‘লোডশেডিং’
পর্ব ২৯.
তাবিনা মাহনূর
_______________
চৈতি যা ভেবেছিল তাই হলো। শিল্পী ফুপি বাড়িতে বেড়াতে এসে যখন জানলেন স্বাধীনের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে এবং স্বাধীন এখন থেকে বাংলাদেশে থাকবে, তখনই তিনি সারাফকে ডেকে বললেন, ‘তোর মেয়ে যেহেতু সৌরভকে মেনে নেয়নি, স্বাধীনই চৈতির জন্য উপযুক্ত ভাইয়া।’
সারাফ অবশ্য এ নিয়ে কিছুই বলছেন না। তিনি আগে চৈতির মনোভাব উপলব্ধি করতে চান। চৈতির আসার এক মাস হলো। স্বাধীনও বাংলাদেশে প্রায় এক মাস ধরে আছে, চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই যেহেতু কা-ফিরদের দেশে স্থায়ী হওয়া জায়েজ নয়। চৈতিকে তিনি একবারও ছাদে যেতে দেখেননি যেদিন জানলেন চৈতি শুনেছে স্বাধীনের আসার কথা। সুতরাং তার মেয়ে আসলে কি চাইছে এটা বোঝার উপায় নেই।
আজ সুযোগ পেলেন তিনি। চৈতিকে বারান্দায় একাকী বসে থাকতে দেখে তিনি বললেন, ‘চৈতালি মা, ছাদে যাবি?’
চৈতি বললো, ‘না বাবা। ছাদে অনেক মানুষ ওঠে। সাত তলার ভাড়াটিয়ার কি কলেজ পড়ুয়া ছেলে আছে?’
– হ্যাঁ রে। কেন?
– ওই ছেলেটা প্রতিদিন ছাদে ওঠে। একা না, বন্ধু দল নিয়ে ওঠে। তুমি সাদিয়ার দিকে খেয়াল রেখো বাবা। মেয়েটা বড় হচ্ছে, আশেপাশে ছেলে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। এটা কিন্তু চিন্তার বিষয়।
সারাফ মেয়ের পাশে বসে বললেন, ‘ভাড়াটিয়া উঠিয়ে দিব?’
– সেটা কীভাবে করবে বাবা? সাত তলা তো বড় কাকাদের। ভাড়াটিয়া উনাদের।
সারাফ হাসলেন, ‘তুই বিদেশ গিয়ে কোনো খবরই ঠিকঠাক রাখিসনি।’
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো চৈতি, ‘কেন বাবা?’
– এ বাড়িতে সজীব ভাইয়ের যতখানি অংশ ছিল, সবটা বিক্রি করেছেন আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে।
– ওমা! তাই নাকি?
– হ্যাঁ। বড় ভাইয়ের নিজস্ব অংশ ছিল সাত তলা আর তিন তলা। তিন তলা কিনেছেন সাজিদ ভাই, আর সাত তলা আমি কিনেছি। এখন আমার ভাগে আছে, সাত, ছয় আর চারতলা। ছোট ভাইয়ের ভাগে আছে, পাঁচ, তিন আর দোতলা। আট তলা শিল্পীর অংশ। শিল্পী আমার কাছে বেচতে চেয়েছে। এখন বেশি টাকা নেই, নাহলে কিনে নিতাম।
– তাহলে বড় কাকারা এখান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন?
– অনেকটা সেরকমই। তোর বড় কাকা এ বাড়িতে মাকে দেখতে এলেও, কামিনী কিংবা দিলারা ভাবি আসে না।
সৌরভের নাম উচ্চারণ করলেন না সারাফ। চৈতি বললো, ‘কিন্তু আত্মীয়তা নষ্ট করা নাজায়েজ।’
– আত্মীয়তা আমরা নষ্ট করিনি মা। আমি বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলি। জেবিন মাঝে মাঝেই দিলারা ভাবীকে ফোন করে। কিন্তু ভাবি ফোন ধরেন না। দুই একবার ধরলে দুই মিনিট কথা বলে রেখে দেন।
– দুই মিনিটই যথেষ্ট। যত যাই হোক, আত্মীয় বলে কথা। আমি এসে কামিনী আপুর খোঁজ নিয়েছি। আপু স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছিল।
কামিনী স্বাভাবিক স্বরে কথা বললেও তাকে সৌরভের অবস্থা জানিয়ে অনেক অপমান করেছে, যেগুলো চৈতি সারাফের কাছে বললো না।
কিছুক্ষণ সাধারণ আলাপ শেষে সারাফ আসল কথায় এলেন, ‘মা রে, তুরস্কে আর ফিরে যাচ্ছিস না তো?’
