‘লোডশেডিং’
পর্ব ২৬.
তাবিনা মাহনূর
____________________
দিন গড়িয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবে। সকলের সময় তেমনই ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই চলে যাচ্ছে। আজ জানুয়ারির দুই তারিখ। চৈতি বসে আছে তার ছাদের দোলনায়। গত মাসে দোলনা কিনেছে সে। সারাফ আর সে দোলনা কেনার পর থেকে প্রতিদিন বিকালে ছাদে এসে গল্পের আসর জমায়। একটা দিন তারা এ সময়টাকে নষ্ট করতে চায় না। চৈতি দ্বীন সম্পর্কে শেখার চেষ্টা চালিয়ে রেখেছে। তার পাশাপাশি সারাফ সাহেবকেও শেখানোর চেষ্টা চলছে। আজও তারা একসাথে বসে আছে। দুজনের হাতে চায়ের কাপ। চৈতি কাপে এক চুমুক দিয়ে বললো, ‘বাবা, বিকেল সুন্দর নাকি সন্ধ্যা?’
– ভোর।
– ওহ বাবা! আমি জিজ্ঞেস করেছি বিকেল আর সন্ধ্যা নিয়ে।
– সন্ধ্যার সময়টা অনেকটাই ভোরের মতো। এজন্য ভোর বলেছি।
– তারমানে সন্ধ্যা পছন্দ।
– সন্ধ্যা পছন্দ ব্যাপারটা তেমন নয়। সন্ধ্যা ও ভোরের মাঝে যেই পার্থক্যটা আছে, সেটা হলো কোলাহল। ভোরের নিস্তব্ধতা সন্ধ্যায় অনুভব করতে পারবি না। কখনোই পারবি না।
– ভোরের নিস্তব্ধতা অবশ্যই মোহনীয়। তবে একটা সময় আছে, যখন সন্ধ্যায় মানুষের কোলাহল কমে যায়। চারিদিকে নীরব আমেজ থাকে।
– কোন সময়?
চৈতি মুচকি হেসে বললো, ‘একটু ভেবে চিন্তে বলো।’
সারাফ ভাবনায় ডুবে গেলেন। হঠাৎ বড় এক হাসি হেসে বললেন, ‘রোজার সময়?’
– একদম!
– এটা ঠিক বলেছিস মা। সেসময় সন্ধ্যায় প্রতিটা মুসলিমের মাঝে অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করে। যারা রোজা রাখে, তারা পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বসে তাকওয়ার প্রমাণ দেয়। খাবার সামনে রেখে চুপ করে আল্লাহর কাছে নিজের মনের যত ইচ্ছে, সব প্রকাশ করে।
– হ্যাঁ বাবা। তখন মনের মাঝে কেমন যেন একটা অনুভুতি জাগে। ওই অনুভূতি শুধুমাত্র রমাদান মাসেই অনুভব করা যায়।
– তাহলে কি তোর রমাদানের সন্ধ্যা পছন্দ?
চৈতি হেসে উঠলো, ‘হ্যাঁ বাবা। সাধারণত আমার রাতের শেষ ভাগের সময়টা পছন্দ। আর রমাদানের সন্ধ্যা। একবার ইফতারির আগে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। রাস্তায় কেউ নেই। এমনকি পাখিরাও ডাকাডাকি করতে করতে হারিয়ে গেল। হয়তো ঘরে যাচ্ছে। তারপর সব নিশ্চুপ।’
সারাফ সাহেব চুপ করে মেয়ের কথা শুনেছেন। এই সময়টা তিনি একান্তে মেয়ের কাছে থাকেন। সময়টা তার জীবনের অতি মূল্যবান কিছু মুহূর্তের একটি।
– তখন মনে হলো, শব্দহীন এই সময়টা কত সুন্দর! তারপর দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে অনেককিছু চাইলাম। মাকে যেন তিনি ক্ষমা করে দেন, জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়ার সৌভাগ্য দান করেন। আমি যেন তোমার কাছে সুযোগ্য কন্যা হতে পারি, যার জন্য শুধু দুনিয়া নয়, আখিরাতও আলোকিত হবে। এমনই সব দুআ করে হাত নামাতেই আজান দিলো। আর তুমি ডেকে উঠলে, ‘চৈতালি মা!’
