#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
বিদায়ে কন্দনরত প্রিয়াকে গাড়িতে বসানো হয়। প্রিয়ার সাথে রাহা ও আরো দুইজন কাজিন যাবে। প্রিয়া যেই গাড়িতে যাবে ওরাও একই গাড়িতে উঠে। গাড়িতে প্রিয়ার পাশে জারিফ এসে বসে একবার প্রিয়ার দিকে তাকালো। প্রিয়া নিশ্চুপ বসে আছে। কাঁদছে না। জারিফ প্রিয়ার বাম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। বলল,
“টিল দ্যা লাস্ট ব্রেথ, অ্যাই ওয়ান্না লাভ ইউ।”
প্রিয়া জারিফের চোখের দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো অতঃপর জারিফের হাতটা শক্ত করে ধরলো।
_________
প্রিয়াদের বাসায় সব কেমন শান্ত পরিবেশ। মেয়ে বিদায়ের পর প্রিয়ার মা, নিজের রুমে বসে আছেন। প্রিয়ার বাবা, চাচারা ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। সব কেমন নিরবতা। হই-হুল্লোড় দেখা যাচ্ছে না। কাজিনরা যারা আড্ডা দিচ্ছে একটা রুমে দরজা বন্ধ করে। প্রিয়ার চাচা বলেন,
“ওরা যোগাযোগ করেছে? পৌঁছেছে ওরা? প্রিয়মকে ডাকো তো।”
প্রিয়মকে ডেকে আনার পর প্রিয়ম বলে,
“হ্যাঁ পৌঁছেছে। জারিফ আমাকে জানিয়েছে। তোমরা টেনশন কেনো করতেছো? জারিফের পরিবার প্রিয়ার সাথে খারাপ ব্যাবহার তো করবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
এদিকে জারিফদের বাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠ ও কিছু প্রতিবেশিরা প্রিয়াকে দেখতে এসেছে। প্রিয়া অসহায়ের মতো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। জারিফকে ওর বন্ধুরা কই নিয়ে গেছে জানে না। প্রিয়ার সাথে রাহা ও আরেক কাজিন তাসফিও বসে আছে। তামান্নাকে তার শাশুড়ি জরুরী কাজে ডেকেছে। জারিফের অন্য কাজিনরা রুম সাঁজানোতে ব্যাস্ত। একমাত্র ফিহা প্রিয়ার সাথে বসে আছে। মুন্নির মা প্রিয়াকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছেন। না, তিনি প্রিয়াকে কোনো আ*ক্রম*ণা*ত্মক কথা বলবেন না। তিনি শুধু দেখছেন, সেই মেয়েটা যে এতো ভাগ্যবতী। যে কীনা তার মেয়ের সুখটা না চেয়েও পেয়ে গেছে অথচ তার মেয়ে চেয়েও পায়নি। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চাইলে সে খারাপ ব্যাবহার করতে পারে কিন্তু তাতে তার মেয়ের কোনো লাভ তো হবে না! উলটো সবাই কটু দৃষ্টিতে দেখবে।
________
জারিফ বাহির থেকে একটা প্যাকেট হাতে বাড়ি ফিরে ড্রয়িংরুমে প্রিয়াকে সবার মাঝে বসে থাকতে দেখে নিজের রুমের দিকে যায়। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা বাজে। নিজের রুমের সামনে গিয়ে দুই তিনবার নক করলে ভেতর থেকে এক কাজিন ‘কে এসেছে?’ জানতে চাইলে জারিফ জবাব দেওয়ার পর তখন সেই কাজিন বলে,
“এখন তো ঢুকতে পারবা না ভাই। সাঁজানো শেষ হলে তোমার বউকে এখানে বসিয়ে দিয়ে তোমাকে গেটে আ*টকাব। তারপর বখশিশ দেওয়ার পর ঢুকতে পারবে। এখন যাও তো।”
“দেখ সাদিক, দরজা খোল। আমার কাজ আছে।”
জারিফের কথায় ভেতর থেকে জবাব এলো,
“মোটেও না। তোমার কোনো চালাকি চলবে না। শ্যালিকাদের তো ঠিকই বখশিশ দিলে। আমরা কি দোষ করেছি? আমাদের বখশিশ না দিলে আজ তোমার বাসর মিস!”