– না বাবা। পড়াশোনা শেষ, আমার পুরোনো ক্ষতে ঔষধ লাগানো শেষ। ক্ষতটা আর বাড়বে না ইন শা আল্লাহ। তাই বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বাকিটা ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করছে।
– ভবিষ্যৎ কি?
– কেন? বিয়ে!
সারাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। চৈতি খিলখিল করে হেসে বললো, ‘বাবা, তুমি কি ভেবেছো আমি কোনদিন বিয়ে করবো না? আমার একটা ভয়ঙ্কর রাতের জন্য?’
সারাফ কিছু বললেন না। মন ভরে মেয়ের মন ভোলানো হাসি দেখলেন।
– বাবা, এ জীবনে অনেককিছু সহ্য করেছি আমি। আলহামদুলিল্লাহ, এই সহ্য ক্ষমতা আমার মালিক আমাকে দিয়েছেন। যার হাতে আমার প্রাণ, তিঁনিই আমাকে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। তাঁর প্রিয় রাসূল, আমাদের হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী জাতিকে জান্নাতে যাওয়ার চারটা রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। সালাত কায়েম করা, রমাদান মাসে সিয়াম রাখা, নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করা আর স্বামীর আনুগত্য করা। এই চারটা রাস্তা যারা যত সুন্দরভাবে অতিক্রম করতে পারবে, তারা তত বেশি সফল। আমি কীভাবে একটা রাস্তা ছেড়ে দিই বলো?
সারাফের চোখের কোণে খুশির জল। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘তুই কেমন ছেলে চাস বল? আমি তোর জন্য তেমনই হাজির করবো ইন শা আল্লাহ।’
চৈতি মুচকি হেসে বললো, ‘আমার একটা রাজপুত্র চাই।’
– রাজপুত্র? ডান! হাজির হয়ে যাবে।
– শুনবে না কেমন রাজপুত্র?
– বল মা।
চৈতি বললো, ‘ছাদে যাবে বাবা?’
ছাদে সেই ছেলেটা তার বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সারাফ আগে গিয়ে নামিয়ে দিয়েছেন। তারপর চৈতিকে নিয়ে ছাদে উঠেছেন। চৈতি এবার ভুল করেনি। চুল, মুখ ঢেকে ছাদে উঠেছে। গোধূলি মাখা আকাশ দেখে চৈতির পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এমনই এক সময়ে সারাফের সাথে দোলনায় বসে গল্প করেছিল চৈতি। আজকেও তারা দুজন একসাথে, দোলনায় বসে আছে।
– আমার একটা রাজপুত্র চাই বাবা। যার অনেক সম্পদ থাকবে।
– এত সম্পদ দিয়ে কি করবি মা?
হেসে উঠলো চৈতি, ‘পুরোটা শুনো আগে।’
– বল মা।
– তিনি হবেন দুনিয়ার গরিব আর আখিরাতের শাহজাদা। আমার রাজপুত্রের এ দুনিয়ায় কোনো সম্পদ থাকবে না। কিন্তু আখিরাতে জান্নাতে তার অনেক প্রাসাদ থাকবে। একেকদিন একেক প্রাসাদে বেড়াতে যাবো আমরা। প্রত্যেকটা প্রাসাদ হবে ভিন্ন ভিন্ন। কোনটা টিনের তৈরি ছোট বাড়ি, যেখানে বৃষ্টি হলে রিমঝিম শব্দ শুনবো আমরা। আবার কোনোটা হবে মুক্তা খচিত, যেখানে আমি থাকবো মৎস্যকন্যার মতো। তিনি থাকবেন আমার সঙ্গী।
রাজপুত্রের অদ্ভুত সংজ্ঞায়ন শুনে সারাফ স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলেন। চৈতি বলছে, ‘আমার রাজপুত্রের একটা ঘোড়া থাকবে, আমরা দুজন সেই ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে যাবো। তোমরাও আল্লাহর অনুগ্রহে জান্নাত পেলে আমরা তোমাদের বাড়ি ঘুরতে যাবো ঘোড়ায় চড়ে। শিমুল আপুদের সাথে দেখা করতে যাবো বিশাল পাখির ডানায় চড়ে। আহ! আমার অনেক বড় স্বপ্ন বাবা। তুমি আমাকে গরিব ছেলের সাথে বিয়ে দিও না, যাদের জান্নাতে থাকার মতো কিছু নেই। শুধু দুনিয়ায় সম্পদ থাকলে আমি বিয়ে করবো না। আমার জান্নাতের রাজপুত্র চাই।’
সারাফ মুচকি হাসলেন, ‘এমন রাজপুত্র কোথায় পাবো বল তো?’
