#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪২
সময় যতো যায় সম্পর্ক ততো গাড়ো হয় নয়তো ফিকে হয়। সময়ের জোয়ারে নতুন সম্পর্ক গঠিত হয়। মুন্নি ও রাদিফের আজ বিয়ে। অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে। প্রকৃতিতে শরৎকালের শেষ সময়। দূর্গা পূজোর ছুটিতে বিয়ের আয়োজন করে ফেলেছে। ঢাকা থেকে জারিফরাও হাজির। জারিফ ও জায়ান গেস্টদের ওখানে দেখাশোনা করছে আর প্রিয়া ও তামান্না মুন্নির কাছে ওর ঘরে আছে। প্রিয়া মুন্নিকে বারবার দেখছে। মেয়েটা দেখতে মায়াবি। মায়াবি মুখশ্রীর অধিকারিণীকে জারিফ নজর-আন্দাজ করে দিলো! মুন্নি কয়েকবার লক্ষ্য করেছে প্রিয়ার তাকানো তাই তামান্নাকে বলে,
“ভাবী একটু মাকে ডেকে দিবে? সাথে আমার জন্য একটু পায়েস নিয়ে আসোনা। ভাইয়াকে বলো সে ব্যাবস্থা করে দিবে।”
তামান্না উঠে গেল। ঘরের ভিতর থাকা অন্যদের মুন্নি একটু বাহিরে যেতে বলে। ওরা বাহিরে যাচ্ছে তাই প্রিয়াও যাওয়া ধরলে মুন্নি ওর হাত টেনে ধরে।
“আপনি যাবেন না।”
প্রিয়া কিছুটা বিস্মিত হয়। সবাই বেরিয়ে গেলে মুন্নি প্রিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“এতক্ষণ যাবত আপনি আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন তাই না?”
প্রিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মুন্নি হেসে বলে,
“ভাবছেন আমি সুন্দরী হওয়া স্বত্বেও আপনার স্বামী আমাকে রিজেক্ট করল কেনো? জানেন? এই প্রশ্ন আমারও মন মস্তিস্কে ঘুরপাক খে*তো। তারপর আমার বাবা আমাকে বুঝালো। যার চোখে যে সুন্দর। আপনার স্বামীর চোখে আমি বোন তাই আমার রূপ-সৌন্দর্যে তার কিছু যায় আসত না। আপনি ভাগ্যবতী বটে। আপনাকে একসময় আমি ঈ*র্ষা করেছিলাম। এখন আর সেই ঈ*র্ষা নেই। যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে। আমার জীবনে এমন একজন এসেছেন, যিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। চারটা মাস বন্ধুর মতো তিনি আমার পাশে ছিলেন। আমাকে তার সাথে সহজ করেছেন। আমার না বলা অনেক কিছু বুঝে নিয়ে তা পূরণ করেছেন। তাছাড়া তিনি মাশাআল্লাহ্ অনেক সুন্দরও। জানিনা ভালোবেসে ফেলেছি কীনা? হয়তো তার জন্য ভালোবাসা জন্মে গেছে। তিনি আশেপাশে থাকলে মানুষিক শান্তি পাই। ভরসা পাই। আর কি চাই বলুন?”
প্রিয়ার ওষ্ঠকোণে প্রশান্তির হাসির রেখা ফুটলো। মুন্নির মনে যে তাকে নিয়ে তিক্ততা নেই সেটা জেনে স্বস্থি পেলো। ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করল। সেখানে একজোড়া ডায়মন্ডের টপ ইয়ারিং আছে। সেটা মুন্নির হাতে দিয়ে বলল,
“এটা আমার ও জারিফের পক্ষ থেকে। তোমার জীবনে রাদিফের সাথে সুখের মুহূর্তগুলো সর্বদা উজ্জ্বল হয়ে থাকুক। আমাদের জন্যও দোয়া করো।”
“এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি আপনাদের নিয়ে মনে কোনো অসন্তোষ রাখিনি।”
“অসন্তোষের জন্য না। আমাদের জন্য তোমার জীবনে কিছু সময়ের জন্য হলেও অন্ধকার ভর করেছিল। সেই অন্ধকার তোমার জীবনে আর না আসুক। বলতে পারো, আলোর দিশারী স্বরূপ দিলাম। তোমার জীবনের শুভ কামনা স্বরূপ।”
মুন্নি চোখে হাসল সাথে প্রিয়াও। ততক্ষণে মুন্নির মা হাজির। তিনি মেয়ের কী লাগবে তা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেন। প্রিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে বিয়ে বাড়িতে জারিফকে খুঁজছে। এই ভারী লাল বেনারসি পড়ে সে ভাবছে আশেপাশের মানুষ আবার তাকে বউ ভেবে ভুল না করে! হলোও তাই। এক বয়স্ক মহিলা এসে কিছুটা সন্দেহের নজরে দেখে সুধায়,
“এই মেয়ে! কোথায় যাচ্ছ? একটু পর তোমার বিয়ে পড়াবে আর তুমি এখানে ঢেং ঢেং করে হাঁটছ! কোনো অন্য মতলব আছে নাকি?”