জারিফ কোমড়ে এক হাত গুঁজে আরেক হাতে কপালে ঘষছে। তামান্না তখন জারিফের রুমের সাঁজসজ্জা দেখতে এসে দেখে জারিফ দাঁড়িয়ে তাই রম্যস্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কী দেবরজি? এখানে কী হ্যাঁ? এখনই বাসর করার শখ হলো! কিন্তু তোমার বউ তো ড্রয়িংরুমে!”
“উফ ভাবী! আমি একটা কাজে এসেছি।”
জারিফের তিরিক্ষি পূর্ণ কথায় তামান্না ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
“কী এমন কাজ শুনি? এখন রুম সাঁজাচ্ছে। তুমি আমাদের সারপ্রাইজ নষ্ট করতে পারো না। ভেতর থেকে কিছু আনা লাগলে আমাকে বলো আমি এনে দিচ্ছি।”
জারিফ একরোখা স্বরে বলে,
“তোমরা বুঝবে না। আমার আর্জেন্ট লাগবে। দরজাটা খুলতে বলো। আমি জাস্ট জিনিসটা রেখেই চলে যাবো। তোমাদের বলা যাবে না। ইট’স সিক্রেট।”
তামান্না বলে,
“আমাকে দেও আমি রেখে দিচ্ছি।”
“না। এটা আমিই রাখব।”
তামান্না সন্দেহের সুরে বলে,
“তুমি অন্য কোনো মোটিভ নিয়ে আসোনি তো? সত্যি করে বলো?”
জারিফ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“হোয়াই শুড অ্যাই? ইটস মাই রুম। নিজের রুমে অন্য কী মোটিভ নিয়ে আসব?”
তামান্না কী বলবে ভেবে পেলো না। জারিফ অবশ্য তেমন ছেলে না যে অন্য কোনো মোটিভে আসবে। চেহারার ভাব দেখেও মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছে। তামান্না এবার দরজায় নক করে। ভেতর থেকে জানতে চাইলে তামান্না এসেছে শুনে দরজা খুলে। তামান্না জারিফকে ঢোকাতে নিলে কাজিন মহলে শোরগোল পরে যায় অতঃপর তামান্না ওদের বুঝিয়ে জারিফকে ঢুকতে সাহায্য করে। জারিফ রুমে ঢুকে এদিকওদিক না তাকিয়ে সোজা আলমারির কাছে গিয়ে লক খুলে প্যাকেটটা রেখে আবার আলমারি লক করে চাবি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওর কাজিনরা উুঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো এখন জারিফ যাওয়ার পরে একজন বলে,
“ভাইয়া ব্যাগে করে কী আনতে পারে? এতো লুকানোর কী আছে?”
জায়ান বলে উঠে,
“যা খুশি আনুক। তোরা তোদের কাজ কর। নয়টা বাজতে চলল। আধ ঘণ্টার মধ্যে রুম সাঁজিয়ে প্রিয়াকে এখানে আনতে হবে।”
তামান্না চিন্তিত হয়ে বলে,
“মেয়েটা অনেক্ষণ ধরে বসে আছে। রেস্ট তো নিবে তাই না? নাস্তা দিয়েছিলাম খেলো না। এখন ওকে আমার রুমে নিয়ে গিয়ে একটু ভাত জাতীয় খাবার দেই। যাই তাহলে। মাও বলেছেন যেতে। আমি তোমাদের কাজ কতোদূর দেখতে আসলাম।”
“জলদি যাও। আর ওর দুই বোনকেও ডিনার করিয়ে ফেলো। বিয়ে বাড়িতে কখন না কখন খেয়েছে!”
