লোডশেডিং’ পর্ব ৩.

0
347

‘লোডশেডিং’
পর্ব ৩.

তাবিনা মাহনূর

_________

বড় চাচার মেয়ে কামিনী অর্থাৎ সৌরভের একমাত্র বোনকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। এ সংবাদ কারো জন্য হঠাৎ বয়ে আসেনি, তবে চৈতির জন্য সংবাদটি নতুন। অবশ্য পরিবারে তার অবস্থান নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে সারাফ সাহেব ডাকেন গল্প করতে, গল্পের ছলে স্ত্রীর আড়ালে কিছু পারিবারিক আলোচনা সেরে ফেলেন। সেসময় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় চৈতির। আর যখন সৌরভ তাকে নিয়ে মাতামাতি করে পুরো দালানজুড়ে, তখন তার উপস্থিতি সকলের কাছে জানান দেয় চৈতি নামের কেউ থাকে এই বাড়িতে।

বড় চাচী দিলারা বেগম চৈতিকে পছন্দ করেন না কিন্তু ছেলের পছন্দকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না। চৈতি সে সম্পর্কে না জানলেও সৌরভ অবগত। তবে সে সেগুলো একদম মনে না রেখে চৈতির সান্নিধ্য পেতে যেকোনো চেষ্টায় প্রস্তুত।

সকালে ঘুম থেকে উঠে চৈতি ঘরের বাইরে গিয়ে দেখলো, সৌরভ বসে আছে তাদের ড্রইং রুমে। সামনে সারাফ সাহেব তার সাথে কোনো আলাপে ব্যস্ত। সারাফের পাশে জেবিন এক চুমুক করে চা খাচ্ছেন আর মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছেন। চৈতির ওখানে যাওয়াটা সঠিক মনে হলো না। ঘরে ফিরে বিছানায় বসে পদার্থবিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়ে জ্ঞানমূলক প্রশ্নের উত্তর দাগাতে শুরু করলো সে। গতকাল সৌরভ তাকে ম্যাসেজ করে জানিয়েছে, এগুলো আজ পড়া ধরবে সে। বহু অনীহা নিয়ে সে পড়াগুলো পড়েছে। এখনো কিছু বাকি আছে। তার খুব ঘুম ধরেছে কিন্তু সৌরভকে দেখে ঘুমানোর সাহস পাচ্ছে না। যদি এখন পড়াতে আসে তাহলে সে সম্পূর্ণ পড়া দিতে পারবে না। তখন তুলকালাম কান্ড বাঁধাবে এই ছেলে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল, সৌরভ এলো না। পড়ায় মন বসছে না চৈতির। হুট করে সাদিয়া এসে বললো, ‘তুমি গোসল করোনি আপি? আজকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। বাড়িতে মেহমান আসবে।’

চৈতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়লো, সৌরভ কি তবে আজই বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে এসেছে? তাহলে কি স্বাধীন কাল রাতে ঘটে যাওয়া সবকিছু বলে দিয়েছে? চৈতির খুব কান্না পেলো। এই মুহূর্তে স্বাধীনের সাথে কথা বলা তার জন্য তৃষ্ণার্ত মানুষের পানি পাওয়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের অবস্থা বুঝতে না দিয়ে প্রশ্ন করলো সে, ‘আমি তৈরি হবো কেন রে? কে আসবে বাসায়?’

– কামিনী আপুকে দেখতে আসবে। আমাদের দাওয়াত দিয়েছে।

শান্তি পেলো চৈতি। তবে কামিনীকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে এই কথা সে আগে কেন জানলো না তা নিয়ে কষ্ট পেলো সে। পরক্ষণেই মনে পড়লো, এ বাড়িতে তার অবস্থান শূন্যের কোঠায়। মুচকি হেসে বললো, ‘আমি যাবো নারে। তোরা দেখে এসে বলিস, দুলাভাই দেখতে কেমন? আপুকে কেমন লাগছিল?’

