‘লোডশেডিং’
পর্ব ৮.
তাবিনা মাহনূর
______________
বিষাদের দূত অধৈর্য হয় না। প্রতিদিন নতুন বিষাদ সঙ্গে নিয়ে দেখা দেয় মনের আঙিনায়। চৈতির জীবনে বিষাদের দূত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে তার মনকে অশান্ত রাখতে, চৈতির কাছে তাই মনে হয়।
বেশ অভিমান হয়েছে চৈতির। আল্লাহর কাছে চাইলো মানসিক শান্তি, আর পেলো রাজ্যের অশান্তি! তার এতে দোষ নেই। মানুষের প্রকাশ্য শত্রু সর্বদা সচেষ্ট থাকে প্রতিকূল চিন্তা ভাবনা তৈরিতে। চৈতির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সে বুঝতেই পারলো না, আজকে তাকে অশান্তিতে নয়, হারাম থেকে বাঁচিয়ে দিলেন আল্লাহ। আর এরজন্য তার জীবনে একদিন ঠিক শান্তি দেখা দিবে।
মাগরিবের আজান দিয়েছে। চৈতি নামাজ না পড়ে বিছানায় শুয়ে মনকে বিশ্রাম দিচ্ছে। সে যদি তার অন্তরের ভাষা শুনতে পেতো তাহলে এক মুহূর্ত দেরি না করে ওযু করার জন্য ছুটে যেতো, নামাজের জন্য পাটি বিছিয়ে দিতো।
বেশ কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা দেয়ার আওয়াজ শোনা গেল। চৈতি ভাঙা গলায় বলল, ‘কে?’
ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, ‘আমি। তুই কি ব্যস্ত?’
শিমুলের কন্ঠ শুনে উঠে পড়লো চৈতি। গলা ছেড়ে অপেক্ষা করতে বলে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো সে। দরজা খুলে শিমুলকে ভেতরে ঢুকিয়ে আবার দরজা লাগিয়ে দিলো চৈতি।
– তোর চোখ লাল হয়ে আছে কেন? মন খারাপ নাকি?
শিমুল তার বড় বোন, কিন্তু মা সমতুল্য। এমন স্নেহ ভরা কন্ঠ শুনে চৈতি ডুকরে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো শিমুলকে। শিমুল কিছুটা বুঝতে পারলো চৈতি কেন কাঁদছে। তবে চুপ করে থাকলো। তাকে মন ভরে কাঁদতে দিলো।
বেশ কিছুক্ষণ চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো শিমুল। ততক্ষণে চৈতি থেমে গিয়েছে, চোখ বুজে শিমুলের কাঁধে মাথা গুঁজে আছে। শিমুল কোমল কণ্ঠে বললো, ‘আমি ভাবতাম আমি তোর সবচেয়ে আপন। যেহেতু তোর আপন বলতে মা নেই। কিন্তু এখন দেখছি তুই কখনোই আমাকে আপন ভাবিসনি।’
চৈতি মাথা উঠিয়ে দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে বললো, ‘বিশ্বাস করো আপু, তুমিই আমার একমাত্র আপনজন। আমি বাবার পরেই সবচেয়ে বেশি তোমাকে ভালোবাসি আর ভরসা করি।’
– তাহলে মনের ভেতরে এতকিছু চেপে রেখে কীভাবে ঘুরে বেড়াস? আমাকে দেখেও তোর মুখ ফুটে না। এটা কেমন আপন? কেমন বিশ্বাস?
চৈতি এবার দমে গিয়ে কণ্ঠস্বর মৃদু করে বললো, ‘সৌরভ ভাইয়া আমার চাচাতো ভাই, তেমনই তোমারও চাচাতো ভাই। আমি ভেবেছি অযাচিত কিছু বললে যদি তুমি রাগ করো।’
শিমুল হতাশা প্রকাশ করে বললো, ‘ওরে বোকা! সৌরভের সাথে বিয়ে না হোক এটা আমিই তো চেয়েছি। মনে নেই? ছোট কাকাকে একবার বলেছিলাম যে ছেলেটা তোকে বেশি খেয়াল করে। তোকে যেন ওর কাছ থেকে একটু দূরে রাখে? মনে নেই?’