– খুব সহজ। প্রথমে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখবে সে শরিয়াহ মেনে চলাচল করে কিনা। হালাল কামাই করে কিনা। তারপর আমার সাথে দেখা করিয়ে দিবে। আমি কিছু প্রশ্ন করবো, ইস্তিখারা করবো। তারপর সিদ্ধান্ত নিব। সবসময় সঠিক হবে তা নয়, তবে আল্লাহর উপর আমার তাওয়াক্কুল আছে। যদি এ দুনিয়ায় নিজের সঙ্গী না পাই, তাহলে আল্লাহর কৃপায় আখিরাতে পেতে পারি।
সারাফ হাসলেন, ‘আমি খুব চেষ্টা করবো তোর জন্য প্রকৃত রাজকুমার এনে দিতে।’
চৈতি মুচকি হেসে সামনে তাকালো। মাগরিবের আজান দিলে দুজনে উঠে পড়লো। চৈতির হাতে একটা ম্যাগাজিন। সেটা দেখে সারাফ বললেন, ‘এটা কবে থেকে পড়ছিস?’
– এবারের সংখ্যাটা নিয়েছি। দেখো তো নামটা চিনতে পারো নাকি?
সারাফ ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে একটা লেখা পড়লেন। গল্পটার লেখকের নাম লেখা, ‘সাফওয়ানা চৈতি’। সারাফ অবাক হয়ে বললেন, ‘এটা তোর নাম!’
চৈতি মুচকি হাসলো, ‘বিদেশ গিয়ে প্রচুর বই পড়েছি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটিয়েছি। এভাবেই একদিন ফেসবুকে লিখতে শুরু করলাম, আস্তে আস্তে প্রতি নিয়ত লিখতে থাকলাম। তারপর দুই এক জায়গায় লেখা পাঠালাম। এই ম্যাগাজিনের সম্পাদক আমার লেখা পছন্দ করেছেন।’
সারাফ হেসে বললেন, ‘মা শা আল্লাহ! তুই ছোট থেকেই দারুন গল্প বলতি। সেটা এখন কাজে দিচ্ছে।’
– আলহামদুলিল্লাহ!
_______________
শিমুল এসেছে মাহতাবকে সাথে নিয়ে। তার কোলে মেহজাবিন ঘুমাচ্ছে। চৈতি তাকে হাত দিয়ে আদর করে বললো, ‘মামণি তোমার মত দেখতে। মা শা আল্লাহ!’
শিমুল কিছুক্ষণ গল্প করার পর হঠাৎ অদ্ভুত কথা বললো, ‘চৈতি, ছোট কাকা তোকে কিছু বলেছে?’
– কি নিয়ে?
– বিয়ের ব্যাপারে?
– বলেছে আমি বিয়ে করতে রাজি কিনা।
– তুই কি বলেছিস?
– বিয়েতে আমার আপত্তি নেই।
শিমুল অনেকটা জোরে উচ্ছাস নিয়ে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’
এই কথায় মেহজাবিন জেগে গেল। চৈতি তাকে কোলে নিয়ে বললো, ‘আহা আপু! বাবুটা জেগে গেল দেখলে?’
