‘লোডশেডিং’
পর্ব ১২.
তাবিনা মাহনূর
__________________
খুব সুন্দর একটা অফ হোয়াইট রঙের জামা কিনেছে চৈতি। সেখানে রুপালি আর সোনালী সুতোর কাজ করা। রুপালি আর সোনালী রং দুটো খুব হালকা হওয়ায় দূর থেকে জামাটা দেখতে জমকালো সাদা জামা মনে হয়। এর সাথে খোঁপা করে বকুল ফুলের মালা গুঁজে দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি চিন্তা করে হিজাব কিনেছে একটা। তাকে অনেক টাকা দিয়েছিলেন সারাফ একটা ভালো জামা কেনার জন্য। কিন্তু সে মোটামুটি দামের মধ্যে পেয়ে গিয়েছে জামাটা।
রাত বাড়ছে। চৈতির চোখে ঘুম নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজেকে সেই পোশাকে দেখছে সে। রং মিলিয়ে হাত ঘড়ি কিনেছে। বিয়ের দিন সম্পর্কে তার খুব আগ্রহ। সে চিন্তা করেছে, মাইমুনাকে বোঝাবে সৌরভকে তার দিকে আকৃষ্ট করার জন্য। তা নাহলে চৈতি সৌরভের থেকে মুক্তি পাবে না।
চৈতির ধারণা নেই, সে কত বড় খেলা খেলছে। মাইমুনা নামের মেয়েটিকে সে রীতিমতো ব্যবহার করছে তার স্বার্থের জন্য। আজ শিমুল যখন তাকে প্রশ্ন করেছিল, কে ফোন করেছে? তখন মাইমুনার কথা বললেও এটা বলেনি যে সে বিশাল বড় পরিকল্পনা করে ফেলেছে চারটা জীবন নিয়ে। এটা জানতে পারলে শিমুল সরাসরি তাকে না করবে। প্রথমত, সে মাইমুনাকে যিনার কাজে উদ্বুদ্ধ করছে। দ্বিতীয়ত, সে অন্যায় ভাবে সম্পর্কগুলো জটিল করছে। এসব মুখস্থ কথা চৈতির জানা আছে। তাই ইদানিং অনেক কিছু চেপে যায় সে শিমুলের কাছ থেকে।
আজ তাহাজ্জুদ পড়া হলো না। তবে ফজরের সময় টের পেল সে। নামাজ পড়ে আবারো ছাদে যেতে ইচ্ছে করলো। হঠাৎ মনে পড়লো, কাল শিমুলের কাছে ক্বুরআন শিখতে যাওয়ার কথা বলতে ভুলে গিয়েছে সে। মন খারাপ হয়ে এলো চৈতির। আজকে সিদ্ধান্ত নিলো শিমুলের কাছে যাবে সে। পাখিদের ডাকাডাকি শোনা যাচ্ছে কাছ থেকে। নিশ্চয়ই স্বাধীন কুরআন পড়া শুরু করে দিয়েছে।
______
বেশ কিছুদিন চলে গেল। আজ পঁচিশে ডিসেম্বর। ছুটির দিন হওয়ায় বাসায় সবাই আছেন। পুরুষ সদস্যরা বাসায় থাকলে মহিলাদের কাজের চাপ বেড়ে যায়, যেন ঈদের আমেজ চারপাশে। ছুটির দিন হওয়ায় সারাফ সাহেব ফজরের নামাজ পড়লেন মসজিদে। আজ অনেকদিন পর ভোর বেলা মসজিদে এসে মন ফুরফুরে হয়ে গেল। জুম্মার দিন ছাড়া অন্য কোনো সময় মসজিদে নামাজ পড়া হয় না। মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় স্বাধীনকে দেখতে পেলেন তিনি। মাত্র অল্প কিছুদিনের মাঝে ছেলেটার বিরাট পরিবর্তন তার কাছে সত্যিই বিস্ময়কর। শুধু সে নয়, এলাকার সকলে স্বাধীনকে নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠে। কেউ সুনাম করে, কেউবা হিংসার বশবর্তী হয়ে দুর্নাম রটায়।
স্বাধীন চোখ নিচু রেখে হাঁটছে। হঠাৎ তার কাঁধে কারো হাত অনুভব করায় পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো, সারাফ সাহেব মুচকি হাসছেন। সেও মুচকি হেসে সালাম দিলো, ‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। ভালো আছেন?’
কি মসৃন কণ্ঠস্বর! শুনেই মন ভালো হয়ে যায়। সারাফ মুচকি হেসে বললেন, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম বাবা। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
– আলহামদুলিল্লাহ। বাসার সবাই ভালো আছে?
