাকে বুকে লেপ্টে ধরে। এখন তার সেই পারুল মা টা কই। মায়ের মায়াভরা যাদুমাখা মুখটা কি একবার ও মরে যাওয়ার আগে দেখতে পারবেনা। একবার ও কি মায়ের কোলে মাথা রাখতে পারবেনা। আর কিছুই ঝিনুক মনে করতে পারছেনা।

ডাক্তার এসে জানালো পেশেন্ট ডেঞ্জারজোনে আছে। স্রস্টাকে ডাকুন। শরীর সাপোর্ট দিচ্ছেনা। রক্ত যাচ্ছে খুব স্লোলি।

আরশাদ মা বোনের মাঝখানে বসে আছে ক্ষয়ে যাওয়া প্রদ্বীপের মতো। মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। মানুষ যখন সবচেয়ে অসহায়ত্ববোধ করে নিজেকে। তখনই সবচেয়ে মমতার মানুষটির কাছে আশ্রয় নেয়। ডাক্তারের কথা শুনে ছোটবাচ্চার মতো কেঁদে ফেলল মাকে ধরে। বলতে লাগলো,
মা কি পাপ করলাম জীবনে। কেন জীবন থেকে সুখটা চলে যাচ্ছে মা। আমিতো কোনদিন ঝিনুককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে টু শব্দটাও করিনি। বরং ভালোবাসা আর কেয়ারিং করেই গিয়েছি। কিভাবে বাঁঁচব মা। আরিশা কিভাবে বাঁচবোরে বোন।

আরিশা থম মেরে আছে। কি থেকে কি ঘটে গেল তাদের পরিবারে। এ যেন এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা। ঝিনুকের বোন জিনিয়া বোনের জন্য অশ্রুপাত করতে করতে নাক চোখ ফুলিয়ে ফেলছে। বাবা পরশ হাত পা ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে।

ঝিনুকের মা পারুলের শরীরটাও যেন নিথর হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কেউ যেন তাকে এলোপাতাড়ি মেরেছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার প্রাণপাখিটা ফুরুৎ করে উড়াল দিবে। ঝিনুকের বন্ধু দুজন ও রয়েছে। তারা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঝিনুককে তারাই অনুরোধ করে নিয়ে গেল চিড়িয়াখানায়।

চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। মসজিদ থেকে ভেসে এলো আযানের সুরধ্বনি। সবাই অযু করে নামাজ পড়ে নিলো একিস্থানে। দোয়া দুরুজ পড়ছে। তারা আকুল হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে ঝিনুকের আপডেট জানার জন্য ।

ওয়ার্ডের গেটে একজন ডাক্তার এলেন। অনেক নারী পুরুষ দেখতে পাচ্ছেন তিনি। বিচলিত চোখে ডাক দিলেন, ঝিনুকের মা কে?

ঝিনুকের মা কাত চিৎ হয়ে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালেন। কাতর স্বরে বললেন আমিই মা।

আরশাদের বুকের ভিতর ধুকপুকানি ক্রমাগত বেড়েই চলছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
আমি আসব ভিতরে?

না কেউ আসার প্রয়োজন নেই। শুধু ঝিনুকের মা আসুন আমার সাথে।

চলবে…২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here