ঠিক সারাফের মতো করেই ডেকে উঠলো চৈতি। তা শুনে সারাফ হেসে ফেললেন। তারপর চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোর দুআগুলো যেন কবুল হয়। আমি এই দুআ করি।’
– ইন শা আল্লাহ। বাবা, আমি এখন আরেকটা দুআ করি।
– কী?
– মামণির জন্য। সাদিয়া ছোট মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মামণির সাথে তর্ক করে। তখন মামণির মুখটা ছোট হয়ে থাকে। দেখতে ভালো লাগে না।
– সাদিয়াকে আমিও বকতে পারি না মা।
– তুমি মেয়েদের বকতে পারো না। আমাকেও না, সাদিয়াকেও না। সাদিককে ঠিকই বকা দাও।
– আমি অন্যায় করছি নারে। আমার বাবা আমাদের শাসন করতেন, আর মা বোনদের শাসন করতেন। এটাই নিয়ম জেনে এসেছি। তোর মামণি শাসন করতে না পারলেও আমার কিছু করার নেই।
– আমি দুআ করি যেন সাদিয়া বড় হয়ে এমন না থাকে। মেয়েটা অবুঝ। আর ওর বন্ধুদের দলটা ভালো না।
সারাফ বললেন, ‘ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেপেলে অকালপক্ব হয়।’
– এটা শুধু ইংলিশ মিডিয়াম না বাবা। এখনকার যুগটাই এমন হয়ে গিয়েছে। তবে একটা ভালো কথা শুনবে?
– কিরে মা?
– সাদিয়া আমাকে ভয় পায়। আমি কড়া সুরে কিছু বললে সে আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না।
– হুম, একজনকে ভয় পেলেই চলবে।
– কিন্তু আমাকে ভয় পেলে তো হবে না বাবা। আমি তো…
– ও কথা তুলিস না এখন। ভাবলেই মন খারাপ লাগে।
চৈতি নিশ্চুপ। সে বাবার মন খারাপ করে দিতে চায় না। এছাড়াও সে আরো বলতে চেয়েছিল, শেষ জামানায় বাবা মায়ের উপর সন্তান কর্তৃত্ব ফলাবে। তারা বাবা মায়ের সাথে রাগী স্বরে কথা বলবে। আর এইযে আজ সন্ধ্যার সৌন্দর্য নিয়ে কথা হলো, একটা সময় আসবে যখন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদয় হবে। আর সন্ধ্যার সুন্দর রূপের মাঝে পরিবর্তন আসবে। তা যেন হবে ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির মতো।
কিন্তু এতসব কথা চৈতি বললো না। বাবার সাথে এ সময়টা শুধুই আনন্দের জন্য রেখে দেয়া। চৈতি হাসি মুখে বললো, ‘বাবা, ছোট মামা কালকে ফোন করেছিল।’
– কী বলেছে?
– আমার দিকে তাকিয়ে দেখো একবার।
সারাফ মেয়ের দিকে তাকালেন। চৈতি দুই আঙ্গুল ঠোঁটের দুই কোণে ঠেকিয়ে তার হাসিটা বড় করে দেখালো। সারাফ তা দেখে হেসে ফেললেন।
– এমন করছিস কেন? পাগল পাগল লাগছে।
– লাগুক। তুমি হাসলেই হলো। মামা বললেন, আমার জন্য সারপ্রাইজ তৈরি করে রেখেছেন।
– যখন কুহু ছিল, তোর ছোট মামা প্রতি মাসেই আসতো। এসে বোনের আঁচল ধরে বিভিন্ন পদের নাস্তা আবদার করে বসতো।
– এখন সাদিয়া আর সাদিক আমাকে যেমন চা বানিয়ে দিতে বলে।
– একদম। সাদিক সেদিন তোকে কী বলছিল রে? দেখলাম তুই কোমড়ে হাত রেখে রাগ দেখাচ্ছিস?
– সেদিন ও চা বানাতে বলেছিল। চা বানানো শেষে তার নাকি মুড সুইং হয়েছে, কফি খাবে। তখন রেগে গিয়ে বলেছিলাম খাবার নষ্ট করার অভ্যাস ভালো না। দুষ্টুটা পরে চা খেয়ে বলে আরো এক কাপ বানিয়ে দিতে!