সাদিয়া চৈতির হাত ধরে বললো, ‘ওসব বললে চলবে না। তোমাকেই লাগবে। কামিনী আপুর হাতে মেহেদী দিয়ে দিবে তুমি।’

চৈতি প্রতি ঈদে মেহেদী দিয়ে দেয় এ বাড়ির মহিলা সদস্যদের। তার মেহেদির নকশা দারুণ হয়! আজও তাকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিমুল আপুর ক্ষেত্রে এসব পালন করতে তার কোনো সমস্যা হতো না। কেননা শিমুল তার অতি কাছের মানুষ। ছোট চাচার মেয়ে শিমুল অনার্স পাস করে মাস্টার্স পড়ছে। চৈতির সাথে সময় পেলেই গল্পে মেতে ওঠে। কিন্তু কামিনীর অহংকার একটু বেশি। এই বাড়ি ছাড়াও ঢাকায় আরো দুটো বাড়ি আছে বড় চাচার। কামিনী বড়লোক বাবার মেয়ে, যার রূপ অত্যধিক সুন্দর না হলেও গায়ের গড়ন আকর্ষণীয়। এসব নিয়ে তার অহংকারের শেষ নেই। মেহেদী ভালো না হলে কথা শোনাবে না কিন্তু মুখ বেঁকিয়ে থাকবে। কামিনী কথাও বলে কম, হাসে কম। তার চামড়ায় ভাঁজ পরে যাওয়ার ভয় অত্যধিক।

বেলা এগারোটা বাজে। চৈতি গোসল সেরে বেরিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। সৌরভের ম্যাসেজ, ‘আজকে পড়া ধরবো না। তোকে এমনিই বলেছিলাম যেন আগেই পড়ে রাখিস সব। তুই আজকে শাড়ি পরবি। লাল অথবা বাসন্তী রঙের। আমি ফুল কিনেছি তোর জন্য।’

‘পাত্র কি আমাকে দেখতে আসছে নাকি!’ মনে মনে কথাটি ভেবে চৈতি খুব বিরক্ত হলো। সৌরভ তো প্রতিদিনই দেখে তাকে। আলাদা ভাবে দেখার কি আছে? শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে না তবু পরতে হবে। তা নাহলে সৌরভের নির্যাতন সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়বে।

বিকেলে তিন তলার উদ্দেশ্যে রওনা হলো চৈতি। তার আগেই সবাই চলে গিয়েছে। সাদিয়া তার সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল কিন্তু জেবিনের চোখ রাঙানি দেখে সেও চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। চৈতির দেরি হওয়ার কারণ আছে। গোসল শেষে তিন তলায় গিয়েছিল কামিনীর হাতে মেহেদী পরিয়ে দিতে। দুই হাতের দুই পাশে মেহেদী দিতে দিতে হাত ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক ঘন্টা পর বাসায় এসে দেখে, তার দুই হাতে মেহেদী লেপ্টে আছে। কোনো নকশা ছাড়াই নিরাকার মেহেদী তার হাতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছে ওঠানোর, পারেনি। হাতের তালু, পিঠ ও কব্জির নিচের অংশে অনেকখানি লেগেছে, দেখতে ভালো লাগছে না। এরপর শাড়ি পরতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধলো। সেফটি পিনের অভাবে শাড়ি সুন্দর করে পরা গেল না। শিমুলের কাছ থেকে নিয়ে আসার চিন্তা করেছিল কিন্তু শিমুল নাকি রান্নার কাজে খুব ব্যস্ত। সে দারুণ রান্না জানে যা খেয়ে মুখে স্বাদ লেগে থাকে। শিমুলের কাছে যাওয়া মানেই ছোট চাচীর তীক্ষ্ণ বাক্যের সংস্পর্শে যাওয়া। যেগুলো শুনলে মন বিষিয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে আজ খুব অগোছালো দিন গেল যার কারণে বিকেল হয়ে গেল তার।