– হ্যাঁ হ্যাঁ। আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো। তোমার মা কেমন আছেন? তোমার ছোট ভাই? তার অবস্থা এখন কেমন?
– মা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন। ইদানিং প্রেসার বেড়ে থাকে সবসময়। আর ভাইয়ার অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। আল্লাহর উপর ভরসা করছি।
– পরপর দুটো শোক একসাথে নিতে পারা সত্যিই কষ্টের।
– জি। ভাবীর ছোট বোনের সাথে ভাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিয়ে দিতে চাইছে। ভাবীর মৃত্যুর এক মাস পূর্ণ হলো না, এখনই এসব চাপ নিতে পারছেন না ভাইয়া।
সারাফ সাহেব দমে গেলেন। তার কুহুর মৃত্যুর পর তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। সেসময় জেবিনকে বিয়ে করার মানসিকতা বিন্দুমাত্র ছিল না। কিন্তু মায়ের অনুরোধে ঢেঁকি গিলে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। শাফিনের অবস্থা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন তিনি।
– ‘জীবন তো থেমে থাকে না’, এ কথা বেশি শুনতে হবে তোমার ভাইকে। তোমার ভাইয়ের অবস্থা আশেপাশের কেউ বুঝবে না যতক্ষণ না তাদের সামনে এমন পরিস্থিতি আসে। আমি বুঝতে পারছি তার অবস্থা। তাই তোমাকে কিছু পরামর্শ দিই।
স্বাধীন আগ্রহী কণ্ঠে বললো, ‘জি, অবশ্যই আঙ্কেল।’
– আগে বলো তোমার ভাইয়া কি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে?
– ভাইয়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিলেন, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির চাপে আবারো ভেঙে পড়েছেন।
– তাহলে আমার পরামর্শ হলো, তোমার ভাইকে একাকী সময় কাটাতে দাও। তাকে কোনো বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে বলো না। আগে নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনুক, এরপর যদি মনে হয় বাকি জীবন সে একা কাটিয়ে দিতে পারবে তাহলে তাকে তার মতো ছেড়ে দাও। আর যদি বিয়ে করতে রাজি হয় তাহলে বিয়ে দিয়ে দাও। জোর করো না।
– আসলে মা ভাবছেন বিয়ে করাটা জরুরি।
– এটাই তো সমস্যা। সবাই ভুক্তভোগীর ভালো হবে মনে করে যা ভাবে, ভুক্তভোগী তা ভালো ভাবছে কিনা সেটা চিন্তা করে না। সবসময় আশেপাশের মানুষ যেটাকে ভালো মনে করে সেটা ভুক্তভোগীর জন্য ভালো হবেই, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটা কেউ মানতে চায় না।
স্বাধীন কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে বেশ ভালো বুঝতে পারছে, সারাফ সাহেব তার প্রথম স্ত্রী অর্থাৎ চৈতির মায়ের মৃত্যুর কথা ভেবে এগুলো বলছেন। স্বাধীন বলে উঠলো, ‘আমি আপনার কথাগুলো মানার চেষ্টা করবো আঙ্কেল। শাফিন ভাই নিজেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় আনার পর এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইবো। কোনো কিছু চাপিয়ে দেব না।’
– এই সহায়তাটুকু যে কত জরুরি! আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তোমার ভাইকে আল্লাহ ধৈর্য দিন আর তাকে বোঝার জন্য আশেপাশের মানুষকে সেই মানসিকতা দিন।
– আমিন।
– আমি তো জানি বাবা, আমার কি হয়েছিল সেসময়। চৈতালির মা মারা যাওয়ার পর আমার জীবন থমকে গিয়েছিল। চৈতালির মামণিকে বিয়ে করলাম ঘোরের মধ্যে থেকে। মাঝখান দিয়ে আমার চৈতালি মা আজীবন একলা থেকে গেল। ওকে নিয়েই আমার যত চিন্তা।
স্বাধীনের ভ্রু কুঁচকে এলো। সে বাবার মৃত্যুর দিনের পর থেকে চৈতিকে একদমই মনে করতে চায় না। কিন্তু চৈতি তার পিছু ছাড়ে না। যেকোনো ভাবে তার সামনে চৈতির প্রসঙ্গ আসবেই।
