লোডশেডিং’ পর্ব ১৩.

0
259

‘লোডশেডিং’
পর্ব ১৩.

তাবিনা মাহনূর
________________

জানুয়ারি মাসের হাড় কাঁপানো শীত। এমন শীতের আমেজে রাত্রি কাটে লেপ-কম্বলের মাঝে ডুবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। অথচ চৈতি আজ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। গায়ে তার কালো রঙের পাতলা চাদর যার কিছু অংশ মাথায় পেঁচিয়ে নিয়েছে সে। এই অবস্থায় ছাদে দাঁড়িয়ে সে। চিলেকোঠার দিকে চোখ। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এখানে এসেছে ফজরের আগ পর্যন্ত সময় কাটাতে। স্বাধীন তাকে ফিরিয়ে দেয়ার পর থেকে তার মাঝে নাছোড়বান্দা ভাব চলে এসেছে যার দরুন এখন সে বাঁধন ছাড়া। অপেক্ষায় আছে, স্বাধীন যদি একটু সময়ের জন্য ঘর ছেড়ে বের হয়।

ফজরের আজান শোনা গেল। স্বাধীন একবারের জন্যও বের হয়নি। মলিন মুখে ঘরে চলে গেল চৈতি। আজ ভোর বেলা ঘর থেকে বের হতে পারতো না সে। কেননা আজ কামিনীর গায়ে হলুদের আয়োজন করা হবে। ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির মহিলা সদস্যরা ভোরের আলো ফুটতেই কাজ শুরু করে দিবেন। আজকে দুপক্ষের গায়ে হলুদ হবে বলে বেশ আয়োজন আর কাজ রয়েছে। রাতে আবার মেহেদী অনুষ্ঠান। তাই সব মিলিয়ে সবাই সকাল সকাল উঠেই কাজে নেমে পড়বেন। সুতরাং, চৈতির ছাদে আসার সময়টা মাঝরাতে পড়েছে। যদিও সে বহুদিন যাবৎ ছাদে আসেনি। তবু আজ না এসে থাকতে পারেনি। শুনেছে স্বাধীন গায়ে হলুদে আসবে না। চৈতি বুঝেছে, ইসলামে বিয়ে নিয়ে অতিরিক্ত উৎসব অনুষ্ঠান যা হারাম বিষয়কে প্রদর্শন করে তা নিষিদ্ধ বলে স্বাধীন আসবে না।

গায়ে হলুদের দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিল চৈতি। এদিন স্বাধীনকে দেখতে চেয়েছিল সে। যেহেতু আজ স্বাধীনকে দেখা যাবে না তাই এক পলক দেখার জন্য ছাদে গিয়েও লাভ হলো না।

নামাজ শেষে ঘুমের প্রস্তুতি নিলো চৈতি। বাসন্তী রঙের শাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো সে।

_______

টেবিলে নাস্তা নেই। চৈতির বেশ ক্ষুধা লেগেছে। কাজল তাকে টেবিলের পাশে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেঁতে উঠলো, ‘বেলা দশটায় উঠলে নাস্তা পাইবেন কেমনে? বিয়া বাড়িতে সবাই নাস্তার লাইগ্গা হুড়মুড় করে। আপনে উঠছেন সূর্য মাথার উপুর যহন, নাস্তা পাইবেন এই আশা ছাইড়া দ্যান।’

চৈতি হাই তুলে দোতলার উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো। সেখানে শিমুলের কাছে একটা রুটি চেয়ে আলু ভাজি দিয়ে খেয়ে নিবে। এতে তার সারাদিন চলে যাবে।
তিনতলায় আসতেই সৌরভের সাথে দেখা। সৌরভ তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পথ আটকালো। চৈতির চেহারায় আজ মায়াবী ভাব আরো বেশি উপচে পড়ছে। ঘুম ঘুম চোখ দুটো ফুলে আছে, ছোট বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে মুখে বিরক্তি ভাব এনে রেখেছে। এভাবে কেউ দেখলে রাগ নয়, বরং আদর করতে চাইবে। যেমনটা সৌরভের ইচ্ছে করছে। তবে রাগ, আদর সবকিছু পাশে রেখে সে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘কখন উঠেছিস?’

– মাত্র।
– নাস্তা করেছিস?