ড্রইং রুমে দামি সোফায় বসে আছে পাত্র পক্ষের লোকজন। কামিনীকে খুব বেশি সুন্দর লাগছে। দুপুরের খাওয়ার পর্ব সেরে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ চলছে এখন। চৈতি কোনো শব্দ ছাড়া ভেতরে ঢুকে শিমুলকে খুঁজতে শুরু করলো। সৌরভ বসে আছে সোফায়। একমাত্র ভাই হিসেবে বোনের বিয়েতে তার ভূমিকা অন্যতম হওয়ায় বেশ ব্যস্ত সে। চৈতির খোঁজ নেয়ার সময়ও পায়নি। চৈতি সেদিকে তাকিয়ে প্রশান্তির শ্বাস নিয়ে একটি রুমের সামনে দাঁড়ালো, দরজা আটকে দেয়া প্রতিটি রুমের। এই রুমের ভেতরে মহিলা না পুরুষ তা সে জানে না। তাই ভেতরে যেতে অস্বস্তি হচ্ছে। দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো কোনো পুরুষালি কন্ঠ শোনা যায় কিনা।

– ভুত সেজে শান্তি হয়নি? এখন গুপ্তচর হয়ে গিয়েছো?

চমকে পিছনে তাকালো চৈতি। সবুজ পাঞ্জাবিতে স্বাধীনকে মোহনীয় লাগছে। এই প্রথম চৈতি খুব কাছ থেকে খেয়াল করলো তার নব তারুণ্য মনে। মোহাবিষ্ট সেই ধারালো চিবুক। কথা বলতে ভুলে গিয়েছে সে। অবুঝ শিশুদের মতো কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাদকতা ধারণ করলো সেই চোখে। স্বাধীনের কপাল কুঁচকে এলো।

– এখন আবার বোবা হওয়ার ভান করছো নাকি?

হুঁশ ফিরে পেলো চৈতি। চোখ নামিয়ে সরে দাঁড়ালো সে। স্বাধীন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পেছন ফিরে বললো, ‘ভেতরে আসবে?’

চৈতি একবার উঁকি মেরে দেখলো ঘরভর্তি পুরুষ মানুষ। দুজন মেয়ে আছে যারা সৌরভের বান্ধবী। সেখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার। ছোট থেকে ছেলে মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকে সে। কোনো এক অজানা ইঙ্গিত তাকে সতর্ক করে ছেলেদের কাছ থেকে। মনে হয়, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু কখনো প্রকৃতির নিয়মটাকে যাচাই করেনি সে। তাই তার ধারণাতে নেই, প্রকৃতির নিয়ম কেন এত নিখুঁত! কার সৃষ্টি এত নিপুণ!

দুই পাশে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো চৈতি। স্বাধীন বলে উঠলো, ‘আমারও তাই মনে হয়। এখানে আসা উচিত হবে না তোমার।’

পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো, ‘কার সাথে কথা বলছিস স্বাধীন?’

স্বাধীন পেছনে ঘুরে উত্তর দিলো। চৈতির কাঁধে সৌরভের হাত পড়েছে। চৈতি অস্বস্তি নিয়ে দেখলো, সৌরভ আজ লাল এবং বাসন্তী রঙের মিশ্রণে একটি পাঞ্জাবি পরেছে। তাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো সৌরভ, ‘তোকে না বলেছিলাম লাল নয়তো বাসন্তী রঙের শাড়ি পরবি? এমন ক্যাটক্যাটা সবুজ রং কেউ পরে?’

চৈতি বলতে পারলো না, সবুজ রং তার পছন্দ। এই রংটি দেখলে তার চক্ষু শীতল হয়। ধরা গলায় বলে উঠলো, ‘বাসন্তী রঙের কোনো শাড়ি ছিল না আমার। আর লাল শাড়িটা আম্মুর। ওটা একটু পুরোনো হয়ে গিয়েছে বলে বাবা পরতে দিলেন না।’

– তাই বলে এমন ফালতু শাড়ি পরবি? হলুদ কিংবা সাদা পরলেও হতো।

সৌরভ তার দুই কাঁধে হাত দিয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘মাহিয়া বল তো, সবুজের সাথে কোন ফুল মানাবে? লাল গোলাপ নাকি গাঁদা?’

