লোডশেডিং’ পর্ব ২০.

0
258

‘লোডশেডিং’
পর্ব ২০.

তাবিনা মাহনূর

________________

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো চৈতি। আজ তার কোচিং এ পরীক্ষা। একাই যেতে চেয়েছিল, সারাফ সাহেব যেতে দেননি। চৈতি মাথায় ওড়না জড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিচ্ছে। গলায় যেই দাগটা ছিল, তা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে। কিন্তু স্মৃতির দাগ মুছে না। সেই দাগ দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়।

সারাফ সাহেব মেয়েকে দ্রুত তৈরি হওয়ার তাগিদ দিলেন। তিনি চৈতিকে কোচিংয়ে রেখে ব্যবসার কাজে অফিসে যাবেন। পরীক্ষা শেষে চৈতিকে নিয়ে আসার দায়িত্ব শিমুলের। চৈতি তৈরি হয়ে বাবার হাত ধরে বের হচ্ছে, এমন সময় জেবিন এসে বললেন, ‘সাবধানে যাও তোমরা। চৈতি, কটু কথা কানে নিও না।’

চৈতি আজ জেবিনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জি মামণি।’

জেবিনের মন ভরে গেল। মেয়েটা মামণি বলে হয়তো মাসে একবার। সেই একবার শুনতে তার ভালোও লাগতো না, খারাপও লাগতো না। মোট কথা, মামণি ডাকে কোনো অনুভূতি জন্মায়নি কখনোই। কিন্তু আজ খুব ভালো লাগলো। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘পরীক্ষা ভালো করে দিও।’

পরীক্ষার সময় সকাল আটটা। রাস্তাঘাটে এই সময় লোকজন কম। তবে পরিচিত যতজন ছিল, সবাই সারাফ আর চৈতির দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বলেনি। চৈতির অস্বস্তি লেগেছে কিন্তু নিজেকে বিভিন্ন উপায়ে শান্ত রেখেছে। কখনো ভাবছে, আর কয়টা মাস। আবার ভাবছে, আল্লাহ ধৈর্যের সুফল দিবেন। এভাবে কোচিংয়ে পৌঁছে সারাফ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিলো চৈতি।

কোচিংয়ের সামনে এসে সারাফ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজকে কি পরীক্ষা?’

– ফিজিক্স।
– পড়েছিস?

চৈতি দুই পাশে মাথা নাড়লো।

– আচ্ছা সমস্যা নেই। যা পারিস তাই লিখিস। তবু পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিস, এটাই অনেক। তবে কেউ কোনো বাজে কথা বললে এক কান দিয়ে ঢুকাবি, আরেক কান দিয়ে বের করবি। মনে থাকবে?
– মনে থাকবে।
– আর শিমুলকে বলেছিস তো আসতে?

চৈতি বলেনি। শিমুলকে কোচিংয়ে আসার কথা সে ইচ্ছে করে বলেনি একা একা বাসায় যাওয়ার জন্য। এতে সে রাস্তায় মানুষের কথার সম্মুখীন হওয়ার অভ্যাস করতে চায়। কিন্তু সারাফ যদি শুনেন চৈতি বলেনি, তাহলে এখনই শিমুলকে ফোন করে বলে দিবেন কোচিং থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা। তাই চৈতি মিথ্যে বললো, ‘বলেছি।’

– গুড। আমি সময় পেলাম না। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে কিনা তাও জানি না। যদি শিমুল আসতে দেরি করে তাহলে ফোন করে জেনে নিবি। একা যাবি না।

চৈতি মাথা হেলিয়ে বললো, ‘আচ্ছা।’

সারাফ সাহেব চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। শুরু হলো চৈতির জবাবদিহিতা। বেঞ্চে বসতেই এক ঝাঁক মেয়ে এসে হাজির হলো প্রশ্নের বুলি নিয়ে। ‘তোমাকে নাকি রেপ করা হয়েছে, এটা কি সত্যি? আমার বিশ্বাস হয় না। সৌরভ ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ।’

‘বোকা মেয়ে! রিলেশন করেছো তো বাসায় এসে করতে হলো কেন? হোটেলে গেলে কেউ জানতে পারতো না। তুমিও গাধা সৌরভ ভাইয়াও গাধা’, এ ধরণের নানান কথার পৃষ্ঠে চৈতি কোনো জবাব দেয়নি। টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে ছিল। শেষে একটা মেয়ে, ‘নোংরা কাজ করে অহংকার দেখাতে আসে!’ এই কথা বলে সবাইকে নিয়ে চলে গেল। কোচিংটা মেয়েদের হওয়ায় এক দিক দিয়ে বাঁচা গিয়েছে। তা নাহলে চৈতির লজ্জা আরো বেড়ে যেতো। সে দ্রুত শিমুলকে ফোন করে বললো, ‘শিমুপু, আমার ছুটি হবে এগারোটায়। তুমি আমাকে নিতে আসতে পারবে?’