শিমুলের সেদিকে খোঁজ নেই। চৈতি বাবুকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। শিমুল উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি মাহতাবকে বলে আসি। নিবরাসকে সঙ্গে নিয়ে ছোট ফুপিকে আজই আসতে বলি।’
ভ্রু কুঁচকে চৈতি বললো, ‘নিবরাস কে?’
শিমুল হকচকিয়ে গেল, ‘ওমা! আমি তো নিবরাসের কথাই বলছি। তুই ওকে বিয়ে করতে রাজি আছিস কিনা?’
– আমি তো উনার নামই শুনিনি। তাহলে বিয়ের কথা এলো কীভাবে?
– তাহলে ছোট কাকা কি বলেছেন তোকে?
– বাবা জানতে চেয়েছেন আমার বিয়েতে আপত্তি আছে কিনা। কোনো নির্দিষ্ট পাত্রের কথা বলেননি।
শিমুল আবার বসে বললো, ‘ছোট কাকা পুরোটা কেন বলেননি? আচ্ছা আমিই বলি। নিবরাস হলো আমার ছোট ফুপি শাশুড়ির একমাত্র ছেলে। ওইদিন পরিচয় হলো তোর সাথে, মনে আছে? জিনাত ফুপি তোকে সেদিন দেখেই নিবরাসের জন্য পছন্দ করেছিলেন। পরেরদিন জানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিবরাস দুই সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে শুনে আর বলেননি। গত পরশু নিবরাস দেশে ফিরেছে। ইচ্ছে আছে তোকে উনারা দেখতে আসবেন।’
চৈতি কিছুক্ষণ হতবাক থেকে বললো, ‘এক মুহূর্তে কীভাবে পছন্দ করে মানুষ?’
– আমি তোর সম্পর্কে আগেই বলে রেখেছিলাম। আর সেদিন তোর মিষ্টি ব্যবহার দেখে তোকে পছন্দ করেছেন উনি। আর তুই তো দেখতে মা শা আল্লাহ! সুন্দরের রানী।
চৈতি মুচকি হেসে বললো, ‘দেশে ফিরতে না ফিরতেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু করলে তোমরা?’
– শোন চৈতি, বিয়ে যত দেরি হবে তত চিন্তা মাথায় থাকবে। ততই তোকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা দেয়া ভালো, কিন্তু তুই নিজেকে গ্যারান্টি দিতে পারবি যে তুই পরীক্ষায় পাশ করবি?
– বুঝেছি আপু। আমার আপত্তি নেই। তুমি দেখো যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করো। তবে উনার সাথে আমার কথা বলানোর ব্যবস্থা করে দিও। আমার ধর্ষণ হওয়ার বিষয়টা…
শিমুল যা আশংকা করেছিল তাই হচ্ছে। চৈতিকে থামিয়ে সে বলল, ‘আহ চৈতি! এতো ভালো হওয়ার দরকার কি? ওই ঘটনা বলা প্রয়োজন নেই। বিয়েটা ভালোমতো হয়ে গেলে শান্তি।’
– এটা কি বলছো আপু? বিয়ের পর জানলে সমস্যা বাড়বে। তাদের সাথে প্রতারণা করা হবে।
– নিজের গোপন পাপের কথা বলা নিষেধ। তুই এখন দ্বীনের পথে, আন্তরিকভাবে তওবা করেছিস সব বিষয়ে। তাই এখন তুই যদি ঘটনার কথা না বলিস, তোর গুনাহ হবে না।
চৈতি অদ্ভুত হাসি হেসে বললো, ‘গোপন পাপ? সৌরভ আর আমি কি স্বেচ্ছায় ওই সম্পর্কে গিয়েছিলাম আপু?’
শিমুল দ্রুত নিজের কথা সংশোধন করে বললো, ‘তুই ভুল বুঝছিস চৈতি। অবশ্যই তোর কোনো দোষ ছিল না। সৌরভ নিজে তোকে জোর করেছে। কিন্তু এ কথা বলে কেন ঝামেলা করবি বল?’