প্রিয়া ঠোঁট উলটে তাকায় অতঃপর করুণ স্বরে বলে,
“আন্টি আমি মুন্নি না। আমি ওর কাজিনের ওয়াইফ। মুন্নি ওইযে কোনার দিকের দ্বিতীয় ঘরটাতে আছে।”
মহিলাটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চোখে চশমাটা ঠেলে বলে,
“অহ। এজন্যই বলি? মাথায় ওড়না কোথায়? এমন পাথরের গহনা কেনো? তা বাপু? তোমাকে কি বিয়েতে গহনাগাঁটি দেয়নি? কিসব পা*থর পড়ে আছ!”
প্রিয়া মহিলাটির কথায় বিরক্তই হলো বেশ।
“দিয়েছে আন্টি। সেই ঢাকা থেকে তো সব আনা যায় না। তাছাড়া আমি যদি সেসব পড়ি তবে আপনি তো আমার এই সাঁজেই বউয়ের সাথে গু*লিয়ে ফেলেছেন! তখন তো আমাকে জি**ম্মি করে আমার দ্বিতীয় বিয়েও সেরে ফেলতেন! আপনার মনের শান্তির জন্য পরশু বউভাতে আমি ওসব পড়বনে। চোখ দিয়ে দেখে নিবেন তখন।”
প্রিয়া এই বলে সরে গেলো। আরেকটু পর জারিফকে দেখল বরের বাড়ির মানুষদের সাথে কথা বলছে। প্রিয়া নিশ্চুপে জারিফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জারিফ একপলক দেখে হেসে আবার কথা বলছে। কথা বলা শেষে জারিফ প্রিয়াকে নিয়ে বাগানের দক্ষিণ পাশে যে শিউলি ফুল গাছটা আছে সেটার কাছে। গাছটার নিচে চাদরের মতো শিউলি ফুলগুলো বিছিয়ে আছে। জারিফ গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়াকে বলে,
“কী ব্যাপার? তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়ালে অথচ কিছু না বলে দাঁড়িয়েই ছিলে। মন বুঝি খুব খুশি?”
প্রিয়া জারিফের দিকে এগুলো। তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“মনে জমে থাকা মেঘ কে*টে গেছে। বুক ভরে প্রশান্তির শ্বাস নিতে পারছি।”
জারিফ প্রিয়ার গালে স্লাইড করে ঘোরলাগা স্বরে বলে,
“বাই দা ওয়ে! তোমাকেই তো বউ বউ লাগছে। কেউ আবার তোমাকে নিয়ে ধরে বেঁধে বিয়ে না দিয়ে দেয়! আমার একমাত্র বউকে আমি অকালে হারাতে পারব না। তুমি আমার সাথে সাথেই থাকবে।”
প্রিয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছিল তন্মধ্যে হেসে ফেলে।
“দিতো তো। ভাগ্যিস উনার এক্সপেক্টেশন অনুসারে আমি সাঁজিনি।”
দুজনেই হেসে উঠল। জারিফ এক মুঠো শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বলে,
“একদিন শিউলিমালা খোঁপায় গেঁথে আমার শরৎশশী সাঁজবে প্রিয়। আমি মুগ্ধ নয়নে দেখব।”
সমীরণে আজ প্রেমের ছোঁয়া। হৃদয়ে প্রখর অনুভূতিরা ঠিকরে পরছে।
____________
মুঠো ভর্তি কাশফুল হাতে নিয়ে পিহুর উচ্ছাসতা দেখছে আয়ান। বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসছে। পরী ও রাদ এদিকে কিছুটা দূরে কাশফুলের সাথে ছবি তুলতে ব্যাস্ত। নিশি, মিম, অর্ষা, অন্যপাশে ছবি তুলছে তাদের ক্যামেরাম্যান সাদ! আয়ান দেখল পিহুর ঝাঁকানোর কারণে কাশফুলের রেণু অনেক ছড়িয়ে পরছে তাই দ্রুত ওর হাত থেকে ফুলগুলো ফেলে দিয়ে বলে,
