#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ১২ #রেহানা_পুতুল
যে মানুষটার প্রতি তিলতিল করে অনুরাগ জমতে শুরু করলো তার মনের চিলেকোঠায়। সে কি করলো এটা। এখন অপেক্ষা কেবল ভোরের । তারপরেই ঝিনুক পালাবে।
সকালে আরশাদ জেগে দেখে ঝিনুক নেই। তারও দুঃচিন্তায় ভারি ঘুম হয়নি রাতে। উঠে গিয়ে নিজে নিজে সারাবাসায় ঝিনুককে খুঁজলো। নেই। কোথাই তার ঝিনুক নামের বধুটা নেই।
বারবার ফোন দিয়েও ঝিনুকের মোবাইলের সুইচড অফ পেলো। ইন্টারকমে ফোন দিলে গার্ড ভাববে, তারা কেন জানেনা ঘরের বউ কোথায়। এই ভেবে ফোন দেয়াও সম্ভব হলোনা। আরশাদ তার রুমে গিয়ে মাথায় দুহাত দিয়ে বসে আছে। যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
_______
শান্ত ভোরের মৃদু হিমেল হাওয়া বইছে। শহরের পিচঢালা পথে দু চারজন জনমানবের আনোগোনা দেখা যাচ্ছে। ঝিনুক লম্বা লম্বা কদমে এগিয়ে গেলো সিএনজি স্টেশনের দিকে। একবার মরা চোখে মাথা তুলে উপরের দিকে চাইলো। বিদুৎতের কালো তারের উপরে চুপটি মেরে বসে আছে একলা নাম না জানা পাখিটি। সেও হয়তো ঝিনুকের মতো সঙ্গীর কাছ থেকে দুঃখ পেয়ে নীড় ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।
খালি রাস্তা অতিক্রম করে ঝিনুক তাদের বাসায় চলে গেলো অল্প সময়ের মধ্যেই । তাকে এত সকালে একা দেখেই তার মা পারুলের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।
ঝিনুক নিজ থেকেই মাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ দিলোনা।
অলশ ভঙ্গিতে বললো,
টেনশনের কিছুই নাই আম্মু। কাল রাত থেকেই তোমার জন্য মনটা খাঁ খাঁ করছে । একদম সে বাসায় মন টেকাতে পারছিনা। ঢাকা শহর হলো যানজটের শহর। তাই বেলা না গড়াতেই ফ্রি রোডে চলে এলাম। বলেই ঝিনুক শুকনো হাসি দিলো।
পারুল বেগম বললেন, যা ফ্রেস হয়ে নে। নাস্তা খাবি। তোর মুখ দেখেই বুঝেছি পেটে দানা পানি পড়েনি বেশ সময় ধরে। শুন বিকেলে জিনিয়াও আসবে তোর দুলাভাই সহ।
ওয়াও। তাহলে হেব্বি মজা হবে। আমার রুশদী মনিকে বুকে পাবো। আম্মু তুমি ভাত রেডি করো। এক থালা ভাত খাবো মলা মাছের শুটকি ভর্তা দিয়ে। আর কাল সকালে ডালের বড়া দিয়ে পান্তা ভাত খাবো। সাথে মচমচে শুকনো মরিচ ভাজা। ওহ! কতদিন খাইনা আমাদের সেই মধ্যবিত্তের প্রিয় খাবারগুলো ।
ঝিনুক রুমের ভিতরে গিয়ে বাবা পরশকে সালাম দিলো। আদরের ছোটমেয়েকে এ সময়ে কাছে পায়ে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। বাবার কাছে তাদের বাসার অনেক গুনগান করলো ঝিনুক। মা পারুল ভর্তা ভাত রেডি করে ডাক দিলো বাবা মেয়েকে। ঝিনুক মা বাবার মাঝখানে বসে আয়েস করে ভাত খেয়ে নিলো।
এখন তার একটু ভালো লাগছে।
‘ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি । ‘ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য জীবনকে কতটা নিংড়ে দেখেছেন বলে এই অমর চরণ লিখতে পেরেছেন। ভেবেই ঝিনুক বেসিনে হাত ধোয়ার জন্য উঠে গেলো।