– আপু, আমি কোনো অন্যায় করিনি। তাই ধর্ষণের বিষয়টা বলতে আমার দ্বিধা নেই। এর বিপরীতে উনার চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই আমি। হয়তো ঘটনার পটভূমি বলতে গিয়ে আমাকে স্বাধীন ভাইয়ের কথাও আনতে হবে, কিন্তু আমি দেখতে চাই উনি আমার কথাকে কতটা গুরুত্ব দেন। বিয়ের পর কোনোভাবে যদি উনি জানতে পারেন আমি ধর্ষিতা, তাহলে তালাক না হওয়ার নিশ্চয়তা তুমি দিতে পারবে আপু?
শিমুল কিছু বলতে যাওয়ার আগেই চৈতি আবার বললো, ‘এখন আবার বলো না যে এ কথা জানবে না নিবরাস। আমাদের গলির কোন লোকটা জানে না আমার আর সৌরভের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল? কে জানে না আমি আর সৌরভ একা ছিলাম এ বাসায়? সৌরভের সাথে বিয়ের দিন আমার চলে যাওয়ার কারণে মানুষ সত্যতা জানতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু তবু একদল অমানুষ আছে যারা সত্যটাকে ছাপিয়ে সেই অপবাদটাই ছড়িয়ে বেড়ায় মানুষের কাছে। এমন অমানুষের অভাব আছে বলো? তুমি কি মনে করছো আমাকে দেখতে এলে তারা আমার সম্পর্কে কোনো খোঁজ না নিয়েই আসবে?’
শিমুল চৈতির হাত দুটো ধরে বললো, ‘আমি এতকিছু চিন্তা করিনি চৈতি। আল্লাহর কাছে শুধু এটুকুই দুআ, যেন তুই একটা উপযুক্ত মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে পারিস। সে নিবরাস হোক বা অন্য কেউ।’
পরেরদিন দুপুরে চার তলায় উৎসবের শান্ত আমেজ তৈরি হলো। হৈচৈ নেই কিন্তু আনন্দের রেশ চারিদিকে। জেবিন নানান পদের রান্না করেছেন। সাহায্য করেছে শিমুল। নিরা সবসময় চৈতির সাথে থেকেছেন যেকোনো প্রয়োজনে। শিমুলের রান্নার হাত ভালো বলে তাকে রান্নাঘরেই সময় কাটিয়ে দিতে হয়েছে। চৈতির আশেপাশে জোঁকের মতো সাদিয়ার বিচরণ ছিল। ‘আপি তুমি সবুজ শাড়িটা পরো না, ধূসর রঙের লাল পাড়ের যেটা আছে, ওটা পরো। লাল লিপস্টিক দাও, লাল চুড়ি পরো…’ সাদিয়ার দেয়া সাজগোজের এমন সব উপদেশে তার বোনের কান নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
অবশেষে সাদিয়ার কথা অনুযায়ী ধূসর রঙা লাল পাড়ের শাড়িটা পরেছে চৈতি। সবাই এমন অন্ধকার রঙের শাড়ি দেখে রাগ করেছে। সবার এক কথা, উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরতে হবে যেন গায়ের রং ফুটে ওঠে। চৈতি শুধু হেসেছে।
নিবরাসের পরিবার এসে উপস্থিত। সাথে রয়েছে নিবরাসের দাদি আর মাহতাবের বাবা অর্থাৎ নিবরাসের মামা। সবাইকে আপ্যায়ন করা শেষে দুপুরের খাবার দেয়া হলো। মেয়েরা ঘরে বসে খেলো আর ছেলেরা ডাইনিং রুমে। খাবারের পর্ব শেষে জিনাত, নিবরাসের দাদি দুজন চৈতির সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলেন। নিবরাসের বাবা আর মামা সারাফ সাহেবের সাথে আন্তরিক আলাপে মগ্ন রইলেন। এসব শেষে নিবরাসকে পাঠানো হল চৈতির সাথে কথোপকথনের উদ্দেশ্যে।