__________

– এইযে! এটা চৈতি নাকি?

রাস্তায় রিয়াজ চাচার সাথে দেখা। তিনি এই এলাকার তিনটা মুদি দোকানের মালিক। এছাড়াও নানান ব্যবসা থাকায় বেশ ধনী মানুষ এবং চৈতিদের বাসার পরের গলিতে তার নিজের বাড়ি। এই এলাকায় পুরোনো মানুষ বলে চৈতির বাবাকে তিনি বেশ ভালো চিনেন। সেই সূত্রে চৈতিকে ঘোমটার আড়ালে একবার দেখেই বুঝে গিয়েছেন। তবে চৈতির পাশে থাকা কালো জিলবাবে আবৃত মহিলাকে চিনতে পারলেন না।

– এইটা কে?

শিমুল জবাব দিলো, ‘আসসালামু আলাইকুম চাচা। আমি শিমুল।’

– ওমা! শিমুল দেখি ইরানি সেজে বসে আছো? লজ্জা তুমি পাইতেছো কেন? পাবে তো তোমার পাশে যে আছে।
– আমি লজ্জা পাচ্ছি না চাচা। গত দুই এক মাস ধরেই ইসলামী জীবন যাপন করে আসার চেষ্টা করছি। আর চৈতির লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ওর কোনো দোষ নেই।

রিয়াজ সাহেব বেশ জোরে হাসলেন, ‘কি বলো মা! আমি কি বুঝি না কিছু? আর সবাই বুঝে কি ঘটছে। আজকাল আবার নারীদের অধিকার বেশি। এজন্য চাইলেই তোমরা ভালো ছেলেও ফাঁসাইতে পারো।’

– চাচা আমরা যাই। আসসালামু আলাইকুম।

অপমানে মুখ থমথম করে উঠলো রিয়াজের, ‘বেয়াদবি করবা না মেয়ে! এলাকার সবাই জানে কি আকাম করছে তোমার বোন।’

শিমুল কোনো কথা না বলে চৈতির হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো। রিয়াজ আরো রেগে গেলেন। উচ্চস্বরে সবাইকে ডেকে বলতে লাগলেন, ‘শোনো ভাইয়েরা! একটা মেয়ে জেনা করছে। তারপরও তার ভাবের কমতি নাই। তার পরিবার তারে সাহায্য করতেছে এসবের জন্য। কি যুগ আইলো রে বাবা!’

বাসায় এসে শিমুল নিজের ঘরে গেল আর চৈতি উপরে চলে গেল। চৈতি ঘরে গিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলো। এত কষ্ট! বাসায় বসে এই কষ্ট সে অনুভব করতে পারেনি। সেই বিভীষিকাময় রাতের চেয়েও বেশি কষ্ট তীক্ষ্ণ অপবাদগুলো। এসব সহ্য করা খুব কঠিন। কীভাবে সে বাকি জীবন কাটাবে?

বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর তার দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ এলো। দরজা খোলার পর দেখলো জেবিন এবং শিল্পী দাঁড়িয়ে আছেন। ফুপি উপাধি পাওয়া মানুষটা আজ চৈতির কাছে কেন এসেছে তা বুঝতে বাকি নেই চৈতির। সে এক পলক দেখে বিছানায় বসে পড়লো। শিল্পী ভেতরে ঢুকে তার সামনে বসে তার হাত ধরে বললেন, ‘এখন কেমন আছিস মা?’