ঝিনুকের মোবাইল এখনো অফ পাচ্ছে আরশাদ। না আর পারা যায়না এই ঝিনুককে নিয়ে। কি জবাব দিবো আমি সবাইকে। তখনই দরজা ঠেলে জোবেদা বেগম ঢুকলেন । আরশাদের গলা শুকিয়ে গেলো মাকে দেখেই। ঢোক গিলতে লাগলো থেমে থেমে।
আম্মু আসো। বসো।
শোন, ঝিনুক তার বাবার বাসায় গিয়েছে ভোরেই নামাজ আদায় করে। বাবা মায়ের জন্য নাকি মন কাঁদছে। তুই যদি যেতে বাগড়া দিস তাই তোকে রাতে বলেনি। বলছে চলে আসবে দুদিন থেকেই।
বড় দম ফেলে আরশাদ বললো, আর আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি ওকে না দেখে। নাম্বার ও অফ পাচ্ছি।
রাতে চার্জ দিতে মনে ছিলোনা। এটাও আমাকে বলছে।
আচ্ছা আম্মু।
হ্যাঁরে আশু তোর কি ওকে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে?
না আম্মু। কোন সমস্যা হচ্ছেনা। তবে ওর ইগোটা একটু বেশী। আর জেদ ও আছে কিছুটা।
বাবা মায়ের ছোট সন্তান। একটু অমন তো হবেই। সব দিক দিয়ে দুনিয়াতে কোন মানুষই শুদ্ধ নয় বাবা। তুই নিজেকে দেখ। নিজের বোনকে দেখ। ঝিনুকের চেয়ে কম কিসে সে। দুদিন পরে তুইই গিয়ে নিয়ে আসিস। বুঝলি।
হ্যাঁ বললো আরশাদ নিরাশ কন্ঠে।
জোবেদা বেগম চলে গেলো। আরশাদ ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। খাটের উপর এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। ঝিনুকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় দুচোখ আরক্ত হয়ে উঠলো।
খালি বন্ধ রুমে আরশাদ ঝিনুককে স্মরণ করে আপন মনে অনুধাবন করতে লাগলো ,
ঝিনুককে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায় সে কতটা উঁচু বংশের ও ভদ্র ফ্যামিলির সন্তান। নিজের স্বামীকে ছোট করে দেয়নি দ্বিতীয় কারো চোখে।
চাইলেই ঝিনুক তার বাসার ও আমার বাসার সবাইকে কালকের বিষয়টা জানাতে পারতো। উচ্চস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারতো। স্ত্রীর অধিকার নিয়ে মারিয়াকে অপমান করতে পারতো। আমার সাথে বাজে আচরণ করতে পারতো। সবার কাছেই সবাইকে ছোট করে দিতে পারতো।
যে কাজটা অন্য কোন স্ত্রী হলে অবলীলায় করে ফেলতো ক্রোধের বশবতী হয়েই।
কিন্তু ঝিনুক এসবের কিছুই করলোনা। ধূপশিখার মতো নিরবে জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যে করেই হোক ঝিনুকের ভুল ভাঙ্গাতেই হবে। সত্যিটা ওকে জানিয়ে দিবো । কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব। আমিতো অন্য ছেলেদের মতো রসিয়ে রসিয়ে কথাও বলতে পারিনা। পারলে কি প্রেম না করে থাকতাম।
যতটুকু বর্তমানে পারি। তাও ঝিনুকের জন্যই। কেমন করে তা পারি এটা চিন্তা করে নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই।
শুরু থেকেই আমাকে নিয়ে তার মনে যে ইম্প্রেশন তৈরি হয়েছে তা কিভাবে দূর করবো। ভীষণ অভিমানী বধুটা আমার।
