#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৫
জারিফের বিয়ের কথা শুনে মুন্নি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। দুপুরে কোচিং থেকে পরীক্ষা দিয়ে এসে মাকে চিন্তিত হয়ে সোফায় বসে থাকতে দেখায় জিজ্ঞাসা করেছিল আর তখনি জানতে পারে জারিফের বিয়ের কথা। জমিলা বেগম নিজেও জারিফের বিয়ের খবর কিছুক্ষণ আগেই জেনেছেন। নিজে স্বেচ্ছায় ফোন দিয়ে আপডেট জানতে চেয়ে জানতে পারেন। এখন একমাত্র মেয়ের পাণ্ডুর মুখশ্রী দেখে বুক ফেটে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে ঠিকই জানেন মেয়ের মনের খবর। মুন্নি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে দৌঁড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। জমিলা বেগম মেয়ের কাণ্ডে হতভম্বি হয়ে দেখলে মনে কিঞ্চিত শঙ্কার উপস্থিতি এলে মেয়ের রুমের দিকে ছুটেন। দরজায় কয়েকবার করাঘা*ত করলে ভেতর থেকে কান্নাজরিত কন্ঠে জবাব আসে,
“প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দেও। প্লিজ!”
জমিলা বেগম মেয়ের কান্নামাখা কন্ঠ শুনে অস্থির হয়ে পরেন। আরও দুয়েকবার করাঘা*ত করে ভেতর থেকে ফোঁপানো শব্দে জবাব শুনে তিনি মেয়ের রুমের সামনে থেকে সরে যান। মুন্নি ঢুকরে কাঁদতে থাকে। ছোটো থেকে দেখা সব থেকে কাঙ্খিত স্বপ্ন এক লহমায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। কাঁচ ভাঙা তীক্ষ্ম ফলার মতো হৃদয়ে বিদীর্ণ করে র*ক্তপাত করছে। জড়ানো কন্ঠে ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুন্নি নিজে নিজেই বলে,
“কেনো জারিফ ভাই? কেনো আপনি আমার মন বুঝলেন না? আমার ভালোবাসাটা কেনো বুঝলেন না? কী কমতি পরেছিল আমার ভালোবাসায়? কেনো আমার হৃদয় এভাবে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলেন? কেনো?”
আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ কেঁদে কে*টে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে পরে। শাওয়ারের পানির সাথে অশ্রুধারা পালাক্রমে বয়ে চলেছে। শাওয়ারের নিচে নিরব দুঃখ বিলাশ চলছে তার।
জমিলা বেগম তার ভাইকে আবারও ফোন করেন।
“কেনো করলে ভাই? আমার মেয়েটের কথা একবারও মনে হলো না? ছোট্ট মেয়েটা আমার কতোটা ভেঙে পরবে কোনো ধারণা ছিল না তোমার? তোমারই তো ভাগ্নি। তোমার ছেলেকে সে ভালোবেসেছিল নিশ্চয়ই বিয়ে করার আশায়! আত্মীয়র মধ্যে সম্ভাবনা দেখেই তো মনে ঠাই দিয়েছিল। সেই আমার মেয়েটাকে এভাবে কস্ট দিলে!”