– আলহামদুলিল্লাহ।
– আজকে কোচিংয়ে গিয়েছিলি?
– জি।
– কেউ বাজে কথা বলেনি তো?
– বলেছে।
– কে বলেছে?
– রিয়াজ চাচা।
– আচ্ছা। আমি তোর ফুপার কাছে রিয়াজ ভাইয়ের নামে বিচার দিব।

চৈতির ফুফা একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি রাজনীতি করার পাশাপাশি, গ্রামে জমিদার হিসেবে বেশ নামডাক আছে। শিল্পী তাই ক্ষমতার ব্যবহার করবেন বলে চৈতিকে আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু চৈতির তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে মানুষ চিনে ফেলেছে। নতুন করে চেনার প্রয়োজন নেই।

– সৌরভের সাথে দেখা হয়েছে এর মাঝে?

মাথায় ব্যথা করে উঠলো চৈতির। এই নামটা শুনলে আজকাল মাথা ব্যথা করে, নিজেকে পাগল বলে মনে হয়। শিল্পীর সামনে কোনো পাগলামি করতে চায় না সে। তাই কপালের রগ গরম হয়ে আসলেও চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো সে। জেবিন ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘শিল্পী, ওই নাম নিস না।’

– কিসের কথা বলছিস?

জেবিন নাম উচ্চারণ করতে ভয় পাচ্ছেন। শিল্পী অবুঝ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘কি নাম? সৌরভ?’

চৈতি হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে বের হয়ে বাবার ঘরে গিয়ে গল্পের বই পড়তে শুরু করলো। জেবিন তখন শিল্পীকে বললেন, ‘ও এই নাম শুনতে পারে না। সৌরভ নামটা বললেই উন্মাদের মতো শুরু করে।’

শিল্পী চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এটা তো সাংঘাতিক বিষয়! সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাসনি?’

– শিমুল ব্যবস্থা করছে কাল পরশুর মাঝে দেখিয়ে ফেলবে।
– বেশি দেরি করিস না। মনে রাখবি, ওর গতি একটাই। সৌরভ ছাড়া গতি নাই। তাই সৌরভের নাম না শুনতে পারলে হবে না। ওর সাথে থাকতে হবে, তাড়াতাড়ি সব ঠিক করার ব্যবস্থা কর।

সবার এক কথা। চৈতির গতি নেই, সৌরভকে বিয়ে করতে হবে। অথচ একজন ধর্ষকের শাস্তি হলো না এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই।

__________

সৌরভ চৈতির সামনে আসে না। তার বিশ্বাস, কিছুদিন পার হলে চৈতি আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে। তখন চৈতির পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নিবে। আপাতত দূরে থাকাই ভালো।

তবে সে ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সাহস পায় না। সে খুব ভালো করে জানে তার কুকর্মে চৈতির কোনো দোষ নেই। কিন্তু মানুষ তাদের দুজনকেই দোষ দিচ্ছে, এতে চৈতি কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে সেই নিয়ে সৌরভ বেশ চিন্তিত। ঘর থেকে বের হতে পারছে না দেখে দিলারা সৌরভের বন্ধুকে ফোন করে আসতে বললেন। জাহিদ এসেই সৌরভের সামনে দাঁড়িয়ে দুই কোমড়ে হাত রেখে বললো, ‘এই! ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকার মানে কি? লুকোচুরি খেললেই সব অপরাধ মাটি চাপা যাবে না।’

সৌরভ মুখ নামিয়ে বললো, ‘জানি। কিন্তু মানুষের সামনে যেতে ভালো লাগে না। কেউ না কেউ বাজে কথা বলবেই।’

– আমি এটা বুঝছি না যে তোরা তো মিউচুয়াল রিলেশন করেছিস, এতে তুই শুধু নিজেকে দোষারোপ করছিস কেন?

সৌরভ কিছুই বলতে পারলো না। স্বাধীন ছাড়া তার অন্য কোনো বন্ধু জানে না সে ধর্ষণ করেছে। এদিক দিয়ে সে স্বাধীনের গোপনীয়তা রক্ষার সততা দেখে মুগ্ধ হলো। তবে এখন জাহিদ এসে ঝামেলা লেগে গেল। জাহিদ তাকে নিয়ে স্বাধীনের বাসায় যেতে চায়। এই মুখে সে স্বাধীনের সামনে দাঁড়াতে চায় না। স্বাধীনকে নিয়ে আলাদা বৈঠকে বসতে হবে তার। তার পূর্বে স্বাধীনের সম্মুখীন হওয়া জরুরি।

