লোডশেডিং’ পর্ব ১০.

0
300

‘লোডশেডিং’
পর্ব ১০.

তাবিনা মাহনূর

_______________

– হা করে কি দেখছো? আমি তোমার থেকে অন্তত এক ফিট এক ইঞ্চি লম্বা। আমার কাছে ছাদ লাফ দিয়ে পার হওয়া কোনো ব্যাপার না। তোমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় চৈতি স্তব্ধ হয়ে আছে। তার সামনে স্বাধীন দাঁড়িয়ে, তাদের বাসার ছাদে। বিষয়টা হজম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। স্বাধীনের কথার পৃষ্ঠে কথা বলার ভাষা নেই তার। এখন মাথা ফাটানোর ইচ্ছেও মরে গেছে।

– এই মেয়ে? কি হলো? মাথা ফাটাবে না? দেখি কত জোর!

হুঁশ ফিরে এলো চৈতির, ‘তখন কি বললেন? আমার থেকে আপনি এক ফিট এক ইঞ্চি লম্বা? বলেন তো আমার হাইট কত?’

– কতই আর হবে? পাঁচ ফিট।
– হুহ! পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি আমি।
– তবু এই ছাদ পেরোনো তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
– আপনি আসলেন কেন?
– কেউ আমার সামনে পাগলামি করবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো?
– আপনার কি তাতে? আমাকে রাগকন্যা বলেন, নিজে কি একবার দেখেন তো। কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে ছাদে এসে হাজির!
– তুমিও তো হুট করে লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করলে। বাদ দাও এসব। রাগকন্যা নামটা আর ডাকবো না। এটা কেমন যেন।
– তাহলে কি ডাকবেন?
– কিছুই ডাকবো না। আলাদা নামে ডাকার অধিকার তোমার স্বামীর। আমার নয়।
– আবার সেই একই গীত গাইছেন!
– এটা গীত না। এটা সত্যি কথা। চৈতি, আমি তোমাকে আবার বলছি। আমার ধর্ম পালনে বাধা হয়ে এসো না তুমি। এটা মোটেও ভালো নয়।
– আমি কি বাধা হতে চাইছি? বিয়ে করে নিলেই হয়। আমার বাবা রাজি থাকবেন আমি জানি। উনি আমাকে খুব ভালোবাসেন।

চৈতির আজকের রূপ স্বাধীনের অচেনা। আজকে যেন বাঁধনহারা সে। না রাগ প্রশমন করছে, না লজ্জা প্রদর্শন করছে। স্বাধীন হতাশার সুরে বললো, ‘ওহহো চৈতি! আমি আর কয়বার বলবো তুমি অন্য কারো? আমি তোমাকে ভালোবাসি না। তুমি সৌরভের ভালোবাসা! এটা অনেক খারাপ একটা গুনাহর কাজ। কিন্তু এটাই সত্যি।’

– আমি কিছু জানি না। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন ব্যাস!

স্বাধীন কিছুক্ষণ চৈতির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে সিঁড়িঘরের দরজার কাছে যেতে লাগলো। চৈতি বুঝতে পারলো না স্বাধীন কি করতে চাইছে। দরজার কাছে গিয়ে পেছনে ঘুরে চৈতিকে ইশারা করলো সেখানে যেতে। চৈতি ভ্রু কুঁচকে তাকালে বলে উঠলো, ‘এসো! তোমার কত সাহস সেটাই দেখবো। সরাসরি তোমার বাবার কাছে যাবো।’

চৈতি নাক ফুলিয়ে মনের মাঝে আত্মবিশ্বাস এনে দরজার কাছে গেল। স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে সে বললো, ‘সাহস আমার অনেক আছে। আপনি শেষে পালিয়ে না যান, সেখানে ভয় করে আমার।’

স্বাধীন কিছু বললো না। শীতল দৃষ্টিতে চৈতির দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খুললো সে। চৈতি দাঁড়িয়ে থাকলো। সে অপেক্ষায় আছে স্বাধীন বাহিরে যাবে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীন চৈতিকে এক ধাক্কায় সিঁড়িঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিলো। চৈতির বোধ আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। যতক্ষণে বুঝতে পারলো, ততক্ষণে স্বাধীন ছাদের দরজা আটকে দিয়েছে।

চৈতি দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘এইভাবে প্রতারণা করলেন! আমাকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিলেন কেন? আপনি আপনার কথায় অটল? আমিও অটল থাকবো। আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না, শুনে রাখুন। প্রতারক!’