চৈতি দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে নাস্তা করেনি।

– নাস্তা না করে বাইরে কোথায় যাচ্ছিস? মাথা ঘুরে পড়ে গেলে মজনু এসে কোলে নিবে?
– নাস্তা নেই। শিমুল আপুর কাছে চাইতে যাচ্ছি।
– শিমুল আপুর কাছেও নেই। ওখানে নাস্তা শেষ। গত রাতেই তো গ্রাম থেকে কতজন আসলো। এরা যে এতো খায় বাপরে!
– আমি তাহলে কি খাবো? উফ! পেটে গ্যাস গ্যাস লাগছে।

সৌরভ চৈতির হাত ধরে ঘরে ঢুকলো। তাদের ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ারে চৈতিকে বসিয়ে টেবিলে থাকা ঢেকে রাখা খাবারগুলো দেখতে লাগলো। চৈতি বাধ্য মেয়ের মতো চুপ করে বসে আছে। অন্য সময় হলে এখানে কিছুতেই খেতো না সে। কিন্তু আজ তার খুব ক্ষুধা লেগেছে, সেই সাথে ঘুমের ঘোরে কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। সৌরভ একটা প্লেটে দুটো রুটি আর গরুর মাংসের পদ তুলে দিয়ে বললো, ‘খেতে থাক। দুটো রুটি শেষ না করা পর্যন্ত উঠবি না। আমি এখনই আসছি।’

চৈতি মাথা দুলিয়ে খেতে শুরু করলো। খাওয়ার মাঝে দিলারা বেগম তাকে দেখে বললেন, ‘সৌরভ দিয়েছে এসব খাবার?’

খাওয়া বন্ধ করে চৈতি উপর নিচ মাথা দুলালো। দিলারার পাশে নীরা দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, ‘ছেলে দেখি বিয়ের আগেই স্ত্রৈণ বনে গেছে!’

এ কথাই যথেষ্ট ছিল দিলারা বেগমকে রাগিয়ে দিতে, ‘এই মেয়ে! খেতে হয় কীভাবে জানো না? এসব খাবার দুপুরে আসা মেহমানদের জন্য রান্না করা হয়েছে। তুমি কোন সাহসে আমাকে জিজ্ঞেস না করে খেতে বসেছো?’

চৈতি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘সৌরভ ভাইয়া খেতে বলেছেন। আমি নিজে খেতে আসিনি।’

– একটা থাপ্পড় দিব মেয়ে। মুখে মুখে তর্ক করছো! আমার ছেলেটার মাথা কি দিয়ে নষ্ট করেছো বলো তো? তাবিজ করেছো নাকি? নাহলে যেই ছেলের জন্য সারা এলাকার মেয়ে বিয়ের লাইন লাগিয়ে দেয়, সেই ছেলে কীভাবে তোমার মতো আনস্মার্ট মেয়েকে পছন্দ করে? এতদিন ছেলের ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। আজকে ছাড়বো না। জবাব দাও মেয়ে!

চৈতির মাথা ঘুরছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এমন পরিস্থিতিতে পড়বে জানলে না খেয়ে থাকতো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। হঠাৎ সৌরভ এসে তাকে বকতে লাগলো, ‘কিরে! তোকে না পুরো খাবার শেষ করতে বলেছি?’

– তোমরা সবাই খালি বকা দিতে জানো। আমি কারো সাথে কথা বলবো না।

শিশুসুলভ অভিমান নিয়ে দৌড়ে বাসায় চলে গেল চৈতি।

________

দুপুরের দিকে জানতে পারলো সে, সৌরভ বাসায় বেশ ঝামেলা করেছে। গরুর মাংসের হাঁড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এরজন্য বাড়তি খরচ করে আবার রান্না করতে হয়েছে। চৈতির কোনো অনুভূতি হলো না। সে ঘর গোছানোর দায়িত্বে আছে। তাদের বাসার প্রতিটা ঘর গোছানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে। এ কথা সাদিয়া এসে বলেছে, তবু জেবিন বলেননি। সে প্রতিটা ঘর সুন্দর করে গুছিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, যুহরের নামাজের সময় চলে যাচ্ছে। গোসল করা হয়নি, পেটে সকালে একটা রুটি পড়েছে শুধু। তারপর খাওয়া দাওয়া নেই। সব মিলিয়ে বেশ ক্লান্ত সে। এরই মাঝে মাইমুনা ফোন করলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন ধরলো চৈতি।