আরশাদের দুচোখের কোন আদ্র হয়ে উঠলো। হাতের তালুর একপাশ দিয়ে দুচোখ মুছে নিলো। আমি তোমাকে ভালোবাসি ঝিনুক। বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার মতো একজনের জন্য অপেক্ষার সীমানায় দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনবো অনন্তকাল ধরে। যে কালের কোন শেষ নেই। তুমি ছাড়া আমার হৃদয়টা শূন্য বিরানভুমি।
আরশাদ কল্পনার অথই জলে ভেসে যেতে লাগলো গন্তব্যহীন ভেলার মতো। মোবাইল হাতে নিয়ে ইউটিউবে গেলো। সার্চ করলো বেস্ট অফ আইয়ুব বাচ্চু লিখে। তিঁনি তার প্রিয় গায়ক।
বন্ধুদের কাছে শুনেছে নব্বই দশকের বাংলাদেশের ছেলেরা নাকি প্রেমিক হয়ে উঠেছে তার স্যাড রোমান্টিক গানগুলো শুনে শুনেই। সেও প্রেমিক হতে চায়। শুধু ঝিনুক নামের যুবতী মেয়েটির অবাধ্য প্রেমিক।
প্লে লিস্ট থেকে একের পর গান বেজে চলছে। আরশাদ নেত্রপল্লব বুঁজে যেন ধ্যানে ডুবে গেলো।
‘” কোনো সুখের ছোঁয়া পেতে নয়/
নয় কোনো নতুন জীবনের খোঁজে/
তোমার চোখে তাকিয়ে থাকা আলোকিত হাসি নয়।
আশা নয়, না বলা ভাষা নয়
আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি
তাই তোমার কাছে ছুটে আসি।
বুকের একপাশে রেখেছি জলহীন মরুভূমি।
ইচ্ছে হলে যখন-তখন অশ্রুফোঁটা দাও তুমি।
তুমি চাইলে আমি দেবো অথৈ সাগর পাড়ি।
আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি
তাই তোমার কাছে ছুটে আসি। ”
তারপরে শুনলো জুয়েল মাহমুদের গান।
” এ কোন ব্যাথায় বুক ভেঙে যায়,
কখনো বোঝোনি তুমি।
…..
কতটা ব্যাথা পেয়ে কেঁদেছি এই আমি
কি করে তোমাকে বুঝাই।
কি করেএএ..বলনা তুমিইই।
আমার চোখ বেয়ে বেয়ে,
বয়ে গেছে দুঃখেরি নদী ।
একা চাঁদ জাগে রাত আমার সাথে,
দুজনে সমান বিবাগী।
অনেক অভিমানে রাত উদাসী
তারারা আলো জালেনি।
কি করে তোমাকে বুঝাই,কি করেএএ..”
তোমার পথ চেয়ে চেয়ে
ফাগুন গিয়েছে চলেএএ…”
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। আরশাদের মগ্নতা ছুটে গেলো। দরজা খুললো অনিচ্ছাকৃতভাবে।
এই ছেলে গেট লক করে কি করছো ভিতরে? ঝিনুক নাকি চলে গিয়েছে? দেখলে কি চতুর মেয়ে। কি বলে গেলো আন্টির কাছে। যদিও এটা তোমার আমার জন্য উপকার হয়েছে। কেউই বুঝলোনা কিছুই। এ হিসেবে ঝিনুককে ধন্যবাদ দিতেই পারি তুমি আমি। নাকি বল ইয়ার? খোশ মেজাজে একটানে কথাগুলো বলল মারিয়া।
আরশাদের রাগ এবার চূড়ায় উঠলো।
তোর ওড়না কই? বেহায়া কোথাকার। লিমিট ক্রস করে ফেলছিস তুই। ঝিনুককে নিয়ে আর কোনদিন কিছু বলবিনা। খবরদার বলছি। তুই নিজেকেই তেতো করে ফেলছিস আমার কাছে।
ওড়না ছাড়া মনে হচ্ছে তুমি আর আমাকে দেখনি? নাকি সামান্য গাঁদা ফুলের খুশবু নিতে নিতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে? এখন আর অসামান্য রজনীগন্ধার খুশবু মনে ধরেনা? তাচ্ছিল্যের বেগে বলল মারিয়া।
তুই যাবিই বলে আরশাদ টেবিল থেকে দামী কাচের গ্লাসটি জোরে আছড়ে ফেললো মেঝেতে। ঝনঝন শব্দ শুনে আরিশা ও তার মা ছুটে এলো। সারামেঝেতে কাচের অজস্র গুঁড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
মারিয়া চোখ লাল করে রুম ছাড়লো।
কি হয়েছেরে? কার হাত থেকে পড়ে ভাঙ্গলো?
