‘লোডশেডিং’ পর্ব ৬.

0
333

‘লোডশেডিং’
পর্ব ৬.

তাবিনা মাহনূর

__________

অনেক রাত হয়েছে। চৈতিকে বাসায় যেতে দেয়নি শিমুল। চৈতি সৌরভের নিষ্ঠুরতার ভয়ে এখানে থাকতে চায়নি কিন্তু শিমুলের জোরাজুরির কাছে হার মানতে হয়েছে। চৈতি দাদির সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে শিমুলের ঘরে এসেছে ঘুমানোর জন্য। ঘুম আর হলো না, সারারাত গল্প করে কাটিয়ে দেয়া হলো।

শিমুলের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের শরীরে কালো রঙের জামা বেশ মানিয়েছে। শিমুলের মুখখানিতে বিশেষত্ব এই যে, তার ভ্রু যুগল কখনো কৃত্রিম উপায়ে আঁকা হয়নি। জন্ম থেকেই তার ভ্রু যুগল চিত্রপটে আঁকা। আরো একটি বৈশিষ্ট্য, তার নাকটি সুনিপুণভাবে গড়ে তোলা। এই দুটি সৌন্দর্য দ্বারা আল্লাহ তাকে প্রকৃত সুন্দরী রূপে রূপায়িত করেছেন। তার মিষ্টি হাসি দেখে চৈতি একটু হেসে বললো, ‘শিমু আপু, তোমার প্রেমে কত সহস্র ছেলে পাগল হয়েছিল বলো তো?’

শিমুল বেশ জোরে হেসে উঠলো, ‘কি যা তা বলছিস! সহস্র মানে তো হাজারটা! পাগল মেয়ে।’

– সত্যি কথাই বলছি। তাহমিদ ভাইয়া কেন ব্রেক আপ করলো তোমার সাথে?

শিমুল হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। আপন মনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ চিন্তায় মগ্ন থাকলো সে। এ সময়ে চৈতি বিরক্ত করলো না। মনকে মাঝে মাঝে একাকী অবসর দিতে হয়। এতে মনের প্রশান্তি বাড়ে, কমে যায় গ্লানি।
শিমুল তার ভাবনরাজ্য থেকে বেরিয়ে চৈতির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বলে উঠলো সে, ‘একটা ছেলে যদি বলে তার সাথে সংসার করতে হলে আমার মা বাবার বাসায় আসা সে মেনে নিবে না, তবে কীভাবে তাকে বিয়ে করি বল?’

– হায় হায়! এটা কেমন কথা?
– হুম… ও চেয়েছিল যেন বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখি।
– তোমাকে এমনটা আগে কেন বলেনি? রিলেশনের আগে বললে তুমি তার সাথে জড়িয়ে যেতে না।

শিমুল বুঝিয়ে বললো, ‘একটা কথা বোঝার চেষ্টা কর। কোনো রিলেশন শুরুর সময় একটা মানুষ কখনো ভবিষ্যৎ ভাবে না। ভাবে কি জানিস? “এই মানুষটা আমার জন্য পারফেক্ট। তাই একেই বিয়ে করবো আমি।” অনেকে তো বিয়েও ভাবে না। তারা মনে করে ছেলেটার সাথে কয়েকদিন টাইম পাস করি এরপর বোঝা যাবে যে সে বিয়ে ম্যাটেরিয়াল কিনা। এভাবে কয়েকটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে কিংবা কয়েকটা মেয়ের সাথে একটা ছেলের প্রেম হয়, আর যিনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু বিয়ের বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। তার আগে আমাকে এক গ্লাস পানি দে তো।’

চৈতি পানি এনে দিলো। শিমুল বারান্দায় থাকা চেয়ারে বসে পানি পান করে কথা শুরু করলো।

– তুই রিলেশন আর বিয়ের পার্থক্য পুরোপুরি বুঝিস না। তার কারণ, তোর রিলেশন এক পাক্ষিক। সৌরভ তোকে ভালোবাসে, তোকে আদর করে কাছে রাখতে চায়। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি, তুই সৌরভকে দেখলেই গুটিয়ে যাস। ওর কাছে থাকাটা মেনে নিতে পারিস না।

চৈতি বিব্রত বোধ করে বললো, ‘সৌরভ ভাইয়ার কথা না বললে হয় না আপু?’