সারাফ সাহেব বাড়ির বাকি খোঁজখবর নিতে নিতে বাসার কাছে চলে এলেন। বিদায়ের সময় বললেন, ‘তোমার জন্য দুআ করি বাবা, তুমি যে পথে আছো সেই পথ তোমার জন্য আল্লাহ সহজ করে দিন।’
– আমিন। আপনিও ভালো থাকুন আঙ্কেল।
– আল্লাহর রহমতে আমার কোনো অশান্তি নেই। শুধু বড় মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি।
এবার স্বাধীন বলে উঠলো, ‘চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা তাই তারই উপর ভরসা করুন। আর চৈতি ভালো মেয়ে। ওর সাথে ভালো কিছু হবে ইন শা আল্লাহ।’
– ইন শা আল্লাহ। তাই যেন হয়। ভাইয়ের ছেলে বলে কিছু বলতে পারি না। সৌরভকে আমার পাত্র হিসেবে ভালো লাগে না। তুমি দুআ করো তো বাবা, আমার মেয়েটার যেন ভালো হয়। তোমার দুআ বিফলে নাও যেতে পারে। কার দুআ আল্লাহ কখন কবুল করে নেন! বলা যায় না।
চমকে উঠলো স্বাধীন। সারাফ সাহেবকে আজ অন্যমনস্ক লাগছে। তিনি অদ্ভুত সব কথা বলছেন। তিনি অত্যন্ত গুরুগম্ভীর এবং মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। অথচ আজ কথা বলেই যাচ্ছেন এমনকি নিজের পরিবারের ব্যক্তিগত কথা। স্বাধীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘ইন শা আল্লাহ চৈতির ভালো হবে। আল্লাহ হাফেজ আঙ্কেল। আসসালামু আলাইকুম।’
সারাফ সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে চলে গেলেন। আর একটু দাঁড়ালেই স্বাধীন দেখে ফেলতো তার অশ্রুসজল চোখ দুটো।
_______
চৈতির দিনকাল ভালোই কাটছে। পড়াশোনা নিয়ে ইদানিং বেশি ব্যস্ত থাকে সে। তবে স্বাধীনের নাম্বারে ফোন করার সাহস তৃতীয়বার হয়নি। প্রথমবার পোশাকের রং জানতে ফোন করেছিল। এরপর একদিন ফোন করেছিল স্বাধীনের কন্ঠ শোনার জন্য। কিন্তু স্বাধীন তার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। চৈতির কাছে অন্য আরেকটি নাম্বার আছে যেটা তার বাবার পুরোনো ফোনের নাম্বার। কেউ ব্যবহার করে না বলে সে নিয়েছিল। কিন্তু সেই নাম্বার থেকে ফোন করার সাহস পায়নি। এত অবহেলার পর ফোন করাটা তার কাছে আত্মসম্মানে লেগেছে।
মাইমুনার সাথে যোগাযোগ চলছে ভালো। ফেসবুকে প্রতিদিন কথা হয়। ইতোমধ্যে সৌরভের ব্যাপারে সে মাইমুনাকে অনেক ভালো ভালো তথ্য জানিয়েছে। আর মাইমুনা আবেগের বশে একবার বলে ফেলেছে, ‘তোমার ভাইয়ার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?’ চৈতি সে কথা কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছে এই বলে, ‘ভাইয়া খুব চাপা স্বভাবের। এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না আপু।’
চৈতি ধীরে ধীরে বৃহৎ ঝামেলার সম্মুখীন হতে চলেছে। বুঝতে পারছে না শয়তানের প্ররোচনা কতটা ভয়াবহ রূপ প্রদান করতে পারে। এমনকি শিমুলকে সে বলছে না তার পরিকল্পনা সম্পর্কে কেননা সে জানে শিমুল তাকে মানা করবে। অর্থাৎ সে বুঝতে পারছে তার কাজটি ঠিক নয় কিন্তু বুঝতে চাইছে না। তার নফস তাকে বারবার বোঝাচ্ছে, ‘তুমি যা করছো একদম ঠিক। তোমার ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে এসব করতেই হবে। আর স্বাধীন তো ধার্মিক ছেলে। ওকে বিয়ে করার পর তুমিও ধার্মিক হয়ে যাবে।’
আজ বাবার কাছে গিয়ে গল্পে মেতে উঠলো চৈতি। কারণ তিন তলায় মহিলাদের গল্প বসেছে। জেবিন সেখানে গিয়েছেন। বাবার কাছে বসে গল্প করতে করতে শিমুল হাজির হলো জয়নাব বেগমকে নিয়ে। এতদিন পর এ বাসায় মাকে দেখে সারাফ সাহেব আনন্দে উল্লাস করতে লাগলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে বসালেন নিজের পাশে। চৈতিও খুব খুশি। সারাফ প্রতিদিন দোতলায় মাকে দেখতে যান কিন্তু আজকের অনুভূতি ভিন্ন। চৈতি এই ফাঁকে চা বানাতে চলে গেল। সাদিয়া রান্নাঘরে ঢুকে চৈতিকে দেখে বললো, ‘দুষ্টুপি? কি করছো তুমি?’