জাবেদ সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরেন। বোনের কথার বিপরীতে কী জবাব দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এখন মনে হচ্ছে স্ত্রী ও পুত্রবধূ এই কারণেই জমিলাকে না জানিয়ে জারিফের বিয়েটা দিয়েছেন। জারিফ যেখানে মুন্নিকে বোন ছাড়া কিছু ভাবে না সেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে জোর করাটা বেমানান। জাবেদ সাহেব বললেন,
“দেখ বোন, তোর মেয়েকে আমার ছেলে বোনের নজরে দেখে। অন্য নজরে দেখে না। ছেলে আমার তোর মেয়েকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক না তাই আমার মনে হয়েছে ছেলেকে জোর করে প্রতিটা সম্পর্কে তিক্ততা না আনাটাই ভালো। মুন্নির এখন উঠতি বয়স। কিছুদিন পর মন ডাইভার্ট করতে পারবে। তুই মুন্নিকে একটু বুঝা। জোর করে বিয়ে করলে কেউ ভালো থাকতো না। এমন তো না যে ছেলে আমার দুঃখে ছিল যার দরুন তাকে ওর পছন্দের বাহিরে বিয়ে দিব! একটু বোঝার চেষ্টা কর। তুই বুঝালে মুন্নিমা বুঝবে দেখিস। মা’থা ঠান্ডা করে ভাব। রাখছি।”
জাবেদ সাহেব ফোন রেখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ‘মানুষ তার সব চাওয়া পায় না!’ কথাটা বড্ড ভারী। খনিকের জীবনে কেউ অপার সুখে থাকে কেউ দুঃখের সাগরে সাঁতরে বেরায়। যার অপার সুখ আছে সেও দেখো জীবনে কিছু না কিছু হারিয়েছেই। সুখ-দুঃখ মিলেই জীবন।
____________
জারিফ বাড়িতে এসে ব্যাগটা রেখে ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে সবে বিছানায় বসলো তখনি দরজায় নকের শব্দে দরজা খুলে নিজের বাবাকে দেখে হালকা হাসে। জাবেদ সাহেব ছেলের হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখে নিজেও হাসে। ছেলের মুখে দুঃখের লেশমাত্র নেই দেখে মনে মনে প্রশান্তি অনুভব করল। জারিফ তার বাবাকে ভেতরে আসতে বলে। জাবেদ সাহেব ভিতরে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করেন,
“কেমন গেলো দিন? প্রিয়া মায়ের সাথে দেখা হয়েছে?”
“তার ক্লাস নেই তো আমি। সে খুব নার্ভাস ছিল আজকে। ক্লাস শেষে তাকে ডেকে শান্ত থাকতে বলে দিয়েছি। ওর সেমিস্টারটা শেষ হলে যা করার করো। তার আনইজি লাগাটা স্বাভাবিক।”
জাবেদ সাহেব ছেলের প্রাণোচ্ছলতা দেখে হালকা হাসলেন। সে যে একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা বুঝতে পারছেন। মুন্নির জন্য খারাপ লাগলেও মুন্নি জারিফের জীবনে আসলে হয়তো জারিফ আজ এতোটা প্রাণোচ্ছল হতো না। জাবেদ সাহেব বলেন,
“হ্যাঁ। সেটাই করব। একে অপরকে আরও জানবে বুঝবে। তোমাকে হাসি খুশি দেখে মন থেকে একটা বোজ নেমে গেলো।”
জারিফ তার বাবার হাত ধরে বলে,
“তোমাদের কনসার্ন আমি বুঝি বাবা। পিএইচডি আমি পরেও করতে পারব। তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। অন্য সংস্কৃতির কোনো মেয়েকে মানতে সবাই পারে না। তাছাড়া মারিয়া আমার গুড ফ্রেন্ড। সে একটু খোলামেলা ধরনের। তুমি নিজেকে দোষ দিও না।”
জাবেদ সাহেব স্বস্থি পান। ছেলের কাঁধে হাত বুলিয়ে চলে যান। জারিফ বাবার গমনপথে তাকিয়ে তারপর উঠে নিজেই ব্ল্যাক কফি বানিয়ে এনে দরজা লাগিয়ে ল্যাপটপে কাজ করতে থাকে।
________
প্রিয়া ভার্সিটি থেকে এসে নামাজ আদায় করে বিকেলে একটু গাছে পানি দিয়ে সন্ধ্যার নামাজের পর পড়তে বসেছে। ফোনটাকে দশ হাত দূরত্বে সুইচঅফ করে রেখে পড়ছে। প্রিয়ার মা এসে অবাক চোখে দেখে গেছেন। তার বিশ্বাস হচ্ছে না মেয়ে তার এতো মন লাগিয়ে পড়ছে। সামনের সপ্তাহে মিড১ পরীক্ষা জানেন কিন্তু সবসময় পরীক্ষার আগেরদিন এভাবে পড়তে দেখেছেন। আজকে ভীন্নতা দেখে নিজেই নিজের চোখ-মুখের জলের ছিঁটা দিচ্ছেন যদি সবটা ভ্রম হয়ে থাকে!