– আসসালামু আলাইকুম আপু।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুমি কি অসুস্থ চৈতি?
– না আপু। সকাল থেকে কাজ করছি তো, তাই একটু দুর্বল লাগছে।
– আহারে! গ্লুকোজ খেয়ে নাও। তাহলে শক্তি পাবে।
– ওহ! মনে ছিল না। গোসল করে এক গ্লাস গ্লুকোজ খেয়ে নিব। তুমি কেমন আছো আপু?
– আলহামদুলিল্লাহ। শোনো, আজকে রাতে আসছি আমি। বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। তোমার কথা বলেছি। বলেছি তুমি একা একা খুব কষ্ট পাবে। তোমার বোনের বিয়ে, একটা বোন চলে যাচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই কষ্টের।

চৈতি চুপ করে থাকলো। কামিনী চলে যাওয়াতে তার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। সে বললো, ‘ভালোই হবে। তুমি এখন এলে আরো ভালো হতো।’

– এখন আসতে পারছি না বোন। তুমি আমাকে মেহেদী দিয়ে দিবে কিন্তু।
– ইন শা আল্লাহ। এখন রাখি?
– হ্যাঁ হ্যাঁ। সরি রে। কথা বলতে গেলে থামা কষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ হাফেজ।

নামাজ পড়তে হবে বলে দ্রুত গোসল শেষে চৈতি বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখলো, তার ঘরে অচেনা মানুষে ভরে আছে। বিয়ে বাড়িতে এই এক সমস্যা। চেনা অচেনা সবাই যার যার মতো ঘরে ঢুকে বসে থাকে। অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয়, পুরুষ মানুষ একজন মেয়ের ঘরে হুট করে ঢুকে যায় অনায়াসে। মেয়েটা কি অবস্থায় আছে তা বিবেচনা করার প্রয়োজন মনে করে না।

এই যেমন এখন, পুরো বিছানা জুড়ে একজন পুরুষ শুয়ে আছে বালিশে মুখ গুঁজে। তার পাশে দুজন পুরুষ বসে আছে। আর ঘরের কোণায় থাকা ডিভানে বসে আছে দুজন মেয়ে। এর মাঝে একজনকে চিনতে পারলো চৈতি। সৌরভের বান্ধবী মাহিয়া হাসছে আর কিছু একটা বলছে। চৈতি ধীরে ধীরে দরজা চাপিয়ে ভাবতে লাগলো, কীভাবে সে বাথরুম থেকে বের হবে। বাইরে ছেলে মানুষ, আর তার কাছে কোনো ওড়না নেই। হয়তো ঘর ফাঁকা দেখে ওদেরকে কেউ বসতে বলেছে এখানে। কিন্তু বিছানা জুড়ে শুয়ে আছে কে? হঠাৎ একজনের কথা মনে পড়ায় দরজায় কান পাতলো চৈতি। শোনা যাচ্ছে তাদের কথোপকথন।

– হুজুর সাহেব এসেই ল্যাটায় পড়লেন বিছানায়। এটা কেমন আদব হুহ?
– জ্বালাইস না তো রাশেক। আমি আসতেই চাইনি, তোদের যন্ত্রনায় টিকতে পারলাম না। তোদেরকে আগেই বলেছিলাম আমি এসে একটা ঘরে ঢুকে ঘাপটি মেরে থাকবো। এখন তোরাও আমার পিছে পিছে আসলি।
– কি করবো বন্ধু? তিন তলায় মানুষের ভিড়ে বসার জায়গা নেই। সৌরভ ব্যাটা কামলা খাটতে খাটতে আমাদের খোঁজই নিতে পারতেছে না। দোতলায় গেলাম, সেখানেও দেখি মহিলা মানুষের ভিড়।

মেয়েলি কণ্ঠে কেউ বললো, ‘দোতলায় সৌরভের দাদি থাকেন। উনাকে ঘিরে মহিলাদের ভিড়। যেখানে বয়স্ক মানুষ দেখবি সেখানে মহিলাদের জমায়েত পাবি।’