সারাফ আবার হাসলেন। এরই মাঝে আজান দিয়ে দিলে তারা দুজনে দোলনা ছেড়ে উঠলো। ছাদের দরজা আটকানোর সময় চৈতি একবার ওপাশের ছাদে চিলেকোঠার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো যেন তার মনের ভার বিলীন হয়ে গিয়েছে।
__________
স্বাধীন রাশিয়ায় গিয়ে আলিয়াকে বিয়ে করেছে। আলিয়ার বাবা মা দুজনেই সেখানে থাকেন। পারিবারিক সম্মতিতে দুজনের বিয়ের পর মাহিয়া সেই খবর সৌরভের কানে পৌঁছে দেয়। সৌরভ নিশ্চিন্ত মনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তার সুচিত্রা ও তার মাঝে আর কোনো বাধা নেই। এই ভেবে সে শিমুলের মাধ্যমে চৈতির কানে খবরটা পৌঁছে দেয়। তবে চৈতি এতে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তার উত্তর ছিল, ‘ওহ। আল্লাহ উনাদের সুখী করুন। বিবাহিত দম্পতির জন্য দুআ করে দিই। বারকাল্লহু লাকা, ওয়া বারকা আলাইকা, ওয়া জামাআ বাইনাকুমা ফি খইরিন।’ (তিরমিজি)
শিমুল অত্যন্ত অবাক হয়ে চৈতিকে বলেছিল, ‘চৈতি, তুই সত্যিই নির্বিকার এ বিষয়ে?’
– কেন আপু? আমার করণীয় কী?
– না মানে, তুই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালি না। এজন্য একটু অবাক হলাম। এতটা পাথর হয়ে গিয়েছিস তুই? অনুভূতি প্রকাশ কর সোনা। নাহলে এখান থেকেই ভয়াবহ রোগের উৎপত্তি হবে।
– কী অনুভূতি প্রকাশ করবো আপু? উনাকে ফোন করে বলবো, কেন বিয়ে করলেন? ফিরে আসুন কিংবা আমাকে বিয়ে করুন?
– তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো…
– দুঃখিত আপু। আমি রেগে যাইনি। আমি শুধু বলতে চাইছি, আমার সত্যিই কোনো অনুভূতি নেই। না সৌরভের জন্য আছে, না স্বাধীনের জন্য। কোনোরকম যিনা আমার মাঝে নেই। যদি আল্লাহ আমার ভাগ্যে কাউকে লিখেই রাখেন, তবে তাকেই মনে রাখবো।
এ কথা শুনে শিমুল বলেছিল, ‘সৌরভকে বিয়েটা না করলেই পারতি।’
চৈতি শুধুই হেসেছিল।
__________
আগামীকাল থেকে বিয়ের আমেজ শুরু হবে। চৈতি খুবই সাধারণ বিয়ে করতে চেয়েছে। তবে সে বলেছে, এলাকার সবাইকে যেন দাওয়াত দেয়া হয়। এভাবে দাওয়াত দিতে গিয়ে বিয়ের আয়োজন বড় হয়ে গিয়েছে। কামিনীর অনুরোধে বাসায় লাইটিং করা হয়েছে। একটু পরপর নীলাভ সাদা আলো জ্বলে আর নিভে। সাথে সোনালী রঙের চোখ ধাঁধানো ঝলক। এগুলো চৈতির চোখে সমস্যা সৃষ্টি করলে সে সারাফকে বলে, যেন লাইট বারবার জ্বলে না ওঠে। এরপর থেকে লাইট একাধারে জ্বলছে। সেই আলোতে চৈতির মুখে সোনালী রঙের আভা তৈরি হয়েছে। সে বারান্দায় চেয়ারে বসে ভাবছে, কতকিছু ঘটে গেল ছোট্ট জীবনে।
এখানেই সে সামনের বাসার ছেলেটার জন্য আকুল হয়ে দিন রাত ভাবনায় ডুবে থাকতো। এই চেয়ারে বসে সে ফিজিক্সের অংকগুলো সমাধান করেছে কতবার! এখানে বসে থাকতে দেখলে সৌরভ এসে জোর করে জড়িয়ে ধরতো। এটা তার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল। যিনা কখনোই মঙ্গল বয়ে আনে না। আজ তার যিনার প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহের জন্য ভয়াবহ দিন কেটেছে।