শিমুল বুঝতে পারলো চৈতির মনোভাব, ‘ঠিকাছে। আমার কথা মন দিয়ে শোন।’

– বলো আপু।
– প্রথমে তোকে রিলেশন বোঝাই। এ সম্পর্কে তোর জ্ঞান যতটুকু, তুই ততটুকুই বল আমাকে।

চৈতি বললো, ‘রিলেশনের অনেক অর্থ হতে পারে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক, বাবা মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, ভাই বোনের সম্পর্ক। কিন্তু এখন আমরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড এর সম্পর্ককে সংক্ষেপে রিলেশন বলি। এই সম্পর্ক বিবাহ বহির্ভূত আর দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মাঝে সমঝোতা থাকে যে তারা একে অপরের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে আছে।’

– কচু সম্পর্কে থাকে!
– আমি তো এটুকুই জানি আপু।
– আরে তোর কথা বলছি না। বলছি, এটা কোনো ভালোবাসাই না। যাই হোক, তুই খুব সুন্দর উপস্থাপন করতে পারিস। ছোটবেলায় যেমন বানিয়ে গল্প বলতি, তেমনই আজকেও গুছিয়ে বললি। কতদিন তোর গুছানো কথা শুনিনি রে!

মুচকি হাসলো চৈতি, ‘আজকে আমিও আগের কথা ভাবছিলাম।’

– স্মৃতি যে কি বেদনার! শোন যেটা বলছিলাম। আমি তোকে পরিষ্কার করে বোঝাই। এখনকার যুগের পিচ্চি ছেলেপেলের ফালতু রিলেশন নিয়ে বলার ইচ্ছে নেই। আমি আমার অভিজ্ঞতা বলি। তাহমিদ আর আমি ক্লাসমেট। আমরা পাশাপাশি একসাথে বসে অনেক ক্লাস করেছি। একই রিকশায় করে ঘুরেছি। ক্যান্টিনে আড্ডা দিয়েছি। এক পর্যায়ে দুজনেরই মনে হলো, আমরা দুজন একে অপরের সঙ্গে কথা বলে খুব শান্তি পাই। এ কথা আমি এখনো বলবো। ছেলেটা লিসেনার টাইপ ছিল। ওর সাথে কথা বললে যে কেউই শান্তি পাবে। ও মন দিয়ে কথা শুনে আর সব শেষে পরামর্শ দেয়। আবার আমিও এমন মেয়ে। আমার কাছে ও সব বলতো, আমি ওকে সান্ত্বনা না দিয়ে পরামর্শ দিতাম। এভাবেই বুঝতে পারলাম আমরা একজন আরেকজনের মানসিক অবস্থা খুব ভালো বুঝতে পারি। ধরেই নিলাম, ওর জন্য আমি পারফেক্ট আর আমার জন্য ও পারফেক্ট। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউই বলতে পারে না ভবিষ্যতে কি হতে পারে। যার মাঝে ঈমান দৃঢ় সে কখনোই পারবে না এসবে জড়াতে। কেননা আল্লাহর সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই।

দমে গেল চৈতি। সৌরভ তাকে বাধ্য করে কাছে টানতে। এতে তার মত থাকে না তাই আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতেও পারেন যদি সে তওবা করে থাকে। কিন্তু স্বাধীনের ক্ষেত্রে তার মন সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। সেসময় দুনিয়া কিংবা আখিরাত, কোনো কিছুই মনে পড়ে না তার। তখন কেবল একজনকে ঘিরেই তার বসবাস। স্বাধীন নামক মুক্ত পাখিকে ঘিরে। তবে কি তার ঈমান ভঙ্গুর? ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। সে ইসলামিক নিয়ম গুলো মানতে পারে না বা সেই সম্পর্কে উদাসীন হলেও ‘আল্লাহ এক’- এ কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখে। অর্থাৎ সে ইসলামের মূল কথায় বিশ্বাসী। তাহলে তাকে নিশ্চয়ই ইসলাম সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সে মন দিয়ে শিমুলের কথাগুলো শুনছে।