তামান্না সায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে প্রিয়ার কাছে যায়। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সবাইকে বসতে বলে প্রিয়া, রাহা ও তাসফিকে নিয়ে নিজের রুমে যায়। জারিফের মা তিনটা প্লেটে খাবার সাঁজিয়ে নিয়ে এসেছে। তিনি মুখে হাসি ঝুলিয়ে নরম স্বরে বলে,
“তোমরা একটু খেয়ে নাও। সারাদিন যা ধকল গেলো আর এতো গরমে পোলাও খাবে! তাই ভাত, মাং*স ভুনা, মাং*স দিয়ে মুগ ডাল রান্না করেছি। তাই দেরি হলো। ঝটপট গরম গরম খেয়ে নাও তো।”
প্রিয়া ধীর স্বরে বলে,
“এতো কস্ট করলেন মা। এমনিও অতো খিদে পায়নি। যা ছিল তাতেই হয়ে যেতো।”
“চুপ মেয়ে। সকালের রান্না তোমাদের এখন দিতাম নাকি! আর বিয়ে বাড়িতে খাবার এখন খেলে তো আরও অস্থীর লাগবে। দেখো, সাথে টমেটো, শসা কাঁচা ম*রিচ ও সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে সালাদ বানিয়ে এনেছি। খেতো ভালো লাগবে।”
প্রিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। শাশুড়ির আদর যত্ন দেখে এখন মায়ের কথা মনে পরছে। জারিফের মা প্রিয়ার অশ্রু টইটম্বুর করা নয়নযুগল দেখে স্নেহের কন্ঠে সুধায়,
“আমি খাইয়ে দেই?”
প্রিয়ার গলায় কথা আটকে গেছে। ঠোঁট কা*ম*ড়ে কান্না আটকানোর প্রচেষ্টায় আছে সে। জারিফের মা হাত ধুয়ে এসে ভাত মাখিয়ে প্রিয়ার মুখের সামনে ধরে। প্রিয়া বহুকষ্টে কান্না আটকিয়ে হা করে। তামান্না, রাহা ও তাসফি এই দৃশ্য দেখে আপ্লুত হয়। তরুণীমা বেগম ওদেরকে বলে,
“তোমাদেরও খাইয়ে দিবো?”
রাহা ও তাসফি ঘার নাড়িয়ে না করে। তারপর ওরাও খেতে শুরু করে। প্রিয়া খাওয়ার মাঝে টিসু দিয়ে চোখের জল গড়াবার আগেই মুছে নেয়। তরুণীমা বেগম খাওয়ানো শেষ করে প্রিয়ার গালে হাত রেখে কপালে চু*ম্বন করেন। বলেন,
“তামান্নার থেকে জেনে নিও আমি শাশুড়ি হিসেবে কেমন। তোমার এতো ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না বুঝেছ। আমার মেয়ের মতো থাকবে তোমরা।”
প্রিয়া ঘার হেলায়। জারিফের মা হালকা হেসে প্লেট হাতে বেরিয়ে গেলেন। ততক্ষণে রাহা ও তাসফিরও খাওয়া শেষ। তুতুল কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে প্রিয়ার কোলে বসে পরে। তুতুল আহ্লাদী কন্ঠে আধো বুলিতে বলে,
“ছোটো আম্মু জানো? চাচ্চুর রুমটা কত্তো সুন্দর লাগছে। একদম ফুলের বাগানের মতন। আমাকে একটা হলুদ ফুল দিয়েছে দেখো। এটা আমি তোমার জন্য এনেছি।”
তুতুলের হাতে একটা গাঁদাফুল। এতক্ষণ তুতুল তার নানুর কাছে ছিল। একটু আগে তার বাবার সাথে জারিফের রুম দেখে এই ফুলটা নিয়ে এসেছে। প্রিয়া তুতুলের দুই গা*লে চু*মু দিয়ে টেনে বলে,
“ইশ! আমার তুতুল সোনা ফুল এনেছে। কতো কিউট।”
তামান্না বলে উঠে,
“আসো বাবা। ছোটোআম্মুকে এখন রেস্ট নিতে পাঠাব ওই ফুলের ঘরে।”
“আমিও থাকব ওখানে।”
তামান্না তুতুলের আহ্লাদপূর্ণ কথায় ভড়কে যায়। এই ছেলেকে এখন মন ভুলাতে হবে নয়তো জেদ ধরে বসে থাকবে।
“না বাবা। তোমার জন্য তোমার বাবা একটা সারপ্রাইজ রেখেছে। ইয়া বড়ো সারপ্রাইজ। দেখবে না?”