চৈতি অবশ্য এখন সম্পূর্ণ আলাদা স্বভাবের মানুষ। অল্পতে অভিমান করা মেয়েটা এখন কারো কথায় কষ্ট পায় না, যেন কাউকে পাত্তা দেয়ার সময় নেই তার। একটুতেই হেসে ফেটে পড়া মেয়েটা এখন মুচকি হাসে। অভিমানে কান্না করে ফেলা মেয়েটা এখন চুপ করে শক্ত হয়ে বসে থাকে। এক ফোটা অশ্রু ঝড়তে দেয় না। রাগ হলে চুপ করে থাকে। চৈতি নিজেকে ইসলামী আদলে গড়ে তুলতে চায়। এতেই সে শান্তি খুঁজে পেয়েছে।
গায়ে হলুদ করবে না চৈতি। এগুলো তার কাছে আদিখ্যেতা। তবু কাল বেশ কিছু মানুষ এসে তাকে ক্ষীর খাওয়াতে চেয়েছে। চৈতি বুঝে উঠতে পারে না, ক্ষীর কি কোনোদিন খায়নি সে? ঘটা করে বিয়ের আগের দিন খেতেই হবে কেন? তাকে কেউ পরোয়া করেনি। কাল সবাই তাকে ক্ষীর খাইয়েই ছাড়বে। সে শর্ত দিয়েছে, মহিলা মানুষ ছাড়া অন্য কেউ আসতে পারবে না।
ঘুম ধরেছে চৈতির। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে গুনগুন করতে করতে বারান্দায় গেল। হঠাৎ তার ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে। সে রেডিমেড হিজাব নিকাব পরে ঘরের বাইরে গেল। দরজার কাছে যেতেই সাদিয়া ডেকে উঠলো, ‘দুষ্টুপি!’
পেছন ফিরে তাকালো চৈতি, ‘কিরে? রাত কত বাড়লো! তুই এখনো জেগে আছিস?’
– তুমিও তো জেগে আছো।
এ কথা বলেই সাদিয়া মাথা নিচু করলো। চৈতির দৃষ্টি শীতল, কণ্ঠে গম্ভীরতা, ‘আমি জেগে আছি বলে তুইও জেগে থাকবি?’
– না, সেটা বুঝাইনি।
– তাহলে?
আড়চোখে তাকালো সাদিয়া, ‘আমিও ছাদে যেতে চাই।’
চৈতি হাত বাড়িয়ে বললো, ‘আয়।’
হুট করে সাদিক এসে বললো, ‘আমিও যাবো!’
চৈতি হেসে আরেক হাত বাড়িয়ে দিলো, ‘তুইও আয়।’
ছাদে আলোয় রেঙে আছে চারিপাশ। চৈতি মুচকি হেসে সাদিয়াকে বললো, ‘আমি যদি অনেক দূরে চলে যাই, তোরা কি মন খারাপ করবি?’
– দূরে কোথায় যাচ্ছ? এই এক তলা নিচে মাত্র।
চৈতি আবার হাসলো। সাদিক বললো, ‘আচ্ছা ঠিকাছে। আমি কল্পনা করলাম তুমি দূরে, অনেক দূরে চলে গেছো। নাহ! কল্পনা করলেই মাথা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।’
আবার হাসলো চৈতি, ‘ভোঁতা কি রে?’
– শোনো আপু, তুমি দূরে গেলে আমিও যাবো তোমার সাথে।
কান্না চলে আসছে চৈতির। সে দুই ভাই বোনকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ার পর নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো। এভাবে কাঁদলে তার মনোবল কমে যাবে। হঠাৎ চোখ পড়লো ওই ছাদের চিলেকোঠার ওদিকে। কেউ একজন চিলেকোঠার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। চৈতি চুপ করে দেখলো, স্বাধীনের মা নাজমা বেগম দরজায় মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছেন। চৈতি দুই ভাই বোনকে ফিসফিসিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি!’