– আমরা দুজন একসঙ্গে যাতায়াত করেছি কিন্তু একসাথে থাকিনি। যার কারণে জানতেও পারিনি তার আচরণ কেমন। একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে সেই সম্পর্কে দুজন মানুষ নিজেদের ভালোটাই প্রদর্শন করতে চায়। তাহমিদ সবসময় নিজেকে ভদ্র আর মার্জিত স্বভাবের ছেলে বলে পরিচয় দিতো। আমি কখনোই ভাবতে পারিনি ওর মনে সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা কাজ করে। আমি যে খুব ভালো তা নয়। ওর ছোট খাটো কিছু কাজ যখন ভালো লাগতো না, তখন কিছু বলতাম না কিন্তু হিসেব করে রাখতাম। বিয়ের পর হিসেব তুলবো এমন মনোভাব নিয়ে। তাই রিলেশনে থাকা মানুষ দুটো একজন আরেকজনকে শতভাগ চিনতে পারে না। তারপর বিয়ে হলে যখন আসল রূপ বেরিয়ে আসে তখন দেখা যায় বড়জোর পাঁচ বছর সংসার টিকে। এরপর ডিভোর্স।

চৈতি বললো, ‘এটা তো এরেঞ্জ ম্যারেজের ক্ষেত্রেও হতে পারে আপু।’

– মানে?
– আমরা যখন অপরিচিত কাউকে বিয়ে করি তখন তো তার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না। একদমই অপরিচিত একটা মানুষ, সে কেমন, তার আচরণ আমাকে মুগ্ধ করবে কিনা এসব না জেনেই বিয়ে করে ফেলি। তারপর সমস্যা হতে পারে না?

শিমুল মুচকি হেসে বললো, ‘এইতো মূল কথায় আসলি। এখানেও আমি আমার উদাহরণ দিই। ধর, আমার বিয়ে হলো এমন একজনের সাথে যার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। তার নাম দিলাম এক্স। এক্সের ব্যবহার গম্ভীর আর কিছুটা রাগী। আমি সেটা প্রথম থেকেই বুঝতে পারলাম এবং সেই অনুযায়ী চলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাকে যদি আগে হাসিখুশি দেখতাম আর বিয়ের পর রাগী রূপে দেখতাম, সেটা আমার মেনে নিতে কেমন লাগতো? তখন আমি কীভাবে নিজেকে পরিবর্তন করতাম? অথচ সে যদি সবসময় একই রূপ প্রকাশ করতো তাহলে আমি অভ্যস্ত হয়ে যেতাম আর আমাদের মাঝে স্যাক্রিফাইজিং মাইন্ড তৈরি হতো।’

– সব রিলেশন তো এক না। কিছু রিলেশনে একজন আরেকজনের কাছে আসল রূপ প্রকাশ করে। তারা বিয়ের পরেও সুখী থাকে দেখেছি।
– তুই তাদের বৈবাহিক জীবনের ভেতরে গিয়ে দেখেছিস নাকি?

চৈতি একটু আমতা আমতা করে বললো, ‘না আপু। কিন্তু আমাদের কলেজের মিতু আপুর বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিয়ে হয়েছে। আপুরা প্রতিদিন সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করে। আপুর জন্মদিনে ভাইয়া আপুকে নিয়ে মালয়েশিয়া ট্রিপে গেছে। খুবই ভালো আছে তারা।’

শিমুল হেসে উঠে বললো, ‘আমি এটা বলিনি যে সব বিয়ে ভেঙে যায়, বলেছি বেশিরভাগ। এটার ব্যাখ্যা দিই তোকে। তোর মিতু আপু আর তার হাজবেন্ড কেমন সুখে আছে জানি না কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় যা যা দেখানো হয় তার সবটা বিশ্বাস করা যায় না। তবু দুআ করি তারা সুখী হোক। কিন্তু তুই যদি তাদের সংসারের ভেতরটা দেখতে পেতি, তাহলে বুঝতি কি হয় দাম্পত্য জীবনে! আমার বান্ধবী ভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে প্রেম করে সেকেন্ড ইয়ারে বিয়ে করলো। সে এখন ভালোভাবে সংসার করছে। শুধু সন্তান নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে।’

