#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২১
জারিফের নাম্বারে ডায়াল করার পর প্রথমবার রিং হয়ে কে*টে গেছে। দ্বিতীয়বার আবার ট্রাই করার পরও রিসিভ হলো না। প্রিয়ার কিছুটা মন খারাপ হলো। সে ভাবলো, হয়তো জারিফ রাগ করেছে। এতো কল, মেসেজ করেও পায়নি তো রাগ করা স্বাভাবিক। প্রিয়া কিছুক্ষণ পায়চারি করে তামান্না ভাবীকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলো। ভাবা মোতাবেক কাজ করেও ফেলল। তামান্নাও প্রথমবার রিসিভ করতে পারলো না কারণ সে তুতুলকে খাওয়াচ্ছিল। দ্বিতীয়বার রিসিভ করে সালাম দিয়ে তামান্না বলে,
“প্রিয়া আমি পাঁচ মিনিট পরে কল করি? তুতুলটাকে খাওয়াচ্ছি। একটুখানি বাকি আছে।”
প্রিয়া রাজি হয়ে যায়। এই পাঁচ মিনিট যেনো ওর কাছে পাঁচ ঘণ্টা। সে তো আর ইচ্ছে করে ফোন অফ করে রাখেনি। চার্জ ছিল না আর বন্ধুরা আগেরদিন বলল পরীক্ষা দিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে একটু ঘোরাঘুরি করলে মন্দ হয় না। কে জানতো সে ওমন সময় ফোন করবে! অন্য পরীক্ষাগুলোতে তো ফোন করেনি। প্রিয়ার অস্থীর অস্থীর লাগছে। আরেকবার জারিফের নাম্বারে ট্রাই করলো। ভাগ্যবশত এবার জারিফ রিসিভ করলো তাতে প্রিয়ার রুহুতে যেনো পানি ফিরল! প্রিয়া হড়বড় করে বলে,
“সরি সরি। আর কখনও এমন হবে না। বিশ্বাস করুন, সকালে ফোন চার্জে দেওয়ার কথা মনে ছিল না। আর বাসায় সবাইকে বলে গিয়েছিলাম ফ্রেন্ডরা একটু ঘুরবো পরীক্ষা শেষে। প্লিজ রাগ করবেন না। প্লিজ সরি।”
জারিফের মনের অবস্থা এতক্ষণ গম্ভীর ছিল। সেই যে রুমে ঢুকেছে আর বের হয়নি। ফুফি আর মুন্নির হাহাকারে জারিফের মা*থাব্যথা শুরু হয়েছিল। এতক্ষণ মাথায় বাম লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল আর ফোন ছিল সাইলেন্ট মুডে। প্রিয়াকে অস্থীর চিত্তে বলতে শুনে জারিফ হালকা হাসলো অতঃপর বলল,
“ডোন্ট বি প্যানিক প্রিয়া। রিল্যাক্স। আমি রাগ করিনি। তুমি যে বেখেয়ালি তা আমি জানি। আমার একটু হেডঅ্যাক হচ্ছিল। ইটস অকে।”
প্রিয়া জারিফের অসুস্থতার খবরে আরও অস্থীর হয়ে বলল,
“এখন কমেছে? ঠিক আছেন আপনি? মেডিসিন নিয়েছেন? একটু ঘুমান ভালো লাগবে।”
জারিফ বলল,
“মেডিসিন নেইনি। ডিনার করে তারপর নিবো। বাম লাগিয়েছি। অনেকটা পেইন কমে গেছে। তুমি কিছু খেয়েছ? লাঞ্চ একসাথে করতাম বলে দুপুরে ফোন করেছিলাম।”
“হ্যাঁ। দুপুরে লাঞ্চ হয়েছে। আপনি লাঞ্চ করেছিলেন?”
জারিফ প্রিয়ার প্রশ্নের জবাবে না বোধক বললে প্রিয়া বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি আমার উপর রাগ করে খাননি? আমাকে আপনি যদি আগে জানাতেন তবে আমি ওদের সাথে যেতাম না সত্যি। অথবা ফোনে চার্জ থাকলেই হতো। ”
জারিফ প্রিয়ার উদ্বিগ্নতায় হালকা হেসে বলে,
“তোমার উপর রাগ না প্রিয়া। বাসার পরিস্থিতিতে খেতে ইচ্ছে করেনি। তুমি অযথা নিজেকে ব্লেম করছো।”
“কেনো? বাসায় কী হয়েছে? কারও কিছু হয়েছে?”
জারিফ প্রিয়াকে মুন্নির ব্যাপারটা জানাতে চাইলো না তাই বলল,
“তেমন কিছু না। তুমি রেস্ট করো। সারাদিন পরীক্ষার টেনশন তারপর ঘোরাঘুরি। টায়ার্ড নিশ্চয়ই। আমিও একটু ঘুমানোর চেষ্টা করব।”
“আচ্ছা। আপনি খেয়ে নিয়েন।”
প্রিয়া ফোন কেটে দিয়ে ভাবলো তামান্না ভাবীর থেকে জেনে নিবে। জারিফ যে বলতে ইচ্ছুক না তা বুঝে গেছে। ম্যাথাব্যাথা তাই জোর করল না। তামান্না ভাবীকে প্রিয়া হোয়াটসএপে ফোন করল। ফোনে ব্যালেন্স শেষ। তামান্না ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,
“বলো প্রিয়া। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভাবী। তুমি কেমন আছো? তুতুল ও বাকিরা?”