– চা তৈরি করছি। খাবি?
– অবশ্যই! সাদিকও খাবে। তোমার চা অনেক মজা হয়।
– পাম্প দিতে হবে না। কেবিনেটে বিস্কিট আছে। বের করে নিস।
সাদিয়া চুলের বেনি দুলিয়ে দুলিয়ে হেটে চলে গেল। শিমুল এলো রান্নাঘরে।
– কি খবর?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপু। তোমার পরীক্ষা শেষ?
– হ্যাঁ সোনা। পরীক্ষা শেষ, প্রেজেন্টেশনের প্যারা শেষ। আলহামদুলিল্লাহ! অনেক শান্তি লাগছে এখন।
– দাদির শরীর ভালো আছে মনে হয়। আজকে হঠাৎ উপরে আসলেন।
– দাদি তার মেয়েকে ভালোই চিনেন। ফুপি যে তোকে দেখলে কিড়মিড় করে এটা দাদি জানেন। এজন্য তোকে আদর করতে এসেছেন তিনি।
চৈতি মুচকি হেসে চায়ের কাপে চিনি ঢাললো। এ বাড়িতে জয়নাব বেগম তাকে আলাদা স্থান দিয়ে থাকেন। সেই স্থান ভালোবাসার। চৈতি চায়ের পাতিল চুলোয় দিয়ে শিমুলের দিকে তাকালো, ‘কামিনী আপুর বিয়ের দেরি নেই। তুমি কাকীকে বলেছো তোমার নিকাব পরার কথা?’
– ভাবছি বলবো না। একবারে বিয়ের দিন নিজ চোখে দেখুক। এখন বললে ফুপির কাছে বিচার দিবে। ফুপি এসে বক্তৃতা দেয়া শুরু করবে। ‘এ যুগের মেয়েরা এভারেস্ট জয় করে ফেললো, আর তুই এখনো পেছনে পরে আছিস!’ এ জাতীয় কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে। আর শোনার ইচ্ছে নেই।
– তাহলে থাক। বিয়ের দিন সবার সামনে কেউ কিছু বলতে পারবে না।
– হুম। তোর খবর বল। স্বাধীনকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছিস না তো?
বেশ রাগ উঠে গিয়েছে চৈতির। বড় বোন বলে বেয়াদবি করতে পারছে না, তা নাহলে উত্তর দিয়ে দিতো সে, ‘আমার যা ইচ্ছা আমি করবো। সবকিছুতে তুমি ঢুকবে না।’ তার নফস তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত তার মস্তিষ্ক সচল হবে না।
– আমার সাথে উনার কোনো যোগাযোগ হয় না। শেষবার উনাকে ছাদে দেখেছিলাম। ভোরে কুরআন পড়ছিলেন।
হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে চৈতি বলে উঠলো, ‘আপু! স্বাধীন ভাইয়া ফজরের নামাজ শেষ করে ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত ক্বুরআন পড়ছিলেন। এরপর কিছুক্ষণ কুরআন বন্ধ রেখে গজল গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলেন। এটা কি কোনো নিয়ম আপু?’
– ইশরাকের নামাজ পড়েছে হয়তো।
– ইশরাকের নামাজ?