– সন্তান নিয়ে মানে?
– আমার বান্ধবী তার বডি ফিটনেস ধরে রাখতে বাচ্চা নিতে চায় না। আর তার স্বামী ভালো মানুষ, বউকে ভালোবাসে। তাই কিছু বলে না। এদিকে শ্বশুরবাড়িতে যত সমস্যা হয়েছে। বিয়ে মানে স্বামী স্ত্রীর মিলন না, তার শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি সব মিলিয়ে একটা পরিবারের বন্ধন। এখানে এই সমস্যাটাই দেখা দেয়। বান্ধবীর শাশুড়ি এমন বউ রাখতে চান না যে বংশের প্রদীপ জ্বালায় না। তিনি বান্ধবীর সাথেই থাকেন। তাই বান্ধবী আলাদা হতে চায়। এদিকে ছেলে যেমন বউকে ভালোবাসে, তেমনি মা ছাড়া কিচ্ছু বুঝতে চায় না। তাই মাকে আলাদা করবে না। এই নিয়ে অশান্তি চলছে।
– তোমার বান্ধবীর নাম কি?
– নাম বললে গীবত হয়ে যাবে। তাই বলছি না।

চৈতি অবাক হলো! শিমুল এতটা পরিবর্তিত হয়েছে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আগে শিমুল কোনো বিষয়ে কষ্ট পেলে চৈতির কাছে বলতো মন খুলে। যাকে নিয়ে বলতো, তার নাম তো প্রকাশ করতোই সেই সাথে তার অতীতের কর্মকান্ড বলে বসতো। অথচ আজ সামান্য কথার প্রেক্ষিতে গীবত হওয়ার ভয়ে নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করছে না!

চৈতি প্রসঙ্গ বদলে ফেললো, ‘সবাই তো এক না আপু। এমন সমস্যা এরেঞ্জ ম্যারেজেও হতে পারে। কেননা একজন আরেকজনকে চিনে না আগে থেকে, এক্ষেত্রে কি আরও জটিল নয় বিষয়টা?’

ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো শিমুল, ‘তুই কি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের পক্ষে যুক্তি দেখাতে চাচ্ছিস?’

এতটা সরাসরি কথা বলবে শিমুল তা বুঝতেই পারেনি চৈতি। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললো, ‘না না আপু! আমি শুধু যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা চাইছি। যেটা হারাম সেটা তো হারামই। সেটাকে হালাল বানানোর জন্য যুক্তি তৈরি করলে তো আমি কাফির হয়ে যাবো।’
শিমুল একটু হেসে বললো, ‘বাহ! এটা তো তুই ভালোই জানিস।’

– কোনটা করলে কুফর আর কোনটা করলে শিরক এটা জানি আপু। এগুলো ক্লাস টেনের বইয়ে ছিল।

– ব্রিলিয়ান্ট! ভালো বিষয় জানিস। এবার ফরজ, সুন্নত এগুলো জানতে হবে। তারপর ছোট ছোট আমল, ভালো কাজ এগুলো জানতে হবে। সেসব লেসন পরে দিব। এখন যেটা নিয়ে বলছিলাম, আমাদের ধর্ম আল্লাহ প্রদত্ত এবং এর পথপ্রদর্শক একজন মহামানব। তাহলে এতে কীভাবে ভুলভাল নিয়ম থাকে বল তো? প্রথমেই একটা কথা বলি, ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ। তাই তুই নিজেকে মুমিন কিংবা মুত্তাকী হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে অবশ্যই তোর ইসলামের বিধি বিধানের সবকিছু মেনে চলতে হবে। ওটার যদি কোনো যুক্তি তোর কাছে না থাকে তবুও তোকে সেটাই মানতে হবে কেননা তুই হলি আল্লাহর কাছে মুখাপেক্ষী।

– জি আপু। তবে যেগুলোতে যুক্তি আছে, সেগুলো জানলে ঈমান আরো দৃঢ় হয় আমার। মনে হয়, এত সুন্দর নিয়ম আমাদের ইসলামে!