চৈতির মনে পড়েছে, ‘হ্যাঁ। তখন ভাইয়া ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়তো আর তুমি দ্বিতীয় বর্ষে। তুমি বাবাকে এটা বলেছিলে। বাবা হেসেছিল সেদিন।’
– ছোট থেকেই আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বেশ সজাগ। আবার বিচক্ষণতাও বলতে পারিস। এজন্য মা আমাকে না বলে কোনো কাজ করতে চান না। কাকা সেদিন হেসে উড়িয়ে দেয়ার পরের সপ্তাহে বড় কাকা এলো তোদের বাসায়। বজ্জাত ছেলেটার জন্য তোকে একেবারে হাতের মুঠোয় রেখে দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিলো। আস্তাগফিরুল্লাহ! নিন্দা করে ফেলছি। ধুর! আসলে সৌরভকে আমি দেখেছি তোর উপর অনেক খবরদারি করে। এজন্য আমার আগে থেকেই সহ্য হতো না ওকে। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তাই হয়ে গেল।
– ইশ! বাবা যদি সেদিন তোমার কথা শুনতেন!
– এসব আফসোস করিস না। সব তোর তাকদীর। এখন মূল কাহিনী বল। স্বাধীনকে কবে থেকে মনে ধরলো?
চৈতি বেশ লজ্জা পেয়েছে। আরক্ত মুখে জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে সে বললো, ‘নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই আপু। যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম স্বাধীন ভাই সবসময় আমার নিরাপত্তাবাহক হিসেবে হাজির হন সেদিন থেকে উনাকে ভরসা করতে শুরু করলাম। ভরসা থেকে কখন কি হয়ে গেল!’
শিমুল বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘নিরাপত্তারক্ষক কেন মনে হলো?’
– তুমি তো দেখোই সৌরভ ভাইয়া কেমন অত্যাচার করেন আমাকে। সেসময় যদি স্বাধীন ভাই থাকেন, তাহলে উনি ব্যাপারটা মজার পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে শেষ করে ফেলতেন। আমাকে তখন কষ্ট পেতে হতো না। ক্লাস সিক্সে একবার বাড়ির পেছনের বড় মাঠটায় অনেক ছেলে খেলছিল। ওখানে আমি সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা দেখে সৌরভ ভাই সবার সামনেই আমাকে বকাঝকা শুরু করেন। আমি কেন টমবয়ের মতো ঘুরাঘুরি করছি! স্বাধীন ভাই সেদিন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আয়হায়! তুমি দেখি চার চাকার সাইকেল চালাও!’ সবাই হেসেছিল এমনকি সৌরভ ভাইও হেসে বলেছিলেন, ‘যাহ! ওকে পঁচাইস না। দিলে লাগে!’ ওখানে থাকা সবাই ‘ওহো…’ বলে চিৎকার দিয়ে মজা নিতে শুরু করলো। আমার খুব রাগ হচ্ছিলো এই বিষয়টা নিয়ে। আমাকে একবার বকা দেয়া হলো, আরেকবার পঁচানো হলো। কিন্তু ফিরে আসার সময় স্বাধীন ভাইয়ের মুখে একবার তাকাতেই দেখি, উনি চোখ টিপ মেরে হাসছেন। তখন বিষয়টা বুঝিনি। এখন বুঝি যে উনি সবার সামনে আমাকে মারধর করা থেকে বাঁচিয়েছেন।
শিমুল বলে উঠলো, ‘এই নিয়মটা ঠিক পছন্দ হলো না। তোকে না পঁচিয়ে অন্য কোনো উপায়…’
– অন্য উপায় উনি বড় হওয়ার পর থেকেই অবলম্বন করে যাচ্ছেন।
চৈতি গত কয়েকদিন সহ অতীতের বেশ কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানালো শিমুলকে। শেষবার কামিনীর বাগদানের সময় যা হয়েছিল, সেটাও বললো বেশ অস্বস্তি নিয়ে। বলতে বলতে কেঁদে ফেললো সে। শিমুলও কষ্ট পেয়েছে মেয়েটার এমন অবস্থা শুনে। চৈতি কান্না ছেড়ে বললো, ‘উনি কিশোর অবস্থায় আমাকে রাগিয়ে কিংবা তুচ্ছ করেই সৌরভ ভাইয়ের থাবা থেকে বাঁচাতেন। আর এখন কৌশলে এই কাজ করেন।’
– তাহলে কি স্বাধীনও তোর প্রতি আগ্রহী?