আমিই ভেঙ্গেছি। কারো হাত থেকে পড়েনি।
তুই পাগল নাকি? এত সুন্দর নতুন গ্লাসটা ভাঙ্গলি কেন? কঠিন গলায় জানতে চাইলেন জোবেদা বেগম।
তোমার নয়নমণি ভাগনিকে জিজ্ঞেস করো। যাও।
তুই বলতে পারিসনা?
নাহ পারিনা। থমথমে গলায় বলল আরশাদ।
আরিশা ও জোবেদা বেগম চলে গেলো। সালেহা এসে রুম পরিষ্কার করে নিলো। রান্নাঘরে গিয়ে কাচের গুঁড়াগুলো বিনের মধ্যে ফেলে দিলো। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখলো কেউই নেই। বিড়বিড় করে বলল,
হায়রে বড়লোকের রাগ। কত দামী গ্লাসটা চুরমার করে দিলো। আমার ও কতদিন রাগ উঠছে আর এমন একটা গ্লাস ভাঙ্গতে খুব মন চাইছে। কিন্তু পারিনাই। কই পামু এত দামী গ্লাস ভাঙার জন্য। বলেই সালেহা একটা ওয়ানটাইম গ্লাস হাতে নিলো। পায়ের নিচে ফেলে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিলো। বলল। ওহ কি শান্তি লাগতাছে।
মারিয়াকে ডাক দিয়ে জোবেদা বেগম গ্লাস ভাঙ্গার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। মারিয়া আগেই জবাব রেডি করে রেখেছে।
ইয়ে আন্টি। আমার গায়ে ওড়না নেই কেন জিজ্ঞেস করলে,
আমি মজা করে একটা কথা বলছি। তা শুনেই ভাঙ্গলো।
চোখের পাতা বড় করে আরিশা জানতে চাইলো,
তুমি কি এমন বললে, এটা হতে পারে তা আমি বুঝেছি। ওকে বাদ দাও খাল্লি বাল্লি।
অবসন্ন বিকেলের দিকে ঝিনুকের সাইলেন্ট করা মোবাইলটি বারবার বেজে উঠলো। সে দেখেও রিসিভ করলোনা। তারপর একটা মেসেজ এলো প্যারাগ্রাফের সমান।
মেসেজে মারিয়ার বিষয়ে সব বলা শেষে লেখা রয়েছে,
” ঝিনুক তোমার প্রেমে পড়তে চাই। দিবে একবার সেই সুযোগ? ওই মৌন পাহাড়ের নামে শপথ করে বলছি। ওই নিষ্পাপ চাঁদের নামে শপথ করে বলছি। ওই নিষ্পাপ শিশুটির খলবল করা হাসির নামে শপথ করে বলছি।
শিরোনামেই তুমি আমার তোমাতেই হবে শেষ। *তোমার আশু গুণ্ডা।*
ঝিনুক এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। নিজেকেই প্রস্ন করলো। হঠাৎ এত পরিবর্তিত নমনীয় আচরণ? এত নিবেদিত প্রণয়? সত্যি নাকি উদ্দেশ্যপ্রাণিত?
চলবে…১২
( পেইজে লাইক ও ফলো এবং শেয়ার দিয়ে, মন্তব্য করে লেখিকাকে অনুপ্রাণিত করার বিশেষ প্রত্যাশা রইলো। ভালোবাসা অবিরাম।💗)