চৈতি এখনো নিবরাসকে দেখেনি। এই প্রথম তাকে এমন এক লজ্জা গ্রাস করেছে যার সাথে সে পূর্বে পরিচিত ছিল না। এমনকি স্বাধীনকে দেখলেও তার লজ্জা লাগেনি কখনো। তখন বেহায়া ছিল সে, আর আজ আরক্ত মুখটা উঁচু করে সামনে বসে থাকা মানুষকে দেখতে অপারগ।
নিবরাস অবশ্য দেখেছে চৈতিকে। দেখে আর চোখ ফেরায়নি। বন্ধু মহলে তাকে ‘ভদ্র স্বভাবের মিচকে বদ’ বলে সম্বোধন করা হয়, সংক্ষেপে ‘ভদ্র ফাজিল’। তার দুষ্টুমি ভরা মন আর হাসির কারণে বন্ধুরা তাকে এই নামে ডাকে। তবে সে কখনোই কোনো নারীর দিকে দ্বিতীয়বার তাকায়নি। তাই নারীজনিত কলঙ্ক তার পবিত্র মনে কোনো আঁচড় কাটেনি। বন্ধুদের একটাই প্রশ্ন থাকতো, এতো দুষ্টু মন নিয়ে নিবরাস কীভাবে নারী ছাড়া থাকে? নিবরাসের উত্তর ছিল, ‘আমার ভালোবাসা আর খুনসুটি, সবটা একজনের জন্য। জনে জনে বিলিয়ে বেড়ানোর মতো তথাকথিত উদার আমি নই। আর কীভাবে থাকি নারী ছাড়া? তোমরা কি দেখো না আল্লাহ কত নিয়ামত ছড়িয়ে রেখেছেন চারিদিকে? এসব দেখে আমি কীভাবে আমার রবের আদেশের পরিপন্থী হই? আর তাছাড়া রাসূলের শেখানো দুআ তো আছেই!’
আর আজ নিবরাসের দুষ্টু মন হঠাৎ এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চাইছে। তবু সামনে বসে থাকা মিষ্টি মেয়েটার সাথে তার বিয়ে এখনো হয়নি বলে চুপ করে বসে আছে সে। এর আগেও দুটো মেয়ে দেখেছে সে। বিয়ে অনেক আসলেও মেয়ে সে দুটোই দেখেছে মাত্র। এর কারণ, প্রথমেই সে মেয়েদের বাহ্যিক বিবরণ শুনে নাকচ করে দেয়। আগের দুটো মেয়ের জীবন বৃত্তান্ত শুনে পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু গিয়ে একজনের চঞ্চলতা তার পছন্দ হয়নি, অন্য জনের কথোপকথন। দুজনের সাথে কথা জমেনি তার। এবার চৈতির পালা।
– সালাম দিয়েছি, শুনেছেন?
চৈতির মিহি স্বর শুনে নিবরাস মুচকি হাসলো, ‘সালাম শুনতে পাইনি, তবে আপনার কন্ঠ যে শুনেছি তাতেই খুশি।’
চৈতির ভ্রু কুঁচকে এলো। লোকটা তাকে তাচ্ছিল্য করলো নাকি সে দুষ্টু স্বভাবের তা বুঝতে পারছে না চৈতি। এবার সে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো। উপরে দৃষ্টি ফেরাতেই নিবরাসের মুচকি হাসিটা প্রশস্ত হলো এবং সে বলে উঠলো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। আলহামদুলিল্লাহ, চোখটা দেখতে পেলাম এবার।’
চৈতি ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘বুঝতে পারলাম না।’
– আপনি আব্দুর রহমানের মতো করছিলেন।
– মানে?
– লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ পড়েননি? সেখানে আব্দুর রহমান যেমন কার্পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতো, আপনিও তেমন তাকিয়ে ছিলেন। লেখকের মতোই বলি, এইযে কতক্ষণ ধরে মুখ নামিয়ে রেখেছেন, মেঝের কার্পেটটা আমিও দেখলাম। আহামরি কোনো মুগ্ধতা পেলাম না, যেটা আপনি পেয়েছেন। চোখ ফেরাতেই পারছিলেন না!