মাহিয়া সৌরভের বান্ধবী। মুচকি হেসে সে বলে উঠলো, ‘চৈতি কত সুন্দর! ওকে যেকোনো ফুল মানাবে। আমার মনে হয় গোলাপই বেশি সুন্দর দেখাবে।’

পাশে থাকা অন্য মেয়েটাও একই কথা বললো। সৌরভ বললো, ‘তুই তোর আম্মুর শাড়িটাই পরে আসতি, আমার সাথে মিলে যেত অন্তত।’

– মামণি বাবাকে বলেছেন এমন সুন্দর দিনে আম্মুর শাড়ি পরে আসলে যদি অমঙ্গল হয়?
– কেন? ছোট চাচী মারা গেছেন জন্য?
– হু।
– অবশ্য এই কথা ফেলে দেয়া যায় না।

হঠাৎ স্বাধীন বলে উঠলো, ‘এগুলো মানা খুব অপরাধ। অনেকেই কুসংস্কার মানে যা ইসলামিক দৃষ্টিতে কুফরের অন্তর্ভুক্ত। মাঝে মাঝে এগুলো মানার কারণে আমরা নিজের অজান্তেই শিরক করে ফেলি।’

বন্ধুরা সব হেসে উঠলো। বন্ধু রাশেক বলে উঠলো, ‘তুই এগুলো মানতে শুরু করেছিস কবে থেকে? যেন মওলানা সাহেব!’

– আরে আমি এটা মামার কাছ থেকে জেনেছি। একদিন বাসার বাইরে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে পেছন থেকে ডাক দিলে মা রেগে যান। বলেন, পেছন থেকে ডাক দেয়া ঠিক না। আমাকে কিছুতেই বের হতে দিবেন না মা। তারপর মামা বুঝিয়ে বললেন এগুলো মেনে চলা ঠিক না।

চৈতির মনে হলো, এটা কি অলৌকিক বিষয়? যেকোনো অস্বস্তিকর পরিবেশে চৈতি যখন ভরসার হাত খুঁজে বেড়ায় তখন এই মানুষটা সামনে থাকলে যেকোনো উপায়ে তাকে আগলে রাখে। সত্যিই বিস্ময়কর তার অবস্থান!

স্বাধীন তার মামার বলা কথাগুলো অভিনয় করে দেখাচ্ছে। চৈতির খুব হাসি পাচ্ছে কিন্তু সৌরভের ভয়ে হাসতে পারছে না। মাঝে মাঝে চৈতির নিজের উপর খুব রাগ হয়। এত নরম স্বভাবের হওয়ার কারণে সৌরভের মতো নিষ্ঠুর মানুষ তাকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে। এই যেমন এখন তার রাগ হচ্ছে, সে কেন সৌরভের হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে দিতে পারছে না? কেন সে হাসবে না? এতটাই রাগ হলো যে খুব বড় একটা ভুল করে বসলো সে। হাসতে হাসতে বললো, ‘বড় চাচী তো এখনও সৌরভ ভাইয়াকে কালো টিপ পরিয়ে রাখতে চান। মেয়েরা জ্বালাতন করে বলে।’

ঘরের সবাই খুব জোরে হেসে উঠলো। এদিকে চৈতি বুঝতে পারলো তার কত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। আজ রাত তার জন্য সব থেকে কষ্টের কিছু রাতের মাঝে একটি হতে চলেছে। সৌরভ থমথমে কণ্ঠে ঠোঁটে হাসি রেখে বললো, ‘হাসতে হাসতে মুখ ফেটে না যায় তোদের। আবালের দল!’

চৈতির হাত টেনে ধরে বাহিরে নিয়ে গেল সে। স্বাধীন উঠে দাঁড়িয়ে বাহিরে উঁকি দিয়ে বললো, ‘সৌরভ তোর পাঞ্জাবির পেছনে ছেড়া কেন?’

বাহিরে বসে থাকা সব মানুষ তাকিয়ে আছে স্বাধীনের দিকে। পরিবেশ নিস্তব্ধ। সৌরভ চৈতিকে একটি ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘ঘরে যা।’ তারপর এগিয়ে স্বাধীনকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। চৈতি জানে, এসময় সৌরভ থাকলে তার গলা টিপে ধরে শাসিয়ে যেত রাতের জন্য। কিন্তু আজ এই অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য রেহাই পেলো সে।