“সবাই আলহামদুলিল্লাহ্।”
এরপর কুশল বিনিময়ের পর প্রিয়া জিজ্ঞেস করল,
“তোমাদের বাড়িতে কারও কিছু হয়েছে?”
“কই নাতো?”
তামান্না ভাবলো, শুধু শুধু মুন্নির কথাটা বলার দরকার নাই।
“তাহলে জারিফ স্যার দুপুরে লাঞ্চ করলো না আবার বলল, বাড়ির পরিস্থিতির কারণে খাওয়া হয়নি। বলো না আমাকে। সে তো বলল না। অনেক আশা নিয়ে তোমাকে ফোন করেছি।”
তামান্না দোটানায় পরে গেলো। প্রিয়াকে বলা ঠিক হবে কীনা ভাবতে লাগল। প্রিয়া মুন্নিকে নিয়ে টেনশনে থাকবে। আবার ভাবে, প্রিয়ার অধিকার আছে জানার। জারিফ ও প্রিয়ার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মুন্নি।
এদিকে প্রিয়া বারবার জিজ্ঞেস করছে তাই তামান্না বলল,
“আসলে আমার ফুফি শাশুড়ির মেয়ে মুন্নি, জারিফকে অনেক ভালোবাসে। সেই ছোটো থেকে। সে জারিফের বিয়ের খবরে অনেক কেঁদেছে। আজ এই বাড়িতে এসেও অনেক কান্না করছে সাথে কাকুতিমিনতি করেছে। তাই জারিফ আসার পর থেকে ঘর থেকে বেরোয়নি। তুমি চিন্তা করো না। জারিফ ওকে বোনের নজরে দেখে।”
প্রিয়া হতবাক হয়ে গেছে। তার একমাত্র গম্ভীর বরের দিকে দেখি মানুষ হাত ধুয়ে পরেছে! বর নিয়ে তো সে এখন রিস্কে আছে। প্রিয়া মুখ ভাড় করে বলে,
“এখন আমার কী হবে? ওই মেয়ে যদি আমার বর নিয়ে টানাটানি করে! এদিকে বর আমার না খেয়ে আছে। অসুস্থও হয়ে গেছে। যাও না ভাবী, তাকে খাবারটা ঘরে দিয়ে আসো। ওই মুন্নি শা*ক*চু*ন্নি যাতে না দেখে। কালকে আবার তার ক্লাস আছে। আমাদের তো মিডের পর বন্ধ দেয় না। যেমনেই পারো মেয়েকে বিদেয় করো। আমার খুব টেনশন হচ্ছে জামাই নিয়ে।”
তামান্না প্রিয়ার বাচ্চাসুলভ কথায় হেসে ফেলে তারপর বলে,
“নো চিন্তা দেবরানী। আমি আমার দেবরানীর বরের উপর অন্য মেয়ের কুনজর পরতেই দিবো না। সাথে তুতুলও! তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”
কথা বলা শেষে প্রিয়া আজগুবি কতোকিছু ভাবতে লাগল মুন্নিকে নিয়ে। শেষে নিজেই নিজের চুল টেনে বিড়বিড় করে বলে,
“একটা পুচকে মেয়েকে ভয় পাচ্ছি! আমার বর আমার জোর চলবে বেশি। ওই মুন্নি ফু*ন্নির না! একবার আমার সামনে এসে এমনে কাঁদুক তখন তার চু*ল ছিঁড়ে দিবো! হুহ্।”
_________
সকালে প্রিয়া জলদি ভার্সিটিতে চলে গিয়ে ডিপার্টমেন্টে জারিফের রুমের সামনে পায়চারি করছে। জারিফ এখনও আসেনি। রুম লক করা। প্রিয়া বারবার ফোনে সময় দেখছে। আবার করিডোরের ব্যালকনিতে এসে উুঁকি দিচ্ছে যে জারিফ আসছে কিনা। আজ আকাশে হালকা রোদ জ্বলমল করছে। পরীক্ষার মাঝেই বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটেছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে টাও চলে গেছে শেষ পরীক্ষার আগেরদিন। জামাই থাকতেও সিঙ্গেলের মতো ভ্যালেন্টাইনস ডে গেছে তার। প্রিয়া হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে নিজে নিজেই বলে,
“কী লাভ বিয়ে করে! যদি ভ্যালেন্টাইনসেও সিঙ্গেলের মতো ঘুরতে হয়! ভ্যালেন্টাইনসের পরেরদিন সে আমারে ফোন করে কিন্তু সেদিন না! আস্ত আনরোমান্টিক। এখন একটা শাঁ*ক*চু*ন্নি জুটেছে কপালে। এই ব্যাটা আসে না কেন! ওই মুন্নি আবার আটকে রাখেনি তো?”