চৈতি অবাক হলো নিবরাসের কথার ঢং দেখে। সে বললো, ‘আপনাকে দেখে মনে হয়নি আপনি…’
চৈতি থেমে গিয়েছে। নিবরাস বুঝে নিলো বাকিটা, ‘থাক বলতে হবে না। সবাই জানে আমি খুব ভদ্র। কিন্তু আমি হলাম বদের মুক্তো। ভদ্র ঝিনুকে ঘেরা এই মুক্তোটাকে সামলে রাখবেন আমার স্ত্রী। তাই যখনই কোনো মেয়ে দেখতে যাই, আমার ভেতরের রূপ প্রকাশ করবো ভেবে রাখি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন? আপনিই দ্বিতীয় নারী যার সাথে আমি এমনভাবে কথা বলছি। প্রথমজন আমার মা যিনি আমার যাবতীয় দুষ্টুমির ভার নিতে নিতে এখন ক্লান্ত। অন্য একজনকে দায়িত্ব দিতে চাইছেন।’
চৈতি মুচকি হেসে বললো, ‘আমার সম্পর্কে নিশ্চয়ই শুনেছেন আমি কেমন?’
– সবাই তো ভালোটা বললো।
চৈতি রেগে গেল, ‘মানে কি? আমি খারাপ?’
নিবরাসের মন ভালো হয়ে গিয়েছে। সে চাইতো তার স্ত্রীর সাথে খুব ঝগড়া হবে। সে কথার মারপ্যাঁচে জ্বালাতন করবে, আর তার স্ত্রী মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। এই মেয়েটাকে একটু ঝগড়ুটে মনে হচ্ছে। দেখা যাক ঝগড়া কতদূর গড়ায়।
– সবাই ভালো খারাপ মিশে তৈরি, তাই না?
চৈতি এবার শান্ত হলো, ‘হুম, আমি আসলেই খারাপ। আপনি জানেন কিনা জানি না, আমি দ্বীনের জ্ঞান পেয়েছি বড় হয়ে। আগে ইসলামী জীবন সম্পর্কে ধারণা ছিল না। যখন থেকে দ্বীন আঁকড়ে ধরলাম, তখন থেকে হারাম ও পাপকাজ বর্জনের চেষ্টা করেছি খুব। হয়তো পারছি, হয়তো পারছি না। তাই অতীত বিবেচনা করলে, আমি সত্যিই খুব খারাপ।’
নিবরাসের প্রশ্ন, ‘আর বর্তমান?’
– হয়তো ভালো, হয়তো না। ভালো মন্দের অনুপাত অর্ধেক-অর্ধেক।
– আর ভবিষ্যৎ?
– ভালো হওয়ার চেষ্টায় আজীবন অব্যাহত থাকবো।
নিবরাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, ‘আর হাতটা কার থাকবে?’
চৈতি বললো, ‘হাত?’
– ভবিষ্যৎ ভালো করার চেষ্টায় যার হাত ধরবেন, সে?
– ভালো হতে হলে কি হাত ধরতেই হয়?
– হাত না ধরতে চাইলে পা ধরতে পারেন, অথবা গলা ধরে ঝুলেও থাকতে পারেন।
এই মোহনীয় সময়টাকে এক মুহূর্তে নষ্ট করে দিলো নিবরাস। চৈতির অজান্তেই ঠোঁট দুটো গোল হয়ে এলো, ‘উফ!’
নিবরাসের খুব হাসি আসছে। তবু সে হাসি চাপিয়ে বললো, ‘সত্যিই! অন্য কেউ আপত্তি করবে কিনা জানি না, আমার গলা ঝুলে বসে থাকলে আপত্তি নেই।’
– আপনি আসলেই অদ্ভুত!
– সহ্য করে নিন। হয়তো আজীবন সহ্য করতে হবে।
চৈতি এবার গম্ভীর হয়ে বললো, ‘আর হয়তো আমার বাকি কথাগুলোর কারণে আপনাকে এই কথা বলার জন্য আফসোস করতে হবে।’
নিবরাস এবার দুষ্টুমি ছেড়ে বললো, ‘কি এমন কথা সাফওয়ানা? যেটা আমার ধারণা বদলে দিবে?’
চৈতি তার মায়াবী হাসি হেসে বললো, ‘ধর্ষিতার সংজ্ঞা আপনার দৃষ্টিতে কি?’
– মানে?
চৈতি বলে উঠলো, ‘একজন ধর্ষিতার সাথে এতক্ষণ কথা বলছেন, অথচ সামান্য এই কথার মানে বুঝছেন না?’
__________
চলবে ইন শা আল্লাহ….