‘লোডশেডিং’
পর্ব ১৮.
তাবিনা মাহনূর
__________________
সারাফ সাহেব জেবিনের হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলেন। এরপর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘শান্ত হও মা।’
চৈতি শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ বাবার বুকে মাথা রাখলো। শিমুল এসে চৈতির কাঁধে হাত রাখলে চৈতি মাথা উঠিয়ে বললো, ‘ক্ষুধা লেগেছে।’
চৈতি নিজের হাতে খাচ্ছে। স্যুপের সাথে মাংসের পাকোড়া ভেজে দেয়া হয়েছে তাকে, এটা তার খুব পছন্দের খাবার। খাওয়ার সময় কোনো ঝামেলা করেনি সে। শিমুল এক মুহূর্তের জন্য নিজের বাসায় যেতে পারেনি। কারণ চৈতির কাছে বসে থাকার মতো কেউ নেই। সাদিয়া আর সাদিককে জেবিন এ ঘরে আসতে মানা করে দিয়েছেন। জেবিনকে সারাফ বকেছেন বলে তিনি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে ঘরে বসে কাঁদছেন। সারাফ সাহেব বাহিরে কোথায় গিয়েছেন, তা শিমুল জানে না। মাইমুনার কথা মনে পড়লে সে দ্রুত তাকে ফোন করলো। কল করার কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইমুনা তা ধরে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম আপু।’
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম মাইমুনা। তুমি কোথায় এখন আপু?
– আপু আমি আমার ভার্সিটিতে এসেছি। হলে একটা সিট রাখবো।
– তোমরা সবাই ঢাকায় থাকো না? তাহলে সিট কেন লাগবে?
মাইমুনা মলিন কণ্ঠে বললো, ‘বাবার শরীরের অবস্থা ভালো না। দুটো কিডনি নষ্ট অনেকদিন হলো। ডায়ালাইসিস করে আমাদের আর্থিক অবস্থা এখন খুব খারাপ। ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেয়া হবে। তাই আম্মু আর ছোট ভাই বাবাকে নিয়ে সিরাজগঞ্জ চলে যাবে।’
– তোমাদের অবস্থা তো সত্যিই খারাপ! আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আর ধৈর্য ধরো, নিশ্চয়ই ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
– ইন শা আল্লাহ। চৈতি কি বাসায় ফিরেছে?
– হ্যাঁ। এজন্যই ফোন করেছি।
– ও কি আমাকে দেখতে চেয়েছে? আপু আমি ভার্সিটির কাজটা সেরেই আসছি।
– তাড়াহুড়ো করতে হবে না। তুমি আসতে পারলে আসো, একবার চৈতিকে দেখে যাও। আর কষ্ট হলে এখন দরকার নেই। সময় করে অন্য সময় এসো একবার।
– না আপু আমি কাজ শেষেই আসছি। এখন রাখি?
– হ্যাঁ, ভালো থেকো।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
শিমুল চিন্তিত মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। চৈতিকে একা রেখে কোথাও যাওয়া সম্ভব না। ফেরার পর গোসল করা হয়নি, যুহরের সময় চলে যাবে। সারাফ সাহেবকে একবার ফোন করবে কিনা ভাবতে ভাবতেই চৈতি পেছন থেকে ডেকে উঠলো।
– শিমুপু!
চমকে উঠে শিমুল বললো, ‘তুই গোসল করেছিস? নামাজ পড়ে নে।’
চৈতি যান্ত্রিক কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘তুমি চাইলে তোমার বাসায় যেতে পারো আপু। আমি আত্মহত্যা করবো না।’
শিমুল দ্রুত চৈতিকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ ছি ছি! এ কথা ভাবিস না, এটা পাপ।’
– জানি। এজন্যই বলছি যে আমি আত্মহত্যা করবো না। তুমি নিশ্চিন্তে যেতে পারো।
– আমি ওটা ভাবছি না। কাকার সাথে দেখা করে তারপর যাবো।
– বাবা এসেছেন। তুমি বাহিরে গিয়ে আমার কাছে বাবাকে আসতে বলে দিও। কথা আছে কিছু।
– কাকা এসেছেন? আমাকে আগে ডাকবি না!
শিমুল চৈতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে সে বারান্দা থেকে বের হয়ে ঘরের দরজার কাছাকাছি যেতেই চৈতি বললো, ‘আপু!’