প্রিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে জলদি করে জারিফের নাম্বার ডায়াল করার জন্য উদ্দত হলো। কাল রাতেই জারিফ প্রিয়ার ফোনে রিচার্জ পাঠিয়ে দিয়েছিল। প্রিয়া কিছু বলেনি তাও জারিফ নিজেই দিয়েছে সাথে একটা মেসেজ,
“তোমার চিন্তা জুরে আমার বসবাস থাকুক কিন্তু দুশ্চিন্তাতে না। একটা মাত্র বউ তুমি আমার। চিন্তা করতে করতে হাইপারটেনশনের রোগী হওয়ার দরকার নাই।”
প্রিয়া মেসেজটা আবারও দেখল। দেখেই তার ঠোঁট কোলে হাসির রেখা ফুটল। মনে মনে প্রশান্তি কাজ করছে। জারিফকে আর ফোন না করে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রায় দশ মিনিট পর জারিফ ডিপার্টমেন্টে এলো আর প্রিয়াকে তার অফিস রুমের বাহিরে পায়চারি করতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে এলো। অফিস রুমের সামনে গিয়ে রুমের লক খুলতে খুলতে প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“তুমি এখানে?”
প্রিয়া হকচকিয়ে তাকায়। সে তখন পায়চারি থামিয়ে ক্যাকটাস গাছটার মিষ্টি রঙের ফুলগুলো ধরে ধরে দেখছিল। জারিফের মুখ নিঃসৃত প্রশ্নে জারিফের দিকে তাকায় তারপর হালকা হেসে বলে,
“কেনো আসতে পারিনা?”
জারিফ রুমের লক খুলে ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থায়ই নিরব হাসে। তারপর বলে,
“ভেতরে আসো।”
প্রিয়া ভেতরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। জারিফ বলে,
“তোমার তো এতো সকালে ক্লাস না। এতো জলদি কেনো আসলে?”
প্রিয়ার সরল জবাব,
“আপনার জন্য।”
জারিফ হেসে ফেলে। প্রিয়া মুগ্ধ হয়ে জারিফের হাসি দেখে।
“মুন্নিকে নিয়ে টেনশনের কিছু নেই। আজকেই চলে যাবে। আমি আসার সময় বলে এসেছি চলে যেতে।”
প্রিয়া অবাক হয়ে বলে,
“ওমা! চলে যেতে বললেন! কেউ কিছু বলেনি আপনাকে?”
“তো কি থেকে যেতে বলব? সে সকালে অন্যায় আবদার শুরু করেছে তাই আমি সরাসরি বলেছি যাতে বাড়ি ফিরে ওকে বাড়িতে না দেখি।”
“কী করেছে? কী করেছে?”
জারিফ প্রিয়ার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে বলে,
“এতো কৌতুহল কেনো? সে চলে যাবে দ্যাটস ইট।”
প্রিয়া এবার জেদী কন্ঠে বলে,
” না। আপনাকে বলতেই হবে। নাহলে কিন্তু আমি নাস্তা করব না।”
“এই তুমি নাস্তা করোনি?”
জারিফের প্রশ্নসূচক দৃষ্টি দেখে প্রিয়া আমতা আমতা করে বলে,
“করে নিবো তো।”
জারিফ হতাশ হয়। প্রিয়া আবার বলে,
“বলেন না। সে কী করেছে? প্লিজ। নাহলে টেনশনে আমি খেতেও পারব না।”
“সকাল সকাল সে রান্নাঘরে গিয়ে আমার পছন্দের খাবার বানিয়েছে তারপর আমার জন্য টেবিল সাঁজিয়ে বসে ছিল। আমায় খাইয়ে দিবে বলে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে খাইয়ে দিবে বলে।”
প্রিয়ার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় এগুলো শুনে। প্রিয়া মনে মনে ভাবে,
“বউ আমি না ওই মেয়ে! আমার বরকে সে তো এমনেই হাত করে নিবে রে!”
চিন্তা করতে করতেই প্রিয়ার মুখশ্রী কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। জারিফ তা দেখে টেবিলের উপর প্রিয়ার হাতটা ধরে বলে,
“আমি এক নারীতে আসক্ত পুরুষ। যদি মুন্নির প্রতি উইক হতামই তবে আগেই হতাম। তোমার হাজবেন্ড নিয়ে ইনসিকিউর হতে হবে না। এবার ভালো মেয়ের মতো নাস্তা করে নেও। আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে চলো। আমার ক্লাস আরও এক ঘণ্টা পর।”
প্রিয়া জারিফের হাতের স্পর্শে শিহরিত হলো অন্যরকম ভালো লাগায়। ভরসা লাগছে তার। তারপর ওরা দুইজন বাহিরের একটু দূরের একটা রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করতে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।