প্রেম_তুমি ফাবিহা নওশীন পর্ব-১১

0
433

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১১

অর্ষা গোলগোল চোখ করে দর্শনের দিকে তাকাল। দর্শন কলেজ ড্রেস পরে, কাঁধে ব্যাগ, চোখে চশমা পরে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একবার চোখাচোখি হলো। তারপর প্রিয়ার দিকে কটমটে চোখে তাকাল।

প্রিয়া আমতা আমতা করে বলল,
“আমি কিছু জানি না। উনি আমাকে জোর করে নিয়ে এসেছে।”

অর্ষা দাঁত খিচিয়ে বলল,
“ফাজলামো করিস? উনি কী আমার বাসা চিনে? তোকে নিয়ে এসেছে, না তুমি নিয়ে এসেছিস?”
অর্ষা চেঁচাতে লাগল।

প্রিয়া কাচুমাচু করতে করতে বলল,
“আমাকে অনেক জোর করেছে তাই……

দর্শন এরই মাঝে হাতের ঘড়িটা দেখল। তারপর কপাল কুঁচকালো। অর্ষা আর প্রিয়ার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
“স্টপ গাইস! তোমাদের বাকি গসিপ পরে বসে নিরিবিলি শেষ করো। আমাদের টাইমলি কলেজে যেতে হবে।”

তারপর অর্ষার দিকে শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে পাগলের মতো লাগছে। আর যেভাবে চেঁচামেচি করছো মানুষ দেখলে ভাববে চুলাচুলি করেছো। ডু ইউ নো হুয়াট্স চুলাচুলি?”

অর্ষা ওর কথা শুনে চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। তারপর নিজের দিকে তাকাল। একটা লম্বা টপ আর প্লাজু পরা। সারাদিন ল্যাদ খেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ভাজ ভেঙে মুচড়ে আছে। চুলগুলো ঝুঁটি করা ছিল। হেয়ার রাবার থেকে অধিকাংশ চুল বের হয়ে ফোলে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই কেঁদেছে কান্নার দাগটাও হয়তো স্পষ্ট। উফফ! অর্ষা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ল।

অর্ষা যখন নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত তখনই দর্শন বলল,
“তাড়াতাড়ি কলেজের জন্য তৈরি হয়ে নেও। নয়তো লেট হয়ে যাব।”

কলেজের কথা শুনে অর্ষা ভীষণ ক্ষেপে গেল।
“কলেজ? কলেজে যাওয়ার উপায় রেখেছেন? আমি যাব না। আপনি আসতে পারেন। প্রিয়া যা এখান থেকে।”

দর্শন আরো শান্ত কন্ঠে বলল,
“গেটে দাঁড়িয়ে গেটের বাইরের মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত নয়। একটু সৌজন্য বজায় রাখো। আশা করতে পারি তো?”

অর্ষা ওর কথা শুনে থমকে গেল। একটু লজ্জাও পেল। চোখ নামিয়ে বলল,
“আমি কলেজে যাব না।”

দর্শন সে-সব পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ফেস ভালো করে ওয়াশ করো। তুমি যে কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছো সেটা তোমার ফেস দেখে যে কেউ বুঝবে।”

অর্ষা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। বলছে যাবে না আর ওদিকে তিনি মুখ ধুয়ে নিতে বলছে।
“এভাবে দেখার সময় অনেক হবে। এখন তাড়াতাড়ি করো। আরে ভাই ক্লাস এটেন করতে হবে তো। ফার্স্ট।”

অর্ষা আবারও বলল,
“বললাম তো আমি যাব না।”

দর্শন দু পা এগিয়ে এসে খপ করে ওর হাত ধরে বলল,
“এভাবেই চলো। তোমাকে এভাবেই কলেজে নিয়ে যাব।”

তারপর দর্শন ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমবার ভালোবাসার মানুষের ছোয়া পেয়ে শিহরিত হওয়ার বদলে ভয় পাচ্ছে। প্রিয়াও আঁতকে উঠে। অর্ষাকে টেনে লিফটের কাছে নিয়ে গেছে।
অর্ষা আতংকিত চোখেমুখে নিজের হাত টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
“কী করছেন? কেউ দেখলে কী ভাববে? এই ড্রেস আপে কলেজে যাওয়া যায়?”