স্বাধীনের কন্ঠ, ‘এতে কি অন্যায় আছে? মেয়েরা মেয়েদের সাথে থাকবে। ছেলেরা ছেলেদের সাথে। এটাই তো উচিত। বয়স্ক মানুষ যদি অসুস্থ থাকেন, তাকে দেখতে যাওয়া নবীজির সুন্নাহ।’

রাশেক বললো, ‘এই যে মওলানা সাহেবের ভাষণ শুরু হলো। থাম ব্যাটা। এরে নিয়ে আসাই দেখছি যন্ত্রনা হয়ে গেল। কিরে জাহিদ, তুই জোর না করলে মওলানা আজকে গুনাহগার হতো না।’

হাসির রোল পড়লো ঘরে। স্বাধীনের বিরক্তি মাখা সুর, ‘দেখ ফাজলামি করবি না। সবখানে মানুষের ভিড় দেখে এখানে পাঠিয়ে দিলেন নীরা আন্টি। এই ঘর ফাঁকা বলে ছোট পিচ্চিটা এখানে থাকতে বললো। ভাবলাম একা একা থাকবো। সৌরভ না আসা পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকবো। তোদের জ্বালায় সেটাও সম্ভব না।’

জাহিদ হেসে বললো, ‘তোমারে কি সাধে আনছি মামা? তোমার হারমনিকা বাজাইতে হইবে।’

চমকে উঠলো স্বাধীন, ‘কি!’

রাশেক বললো, ‘ইয়েস মামা। জাহিদ ঠিক বলছে। আজকে গান বাজনা হবে। ওখানে তোমার বিশেষ আয়োজন রাখবো। এই শোন স্বাধীন, এবার কিন্তু মাওলানা গিরি দেখাবি না। আমরা সিরিয়াস। কামিনী আপু আমাদেরকে ছোট থেকে ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতেন। তার বিয়েতে একটু হই হুল্লোড় না করলে আমরা জবাব কি দিব? আমাদের তৈরি কোনো বিনোদন না রাখলে আপু রাগ করবেন না?’

– আর আল্লাহকে কি জবাব দিবি? আল্লাহ রাগ করবেন না?
– ওহ স্বাধীন! কামিনী আপু আমার গলায় গান শুনতে চাইছে, তোর বাজানো হারমনিকার সুর শুনতে চাইছে। আমি আর রুবিনা একসাথে ডুয়েট গান করবো। এসব না করলে আপু অনেক রাগ করবেন। ছোট বেলা থেকে আপু আমাদের খুব স্নেহ করতেন। এখন যদি এগুলা না করি তাহলে আপু কত কষ্ট পাবে বুঝতে পারছিস না কেন? আর আল্লাহর কথা বলছিস? আল্লাহ হলেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনি আমাদের মা বাবার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। আমরা গুনাহর কাজ করলে তিনি নিশ্চয়ই মাফ করবেন। মাফ চেয়ে নিলেই হবে।

স্বাধীন হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। এর সুন্দর জবাব সে জানে। সে চাইলেই বলতে পারতো, ‘এখনই যদি তোর মৃত্যু হয় তাহলে তুই কীভাবে ক্ষমা চাইবি? এটা কি আল্লাহর সাথে মশকরা করা হলো না?’ কিন্তু এখন কোনো ফিতনায় জড়াতে চায় না সে। বিয়ে বাড়িতে ঝগড়া বিবাদ করে ঝামেলা বাড়ানো সহজ, কিন্তু এই সহজ কাজটার কঠিন ভার আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সে ঠিক করলো, কোনো জবাব দিবে না। গানের আসর বসার আগেই এখান থেকে কেটে পড়বে সে। পরে সৌরভকে বলে দিবে কামিনীকে তার বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে। আরো বড় কথা, সে তার হারমনিকা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।

কথোপকথন চলছে। এবার স্বাধীনের গলা ভেসে আসছে না। তবে বাকি চারজনের কথা শুনে বোঝা গেল, স্বাধীন ঘুমানোর চেষ্টা করছে। বিরাট মুশকিলে পরে গেছে চৈতি। একদিকে স্বাধীন আসার আনন্দে মনে ঢেউ খেলছে, অন্যদিকে ঘরে ঢোকার কোনো সমাধান খুঁজে না পাওয়ায় চিন্তায় মগ্ন। উপায় না পেয়ে দরজা খুলল সে।