চমকে উঠলেন নাজমা। পরক্ষণেই নিজের চোখ শাড়ির আঁচলে মুছে বললেন, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা। তুমি কি চৈতি?’
– জি আন্টি। আমি কি আপনার ছাদে আসতে পারি? অল্প কিছুক্ষণের জন্য।
– জিজ্ঞেস করছো কেন? এসো এসো। আমি অপেক্ষা করছি।
চৈতি ইশারায় সাদিক আর সাদিয়াকে নিচে নামতে বললো। নাজমা ছাদের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চৈতি, তুমি এসো। আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এইদিকের লাইটটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে অন্ধকার হয়ে আছে। ভয় পেও না কেমন?’
তার কথা শেষ হতে না হতেই চৈতি ঝপ করে ছাদের মেঝেতে পড়লো। নাজমা হা করে তাকিয়ে আছেন। চৈতি হেসে বললো, ‘আমি মনে হয় লম্বা হয়েছি।’
– তুমি কীভাবে এলে মেয়ে! আমার দম আটকে আসছে ভয়ে।
চৈতি উঠে নিজের গা ঝাড়া দিয়ে নিকাব উঠালো, ‘ভালো আছেন আন্টি? দুই ছাদের দূরত্ব তো বেশি না।’
– তাই বলে এতো সাহস কীভাবে পেলে?
চৈতি বলে ফেলেছিল, ‘আপনার ছেলেও এভাবে গিয়েছিল।’ কিন্তু নাজমা বিষয়টা কীভাবে নিবেন বুঝতে পারছিল না সে। চৈতি নাজমার হাত ধরে বললো, ‘স্বাধীন ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে আন্টি?’
নাজমা আবার কেঁদে ফেললেন। চৈতি জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আপনি রাশিয়া যাননি একবারও?’
– গিয়েছি মা। এইতো এক মাস হলো, চলে এসেছি। এজন্যই কষ্ট লাগছে বেশি। ছেলেটা আমার কত নুরানী চেহারার। অথচ মুখটা সারাক্ষণ মলিন হয়ে থাকে।
– আপনাদের কথা মনে পড়ে বলেই মনে শান্তি পান না উনি। দুআ করুন বেশি বেশি। সন্তানের জন্য মায়ের দুআ সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।
– দুআ তো করিই মা। এটা তো বলে দেয়া লাগে না। কিন্তু, সন্তানের মন খারাপ দেখলে মায়ের বুকে যে কি করে রে মা!
– আন্টি, আপনাকে কাঁদতে দেখেই আমি এখানে এসেছি। আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।
– বলো মা।
– পরশু আমার বিয়ে। জানেন মনে হয়।
– হ্যাঁ জানি। সৌরভ আজ সবাইকে দাওয়াত করে গিয়েছে।
নির্লজ্জ বেহায়া ছেলেটা আবার হাসিমুখে দাওয়াত দিয়ে বেড়াচ্ছে! ভাবতেই চৈতির সেই দিন মনে পড়ে গেল। সে দ্রুত মাথা থেকে সেসব ঝেড়ে বললো, ‘আমিও ওই কথাই বলতে গিয়েছি। আপনারা সবাই আসবেন, কেমন?’
– চেষ্টা করবো মা।
– রাত হয়েছে, আপনি কি নিচে যাবেন?
– তুমি চলে যাবে?
– আপনি চাইলে আরো কিছুক্ষণ থাকবো।
প্রায় তাহাজ্জুদের আগ পর্যন্ত দুজনে বেশ গল্প করলো। চৈতি এর মাঝে একবারও স্বাধীনের প্রসঙ্গ আনেনি। সে স্বাধীনের সাংসারিক জীবন নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করে না। অযথা গীবতের ঝুলি বাড়ার ভয়ে সে এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। বাসায় ফেরার পথে নাজমা চৈতির হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, মেয়েটা আবার ছাদ লাফিয়ে যায় কিনা! চৈতি বিদায় নেয়ার সময় হেসে আবার বললো, ‘আসবেন কিন্তু!’
__________
চলবে ইন শা আল্লাহ….