– এটা ঠিক বলেছিস। বিয়ের আগে পাত্র পাত্রী দেখা জায়েজ আছে। আমার বান্ধবী যদি ইসলামিক নিয়মে বিয়ে করতো তাহলে সে বিয়ের আগে জেনে নিতো ছেলে একা থাকবে নাকি ফ্যামিলি নিয়ে থাকবে। সে কিন্তু রিলেশনের সময় বলে দিয়েছিল তার বয়ফ্রেন্ডকে, যে সে যৌথ থাকতে পারবে না। তার বয়ফ্রেন্ড তাকে আশ্বস্ত করেছিল। এক্ষেত্রে কেউই নিজেদের অবস্থান ভালো প্রমান করেনি। তারা পরস্পরের অবস্থান পরিষ্কার করেছিল। কিন্তু বিয়ের পর ঝামেলা বেঁধে গেল। ছেলের মা ছেলেকে ছেড়ে থাকবেন না। মা ভক্ত ছেলে তখন মুখ ফুটে বলতে পারল না, ‘তোমার থাকার জন্য আমি একটা বাড়ি করে দিয়েছি। সেখানে যাও।’ কিন্তু এই বিয়েটা যদি এরেঞ্জ ম্যারেজ হতো, তাহলে মা বাবা সহ সিদ্ধান্ত নিতেন। তখন আমার বান্ধবী ঠিকই জেনে যেত যে ছেলের মা তার সাথেই থাকতে চায়, ছেলে যতই বলুক বাড়ি আছে। এখানে দেখ, বান্ধবী আর তার বয়ফ্রেন্ড রিলেশনে নিজেদের আসল রূপ প্রকাশ করেও শান্তিতে নেই। তবে সবকিছুর ব্যাতিক্রম থাকে।

চৈতি ভাবনায় পরে গেল। স্বাধীনকে তার ভালো লাগে। কিন্তু স্বাধীনের পরিবার সম্পর্কে সে জানে না। এদিকে তার সাথে সৌরভের সম্পর্কের কথা পুরো মহল্লা জানে এক প্রকার। এটা নিশ্চয়ই স্বাধীনের পরিবারও জানে। তাহলে স্বাধীনের পরিবার তাকে মেনে না নিলে এই সম্পর্ক কীভাবে এগোবে! মন খারাপ করে চৈতি বললো, ‘আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই আপু।’

হঠাৎ ঘরে খটখট শব্দ ভেসে এলো। শিমুল চৈতিকে অপেক্ষা করতে বলে ঘরে ঢুকলো। আনাস এসেছে হেডফোন চাইতে। তার হেডফোন নষ্ট। শিমুল দিতে পারবে না বললে গাইগুই করতে লাগলো সে। আড়চোখে কয়েকবার চৈতিকে খোঁজার চেষ্টা করেছে। সেটা টের পেয়ে শিমুল গম্ভীর স্বরে বললো, ‘চৈতির সাথে সৌরভের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বলা যায়, তুই এক ধরণের ক্রাইম করছিস।’

বোনের কাছে ধরা খেয়ে হেডফোন না নিয়েই কেটে পড়লো আনাস।

বারান্দায় এসে বসেই চৈতিকে প্রশ্ন করলো শিমুল, ‘কি যেন বলতে চাইলি?’

চৈতি মৃদু হেসে পুরো বিষয় পাল্টে দিলো, ‘আমাকে নামাজ সম্পর্কে কিছু বলো তো আপু। নামাজে মনোযোগ আসে না।’

_____

কেউ আলতো করে ধাক্কা দিয়ে চৈতির নাম ধরে ডাকছে। আবছা দৃষ্টি নিয়ে চোখ খুলে চৈতি দেখতে পেলো, এখনো গাঢ় অন্ধকার ছেয়ে আছে। গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে অতিরিক্ত ঘুম ধরলে রাত তিনটার দিকে ঘুমিয়ে পরে সে। এখন তাকে শিমুল ডেকে তুলেছে ফজরের নামাজের জন্য।

– তাহাজ্জুদের জন্য ডাকতাম। পরে ভাবলাম, এমনিতেই দেরি করে ঘুমিয়েছিস। তাছাড়া তোর ফরজ নামাজ আগে ঠিক করতে হবে। এরপর নফল ইবাদত।
– তুমি সারারাত জেগে ছিলে?
– হ্যাঁ রে। এবার উঠে পর তাড়াতাড়ি।