চমকে তাকালো চৈতি। শিমুলের কথা প্রায় অসম্ভব বলা চলে। এমন হলে কখনোই আজকের কথাটা অকপটে বলতে পারতো না স্বাধীন। চৈতি ভেজা কণ্ঠে বললো, ‘কিন্তু আজকে যে অন্যরকম কথা বলেছে সে।’
‘মনে আশা রেখো না’, এই কথা শুনে শিমুল আরো বেশি চিন্তিত হলো এই ভেবে, ছেলেটা বলতে পারতো ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না’ অথবা ‘তুমি কিন্তু কাজটা বেহায়াদের মতো করছো!’ কিন্তু তা না বলে এই কথা বলেছে। শিমুলের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, ‘মনে আশা রেখো না’ কথার অর্থ, স্বাধীনকে পাওয়ার আশা যেন চৈতি না করে। শুধু তাই না, স্বাধীন চাইলেও সেটা সম্ভব না কারণ চৈতি তারই বন্ধুর ভালোবাসা।
– শিমু আপু, উনি এই কথা বললেও আমি আশা ছাড়তে পারিনি।
– তুই খুব বোকা। তোর আগেই বলা উচিত ছিল উনাকে। যদিও এটা যিনা। কিন্তু তুই তো সৌরভের সাথেও একই কাজ করিস, বরং আরো বাজে পর্যায়ে যায় সেই কাজগুলো।
– আমি তো ইচ্ছে করে করি না।
– এর কোনো সমাধান পাচ্ছি না। ছেলেটার বাবা মারা গেল, ছোট ভাবি মারা গেল। এমন সময় কি বিপর্যয় যাচ্ছে ওদের উপর চিন্তা কর। এখন ওকে একটু একা থাকতে দে। তারপর চিন্তা করা যাবে। দরকার হলে আমি বিয়ে দিব তোদের। আমার বিশ্বাস, ছোট কাকা আমার সাথে থাকবেন।
– তুমি এত দূর ভেবে ফেললে! উনি যে পছন্দ করেন আমাকে তার কি গ্যারান্টি? আর উনি বন্ধুর ক্ষতি কেন করতে চাইবেন বলো?
– তোর এতো ভাবতে হবে না। আগে ছেলেটা কিছুদিন সময় কাটাক নিজেকে নিয়ে।
– উনাকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছি। তুমি কি জানো উনি কোথায় যাচ্ছেন?