রুবিনা নামের মেয়েটি বলে উঠলো, ‘ঘরটা খুব সুন্দর করে গোছানো। মনে হচ্ছে কোনো মেয়ের ঘর এটা।’

স্বাধীন চোখ বন্ধ অবস্থায় বললো, ‘ব্যাচেলর ছেলেরা এসব পারে না। আমার ঘরের অবস্থা খুব খারাপ ছিল এতোদিন। ইসলামিক চিন্তা ভাবনা আসার পর তাও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু একটা বউ আনার প্রয়োজন বোধ করছি রে। আর কতদিন ঘর বাড়ি গুছিয়ে রাখবো!’

হেসে উঠলো সবাই। মাহিয়া বললো, ‘এই ঘরটা কার জানিস? দেখে মনে হচ্ছে চৈতির। সৌরভের কপাল ভালো। গোছানো মেয়ে পাবে।’

ঠিক তখনই চৈতি দরজা খুলে ঘরে উঁকি মেরে বললো, ‘মাহি আপু, একটু এদিকে আসবে?’

ঝট করে উঠে বসলো স্বাধীন। খাট থেকে নেমে বাহিরে যেতে যেতে সে বললো, ‘রাশেক, জাহিদ, তোরাও আয়।’
পুরুষ মানুষ বেরিয়ে গেলে মাহিয়া দরজা ভিড়িয়ে চৈতিকে বললো, ‘তুমি এখানে! কতক্ষণ ধরে ছিলে?’

– বেশিক্ষণ হয়নি আপু। আমার গায়ে ওড়না নেই জন্য বের হতে পারছিলাম না।
– বোকা মেয়ে, আমাকে আরো আগে ডাকবে না? আচ্ছা বাদ দাও, এখন তাড়াতাড়ি মাথা মুছে নাও। ভেজা চুলে শরীর ভিজে যাচ্ছে।

চৈতি মুচকি হেসে বললো, ‘আরেকটা উপকার করবে আপু?’

– হ্যাঁ অবশ্যই আপু, বলো?
– আমি এখন নামাজ পড়বো। যতক্ষণ পড়বো ততক্ষণ কোনো ছেলে মানুষ যেন এই ঘরে না ঢুকে সেদিকটা খেয়াল রাখতে পারবে?
– হ্যাঁ, পারবো না কেন? তুমি নামাজ পড়ো। সময় চলে যাচ্ছে।
– উনাদেরকে সাদিকের রুমে যেতে বলো। ওই ঘর ফাঁকা থাকতে পারে।
– সেই চিন্তা করতে হবে না। ওরা ছেলে মানুষ, যেকোনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও সমস্যা হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে নামাজ পড়ো আপু।

চৈতি নামাজের জন্য মুসাল্লা বিছিয়ে দিলো। রুবিনা আর মাহিয়া ডিভানে বসে কথা বলছে। নামাজের মাঝে থাকলেও চৈতির মনোযোগ তাদের ফিসফিসিয়ে বলা কথোপকথনে।

– রুবী, তুই বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে রাখিস না। বিয়ে বাড়িতে এসেছিস, মজা কর।
– আমি গান গাবো না। তোকে বলেছিলাম এ কথা, স্বাধীন হারমনিকা না বাজালে আমি গান গাবো না।
– পাগলামি করিস না। স্বাধীন ধর্মের পথে আসতে চাইছে। ওকে সেই পথে থাকতে দে, জোর করা যাবে না। তুই কেন ওর জন্য লোক দেখানো ধার্মিক হবি?