চৈতি আজকে ফজরের নামাজ পড়লো খুব মন দিয়ে। তবে একটা বিষয় তার মাথা থেকে গেল না। এতে তার মনে হলো, শয়তান তাকে জাপটে ধরেছে স্বাধীন নামক মুক্ত পাখির ডানায় জোর করে ভর দেয়ার জন্য। তাই নামাজের মাঝেও বারবার মনে হতে লাগলো, আজ তার মনচোরা তাকে বেকায়দা অবস্থায় দেখেছে। এরপর হয়তো কোনোদিন তার চেহারা দেখতে চাইবে না। ভাবতেই কেঁদে উঠলো সে, নিঃশব্দে। অন্যায় আবদার করে বসলো আল্লাহর কাছে।

নামাজ শেষে বারান্দায় গিয়ে হারমনিকার সুর শোনার আশা করলো চৈতি। কিন্তু ওপর থেকে কোনো সুর ভেসে এলো না। তারমানে আজ স্বাধীন হারমনিকা হাতে নেয়নি। শিমুল অবশ্য বলেছে, বাদ্যযন্ত্র ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু এতে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। উদাস চিত্তে বাহিরের মলিন দালান দেখতে দেখতে তড়িঘড়ি করে শিমুলকে তার কাছে আসতে দেখে হকচকিয়ে গেল চৈতি।

– চৈতি, তুই ঘরে থাক। আমি দরজা খুলি। এত ভোরে এ বাড়ির কারো জেগে থাকার কথা নয়।

চৈতি প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না, দরজা খোলার প্রয়োজন কি? সে ঘরে গিয়ে দরজার কোণে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো বিষয়টা। শিমুল মূল দরজার লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে একবার দেখে নিলো বাহিরে কে আছে। দেখেই ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে চৈতির দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো, ঘরে গিয়ে ঘুমের ভান করতে। চৈতি ইশারা বুঝে তাই করলো কিন্তু কারণ বুঝতে পারলো না। মাত্র দু মিনিটের মাথায় শিমুল আসলো চিন্তিত মুখে।

– সৌরভ এসেছিল। ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে যাবে। এখানে থাকার জন্য বকবে।
– তিনি তো জানেন না আমি এখানে আছি।
– হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম আরকি। তাই তোকে শুয়ে পড়তে বলেছিলাম।
– কিন্তু তোমাকে এখনো চিন্তিত দেখাচ্ছে।

একটা শ্বাস ফেলে শিমুল বললো, ‘পৃথিবীর সব থেকে বড় আশচর্যের বিষয় কি জানিস? এখনো বেঁচে আছি এটা ভাবা। মৃত্যুর কোনো আগমনী বার্তা নেই।’

ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো চৈতি, ‘কি হয়েছে আপু? কেউ কি মারা গেছে?’

– স্বাধীন আছে না? ওর বাবা আজ তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে মারা গিয়েছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন। সৌরভ কলাপসিবল গেটের চাবি চাইতে এসেছে। এই বাড়ির বাকিরা তো জেগে নেই। ও জানে যে আমি ফজরের নামাজ পড়তে উঠি।

চৈতির মন বিষাদে ছেয়ে গেল। একের পর এক বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে স্বাধীন। না চাইতেও চৈতির মনে হলো, স্বাধীন নিশ্চয়ই তাকে ওমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে দেখে কষ্ট পেয়েছে। তার উপর বাবার মৃত্যু তাকে কতটা আঘাত করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চৈতির চোখ ছলছল করে উঠলো। শিমুল মন খারাপ করে বালিশ ঠিক করতে করতে চৈতিকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললো, ‘তুই কাঁদছিস কেন?’

মনের কথা বলার সাহস কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। কিন্তু মনের কষ্ট চেপে রাখতে পারছে না সে। চোখ দিয়ে গড়গড়িয়ে পানির ফোয়ারা নেমে এলো। শিমুলকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমাদের সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে তাই না আপু?’

শিমুল ধরেই নিলো চৈতি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছে। মৃদু হেসে সে বলল, ‘এটা তো চিরন্তন সত্য। এর কোনো হেরফের নেই। তাই আমাদের মনে ভয় জেগে উঠলে সেটাই কাজে লাগাতে হবে। কেঁদে কেঁদে শুধু ভয় পেলেই চলবে না। আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে।’

চৈতির মন কিছুই শুনেনি। তার এখন একটাই চিন্তা, মনচোরা কি শুকনো মুখেই আছে?

________

চলবে ইন শা আল্লাহ…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here