ধপ ধপ করে সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে আবারো উপরে উঠে এলো চৈতি। দরজার কাছে এসে বললো, ‘এখানেই থাকুন। ছাদ পেরিয়ে বাসায় যাবেন না দয়া করে। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি দয়া করে আবারো ছাদ পেরিয়ে যাবেন না। আমার ভয় করছে।’

চৈতির কণ্ঠে আকুতি ও কোমলতা হয়তো স্বাধীনের মনে আঘাত হানলো। সে বলে উঠলো, ‘চিন্তা করো না। আমি ছাদেই থাকবো। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবো। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি তাই। তুমি ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।’

চৈতির অশ্রু সজল আঁখি দেখতে পেলো না স্বাধীন। ভেজা কণ্ঠে চৈতি দরজায় মাথা ঠেকিয়ে বললো, ‘ক্ষমা করেছি। আপনি কষ্ট পান এমন কিছু করার মতো দুর্ভাগ্য যেন না আসে। আল্লাহ হাফেজ।’

চৈতি বুঝতে পারলো না, তার ঠিক অপর পাশে দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার মনচোরা, ঠিক তার সমান্তরালে।

________

বিকেলে সারাফ সাহেবের বন্ধু তৌফিক উদ্দিন ও তার পরিবার এলেন দাওয়াত রক্ষার্থে। জেবিন বেশ ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কাজের মেয়ে কাজলকে নিয়ে নাস্তা তৈরি করছেন তিনি। তৌফিক সাহেবের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে আসেনি। মেজো সন্তান মেয়ে, মাইমুনা। আর ছোটজন ছেলে, ইমাম। ইমামের বয়স পাঁচ বছর। সে সাদিকের ছোট বেলার খেলনা নিয়ে খেলতে বসে গিয়েছে। সাদিয়া ছোট বাচ্চাদের খুব পছন্দ করে। তাই ইমামের সাথে ওর ভাব হয়েছে খুব। সাদিক এক কোণে ওদের খেলা দেখছে, মাঝে মাঝে কথা বলে সঙ্গ দিচ্ছে যেন সে অভিভাবক।

চৈতির ঘরে মাইমুনা বসে আছে। সে সামনে বছর অনার্স প্রথম বর্ষের পড়াশোনা শুরু করবে অর্থাৎ চৈতির এক বছরের বড়। ভালো ছাত্রী হওয়ায় চৈতির সাথে কথা জমে উঠলো। মেয়েটার পদার্থবিজ্ঞানর প্রতি দুর্বলতা প্রবল হওয়ায় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে বেশ কয়েকবার ব্রোঞ্জ ও রৌপ্য পদক পেয়েছে। মেয়েটা বেশ মিশুক। এক মুহূর্তের পরিচয়ে যে কাউকে আপন করে নিতে পারে। চৈতির সারাদিনের ক্লান্তি ঝরে গেল মেয়েটার গল্প শুনে। তবু কোথাও একটা সূক্ষ্ম কষ্ট চাপা থাকলো।

– তারপর কি হলো জানো চৈতি? আমি শেষের বড় ম্যাথটা পারি না। এদিকে ওটার জন্য আলাদা নাম্বার, তাও আবার দশ নাম্বার। তখন আমি যেটা করলাম সেটা হলো, বিজ্ঞানীদের মজার ঘটনা ভাবতে লাগলাম মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য। নিউটনের বন্ধুর ঘটনা জানো তুমি?
– না আপু।
– নিউটন তার বন্ধুকে এক রাতে দাওয়াত করেছিলেন। গণিতের জটিল সমস্যা সমাধানে তিনি এতটাই ডুবে ছিলেন যে দাওয়াতের কথা ভুলে গেলেন। বন্ধু সময়মতো এসে নিউটনের সেই অবস্থা দেখে চুপচাপ বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর শুধু একজনের খাবার এলো। বন্ধুটি মনে করলেন, তার জন্যই খাবার আনা হয়েছে। বন্ধুটি নিউটনকে বিরক্ত না করে চুপচাপ খাবার খেয়ে ফেললেন। এর কিছুক্ষণ পর গণিতের সমাধান শেষ করে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে নিউটন অবাক! এবার তার খেয়াল হলো, বন্ধুকে দাওয়াত করার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। প্লেটের দিকে নজর পড়তেই বন্ধুকে নিউটন বললেন, ‘ভাগ্যিস তুমি এসেছো। নইলে তো বুঝতেই পারতাম না যে আমি এখনো খাইনি!’