স্বাধীন চিলেকোঠার দরজা আটকে বাহিরে যাবে এমন সময় রাশেকের ফোন আসলো। রাশেক তার বাসায় আসতে চাইছে। স্বাধীন দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যাবে। এটা নিয়ে ভার্সিটির শিক্ষকদের সাথে তার ব্যক্তিগত কিছু আলোচনা ছিল। রাশেককে সেটা না জানালেও কৌশলে বোঝালো এখন সে বাহিরে যাচ্ছে। কিন্তু রাশেক তার কাছে আধা ঘণ্টা সময় চাইলো। কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা, স্বাধীন বুঝতে পারলো না। যখন রাশেক আর জাহিদের সাথে সৌরভকে আসতে দেখলো, তখন বুঝতে পারলো কি হতে চলেছে।

রাশেক বন্ধুকে আলিঙ্গন করে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছিলি?’

স্বাধীন শান্ত কণ্ঠে বললো, ‘ভার্সিটিতে।’

– এখন ভার্সিটি বন্ধ। এসময় কি কাজ তোর? নতুন স্টুডেন্ট নিয়ে ভার্সিটিতে বেশ ব্যস্ত সবাই।
– আলতাব স্যারের সাথে কথা বলবো।
– কি নিয়ে।
– দোস্ত, এখন কিছু বলতে পারবো না। সময় হলে জানাবো।

জাহিদ বললো, ‘তোর মতিগতি ঠিক নাই। কি করিস বোঝা যায় না।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে স্বাধীন বলে উঠলো, ‘মতিগতি যা আছে, তাতেই আলহামদুলিল্লাহ অনেক শুকরিয়া জানাই।’

বন্ধুদের আড্ডায় কিছুক্ষণের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হলো। রাশেক সেটা স্বাভাবিক করার জন্য বললো, ‘দেখ স্বাধীন, এই ব্যাটা ওই ঘটনার পর থেকে ঘর থেকে বেরই হইতেছে না। জাহিদরে আন্টি ফোন করার পর ওরে এখানে আনলাম।’

স্বাধীন একবারও তাকালো না সৌরভের দিকে। জাহিদ বলে উঠলো, ‘কিরে স্বাধীন? তুই এত ভাব নিতেছিস কেন? নাকি আমরা আসছি বলে বিরক্তি হইতেছিস?’

প্রচন্ড রাগ উঠে গেল স্বাধীনের। সৌরভ চোরের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে মনে মনে ক্ষণ গুনছে। এখান থেকে তাড়াতাড়ি পালাতে পারলে সম্মান বাঁচে যেন। স্বাধীনের চেহারা একবার দেখেই সে বুঝে গিয়েছে, স্বাধীন তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে।

স্বাধীন ক্রোধ সংবরণ করে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি কী জানিস?’

সৌরভ চমকে তাকালো স্বাধীনের দিকে। জাহিদ বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ধর্ষণের কথা কেন আসছে?’

রাশেক ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘এই এক মিনিট। সৌরভ চৈতিকে ধর্ষণ করেছে, এটাই বলতে চাচ্ছিস? আরে গাধা, ওরা দুজন রিলেশনে ছিল। এটা কি ভুলে গেছিস?’

– আমি যা বলবো তা শুনবি তোরা?
– কি বলবি?
– ইসলামে ধর্ষণ নিয়ে ঘটে যাওয়া একটা হাদিস বলবো।

জাহিদ সাথে সাথে বললো, ‘ধুর! এই রাশেক চল তো।’

স্বাধীন এবার সৌরভের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোরা চলে গেলে যা। কিন্তু আমার ছোট্টবেলার বন্ধুকে আমি নসীহত করতে চাই।’

স্বাধীনের অদ্ভুত ব্যবহার কারো কাছেই ভালো লাগছে না। স্বাধীন দুই বন্ধুকে পাশ কাটিয়ে সৌরভের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে হাদিস বলতে শুরু করলো।

– রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সময়ে একবার এক সম্মানীয় সাহাবিয়া (নারী সাহাবী) ফজরের নামাজ পড়তে বাড়ির বাইরে বের হয়েছিলেন। অন্ধকার পথে এক ব্যক্তি তাকে আক্রমণ করে এবং জোরপূর্বক নির্যাতন করে। ভুক্তভোগী সাহাবিয়া চিৎকার করেও লাভ হয়নি, ফলাফল ধর্ষণ। তিনি রাসূলের কাছে গিয়ে বিচার দেন। সেখানে অন্যান্য পুরুষ সাহাবীগণ ছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ ব্যাপারে বিচার করার আশ্বাস দেন। অন্যান্য সাহাবী মহিলাটিকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করতে শুরু করেন। একজন ব্যক্তিকে সনাক্ত করা হলে তাকে সাহাবিয়ার সামনে আনা হয়। সাহাবিয়া অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিলেন বলে ভুল মানুষকেই অপরাধী ভেবে ফেলেন এবং সনাক্তকৃত লোকটির উপর দোষারোপ করেন। কিন্তু অপরাধী এ অবস্থা দেখে নিজে সকলের সামনে দোষ স্বীকার করে। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবিয়াকে সান্ত্বনা দিলেন এবং অপরাধী ব্যক্তিকে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিলেন। অর্থাৎ, অপরাধীর শরীরে ততক্ষণ পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপ করা হবে যতক্ষণ না তার মৃত্যু হচ্ছে।
(হাদীসটি সুনানে আবু দাঊদ হতে বর্ণিত।)

স্বাধীন হঠাৎ এসব কথা কেন বলছে তা সৌরভ খুব ভালো করে জানে। রাশেক দ্বিধায় পরে গিয়েছে মূল ঘটনা সম্পর্কে। আর জাহিদ অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত অনুভব করছে। স্বাধীন সৌরভের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে দুই পকেটে হাত রেখে বললো, ‘এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট, ভুক্তভোগী তার সুষ্ঠ বিচার লাভ করেছেন এবং তাকে কোনো দোষারোপ করা হয়নি। বলা হয়নি, তুমি অন্ধকারে একা বের হয়েছো কেন? তুমি কি তোমার কাপড় ঠিক রাখোনি? সেসময় কি সত্যিই নামাজে বেড়িয়েছো? একজন শক্ত সামর্থ্যবান পুরুষকে নিয়ে বের হতে! ঘরেই নামাজ পড়তে!’

রাশেক যা বুঝার বুঝে গিয়েছে। সে ধারণা করছে, চৈতির হয়তো বিয়ের আগে এসব রিলেশনে জড়ানোর ইচ্ছে ছিল না। সৌরভ জোর করেছিল। জাহিদ অবশ্য কিছুই বুঝতে পারছে না।

স্বাধীন আবারো বললো, ‘এমন অসুস্থ চিত্র দেখা যায়নি, বরং সাহাবিয়াকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। এবং আমরা জানি, দুনিয়ায় শাস্তি পেলে আখিরাতের শাস্তি কিছুটা কমে যায়। তাই অপরাধী স্বীকার করে নিয়েছে তার অপরাধ। আল্লাহর শাস্তি যে কত ভয়ঙ্কর তা তো সে জানতোই!’

সৌরভ হুট করে ছাদ থেকে নেমে গেল। জাহিদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে ‘সৌরভ’ বলে ডাকতে ডাকতে দ্রুত নীচে চলে গেল। আর রাশেক একবার সিঁড়ির দরজার দিকে এগিয়ে আবার স্বাধীনের কাছে এসে বললো, ‘এসব কি বললি রে? আমাদেরকে সবটা পরিষ্কার করে বলবি?’

স্বাধীনের গম্ভীর কন্ঠ, ‘আমি কিছু বলতে পারবো না যতক্ষণ না সৌরভ তোদের কিছু জানায়।’

– তোর কথা শুনে মনে হলো ও চৈতিকে রেপ করেছে। কিন্তু ওরা তো রিলেশনে ছিল, তাই না? মানলাম চৈতি হয়তো বিয়ের আগে ফিজিক্যাল রিলেশন করতে রাজি হয়নি। তবু, সৌরভ তারই প্রেমিক। এতে এতো বেশি রাগের কিছু নেই, তাই না?
– আমি কিছুই বলবো না। তবে একবার ভেবে দেখিস, সৌরভের সামনে এতগুলো কথা বললাম। ও কেন প্রতিবাদ করলো না। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসছি।

স্বাধীন চলে গেল। রাশেক অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, এর মাঝে নিশ্চয়ই কোনো গুপ্ত বিষয় আছে!

__________

চলবে ইন শা আল্লাহ…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here