শিমুল পেছন ফিরে বললো, ‘কিরে?’
– সবাইকে একটু বলে দিবে, আমাকে যেন কেউ সহানুভূতি দেখাতে না আসে? এটা আমার খুবই অপছন্দ।
– বলবো।
– আর, আমাকে যেন কেউ দেখতে না আসে। আমি চিড়িয়াখানার জন্তু না কিংবা আমি কোনো এলিয়েন না। আমাকে ঘটা করে দেখতে এসে বিনোদন নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
– কেউ আসবে না। আমি তোর সাথে থাকবো।
শিমুল খুব কষ্টে কান্না চাপিয়ে সারাফ সাহেবের কাছে গেল। উনি কেবলই নামাজ শেষ করে মুসাল্লা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। জেবিন ঘুমাচ্ছেন। শিমুল তাকে বললো, ‘কাকা, আমি নিচে যাচ্ছি। চৈতির কাছে কিছুক্ষণ বসতে পারবেন? ওর কি যেন বলার আছে।’
– হ্যাঁ মা। আমি চৈতালির কাছে যাচ্ছি। তুই নীচে যা।
শিমুল চলে গেলে সারাফ প্রায় দৌড়িয়ে মেয়ের ঘরে আসলেন। এক মুহূর্তের জন্য মেয়েকে একা রাখতে চান না তিনি। চৈতি বাবাকে হন্তদন্ত অবস্থায় দেখে বললো, ‘আস্তে বাবা। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
মেয়েকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শুনে সারাফ সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
– শরীর এখন কেমন মা?
– আলহামদুলিল্লাহ। তোমার সাথে কিছু বলবো বাবা।
– কি বলবি মা?
– জাহান্নাম নিয়ে।
_____________
শিমুল গোসল সেরে জয়নাব বেগমের ঘরে গেল। জয়নাব চোখ বুজে শুয়ে আছেন, ঘুমাচ্ছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না। শিমুল চলে আসবে এমন মুহূর্তে তিনি ডেকে বললেন, ‘ক্যাডা রে?’
শিমুল দাদির পাশে বসে বললো, ‘আমি দাদি। তোমার কি অবস্থা হুম? তুমি নাকি নিয়ম করে খাওয়া দাওয়া করছো না?’
– তুই না থাকলে নিয়ম হয় কেমনে ক?
– আমি কি সারাজীবন থাকবো?
– হেইডাও একখান কতা। তুই তাড়াতাড়িই শ্বশুরবাড়ি চইলা যাবি। আমারে অহন থেইক্যা অভ্যাস করন লাগবো।
– চিন্তা করো না। আমার বিয়ে হলে তার আগে একটা ব্যবস্থা করে যাবো।
– কি ব্যবস্থা করবি রে দিদু?
– চৈতিকে দায়িত্ব দিয়ে যাবো। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি তখন চার তলায় থাকবে, ঠিকাছে? তুমি তো ঘর থেকে বের হও না। উপরে থাকতে অসুবিধা হবে না।
– আমার ছুডু কুহু কেমন আছে রে দিদু?
শিমুল বুঝতে পারলো, জয়নাব বেগমকে কিছু জানানো হয়নি। হয়তো তিনি জানলে স্ট্রোক করে বসতেন। তিনি চৈতিকে খুব ভালোবাসেন। শিমুল যথাসম্ভব কন্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। তোমাকে দেখতে আসতে বলবো।’
– আমারে কি হ্যায় দ্যাখতে চায়? আমারই মন পুড়ে। হ্যার তো পুড়ে না।
– না দাদি। ও তোমাকে দেখতে চায়। ওর সামনে পরীক্ষা বলে সময় করে আসতে পারে না। তারপরও ওকে নিয়ে আসবো আমি। এখন একটু উপরে যেতে হবে। তুমি কিন্তু অনিয়ম করো না। দুদিন ধরে নাকি সকালে হাঁটছো না। অথচ ডায়াবেটিসের রোগীকে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ হাঁটতে হয়। কালকে কোনো কথা শুনবো না। আমি তোমাকে নিয়ে কাল সামনের মাঠে যাবো।
– বাতের ব্যথা উঠছে রে!