দর্শন ওর হাত চেপে রেখে লিফটের দরজা খুলছে। অর্ষা প্রায় কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল,
“আমি যাব। আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”

দর্শন সাথে সাথে ওর হাত ছেড়ে দিল। তারপর ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,
“একটা প্রবাদ পড়েছ নিশ্চয়ই গাধা সেই পানি খায় তবে ঘোলা করে খায়।”
তারপর কঠিন কন্ঠে বলল,
“দশ মিনিটে রেডি হয়ে আসো।”

অর্ষা সীমাহীন রাগ নিয়ে রেডি হতে গেল। প্রিয়া দর্শনকে ভেতরে এসে বসতে বলল। দর্শন প্রিয়ার পেছনে পেছনে ভেতরে গেল। বিশাল বড় বসার ঘরটা দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। সোফায় বসতে বসতে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। বাড়িটা যথেষ্ট বড় এবং পরিপাটি। প্রিয়া অর্ষার রুমে গিয়ে বসল। অর্ষা ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকাল। নিজের দিকে চেয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করছে,
“দর্শন কেন এসেছে? ও এখানে আসবে সেটা আমার কল্পনাতীত। ও কি আমাকে সরি বলবে? না-কি এতদিন ধরে কলেজে যাচ্ছি না তাই কি কারো রিকুয়েষ্ট রাখার জন্য এসেছে? ধূর কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে আমার বিরুদ্ধে কেউ কোন কাজ করাতে পারবে না। তবুও দর্শনের কথা শুনে কলেজে যাচ্ছি শুধু রিজনটা জানার জন্য। তাছাড়া আমার মনটা বড্ড বেহায়া। দর্শনকে ফেরাতে পারছি না।”

অর্ষা ফ্রেশ হয়ে কলেজ ড্রেস-সু পরে, চুলে একটা ঝুঁটি করে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ক্রসবেল টেনে ঠিক করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে এল। দর্শন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়িটা দেখল। তারপর কিছু না বলে বাসা থেকে বের হতে লাগল।

…..

অর্ষা গাড়ি থেকে নামার পর দেখল কয়েকজন পরিচিত সহপাঠী ওদের দিকে চেয়ে আছে। অর্ষা প্রিয়াকে বলল,
“এই যে আমরা এক সাথে নামলাম কেউ যদি রিজন জানতে চায় তখন কী বলব?”

দর্শন চশমা পরতে পরতে বলল,
“চাপ নিচ্ছো কেন? বলবে আমি তোমার বাসায় গিয়েছিলাম আর তুমি দীর্ঘ পনেরো মিনিট উইদাউট চা-কফি ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখেছিলে। সিম্পল।”

অর্ষা ওর কথা শুনে থ। বলে কী? আবার চা কফি দেয়নি সেটাও বলে দিচ্ছে। এত বড় অপমান এত সহজ ভাষায়? অর্ষার নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। আসলেই তো প্রথম বার গিয়েছে চা-কফি দেওয়া উচিত ছিল। খালি মুখে বসিয়ে রেখেছিল।
অর্ষা নিচু স্বরে বলল,
“চা-কফি দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল? আপনি আমাকে এক প্রকার জোরজবরদস্তি করে নিয়ে এসেছেন।”

দর্শন দাঁড়িয়ে গেল। ওর দিকে তাকাল। গভীর সে চাহুনি।
“তোমাকে জোর করে আনা সম্ভব যদি না তুমি নিজে আসো?”
অর্ষা বড়বড় চোখ করে ওর দিকে তাকাল। দর্শন মুচকি হাসল। কত মিষ্টি সে হাসি। কত নির্মল,স্বচ্ছ!
প্রিয়া ওদের কথা বলতে দেখে সামনে আগাল। দর্শন একবার প্রিয়ার যাওয়ার দিকে চেয়ে অর্ষার দিকে তাকাল। খুবই শান্ত হয়ে দাঁড়াল। অর্ষা বুঝতে পারছে না কি হতে চলেছে। বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। প্রিয়ার উপর রাগ হচ্ছে একা ফেলে পালাল।
“অর্ষা, আমি খুবই দুঃখীত। সেদিন আমি তোমার সাথে খুব বাজে আচরণ করে ফেলেছি। এমনটা করা উচিত হয়নি। আসলে ওরা আমার অনেক বছরের ফ্রেন্ড। পড়াশোনা আর বন্ধুর বাইরে আমার আর কোন লাইফ নেই। আর সেই বন্ধুরা যখন আমাকে নিয়ে একটা প্লান করে আর আমি অন্যের কাছ থেকে জানতে পারি তখন খুব কষ্ট পাই, ভেঙে পড়ি। আর সব ডিপ্রেশন ওদের আর তোমার উপর ঢালি। আমি তোমার সাথে মিশিনি তাই জানি না তুমি কেমন, কি করতে পারো। তাই তোমাকে অবিশ্বাস করাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে বলব ভুল করেছি কি-না জানি না তবে সরি বলতে চাই। প্লিজ মাফ করে দিও। আমি এই কাজের জন্য অনেক অনুতপ্ত ছিলাম। তোমাকে অনেক খুঁজেছি, তোমার বন্ধুদের কাছে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আর তুমি আমাকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছো। তাই আমি বাধ্য হয়ে তোমার বাড়িতে গিয়েছি যেটা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। এর জন্যও মাফ চাইছি। তুমি আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করো, কলেজে আসো। এটা আমার অনুরোধ প্লিজ।”

দর্শন এমন ভাবে কথাগুলো বলল অর্ষা আর ওর উপর রাগ করতে পারছে না যেহেতু ওর উপর একটা সফট ফিলিং আছে৷
দর্শন আবারও বলল,
“প্লিজ ফরগিভ মি।”

অর্ষার খুব বলতে ইচ্ছে করল পাব্লিক প্লেসে অপমান করেছেন পাব্লিক প্লেসে সরি বলুন। কিন্তু বলতে পারল না। শুধু বলল,
“ওকে। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন যাই?”