প্রিয়া মন দিয়ে পড়ছে। তাকে এই সেমিস্টারের সব সাবজেক্টে ভালো করতে হবে। স্যারের বউ হয়েছে এখন খারাপ রেজাল্ট করলে তার সহ স্যারেরও মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। পড়ালেখার দুশমন ওই ফোনটাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। প্রিয়ার মা আবার এসে দেখে গিয়ে খুশি মনে প্রিয়ার জন্য চকলেট হরলিক্স বানাতে গেছেন। প্রিয়ার খুব পছন্দের চকলেট হরলিক্স।
_______
আয়ান রিসোর্টের রুফটপে উঠে একা একা চন্দ্রবিলাশ করছে। আজকে পূর্ণচন্দ্র না তবে মৃদু জোৎসনা আছে। আকাশে তারকারাজি জ্বলজ্বল করছে। আয়ান কানে হেডফোন গুঁজে ‘শ্রেয়া ঘোষালের’ একলা আকাশ গানটা শুনছে। ইদানীং এই গানটা তার বড্ড প্রিয় হয়ে গেছে। নিজেকে খুঁজে পায় গানের মাঝে। আজকে সারাদিন হোটেলেই শুয়ে বসে ছিল। আগামীকালকে ঘোরাঘুরি করবে। একদিন ঘোরাঘুরি করে পরশু সকাল সকাল রওনা হবে। মনটাও ভালো হবে। একা একা ঘোরাঘুরির একটা আলাদা মজাই আছে। আয়ান নিজ মনে হাসে। প্রিয়া ভালো থাকুক এটাই চায়। ছয়টা সেমিস্টার শেষ হলে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে এব্রোডে চলে যাবে। তবে এই ছয়টা সেমিস্টার তো কম সময় না। প্রিয়াকে প্রতিনিয়ত নিজের চোখের সামনে দেখবে সাথে জারিফ স্যারকেও। নিজের ধৈর্যশক্তি আরও বাড়াতে হবে। পড়ালেখাতেই ফোকাস করতে হবে।
——–
জারিফ রাতের খাবার খেয়ে ফেসবুকে স্ক্রলিং করছে তখন প্রিয়ার আইডি সামনে এলো কারণ প্রিয়ম বাসায় গিয়ে মায়ের মুখ থেকে প্রিয়ার পরিবর্তনের কথা শুনে প্রিয়াকে ট্যাগ করে পোস্ট দিয়েছে যে,
“আমার বোনটা রাতারাতি বদলে গেলো! এই পরিবর্তনের পেছোনে মূল হোতা কে? জানতে চোখ রাখুন আমার আইডিতে।”
বিকেলেই জারিফ প্রিয়মকেও মানা করেছে বিয়ের ব্যাপারটা সামনাসামনি এখনি না আনতে। এমনকি জারিফের পরিবারও প্রিয়ার পরিবারকে বলেছিল আকদের দিনই। জারিফ প্রিয়মের পোস্ট দেখে হাসলো। প্রিয়ার অ্যাকাউন্ট লক করা। রিকুয়েস্ট পাঠাবে কি পাঠাবে না করে আর পাঠালো না। প্রিয়াই নাহয় আগে দিক। মারিয়া নক করে। মারিয়া জানায় সামনের মাসে জেমসের সাথে মারিয়ার বিয়ে ঠিক। জারিফ যদি পারে তবে আসতে। জারিফও মারিয়াকে বিয়ের কথাটা জানায় সাথে সবকিছু ডিটেইলসে বলে। মারিয়া এখন নিজের বিয়ের থেকে তিন মাস পর জারিফের বিয়ের জন্য এক্সাইটমেন্ট দেখাচ্ছে। সে তখন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসবে জেমসকে নিয়ে।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।