সন্ধ্যে হওয়ার আর অল্প সময় বাকি। মেহমান চলে যাচ্ছে। এখন নভেম্বর মাস। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিয়ের দিনক্ষণ ধার্য করা হলো। ডিসেম্বরে সৌরভের অনার্স শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় বিয়েটা দেরিতে হচ্ছে। এতক্ষণে সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেছে। আছে শুধু স্বাধীন। তার মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। চৈতির হাত ধরে রেখেছে শিমুল। তাই সে বাসায় যেতে পারছে না। এদিকে শিমুল তার হাত ধরে অন্যদের সাথে গল্পে ব্যস্ত। চৈতি খেয়াল করলো সৌরভ স্বাধীনকে এক পাশে নিয়ে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। স্বাধীন ভ্রু কুঁচকে বোঝাপড়া করছে সৌরভের সাথে। কি হয়েছে সে জানে না তবে এখন সৌরভকে নরম দেখা যাচ্ছে।

মেহমান চলে যাচ্ছে বলে সৌরভ আর বাকি সবাই নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। চৈতি সেই ফাঁকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। যাওয়ার আগে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একবার দেখলো স্বাধীনকে দেখা যায় কিনা। দরজা দিয়ে বের হচ্ছে স্বাধীন। চোখাচোখি হলে চৈতি কোনো কথা না পেয়ে বলে বসলো, ‘কালকের ঘটনাটা বলবেন না দয়া করে।’

হালকা হাসলো স্বাধীন। সেই হাসি ধরে রেখে বললো, ‘হাতের এই অবস্থা কেন? গোবর লেপে দিয়েছো নাকি?’

অবাক হয়ে গেল চৈতি। মেহেদির রং অনেক গাঢ় হয়ে যাওয়ায় কেমন যেন দেখাচ্ছে সেটা। তাই বলে গোবর কেন হবে! স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আপনার কি তাতে?’

স্বাধীনের হাসি প্রশস্ত হয়েছে, ‘হাতের মেহেদী যেভাবে লেপ্টে আছে তাতে তেমনই লেগেছে। যাই হোক, অনন্য নকশা। ছোট হাত দুটো আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। আল্লাহ হাফিজ রাগকন্যা!’

স্বাধীন তার হাতকে সুন্দর বলেছে, তাও আবার বিশ্রী অবস্থায়! আর কতদিন পর রাগকন্যা ডাক! চৈতির অনুভূতি থমকে গিয়েছে। সাদিয়ার ডাকে চেতনা ফিরে বাসায় গেল সে।

রাত বাড়ছে। চৈতি ভুলেই গিয়েছে সৌরভের সাথে আজ কি করেছে সে। স্বাধীনের শেষ দুটো বাক্য বারবার মনে পড়ছে তার। কেন এত মাতাল কন্ঠ সেই মানুষটার? কন্ঠ দিয়েই খুন করে ফেলবে চৈতির মন।

সৌরভ ম্যাসেজ দিয়েছে। ছাদে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে। চৈতির খুব কান্না পেলো এখন। সে ঠিক করলো ছাদে যাবে না। আজ সেই নির্যাতন সে ভোগ করবে না। খুব বাজে ভাবে স্পর্শ করে সৌরভ। সাধারণ মারধর নয়, তাই কষ্টটাও বেশি।

সকালে ঘুম ভাঙলো পানির ঝাপটায়। সৌরভ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চৈতি তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলেই সৌরভ তাকে জাপটে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘নড়বি না একদম। জানে মেরে ফেলবো।’

এই স্পর্শই চৈতিকে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে রাখে। সৌরভ পেট খামচে ধরলে চৈতির গাল বেয়ে জলধারা নামতে শুরু করলো। মুখ দিয়ে শব্দ করেও লাভ নেই। উল্টো তার নামেই বাজে কথা ছড়িয়ে যাবে।

সৌরভ সাপের মত হিসহিস করছে, ‘তোর হাসির দেমাগ বেড়ে গিয়েছে দেখছি! হাসতে হাসতে আমাকে সবার সামনে অপদস্থ করতে খুব মজা পেয়েছিস তখন। এখনো মজা নে। এখন কেন কাঁদছিস?’

