প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড) ফাবিহা নওশীন পর্ব-12

0
448

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-12

আয়ানের কথা শুনে দিশার একদম দিশাহারা অবস্থা। এই মুহুর্তে বিয়ে অসম্ভব। অসম্ভব মানে অসম্ভব। ফ্যামিলির কেউ বিয়ের জন্য রাজি হবে না। ওর বিয়ের কথা এখন কেউ ভাবছে না। কেন ভাববে? ও তো গ্রাজুয়েশনই শেষ করেনি। পড়াশোনা শেষ করে কিছু করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর না বিয়ে। কিন্তু আয়ান বাড়ির যে পরিস্থিতি বলছে তাতে বিয়ের কথা না আগালে অনিশ্চয়তায় ভুগবে। যদি ওর মা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে দিয়ে দেয়? তাহলে ওর কী হবে? ও আয়ানকে অনেক ভালোবাসে। ওকে ছাড়া একদম বাঁচতে পারবে না। কিন্তু এখন কি করে বাবা-মাকে গিয়ে বলবে আয়ানের কথা, আয়ানের ফ্যামিলি কন্ডিশন। এত সাহস ওর নেই। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিশার। ঘরজুড়ে পাইচারি করছে ও। চুলগুলো এলোমেলো। একটু পর পর রাগে চুল টানছে। কোন উপায় বের করতে না পেরে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। তারপর মোবাইল হাতে নিল আয়ানকে কল করার জন্য। কল করতে গিয়েও থেমে গেল। কিন্তু একটা মনে করে মোবাইল ঘরে রেখে বের হয়ে গেল।

দর্শনের রুমের কাছে গিয়ে দেখল দরজা খোলা। দিশা দরজায় নক করল। ভেতরে থেকে দর্শন যেতে বলল। দিশা উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকাল। ওর ভাই বসে বসে গিটার পরিষ্কার করছে। দর্শন গিটার বাজায় না কিন্তু গিটারটা পরিষ্কার করে রাখে। কিন্তু কেন এসব করে কে জানে। হয়তো বেকার বোর লাগে তাই। সময় কাটাতেই এসব করে।
দিশা ভেতরে যাওয়ার পরেও ওর ভাইয়ের নজর ওর দিকে আসেনি।
“ভাইয়া, তুমি তো গিটার বাজানো ছেড়ে দিয়েছো তবে এসব কী?”

“কোন সব?”

“এই যে কয়েকদিন পর পর গিটার পরিষ্কার করছো। গিটার যখন বাজাও না….

” গিটার বাজানো ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু গিটার তো ছাড়িনি। যতদিন সাথে আছে যত্ন করে যাব।”

“আচ্ছা, গিটার বাজাও না কেন?”

দর্শন প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
“তুই কী বলতে এসেছিস?”

দিশা এতক্ষন ভাইয়ের দিকে চেয়ে থাকলেও এখন দৃষ্টি নামিয়ে নিল। বুক ধুকপুক করছে। কিভাবে বলবে ভাইকে বুঝতে পারছে না। ওকে নিশ্চুপ দেখে দর্শন মাথা তুলে ওর দিকে তাকাল। ও মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। আঙুলে আঙুল ঘষছে। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু ইতস্তত বোধ করছে। বিষয়টি অবশ্যই সিরিয়াস আর স্পর্শকাতর নয়তো চট করে বলে চলে যেত। দর্শন গিটার রেখে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকাল।
“দিশা, নির্ভয়ে বলতে পারিস। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোর সমস্যার সমাধান দেওয়ার।”

দিশা সাহস পেয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। সাহস সঞ্চার করে বলল,
“ভাইয়া, আমি অনেক বড় সমস্যায় আছি। বাবা কিংবা মা কারো সাথে শেয়ার করতে পারছি না। বলতে ভয় করছে। তাই তোমার কাছে এলাম। প্লিজ ভাইয়া হেল্প মি।”

“হ্যাঁ, বল। শুনছি।”

“আমি আসলে…..
দিশা ঢোক গিলল। হাত-পা কাঁপছে কেন? কাঁদোকাঁদো হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। দর্শন ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে।
” তুই কী?”

দিশা আবারও ঢোক গিলল। চোখ বন্ধ করে গরগর করে বলল,
“আমি একজনকে ভালোবাসি।”

দর্শনের কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক লাগল। বর্তমান যুগের মেয়ে প্রেম করতেই পারে। কাউকে ভালোবাসতেই পারে।
“তো?”