– হ্যাঁ। ফজরের নামাজ পড়ে দুনিয়াবী কোনো কাজে লিপ্ত না হয়ে ক্বুরআন তিলাওয়াত, জিকির সূর্যের আলো ছড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত করতে থাকবে। এরপর সূর্য ওঠার বেশ কিছুক্ষণ পর ইশরাকের নামাজ দুই রাকআত অথবা চার রাকআত পড়তে হবে। এর ফজিলত অনেক। স্বাধীন আমার চাইতেও দ্বীনি হয়ে গিয়েছে। আমি একবারও ইশরাকের নামাজ পড়িনি।
স্বাধীনের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে গেলে চৈতির লজ্জা অনুভূত হয়। সে দিন দিন অকাজ করে যাচ্ছে, অথচ ছেলেটা কি সুন্দর দ্বীনের প্রতি নিজের মনোভাব অটুট রেখেছে। কিন্তু তার নফস তাকে বলছে, বিয়ের পর সেও ধার্মিক হয়ে যাবে।
চা নাস্তা নিয়ে সারাফ সাহেবের ঘরে হাজির হলো চৈতি। সারাফ, শিমুল, সাদিক ও সাদিয়াকে চা দিয়ে দাদির পাশে বসে এক কাপ চা হাতে গল্প করতে লাগলো সে। দাদি ভ্রু নাচিয়ে চায়ের ভাগ চাইলেন। মুচকি হেসে চৈতি তার কাপ এগিয়ে দিলো। এক চুমুক খেয়েই তিনি বললেন, ‘কুহুর হাতের স্বাদ পাইলাম রে সারাফ! তোর মাইয়াটার নাম ছুডু কুহু দিয়া ভালা করছি।’
চৈতির চা খাওয়া হলো না। দাদি ডায়বেটিসের রোগী হওয়ায় তার জন্য চা বানানো হয়নি। কিন্তু তার ভাগের চা খেয়ে নিলেন জয়নাব। সারাফ বেশ রাগ করলে তিনি কৈফিয়ত দিলেন এই বলে, ‘চিনি একেবারেই দেয় নাই। ছুডু কুহু মনে অয় ইচ্ছা কইরা কম চিনি দিছে। হ্যায় জাইনতো আমি ভাগ চাইয়া নিব।’
মুচকি হাসলো চৈতি। বাকিরাও হাসলো জয়নাব বেগমের অজুহাত শুনে। চায়ের পর্ব শেষ হলে জেবিন আর শিল্পী এসে হাজির হলেন। জেবিন হাসিমুখে ঘরে ঢুকে গল্পের আসর দেখে থমকে গেলেন। মুহূর্তে হাসি মুছে গম্ভীর ভাব ধারন করেছেন তিনি। শিল্পীও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। জয়নাব তাদের দেখে বললেন, ‘কিরে মা? তুই আইছোস আর আমার লগে দেখা করছ নাই। তুই কি আমার মাইয়া?’
শিল্পী হেসে মায়ের পাশে বসলেন। আরেক পাশে চৈতি তখনো বসে আছে। শিল্পীকে বসতে দেখে যেই না উঠতে যাবে, জয়নাব তখন তার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন।
– আম্মা, তুমি উপরে উঠেছো কেন এই শরীরে? আমি বাসায় যাওয়ার সময় দোতলায় যেতে চেয়েছিলাম। তখনই দেখা করতাম তোমার সাথে।
– আমি এইহানে কত্তদিন আহি না। ছুডু কুহুর জন্যি আইছি। হ্যারে সৌরভ দোতলায় যাইতে দেয় না।
ঘরময় গম্ভীরতা ছেয়ে গেল। শিল্পী উঠে দাঁড়িয়ে জেবিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি আসি জেবিন। তুই আমার বাসায় কাল যাবি। কথা আছে।’
জয়নাব বললেন, ‘এইহানে আইসা তর বাসায় যাইতে কস কেন? আমি আইছি দেইখা?’
ফুঁসে উঠলেন শিল্পী, ‘আম্মা! তুমি এসেছো তোমার কুহুর মেয়েকে দেখতে। থাকো না ওর কাছে। ওর পাশেই বসে চা বিস্কিট খাও। আমাকে তো তোমার প্রয়োজন নেই।’
সারাফ সাহেব চুপ থাকতে পারলেন না, ‘শিল্পী, আমার মেয়েটা তোর কি ক্ষতি করেছে বলবি? জেবিন নাহয় সৎ মা। তুই তো ওর ফুপু।’
হঠাৎ হু হু করে কান্নার আওয়াজ এলো। জেবিন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি আজ এতগুলো বছর পর সৎ মা উপাধি পাচ্ছি রে শিল্পী। এত বছর ধরে মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়ে আজকে সৎ মা হয়ে গেলাম।’
শিল্পী জেবিনকে ধরে ভাইয়ের বিরুদ্ধে বকতে লাগলেন। আর সারাফ সাহেব চোখ মুখ কুঁচকে জয়নাবের পাশে বসে তার কোলে মাথা রাখলেন। এসব ন্যাকা কান্না তিনি সহ্য করতে পারেন না।
চৈতির চোখে অশ্রু উঁকি দিচ্ছে। সে দাদির কানে কানে বললো, ‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি দাদি। তুমি আর কখনো আমার জন্য এখানে এসো না।’ তারপর নিজের ঘরে চলে গেল সে। শিমুল তার পিছে পিছে ঘরে ঢুকলে সে বললো, ‘আমাকে একটু একা থাকতে দাও আপু।’
_______
ইন শা আল্লাহ চলবে …..