– ছেড়ে দিন না ভাইয়া! আমি বুঝে উঠতে পারিনি তখন।
– আর একটা কথাও না। কাল রাতে আসিসনি। খুব সাহস হয়েছে দেখছি! সাহস কে দিয়েছে হ্যাঁ?
– মাফ করে দিন দয়া করে।

আরো জোরে খামচে ধরলো সৌরভ। চৈতি শব্দ করে কাঁদতে গেলেই মুখ চেপে ধরলো।

– বাসায় ছোট চাচা নেই। চিৎকার দিয়ে নিজের বিপদ আনিস না। ভালো করেই জানিস মামণি তোকে না, আমাকেই সাপোর্ট করবে। কথা শোন।

চৈতির ইচ্ছে করছে এক ছুটে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরতে। বাবা থাকলে বাসায় এসে এমন করার এত সাহস সৌরভ পেত না। সৌরভ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলছে, ‘ভার্সিটিতে উঠে নে, তারপর তোর হাল কি করি দেখিস। এখন ছাড় দিচ্ছি বেয়াদব। আর একটাও বেয়াদবি করলে জানে মেরে ফেলবো।’

সৌরভ যেতেই কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিলো চৈতি। আর কতদিন এই কান্না সহ্য করবে সে? তার পরিকল্পনা ভিন্ন। ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে স্বাধীনকে মনের কথা জানাবে। তার বিশ্বাস, স্বাধীন তার করুণ অবস্থার কথা শুনে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দিবে না। তখন বাবার কাছে সবকিছু খুলে বলবে। যদি বাবা মেনে নেন তাহলে বাবাকে সাক্ষী করে বিয়ে করবে সে স্বাধীনকে। আর যদি বাবা মেনে না নেন, তাহলে পালিয়ে যাবে স্বাধীনের হাত ধরে। কিন্তু স্বাধীন যদি মেনে না নেয়, তবে সেদিন হবে তার শেষ দিন।

কিন্তু আরো একটা বছর সৌরভের যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে ভাবলেই নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে ইচ্ছে করে তার। কীভাবে সে এই মাসগুলো পার করবে?

– এই আপি! আপি? এই আপি?

দরজায় ধাক্কা পড়ছে। গলাটা সাদিকের। সাদিক কখনই জেবিনের উপস্থিতিতে ঘরে আসে না। তারমানে বাসায় জেবিন এবং সারাফ কেউই নেই। তাই সৌরভ নিঃসংকোচে এসে নিজের দাপট দেখিয়েছে। চৈতি শাওয়ার বন্ধ করে দরজা খুললো। তার সারা শরীর ভেজা।

– আপি, তুমি কি গোসল করছিলে?
– না রে। কিছু বলবি? মামণি কোথায়?
– মা তিন তলায় কামিনী আপুর কাছে। একটু পর উনারা সবাই মার্কেটে যাবেন।
– বিয়ের তো অনেক দেরি। মার্কেটে এখন কেন যাবে?
– ওমা! তুমি জানো না? আগামী পরশু ইংগেজমেন্ট।
– ওহ। জানতাম না। আংটি কিনতে গিয়েছে?
– তা জানি না। এত কথা বাদ দাও। তুমি আমাকে এই অংকটা বুঝিয়ে দাও। সরল অঙ্কের নাম সরল কে রেখেছে আল্লাহই জানেন!

হেসে উঠলো চৈতি। সাদিক কম কথা বলে। কিন্তু খুব চতুর আর মাঝে মাঝে মজার কথা বলে ফেলে। মায়ের ভয়ে বোনের কাছে আসে না সে। কারণ এতে তাকে দোষারোপ না করে জেবিন চৈতিকে খারাপ বানিয়ে কটু কথা বলবেন সারাফের কাছে। এটা সাদিকের একদম পছন্দ নয়। এই কথা সে চৈতিকে বলেনি। এখানে তার বিচক্ষণতা প্রকাশ পায়। এই বয়সে সে বুঝে গিয়েছে তার মায়ের নিন্দা সে কারো কাছেই করতে পারবে না। কার কাছ থেকে শুনছিল, পরনিন্দা অতি নিকৃষ্ট একটি কাজ।

সাদিককে পড়াতে ইচ্ছে না করলেও পড়াতে হলো। জামা পাল্টে খাতা কলম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলো তারা। মাঝপথে জেবিন এসে হাজির হলেন।

__________

চলবে ইন শা আল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here