– এসব অজুহাত দেখিয়ে লাভ নেই। আমি কালকে নিয়েই যাবো।
শিমুল দ্রুত হাঁটতে লাগলো। নীরা বাসায় নেই, নিশ্চয়ই তিন তলায় আছেন। মায়ের অগোচরে চৈতির কাছে যেতে চায় সে। নাহলে অযথা কথা কাটাকাটি হবে। হাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে চার তলায় উঠে গেল সে।
গিয়ে দেখলো চৈতি তার বাবার সাথে মনোযোগ সহকারে গল্প করছে। গল্পের বিষয়বস্তু কি তা জানা গেল না। শিমুল তাদেরকে ব্যস্ত দেখে জেবিনের কাছে গেল। জেবিন ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে মন ভার করে বিছানায় বসে আছেন। শিমুল কাছে গিয়ে বললো, ‘ছোট কাকী, একটা কথা বলি? ক্ষমা করে দিয়েন দয়া করে। এসময় কি অভিমান করা সাজে?’
জেবিন কিছু বললেন না। শিমুল আবার বললো, ‘কাকী, চলুন ভাত খেয়ে নিই। আমিও খাইনি। আপনার সাথে খাবো।’
– তুমি খেয়ে নাও। আমাকে ডেকো না।
– কাকী, আপনি ছোট বাচ্চাদের মতো করছেন। আপনি কি জানেন? আমার মা, বড় কাকী আর আপনার মাঝে আমি আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালো বৌমা হিসেবে জানি?
জেবিনের মন গলেনি এ কথায়, ‘এসব বলেও আমাকে খাওয়াতে পারবে না তুমি।’
– বিশ্বাস করছেন না? তাহলে শুনুন। বৌমা কখন ভালো হয়? যখন তার স্বামী আর শ্বশুর শ্বাশুড়ি তার উপর সন্তুষ্ট থাকে। তিন বউয়ের মাঝে আমি দাদিকে শুধু আপনার উপর সন্তুষ্ট হতে দেখেছি।
– আমি তার বোনের মেয়ে। তাই হয়তো…
– কিন্তু দাদি আপনাকে একটা কারণে অপছন্দ করেন। উনি যদি আপনাকে বোনের মেয়ে ভাবতেন তাহলে সেটাও স্যাক্রিফাইস করতেন। কিন্তু উনি আপনাকে বৌমা ভাবেন, মেয়ে ভাবেন।
– বুঝেছি, চৈতির কারণে। এটাই বলতে চাইছো?
– জি। আমরা সবাই খুব খুশি যে আপনি চৈতির এসময়টায় ওকে কোনো দোষ দেননি, বকাঝকা করেননি। এমনকি চৈতির চরিত্র সম্পর্কে সত্যি কথা বলেছেন।
এবার জেবিন শিমুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শিমুল, তুমি আমাকে একটা কথা বলো তো মা। যার কারণে আমি আমার প্রিয় মানুষকে কয়েকটা বছরের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাকে কী ঘৃণা করা অস্বাভাবিক?’
– কুহু কাকীর কথা বলছেন?
– হুম।
– স্বাভাবিক। বরং মানব চরিত্র হিসেবে ঘৃনা না করাটাই যৌক্তিক নয়।
– তাহলে তার মেয়েকে দেখলে আমি কীভাবে সহ্য করবো?
– চৈতির দোষ কোথায় এটা বলুন?
জেবিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমারই বা দোষ কোথায়? কুহুর মতোই দেখতে এই মেয়ে। ওকে দেখলেই কুহুর চেহারা মনে পড়ে। বারবার মনে হয় সেসময় আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। তোমরা ছোট মানুষ, তোমাদের মতো অল্প বয়সীদের কাছে আমাদের সুখ দুঃখের কথা বলতে লজ্জা লাগে।’
– আপনার বিষয়টা আমি বুঝতে পারব না জানি। কিন্তু চৈতি যখন ছোট ছিল তখন ওর কী অপরাধ ছিল? বড় হলে নিজের ভালো নিজে বুঝতে শুরু করে। ছোট বেলায় সেই বোধ থাকে না।
– সেসময় ও কুহুর ছবি নিয়ে কান্নাকাটি করতো। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। শিমুল, এ নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না। আমি সাদিয়ার আব্বুকে নিয়ে খুব সুখে ছিলাম। চৈতির এই বিষয়টা মিটে গেলে আবারও সুখ আসবে। এসব ব্যাপার ভাবলে আমার সুখ শান্তি চলে যায়। আমাকে এ ধরণের প্রশ্ন কখনো করবে না।
শিমুল অনুতপ্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘ক্ষমা করবেন কাকী। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলেছি।’
জেবিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। শিমুল বুঝতে পারছে না সে চলে যাবে কিনা। চলে যাওয়ার চিন্তা করার মুহূর্তে জেবিন বলে উঠলেন, ‘কেন করছো জানি। চৈতির বাজে পরিস্থিতিতে আমাকে সবাই চৈতির বিপক্ষে দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু সবার চিন্তা উল্টে দিয়ে আমি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছি। বলতে গেলে, মোটামুটি চৈতির পক্ষেই আছি। এর কারণ, আমি একজন মেয়ের মা আর আমি নিজেও একজন নারী।’
শিমুল বলে উঠলো, ‘বড় কাকীও একজন নারী আর মেয়ের মা।’
– তার মেয়ে পার হয়ে গিয়েছে। কামিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। সেই মেয়েকে নিয়ে কোনো ঝামেলা ঘটার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ছেলেকে আঁকড়ে ধরে তার জীবন। এই জীবনকে শান্তিতে বাঁচিয়ে রাখতে ছেলের কুকীর্তি ঢাকতেই হবে।
– সাদিক যদি কখনো এমন কাজ করে? প্রশ্নটা সরাসরি করে ফেলেছি তবু…
জেবিন এবার মুচকি হাসলেন। তিনি বললেন, ‘সমস্যা নেই। করতেই পারো। আমার একটা মেয়ে আছে। তুমি হয়তো জানো না বা দেখোনি, আমি হসপিটাল থেকে এসে ওদের ঘরে গিয়েছিলাম। সাদিক এখন বড় হচ্ছে। ওকে সবকিছু বোঝানো উচিত। সাদিয়াকে এই শিক্ষা আমি আগেই দিয়েছি। ব্যাড টাচ, ভালগার এক্টিভিটিস, এগুলো সাদিয়ার জানা আছে। সাদিককেও বলেছিলাম কারণ পেডোফিলরা ছেলে মেয়ে সবাইকে হ্যারাস করে। কিন্তু আমি সাদিককে বুঝিয়েছি, সে যেন কখনো কোনো মেয়ের সাথে বাজে আচরণ না করে। করতে গেলে যেন ও প্রথমে সাদিয়ার মুখটা ভাবে। আমার ছেলে কী বলেছে জানো?’
– কী?
– কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, ও সবার প্রথমে চৈতির মুখ কল্পনা করবে। তারপর যেসব ছেলেরা মেয়েদের কষ্ট দেয় তাদেরকে মারধর করবে। ও আরো একটা কথা বলেছে। সৌরভের সাথে যেন চৈতির বিয়ে না দেওয়া হয়। এইটুকু ছেলে এখনই এই কথা বলছে।
– এভাবে যদি সবাই ভাবতো!
– শোনো মা, সবার আগে সবাইকে মনুষ্যত্ব শেখানো উঠিত। যার মাঝে মনুষ্যত্ব নেই, তাকে বোনের উদাহরণ দিয়েও লাভ নেই। সে মনে করবে, বোন রেপ হলে আমার কী? আমার তো কোনো মামলা নেই এখানে।
শিমুল অবাক হয়ে শুনছে। জেবিন যে এতো সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারেন তা শিমুলের ধারণাতীত ছিল। সবশেষে জেবিন বললেন, ‘আর যাই হোক, চৈতিকে আমি আত্মহত্যা করতে দিবো না। সত্যি বলতে, কুহুর প্রতি রাগ থাকলেও চৈতিকে আমি কখনোই অভিশাপ দিইনি। চৈতি আমার সাদিয়ার চেয়েও শান্ত আর ভদ্র। আমি আরেকটা কথা বিশ্বাস করি। শুনতে অবাক লাগলেও এটা সত্যি, সাদিয়া আমাকে কষ্ট দিতে পারলেও চৈতি দিবে না। কারণ চৈতি তেমনি মেয়ে।’