– নারে। আমি জানি না কিন্তু আসার সময় সৌরভকেও দেখলাম ব্যাগ নিয়ে নীচে নামছে। মনে হয় মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য কোথাও যাচ্ছে ওরা।
চৈতির মন আরো খারাপ হয়ে গেল। শিমুল মুচকি হেসে বললো, ‘হারমনিকা স্বাধীন বাজায়?’ উপর নিচ মাথা দুলালো চৈতি।
– তোকে বলেছি না? গান বাজনা ইসলামে হারাম। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও বাঁশির আওয়াজ শুনলে কানে হাত দিয়ে রাখতেন। একবার উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শুনে কানে হাত দিয়ে রেখেছিলেন। উনার সাথে থাকা সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করছিলেন যে শব্দটি তখনো শোনা যাচ্ছে কিনা। উনি যখন বললেন হ্যাঁ, তখন তিনি কানে হাত দিয়েই রাখলেন। এরপই যখন উত্তর দিলো ‘না’, তখন তিনি হাত নামিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটাই করেছিলেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৪৫৩৫, সুনানে আবু দাউদ : ৪৯২৪)
চৈতি চুপ করে থাকলো। সে জানে এগুলো অপরাধ। তবু তার মন বলে, ‘একটু শুনলে ক্ষতি নেই। তুমি তো গাইছো না কিংবা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছ না। আর মন খারাপ থাকলে কি করবে? গান না শুনলে মন ভালো হবে কি করে?’ এগুলো যে তার নফসের কথা, তা সম্পর্কে জানলে সে এমন কাজ আর করতে চাইতো না।
_______
ডিসেম্বর মাসের পাঁচ তারিখ। চৈতির টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। বাংলা আর আইসিটি ছাড়া সব গুলোয় এ প্লাস আছে। এরজন্য সে মোটামোটি চিন্তামুক্ত। আইসিটি এক সপ্তাহ ঠিকমতো পড়লেই হবে। বাংলায় লেখা শেষ করতে পারেনি বলে নাম্বার কম পেয়েছে। এদিকে সৌরভের অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা থাকায় চৈতিকে বেশি সময় দিতে পারছে না। তবু প্রতিদিন নিয়ম করে পড়াতে আসে। এত ব্যস্ততার মাঝেও চৈতি একজনকে ভুলতে পারে না।
এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল, স্বাধীন তার মামার বাসায় আছে। সেখানে থেকে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। সৌরভ তার সাথে সেখানে গিয়েছিল। তারপর একদিন থেকে ফিরে এসেছে। স্বাধীনের মামা একজন মুমিন ব্যক্তি। তার কাছে থাকলে স্বাধীন মানসিক শান্তি পায় বলে স্বাধীনের বড় ভাই শামীম তাকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। নাজমা বেগমও গিয়েছেন ভাইয়ের বাসায়। আর শাফিন শ্বশুরবাড়িতে।
টেস্টের রেজাল্ট ভালো হওয়ায় সারাফ চৈতিকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে বেড়িয়েছেন। সাদিয়া পিছু নিলে তিনি বলেন, ‘তোরা তো প্রায়ই বেড়াতে যাস। আমি এবার আমার চৈতালিকে নিয়ে বের হবো। তোদের জন্য কিছু আনবো। কি খাবি বল?’ সাদিয়া মন খারাপ করলেও বাবার কাছে খাবারের একগাদা লিস্ট ধরিয়ে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছে।
রিকশায় বাবার সাথে বসে আছে চৈতি। সারাফ আজকে তার প্রানপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে যাবেন চৈতিকে নিয়ে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে গেলেন তিনি। সেখানে গিয়ে এর ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে লাগলেন উৎসাহ ভরে। প্রথমে এই জায়গার নাম ছিল ‘আন্টাঘর’, পরে নাম হয়েছিল ‘ভিক্টরিয়া পার্ক’। ইংরেজ শাসনামলে বিদ্রোহী সিপাহীদের ফাঁসি দেয়া হতো। জনগণকে ভয় দেখাতে সেসব লাশ এনে এখানকার গাছগুলোয় ঝুলিয়ে রাখা হতো। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের সময় এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে জায়গার নাম রাখা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।