দিশা চোখ খুলল। তারপর কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
“ওর বাবা-মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। ওকে বিয়ে করাতে চাইছে। আসলে ওর বাবা অনেক অসুস্থ। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক বছর আগে। এখন একমাত্র ছেলের সংসার দেখতে চায়। আর এইজন্য ওর মা ওকে ফোর্স করছে প্লাস ইমোশনাললি ব্ল্যাকমেইল করছে।”

“এখন?”

দিশা আবারও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“বাবা-মা এই মুহুর্তে কিছুতেই বিয়ের জন্য রাজি হবে না। বলবে আগে পড়াশোনা করো, ক্যারিয়ার গড়ো তারপর বিয়ে।”

“তুই এখন বিয়ে করতে চাইছিস? লাইক সিরিয়াসলি? আর বাবা-মা তো ঠিকই বলবে। আগে পড়াশোনা শেষ কর। ভালো একটা জব কর তারপর বিয়ে নিয়ে ভাবিস। বিয়ে করে লাইফ হেল করার বুদ্ধি তোকে কে দিল?”

দিশা মৃদু হাসল। তারপর বলল,
“হয়তো একদিন খুব ভালো ক্যারিয়ার হবে কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাই যদি না থাকে ক্যারিয়ার দিয়ে কী হবে? এই মানুষটার জায়গা অন্য কেউ পূর্ণ করতে পারবে? সারাজীবন অপূর্ণতায় ভুগবো না?”

দিশার কথা শুনে দর্শন থমকে গেল। এ কি বলল ওর বোন? ও তো রুশান আর অর্ষার সুরে কথা বলছে। একদিন রুশান বলেছিল ভালো ক্যারিয়ার পাবি কিন্তু ভালোবাসার মানুষ পাবি? অর্ষাও শেষ বেলায় বলে গিয়েছিল জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারলেও ওর মতো ভালোবাসার একটা মানুষ পাবে না। তাই তো হয়েছে। এই যে আজ এত বড় ডিগ্রি তবুও শূন্যতায় ভুগছে। ভালোবাসাহীন এতগুলো বছর কাটিয়েছে। এখনো কাটাচ্ছে। দিশা ভাইয়ের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে আছে। ও কি ভুল কিছু বলে ফেলল? ভাইয়া কি ওর কথায় কষ্ট পেল?
দর্শন নিজেকে সামলে বলল,
“নাম কী ছেলেটার? কী করে?”

“ওর নাম আয়ান। ও একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করে।”

“আচ্ছা আমি বাবার সাথে কথা বলব। চেষ্টা করব রাজি করানোর।”

দিশার মুখে হাসি ফুটল। উচ্ছাসিত মুখে বলল,
“ধন্যবাদ ভাইয়া। এখন আমিও বিয়ের কথা ভাবছি না। কিন্তু চাইছি ওর সাথে আমার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যাক। দুই ফ্যামিলি একসাথে বসুক। তাহলে আমি একটু চিন্তামুক্ত হতে পারব। তুমি প্লিজ চেষ্টা করো। আই হোপ তুমি আমার সিচুয়েশন বুঝতে পারছো।”

দর্শন মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। আর ইংগিত দিল ভরসার।

_________

দর্শন অনেক চেষ্টার পর অর্ষার নাম্বার জোগাড় করেছে। মনে মনে অনেক কথা গুছিয়ে কল দিল ওর নাম্বারে। কল রিসিভ করে অর্ষা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন?

উত্তরে দর্শন বলল,
“জানো, রাতে ঘুম হচ্ছে না আমার। কোন কাজ করতে পারছি না। একটু দেখা করতে পারবে?”

অর্ষার আর উত্তরের প্রয়োজন হলো না। ও যে দর্শন সেটা বুঝতে একটুও সমস্যা হলো না। হবে কেন? এ যে সেই মানুষটা যার কন্ঠস্বর ছাড়া একটা দিন কাটেনি।
“জি না। সময় হবে না।”

“এত ব্যস্ত?”