চৈতি হেসে উঠে বললো, ‘হায় আল্লাহ! এতো মন ভোলা মানুষ হয়?’

– হ্যাঁ! এমন আরো ঘটনা আছে। আমার আবার এসব ঘটনা মনে করলে মস্তিষ্ক খুলে যায়। আর তখন ম্যাথ সমাধান করতে কোনো সমস্যা হয় না। তো সেবার অলিম্পিয়াডে যখন সমস্যা হলো তখন…

ঠিক তখন সৌরভ এসে হাজির। সারাফ সাহেবের বন্ধু আসবে শুনে সৌরভ বেশ চিন্তিত ছিল যে বন্ধুর কোনো ছেলে আছে কিনা। ছেলে থাকলে চৈতিকে সাবধানে রাখবে সে। তাই এক মুহূর্তের জন্য দেখতে এলো চৈতিকে। এসে দেখতে পেলো চৈতির সাথে একটা মেয়ে বসে আছে। দেখে স্বস্তি পেলো, কোনো ছেলে মানুষ এ ঘরে নেই। চৈতি সৌরভকে দেখে গুটিয়ে গিয়ে মাইমুনার দিকে তাকালো। তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল চৈতির। মাইমুনা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সৌরভের দিকে। চৈতি কিছু ভাবার সময় পেলো না। সৌরভ বলে উঠলো, ‘সুচিত্রা, তোর কাছে বড় স্কেল আছে?’

– আছে।
– দে তো। আমারটা খুঁজে পাচ্ছি না।

চৈতি উঠে গিয়ে স্কেল খুঁজতে লাগলো। সৌরভ কৈফিয়তের সুরে বললো, ‘কাগজের মাপ নিব বুঝলি। কাগজ দিয়ে বক্স বানাতে হবে। কামিনীর বিয়ের জুতোর বক্স নষ্ট হয়ে গেছে কীভাবে যেন।’

চৈতি বুঝতে পারলো, সৌরভ সবই মিথ্যে বলছে। সে যে তাকে দেখতে এসেছে এটা একজন অপরিচিত মানুষের সামনে বলতে পারছে না। প্রিয় মানুষকে সে এত বেশি সন্দেহ করে এটা বাহিরের মানুষ জানুক, সৌরভ তা চায় না।

স্কেল নিয়ে চলে গেল সৌরভ। এদিকে মাইমুনার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জীবনে এতো সুন্দর ছেলে সে দেখেনি। অলিম্পিয়াডের বদৌলতে বিদেশে গিয়েছে কয়েকবার। সেখানে সাদা চামড়ার সুদর্শন পুরুষ দেখলেও সেসব ছেলেকে তার ভালো লাগেনি। তার দাড়ি ছাড়া ছেলে ভালো লাগে না। তার কাছে সেসব ছেলেকে ছিলা মুরগি মনে হয়। আজকের ছেলেটার চাপ দাড়ি তার কল্পনায় আঁকা পুরুষের মতো। চৈতি এসবই বুঝে গেল মাইমুনার মুখশ্রী দেখে। লালিমা ধারন করেছে মাইমুনার ফর্সা মুখখানি। চৈতি হেসে বললো, ‘উনি আমার চাচাতো ভাই। বড় চাচার ছেলে সৌরভ।’

মাইমুনা যেন হুঁশ ফিরে পেলো, ‘কে সৌরভ?’

– এইযে, কেবল এসেছিলেন যিনি। উনি আমার ভাই।

‘ভাই’ কথাটা জোর দিয়ে বলছে চৈতি। ভাই ভাবতে এক প্রকার শান্তি অনুভূত হচ্ছে। সৌরভ নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ। তার উপর যেকোনো নারী আকৃষ্ট হবে যতক্ষণ না তার স্বরূপ সে প্রকাশ করবে। চৈতি খুব করে চাইলো, মাইমুনা যেন সৌরভের প্রতি দুর্বল হয় আর এ বিষয়টা কোনো না কোনোভাবে চৈতি আর সৌরভ থেকে মাইমুনা আর সৌরভে রূপান্তরিত হয়।

মাইমুনা মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘উনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন?’

– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভাইয়া অনেক ভালো ছাত্র।
– ওমা! আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি এপ্লাইড ফিজিক্সে। উনি কোন বিভাগে?
– ভাইয়া নিউক্লিয়ার সায়েন্স নিয়ে পড়ছেন।
– এটা তো খুব ভালো সাবজেক্ট! অনেক ভালো ছাত্র ছাত্রী পড়াশোনা করে সেখানে।
– ওটাই বললাম। সৌরভ ভাইয়া দেখতে যেমন, বুদ্ধিতে তেমন।
– কিন্তু উনি তোমাকে সুচিত্রা বলে ডাকলেন কেন?

চৈতি মনে মনে জিভ কাটলো। দ্রুত সামলে সে বললো, ‘আমাকে নাকি সুচিত্রার মতো লাগে। ছোট ভাই বোনকে উনি এভাবেই আদর করে ডাকেন।’

মাইমুনা বুঝতে পারলো না, চৈতিকে কোন দিক থেকে সুচিত্রা সেনের মতো লাগে! মোটামুটি ফর্সা, সাদা নয়। চৈতির এমন গায়ের রং আর গোলগাল মুখ সুচিত্রার সাথে কোনো দিকেই মিলে না। তবু কিছু না বলে সে মুচকি হেসে বললো, ‘উনারা কয় ভাই বোন?’

– ভাইয়ার একটা বড় বোন আছে। কামিনী আপু। জানুয়ারি মাসে ইন শা আল্লাহ, আপুর বিয়ে হবে।
– বাহ! দুই ভাই বোন। উনারা কি এই বাসায় থাকেন?

চৈতির মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। মাইমুনার মনে যে লাড্ডু ফুটেছে সেটা বুঝতে এতটুকু চাপ নিতে হয়নি চৈতির। সে সৌরভের ভালো দিক তুলে ধরলো, যদিও মনে মনে গালমন্দ করলো। মাইমুনার চোখে আলোর ঝিলিক। এতক্ষণ নিজে বকবক করে গল্প করছিল আর এখন মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে চৈতির মুখে সৌরভের সুনাম শুনছে।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় চৈতির ডাক পড়লো। কেউ বাসায় এলে চৈতিকে খেতে ডাকা হয় হাসিমুখে। জেবিন আজ অনেক অনেক দিন পর ডাকলেন, ‘চৈতি! খেতে আসো।’

ডাইনিং রুমে টেবিলে ছয় জন বসতে পারে। সেখানে বড় সদস্যরা বসলো। চৈতি, মাইমুনা, সাদিক আর সাদিয়াকে ড্রইং রুমে সোফায় বসতে হলো। টেবিল থেকে খাবার নিতে গিয়ে চৈতি তৌফিক সাহেবকে অনুরোধ করলো, কামিনীর বিয়েতে যেন মাইমুনাকে আসতে দেয়া হয়। সে মাইমুনাকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে খুব খুশি। তৌফিক সাহেব হাসতে হাসতে মৌন সম্মতি দিলেন। মাইমুনাও আশাবাদী, এখানে সে আসবে সৌরভকে দেখতে। খাওয়া শেষে বিদায় দিয়ে চলে গেলেন তৌফিক সাহেব ও তার পরিবার। যাওয়ার আগে মাইমুনাকে জড়িয়ে চৈতি বললো, ‘ইন শা আল্লাহ! তুমি হবে আমার সবচেয়ে আপনজন!’

মাইমুনা মুচকি হেসে মুখে রক্তিম আভা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

______

মধ্য রাত। চৈতি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছে আর কাঁদছে। নিয়ম করে নামাজ ধরেছে সে। সেই সাথে, সুযোগ পেলে তাহাজ্জুদ পড়ে সে। তাহাজ্জুদের নামাজে আল্লাহর প্রশংসা করে তার মনের সমস্ত কথা তুলে ধরে আল্লাহর কাছে। মা কুহু বেগমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তাকে জান্নাত দানের জন্য দুআ করে। সে শুনছিল, তার মা আর বাবা প্রেম করে বিয়ে করার কারণে তওবা করেছিল। বাবা অতটা ধর্মীয় মানসিকতার না হলেও মা ছিলেন ইসলাম প্রেমী। তাই হারাম সম্পর্কের জন্য সবসময় তওবা করতেন। শেষ জীবনে তিনি পর্দার বিধান মানার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সময় তাকে সুযোগ দিলো না। নিয়ে গেল বারযাখের জীবনে।

প্রতি রাতের মতো এই নামাজে সে স্বাধীনকে চেয়ে বসলো আল্লাহর কাছে। এ বিষয়ে সে যেন অজ্ঞতার পরিচয় দেয়। কাঁদতে কাঁদতে স্বাধীনকে নিজের করে পাওয়ার জন্য দুআ করে আর নিজের হিদায়াতের জন্য অবিরত অশ্রু ঝড়ায়।