দর্শনের মাথা থেকে যেন বোঝা নেমে গেল। হাফ ছেড়ে বাচল। মাথা নাড়িয়ে শায় দিল। অর্ষা ওর চেয়ে দু-কদম এগিয়ে যেতেই দর্শন পেছনে থেকে ডাকল। অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন ওর কাছে এসে চিন্তিত ভাব নিয়ে বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“হ্যা, অবশ্যই।”

দর্শন কপালে দ্বিগুণ ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা, তোমার চোখগুলো এত বড় বড় কেন?”

অর্ষা ওর প্রশ্ন শুনে হতবাক। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। অর্ষা শুধু বলল,
“মানে কী?”

“বললাম তোমার চোখগুলো এত বড় বড় কেন?”

দর্শনের মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়নি। অর্ষা কী উত্তর দিবে এই প্রশ্নের? কী উত্তর দেওয়া যায়? অর্ষা অনেক খুঁজে কোন উত্তর পেল না। তারপর ওর দিকে লাজুক এক্সপ্রেশন দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। যতই আগাচ্ছে ততই মুচকি মুচকি হাসছে।

….

অর্ষাকে ক্লাসের সামনে দেখে আলিশা বলল,
“আরে অর্ষা, কলেজে এসেছো? হোয়াট এ সারপ্রাইজ!”

“কেন কলেজে আসার জন্য তোমার পারমিশন নিতে হবে? কলেজে আসতে হলে তোমাকে কল করে তোমার পারমিশন নিতে হবে? না কলেজে এসে জানাতে হবে আমি এসেছি।”

“ভদ্রভাবে কথা বলো আমি তোমার সিনিয়র।”

“তো এখন আপনি বলে সম্বোধন করব?”

“হ্যা, করবে কারণ আমি তোমার বয়সে বড়।”

“ওকে আন্টি। আমি আপনাকে আর তুমি করে বলব না।”

আন্টি শব্দটা শুনে আলিশা রাগে ফেটে যাচ্ছে। গজগজ করতে করতে বলল,
“তুমি অনেক বাড় বেড়েছো।”

“কেন তুমি কী একাই বাড়বে? বাড়তে বাড়তে পাতাল থেকে আসমান ছুয়ে ফেলবে?”

আলিশা যতই ওর কথা শুনছে গায়ে আগুন জ্বলে যাচ্ছে। রেগেমেগে সে জায়গা থেকে চলে গেল। অর্ষা মুখ ভেংচি কেটে ক্লাসে চলে গেল। ক্লাসে যেতেই সব ফ্রেন্ডরা ওকে ঘিরে ধরল। সবার হাত থেকে ছাড়া পেলেও প্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল না। প্রিয়া ওকে জিজ্ঞেস করছে দর্শনের সাথে কী কথা হলো। অর্ষা উত্তরে শুধু বলল,
“সেটা জানার ইচ্ছে থাকলে আমাকে ফেলে ড্যাংড্যাং করে চলে আসতি না৷”

অর্ষা ডায়েরিতে একটা পাতায় লিখল,
“বহুদিন আগে যে ঘা দিয়েছিল আজ সে মলম লাগিয়ে দিয়েছে।”

……
কলেজ শেষে অর্ষা আর ওর বন্ধুরা এক সাথে বের হচ্ছিল। পেছনে থেকে দর্শন ওকে ডাকল। ওর ডাক শুনে অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন ওকে বলল,
“সাইডে আসো কথা আছে।”

অর্ষা ওর সাথে সাইডে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দর্শন বলল,
“তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”

অর্ষা হুট করে আপনি থেকে তুমিতে নেমে বলল,
“কী বলবে? এখন নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে আমার নাকটা এমন বোঁচা কেন?”

দর্শন ওর কথা শুনে স্তব্ধ। তারপর ভালো করে ওর নাকের দিকে চেয়ে দেখল আসলেই ওর নাক বোঁচা কিন্তু ও এটা বলতে আসেনি।
“আমি এটা বলতে আসেনি। অন্য কিছু বলতে এসেছি।”

তারপর দুজন নীরব। কেউ কোন কথা বলছে না। চুপ করে আছে। নীরবতা কাটিয়ে দর্শন বলল,
“তোমাকে অল্প ভালোবাসলে চলবে?”

আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে এক্ষনি ফ্লো করুন ✊🖐️

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here