রুবিনা ধৈর্যহীন কণ্ঠে বললো, ‘তোরা কেউ আমাকে বুঝতে চাস না।’

মাহিয়া বোঝানোর চেষ্টা করছে, ‘বুঝতে পারছি বলেই বলছি, স্বাধীনের আশা ছেড়ে দে। ও তোকে বলেছে যে ও সারাজীবন তোকে বন্ধু ভেবে এসেছে, অন্য কিছু ওর মনে নেই। এখন ও তোকে দেখলেই পালাই পালাই করে গায়রে মাহরাম বলে। তবু তুই কেন এখনো ওর আশায় আছিস? এখনকার পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এমন, তুই আর স্বাধীনের পার্থক্য আকাশ পাতাল।’

– আমি ওকে ছোট বেলা থেকে ভালোবাসি।
– হায় আল্লাহ! ইসলাম আসলে ঠিকই বলে, ছেলে মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না। মাঝে শয়তান বসে থাকে।

রুবিনা মুখ বেঁকিয়ে উল্টো ঘুরে বসে থাকলো।
চৈতির নামাজের মাঝে কোনো মনোযোগ নেই। সে মনে মনে ভাবছে, রুবিনার লম্বা মুখ ভোঁতা করে দিতে পারলে শান্তি হতো। এভাবে পুরো নামাজে মনোযোগ নষ্ট করে শয়তানকে জিতিয়ে দিলো সে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। বাসন্তী রঙের শাড়ি আর খয়েরি ব্লাউজ পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চৈতি। এলোমেলো চুলে শুধু কাজল চোখে দিয়ে ভাবছে সে এভাবেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাবে কিনা। এক হাতে বাসন্তী রাঙা গাঁদা ফুলের মালা পেঁচিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে শরীর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে কোনো খুঁত আছে নাকি। শাড়ি পরা শিখে নিয়েছে শিমুলের কাছ থেকে। তাই একাই পরতে পেরেছে। ঠোঁটে কোনো প্রসাধনী লাগায়নি। শুধু কাজল কালো চোখ, এলোমেলো চুল আর হাতে প্যাঁচানো ফুলের মালা দিয়ে তার সৌন্দর্য যেন বহু গুন বেড়ে গিয়েছে। সে আয়নায় তাকিয়ে মুচকি হাসতেই গাল দুটো ফুলে উঠলো।

তিন তলায় গিয়ে আশেপাশে মানুষের ভিড় দেখে বেশ বিরক্ত বোধ করলো চৈতি। তবু ভিতরে ঢুকে স্বাধীনকে খুঁজতে লাগলো সে। তার এই রূপ স্বাধীনকে না দেখানো পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। আশেপাশে কোথাও খুঁজে না পেয়ে একবার ভাবলো মাহিয়াকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তখনই রাশেক এলো উপর তলা থেকে। এসে মাহিয়াকে বললো, ‘হুজুর সাহেব ছাদে গিয়ে বসে আছেন। এখানে নাকি মেয়ে মানুষ বেশি!’

সকলের অগোচরে ছাদের উদ্দেশ্যে উপরে যেতে লাগলো চৈতি। ছাদের দরজার কাছে আসার পূর্বেই স্বাধীনের সাথে দেখা। স্বাধীন বকবক করতে করতে বের হচ্ছে, ‘এখনই পালিয়ে যাবো! উফ! কড়া শীতের মাঝেও গরম লাগছে এতো মানুষ দেখে!’

চৈতিকে দেখে হুট করে দাঁড়িয়ে গেল স্বাধীন। চৈতি চোখ পাকিয়ে বললো, ‘পালানো হচ্ছে?’

আগুন রাঙা রূপ দেখে চোখ ঝলসে যাওয়ার ভয় থাকে। স্বাধীনের নয়ন থেকে ইতিমধ্যে ধূসর ধোঁয়া বইতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে জ্বলে যাবে। মুখ নামিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘সরে দাঁড়াও।’

চৈতি ঠিক উল্টো কাজ করলো। স্বাধীনের কাছাকাছি এসে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো, ‘এখান থেকে সোজা বাসায় চলে যাবেন। কোনো রুবী রায়ের জন্য কবিতা পড়তে হবে না। রুবী, ধুমসি, ফটকা, কেউ আপনার বউ হবে না। এই চৈতি হবে বউ। মাইন্ড ইট!’

ঝট করে তাকালো স্বাধীন। কি বলছে চৈতি! তার চেয়েও বড় কথা, মেয়েটা তার দিকে আঙ্গুল তুলে ভ্রু উঁচিয়ে কথা বলছে!

স্বাধীনের বিস্ময়কর দৃষ্টি উপেক্ষা করে বড়সড় হুমকি দিয়ে চৈতি চুল উড়িয়ে নীচে চলে গেল।

______

চলবে ইন শা আল্লাহ…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here