“হুম হুম। কই সারপ্রাইজ?”
তুতুলের উৎসুক কন্ঠে তামান্না স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“ঘুমানোর আগে দিবে বলেছে। এখন ছোটোআম্মুকে রেখে আসি চলো।”
তুতুল রাজি হয়ে যায়। প্রিয়াকে নিয়ে জারিফের রুমে বসিয়ে দিয়ে হাসি ঠাট্টা করে চলে আসে। প্রিয়া রুমের সাজসজ্জা দেখতে থাকে। লাল, হলুদ, সাদা গোলাপের কম্বিনেশন সাথে রজনীগন্ধা, গাঁদাফুল, বিভিন্ন রঙের জারবেরা ফুল দিয়ে সাঁজানো। বিছানার উপর গোলাপের পাঁপড়ি ছিটানো। ঘরের মেঝেতে একটা বড়ো পাত্রে পানির উপর বিভিন্ন রঙের জারবেরা ফুল, বেলি ফুল ও ছোটো মোমবাতি ভাসছে। রুমে তিন রঙের ডিম লাইট একত্রে জ্বালানো। সাঁজটা প্রিয়ার পছন্দই হয়েছে কিন্তু খুব নার্ভাস লাগছে।
এখন সবাই মিলে জারিফের থেকে গেট আটকিয়ে হাজার দশেক টাকা হাতিয়েও নিয়েছে। জারিফ দেনাপাওনা মিটিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক তরে। রুমের আলোকসজ্জায় সবকিছু আবছা সুন্দর লাগছে। বিছানার মধ্যিখানে লাল টুকটুকে বধূ সাঁজে প্রিয়া বসা। জারিফ ধীর পায়ে আলমারির কাছে গিয়ে সেই প্যাকেটটা বের করে প্রিয়ার কাছে যায়। প্রিয়া চোখ খিঁচে বন্ধ করে বসে আছে। জারিফ প্রিয়ার সম্মুখে বসে বলে,
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস–
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
কবিতাটা দুটি পঙক্তি বলে জারিফ আবার বলে,
“এখনও তোমার সামনে বলেছি বলে মনে হয় না। আমার হৃদয় হিয়ার মাঝে প্রিয়তমা ভালোবাসার নাম প্রিয়া। দ্যা গার্ল, অ্যাই অ্যাম ইন লাভ উইথ।”
প্রিয়ার মুখশ্রী রক্তিম হয়। শরীরে কম্পনের সৃষ্টি হয়। লোমকূপে কেমন শীতলতা বয়ে যায়। জারিফ প্রিয়ার দিকে একটু এগিয়ে হাতের প্যাকেটটা খুলে একটা ছোটো বক্স বের করে তারপর বক্স খুলে একটা ছোটো ডায়মন্ডের হার্ট শেইপ পেন্ডেন্টের চেইন বের করে প্রিয়াকে নিজ হাতে পড়িয়ে দেয়। তারপর আঙুলে ছোট্ট হার্ট শেইপ ডায়মন্ড পাথরের একটা রিং পড়িয়ে দেয়। প্রিয়া অবাক চোখে জারিফের দিকে তাকিয়ে আছে। জারিফ বলে,
“বিয়ের গহনা আমার মা-বাবার দেওয়া। আমার মা, তার দুই পুত্রবধূর জন্য একই ওজনের সবকিছু বানিয়েছেন। তাও এখনকার উপহার আমার তরফ থেকে। এতো ভারী সাজসজ্জা ছেড়ে এই শাড়িটা পড়ে আসো। সাথে এই নোজপিন ও এয়াররিংটাও (পেন্ডেন্টের সাথে)। আমি তোমাকে এই সাঁজে স্নিগ্ধ বেশে দেখতে চাই। তারপর ঘুমোনোর আগে চেঞ্জ করে নিও নাহয়।”
প্রিয়া দেখে একটা লাল জামদানী শাড়ি। শাড়িটার কারুকাজ একটু অন্যসব সচরাচর কারুকাজ থেকে আলাদা। প্রিয়া মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।