ফজরের আজান দিয়েছে। নামাজ পড়ে বিছানায় হিজাবটা ছুঁড়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো চৈতি। হঠাৎ মনে হলো, ইসলামে গান বাজনা, বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ। তাহলে কি স্বাধীন হারমনিকা আর বাজাবে না? একবার মনে হলো, স্বাধীন জেগে আছে কিনা ছাদে গিয়ে দেখবে। কিন্তু স্বাধীন তাকে ধর্ম পালনের বাধা হিসেবে দেখে, এ কথা মনে পড়ায় সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে মরে গেল। কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেও চোখে ঘুমের দেখা মিললো না। উঠে দাঁড়িয়ে বড় ওড়না মাথায় দিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে চললো চৈতি।

ছাদের দরজার চাবি তার কাছে সবসময় থাকে। এটা সারাফ সাহেব এক্সট্রা বানিয়েছিলেন চৈতির জন্য। যেহেতু জেবিন চৈতিকে নিজ উদ্যোগে কোনো সুযোগ সুবিধা দিতে চান না তাই প্রতিটি বিষয়ে চৈতির জন্য আলাদা করে কার্যক্রম রাখা হয়। চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলে ছাদে প্রবেশ করলো চৈতি।

শীতল বাতাস। শীতের মৃদু হাওয়া চৈতির শরীর ভেদ করে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। গায়ে থাকা ওড়না ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো সে। তাড়াহুড়ো করে চাদর আনতে মনে নেই। স্বাধীনের চিলেকোঠার সামনের অংশ পুরোটা কাচের তৈরি। কিন্তু সাদা রঙের ভারী পর্দার কারণে কাচের ভেতরে কি চলছে তা দেখার উপায় নেই। চৈতি মাঝে মাঝে ভাবে, বৃষ্টি হলে কতই না সুন্দর দেখা যায়! স্বাধীন বেশ সৌখিন হওয়ায় চিলেকোঠার ছাদ কাচ দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে। শুধু তিন দিকের দেয়াল ইট সিমেন্টের তৈরি। সুতরাং, কাচের ছাদে যখন বৃষ্টি নামে, তখন কতটা দারুন লাগে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! পূর্ণিমা রাতে হয়তো আলো দিয়ে ভরে থাকে ঘরটা। আর অমাবস্যায় তারার আলো দেখা যায়।

উদাসীনতায় ছেয়ে গেল মন। দুনিয়াবী সৌন্দর্য দেখে মানুষ কত অভিভূত হয়! আর জান্নাতের সৌন্দর্য? সেই সৌন্দর্য তো অকল্পনীয়! তবু মানুষ দুনিয়ার পেছনেই ছুটে। জান্নাতের সৌন্দর্য উপভোগ করার ইচ্ছে যেন কারোরই নেই।

সুর শোনা যাচ্ছে। না, হারমনিকা নয়। ক্বুরআন তিলাওয়াতের মনোমুগ্ধকর সুর। স্বাধীনের গম্ভীর ভরাট কণ্ঠে সেই সুর মোহাবিষ্ট করে তোলে প্রকৃতিকে। কোথা থেকে যেন পাখিদের আওয়াজ মুখরিত হতে লাগলো। স্বাধীনের ছাদের রেলিংয়ে এক ঝাঁক পাখি বসে গুনগুন করতে লাগলো। চৈতি হতবাক হয়ে সেই চিত্র দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ মৃদু কণ্ঠে ক্বুরআন তিলাওয়াত শোনা গেল। মাঝে মাঝে পাখিদের কলকাকলির কারণে কন্ঠ চাপা পড়ে গেলেও চৈতি চোখ বুজে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো। আকাশে গাঢ় নীলাভ আবরণ মুছে গিয়ে সোনালী হলদে রং ধারণ করলে তিলাওয়াত বন্ধ হলো। এরও বেশ কিছুক্ষণ পর কাচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো সবুজ পাঞ্জাবি পরা যুবক। গুনগুনিয়ে সে বলছে, ‘আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহ…’

______

ইন শা আল্লাহ চলবে……

[ঠিক করেছি তিনটা তিনটা করেই দিব ইন শা আল্লাহ। কারণ এটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে আমাকে। কিছুদিনের জন্য অফলাইন হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here