“হ্যা, খুব ব্যস্ত। নিজেকে নিয়ে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে।”

দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,
“এই ক্যারিয়ারের জন্য একদিন কেউ তোমায় অবহেলা করত যদিও এটা তোমার ভাষ্যমতে। তাই ক্যারিয়ারের আমসত্ত্ব করতে চাইছো? ব্যস্ততা দেখাচ্ছো? এই যে আমি ডাক্তারি পাশ করে ঘরে বসে আছি। কোথাও মন বসাতে পারছি না এইজন্য একটু করোনা তো করো।”

“আমি এতটা মহৎ নই যে করোনা করব। আমাকে আর কল করবে না। অনুরোধ করছি, একটু শান্তিতে বাঁচতে দেও।”
অর্ষা খট করে কল কেটে দিল। দর্শনের বেশ রাগ হলো। মোবাইলের দিকে চেয়ে রাগে গজগজ করছে। চোখ লাল করে হাত শক্ত করে মুঠো করল। রগগুলো দৃশ্যমান। কোমল দর্শন দিন দিন হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। এই অবহেলা মেনে নিতে পারছে না। আদোও কি এই অবহেলার যোগ্য?

অর্পা রুশানের সাথে দেখা করতে ওর অফিসে এসেছে। প্রথমে বাসায় যেতে চেয়েছিল কিন্তু সে স্পর্ধা হয়নি। ওদের রিলেশনের ব্যাপারটা রুশানের পরিবার জানত। তাই সেখানে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ার মানেই হয় না। অর্পা রুশানের ডেস্কে গেল। রুশান ডেস্কে নেই। অর্পা ওকে খুঁজতে খুঁজতে দোতলার ক্যান্টিনে চলে গেল। ক্যান্টিনের কফিশপে গিয়ে বসল। এক কাপ কফি অর্ডার করে একটা টেবিলে গিয়ে বসল। রুশান কাজ রেখে কোথায় গেল বুঝতে পারছে না। এখন না ব্রেক আর না লাঞ্চ টাইম। তাহলে গেল কোথায়। অর্পা ওকে কল করার কথা ভাবল। ভাবতে ভাবতে কফি চলে এল। কফিতে ধোঁয়া উড়ছে। মোবাইল ব্যাগের পাশে রেখে ধোঁয়া উড়া কফির মগ হাতে নিল। মগে মৃদু ফু দিয়ে এক চুমুক কফি ইঞ্জয় করতে করতে রুশানকে কল দিল। রিং হচ্ছে। শুধু রিং-ই না ওর ফোনের রিংটোন বাজছে আশেপাশে কোথায়। অর্পা ওর মোবাইলের রিংটোনটা জানে। শুনেছে অনেকবার। আশেপাশে ওকে পাবার আশায় ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল। ওই তো রুশান। পকেট থেকে মোবাইল বের করেছে। মোবাইলের স্কিনে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কল কেটে দিল। অর্পা ওর কাজে অবাক হলো। ও কল কেটে দিতে পারে এমনটা ভাবতেই পারেনি। অর্পার রুশানের অবস্থান খেয়াল হলো। ও একটা টেবিলে কফি নিয়ে বসে আছে। একা নয় ওর সাথে একটা মেয়েও আছে। ওরা কি বিষয়ে কথা বলছে। এতটা গুরুত্বপূর্ণ! অর্পার ভীষণ রাগ হলো। রুশান বদলায়নি। নয়তো কাজ রেখে একটা মেয়ের সাথে বসে বসে গল্প করত?
মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা বেশ সুন্দরী, গোছানো ধরনের। ওরা হেসে হেসে কথা বলছে। অর্পা রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ওদের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রুশানের কলার টেনে ধরে বলল,
“একটুও বদলাওনি। অফিসের কাজ রেখে এখানে বসে মধুর আলাপ করা হচ্ছে? এই মেয়েটা কে? ওর সাথে কী চলছে?”

রুশান কিছু বলার আগেই মেয়েটা ভয় ভয় মুখ করে বলল,
“মেম মেম, আপনি ভুল বুঝছেন। আমি উনার কলিগ মাত্র। বস আমাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছে। আমরা কাজেই এসেছি। কাজের কথাই বলছি। বিশ্বাস করুন।”

অর্পা রুশানের কলার ছেড়ে দিল। বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বলল,
“আ’ম এক্সট্রিমলি সরি। আমি বুঝতে পারিনি।”

রুশান শুকনো হাসল। ওর এই হাসিতে কত ব্যথা, কত অভিমান, কত অভিযোগ!
“বুঝতে তো সেদিনও পারোনি। যদি বুঝতে……

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here