“এই রেণু কিন্তু চোখের জন্য ক্ষ*তিকর। অনেক লা*ফালে এবার চলো।”
পিহু আয়ানের ধরা হাতের দিকে তাকালো। এতোদিনে ওদের বন্ধুত্ব আরও সুন্দর হয়েছে। পিহুর ভালোবাসা আরও গাড়ো হয়েছে আর আয়ানের মনে হচ্ছে সে এই বাচ্চা স্বভাবের মেয়েটির ভালোবাসায় আটকে গেছে। আয়ান পিহুর নজর দেখে হাতটা আরও জোড়ালো ভাবে ধরল। পিহু মুচকি হাসে। সূর্যরশ্মি মৃদু আঁচ দিচ্ছে। সূ্র্যের দিকে তাকিয়ে কদম বাড়াতেই হোঁ*চট খেতে নিলে আয়ান সামলে নেয়।
“পরে যেতে তুমি।”
“আপনি আছেন তো।”
এই ভরসাস্বরূপ জবাবে আয়ান স্নিগ্ধ হাসলো। কিছুটা দূরে এক হাওয়াই মিঠাইওয়ালা দেখলে পিহু বলে ওঠে,
“ওই দেখুন। ওখানে নিজেদের পছন্দ মতো শেইপে হাওয়াই মিঠাই বানানো যায়। চলুন খাব।”
আয়ান পিহুকে নিয়ে গেল। বেচারি শাড়িতে বারবার পা পেঁচিয়ে যাচ্ছিল। একটা লাভ শেইপ হাওয়া মিঠাই বানাতে বলল। সেটা নিয়ে পিহু আয়ানের সাথে সেলফিও তুলল। আয়ান মনে মনে ভাবে,
“আমার যাওয়ার দিন তোমাকে উপহারস্বরূপ দেওয়ার আরও একটা কিছু যুক্ত হলো। তোমার মুখের বিষাদময়তায় এক টুকরো হাসির কারণ হবে।”
________
দেখতে দেখতে জারিফ ও প্রিয়ার এনিভার্সিরি চলে আসে। বসন্তসাঁজে প্রিয়া নিজেকে সাঁজিয়েছে। খোঁপায় তার বেলিফুল। সাদার মধ্যে হরেক রঙের ফুলের সমাহার শাড়িতে। জারিফকেও ম্যাচিং পাঞ্জাবি পড়িয়েছে। আজ ওরা রবীন্দ্র সরোবরে এসেছে। জারিফ বেলিফুল ও কাঠগোলাপের মালা কিনে প্রিয়ার দুহাতে পড়িয়ে দিয়েছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসেছে ওরা। প্রিয়া বলে,
“কীভাবে একটা বছর পেরিয়ে গেলো বলুন? সব কেমন দ্রুত চলে গেল না? এইতো সেদিন আমাদের পরিচয় হলো।”
জারিফ একটা কৃষ্ণচূরা প্রিয়ার কা*নের পিঠে গুঁজে বলে,
“একদিন আমরা বুড়ো হবো। তখন দুজনে আবার আসব এখানে। সাথে নাতি-নাতনী থাকলে মন্দ হয় না বলো?”
“ইশ! এখনও বাচ্চাই হলো না আর সে নাতি-নাতনীর চিন্তা করে!”
“হবে তো। তোমার গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট হোক।”
প্রিয়া আফসোস করে বলে,
“ভেবেছিলাম, বিয়ে হবে আর পড়ব না। কিন্তু কপালে তো শান্তি নাই। স্যারের সাথে বিয়ে হলো।”
জারিফ হেসে উঠল যার দরুন প্রিয়া ওর বাহুতে থা-*প্প**ড় দিলো। জারিফ রম্যস্বরে বলে,
“আমার আরও দূরদর্শী চিন্তা আছে। তোমাকে নিয়ে কানাডা যাব। আমি পিএইচডি করব আর তুমি মাস্টার্স ও পিএইচডি করবে।”
প্রিয়া চোখ রসোগোল্লার মতো বড়ো বড়ো করে বলে,
“কিহ! গ্রাজুয়েশনের পর আমি অতো প্যা*রা নিতে পারব না। আপনার মন চাইলে ডাবল ত্রিপল পিএইচডি কইরেন। আমাকে টানবেন না। আমি তো রিল্যাক্স করব।”
“আচ্ছা! তখন দেখা যাবে।”
সন্ধ্যার বাতায়নে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। জীবনের প্রহর থেকে আরও একটি বাৎসরিক সন্ধ্যা বিদায় জানাচ্ছে ওদের।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।