______________
রাত বেড়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, চৈতিকে দেখতে কেউ আসেনি। সারাফ সাহেব জানতে পারলেন, এলাকায় একটা কথা ছড়িয়ে গিয়েছে। চৈতি আর সৌরভ দুজনে অবৈধ সম্পর্ক করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। যেহেতু দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে, আর বাসায় কেউ ছিল না, তাই দুজনের এটাই সুন্দর সময় একজন আরেকজনকে উপভোগ করার।
বাজে অপবাদ শুনে সারাফ সাহেবের ইচ্ছে হলো এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে। সবাই নাকি চৈতির চরিত্র নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে বলেই তাকে দেখতে আসেনি। কেউ কেউ আসতে চেয়েছিল, কিন্তু দারোয়ান বাড়িতে ঢুকতে না দেয়ায় বাহিরে গিয়ে তারা আরো অপবাদ ছড়িয়েছে। এসব কথা চৈতিকে জানানো হয়নি। সারাফ আজ দুপুরে উকিল বন্ধু কামালের কাছে গিয়েছিলেন, সৌরভের বিপক্ষে মামলা করলে কোনো সমাধান মিলবে কিনা। উত্তরে বন্ধু ভালো কিছু বলেননি। তিনি চৈতির পক্ষে কথা বলতে পারলেও সৌরভের পরিবার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা সত্তর ভাগ। টাকা আর তাদের পূর্বে সম্পর্কে ছিল, এমন তথ্য পেশ করলেই সৌরভ অর্ধেক বিজয়ী।
তবে চৈতির সাথে আজ বেশ সময় নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন তিনি। সেই আলোচনাটি ছিল নির্ঝঞ্ঝাট। চৈতি শান্ত মুখে কিছু কথা বলেছে, সারাফ তা চুপচাপ শুনেছেন। কথাগুলো দুজনের মাঝেই গোপন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সৌরভের বিরুদ্ধে কোনো কেস করবেন না। চৈতির কথা মতো চলবেন। যেই কাজে তার মেয়ে শান্তি পাবে, সেটাই তিনি করবেন।
ঘুমানোর আগে শিমুল ওযু করে আসলো। এটা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। সূরা মুলক্ব পাঠ করে, সূরা বাক্বরার শেষ দুই আয়াত পড়ে আয়াতুল কুরসী পড়লো। এসবই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ। সে মুখে উচ্চারণ করে চৈতিকেও বাক্বরার আয়াত পাঠ করালো। এই আয়াতের ফজিলত অনেক গভীর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বরার শেষ দুটি আয়াত পাঠ করবে তার জন্য এটিই যথেষ্ট হবে।’ (বুখারী ৫০১০, মুসলিম ৮০৭)
কিছু আলেমের মতে এই আয়াত দুটি পড়লে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সম পরিমান সওয়াব মিলবে। কেউ বলেছেন, আয়াত দুটি পড়লে শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কেউ বলছেন, বালা মুসিবত থেকে দূরে থাকবে। তবে সবগুলো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাজের মতটি। তাই শিমুল কখনোই এই আমল বাদ দেয় না।
চৈতি বালিশে মাথা রেখে বললো, ‘কাল থেকে আমাকে কুরআন তিলাওয়াত শেখাবে আপু? আমি ভুলে গিয়েছি।’
চৈতির মাঝে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে দেখে শিমুল মুচকি হেসে উঠে বললো, ‘ইন শা আল্লাহ। যে কুরআন নিজে পড়ে এবং অন্যকে শেখায় সে মুমিনদের মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ (সহীহ বুখারী ৫০২৭)
চৈতি অন্য পাশে ঘুরে শুয়ে পড়লো। শিমুলের তা দেখে মন খারাপ হলো। শিমুলকে হাসতে দেখলে চৈতিও হাসে। কিন্তু এখন সে আর হাসে না। তার সবকিছু আল্লাহর রহমতে ঠিকঠাক চলছে কিন্তু হাসিটা আর নেই। শিমুল শুয়ে পড়লে চৈতি বললো, ‘শিমুপু, কালকে দাদিকে এখানে আনতে পারবে?’
– হ্যাঁ পারবো না কেন? দাদির নাকি তোকে দেখার জন্য মন পুড়ে।
– কাল দাদির সাথে ঘুমাবো। অনেক গল্প করবো।
– আচ্ছা।
– আপু, জীবন অনেক সুন্দর! জান্নাত এর চেয়েও কোটি গুন সুন্দর তাই না?
শিমুল কিছুটা চমকে উঠলো। চৈতিকে বুঝতে না দিয়ে বললো, ‘তা তো অবশ্যই। কল্পনা করা যায় না, এত সুন্দর!’
চৈতি সিলিং ফ্যানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আমি আত্মহত্যা করবো না।’
_______________
চলবে ইন শা আল্লাহ…..