এরপরই তারা এলো আহসান মঞ্জিলে। এখানেও সারাফ সাহেব কিছু ইতিহাস তুলে ধরলেন।
চৈতি ইতিহাস পছন্দ করে না। তবে বাবার সাথে এসে এসব শুনতে মোটেও খারাপ লাগছে না তার। বরং মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবকিছু শুনছে সে। যেন হারিয়ে গিয়েছে ইংরেজ শাসনামলে। আজ সে মায়ের সেই লাল শাড়িটা পরেছে। চুলগুলো হাত খোঁপা করেছে, চোখে কাজল আর নাকে পরেছে কৃত্রিম নাকফুল। শুধু একটা পাথর আঠা লাগিয়ে পরেছে। এভাবে সাজগোজ করতে ইচ্ছে হলো কেন সে জানে না। কালো ব্লাউজের ছোট হাতা, তাই তার কোমল হাত দুটো লাল কালো চুড়িতে আকর্ষণীয় লাগছে। সে বেশি ফর্সা নয়, ফর্সা ও শ্যামলার মাঝামাঝি রং। বাবার হাত ধরে হাঁটছে সে, মাঝে মাঝে হাত ছেড়ে দিয়ে একাই হাঁটছে। আবার ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরছে। হালকা শীত পড়েছে, তাই গায়ে থাকা কালো চাদর টেনে বারবার শীতের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এই অঙ্গভঙ্গির মাঝে কি এমন শৈল্পিক নিপুনতা আছে জানা নেই, তবে কেউ একজন নিষ্পলক চাহনিতে খেয়াল করছে চৈতির প্রতিটি পদক্ষেপ।
স্বাধীন এসেছে মামাতো ভাই বোনের সাথে। আহসান মঞ্জিলে এর আগে দুই একবার আসা হয়েছে। তবু তার ভাই বোন জোর করে এখানে এনেছে মন ভালো করতে। পরীক্ষার দোহাই দিয়েও কাজ হয়নি। তাছাড়া বড় মামা বলেছেন, আমাদের ধর্মে কারো মৃত্যুর শোক পালন তিনদিনের বেশি করা নিষেধ। শুধুমাত্র একজন বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর জন্য চার মাস দশদিন এবং গর্ভাবস্থায় থাকলে সন্তান প্রসব হওয়ার সময় পর্যন্ত শোক পালন করতে পারবে। স্বাধীনকে তাই এক প্রকার জোর করে আসতে হয়েছে এখানে। ভেবেছিল চুপচাপ থাকবে, ভাই বোনেরা প্রশ্ন করলে উত্তর দিবে। কিন্তু শান্ত স্বাধীন আজ চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
সেদিন চৈতিকে সেই কথা বলেছে প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে। সে জানে চৈতি তাকে পছন্দ করে। তার মাঝে কোনো অনুভূতি জন্মায়নি চৈতির প্রতি। এটা সত্যি, সৌরভের কর্কশ কণ্ঠে বলা তিক্ত কথা ও সবসময় তিরস্কার দেখে তার মায়া হয় মেয়েটির প্রতি। কিন্তু কখনোই সে অন্যরকম অনুভূতির সম্মুখীন হয়নি। এটা বরাবরই হয়ে এসেছে। কোনো মেয়েকে তার মনে ধরেনি। বাবা ও ভাবীর মৃত্যুর দিন হঠাৎ তার মাথায় আদরের স্পর্শ পেয়ে যখন দেখেছিল, জলাচ্ছন্ন দুটি চোখ ভালোবাসা নিয়ে তার মনের বোঝা বহন করতে প্রস্তুত। তখন থেকে তার চোখ দুটো আটকে গিয়েছে সেই মুখশ্রীতে। তাই সেদিন বেশ বিরক্ত নিয়ে বলেছিল, ‘মনে আশা রেখো না’। আর তারপর থেকে তার এই চিন্তা আরো জেঁকে বসেছে। ঘুমের মাঝেও চৈতি এসে তার কণ্ঠলগ্নে নিঃশ্বাস ছাড়ে।
আজকেও চৈতির ভূত চেপেছে তার ঘাড়ে। চৈতি যেখানে যায় সেও সেখানে দাঁড়িয়ে দেখে তাকে। দেখে যেন বুঝতে চায়, কি আছে এই মেয়ের মাঝে! মায়া ভরা মুখখানি তাই ছোট থেকেই সৌরভের বকুনি থেকে মেয়েটাকে রক্ষা করতে এক প্রকার টান অনুভব করতো সে। কিন্তু কখনোই তার মনে হয়নি, সৌরভ এই মেয়েটাকে বিয়ে করলে তার কষ্ট হবে কিনা! সবসময় মেয়েটাকে বন্ধুর বউ ভেবে এই শেষ সময়ে এসে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যতটা, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে বিষয়টা মানতে। এসব ভাবার মাঝখানে খেয়াল করলো চৈতি তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বিব্রতকর পরিস্থিতি!
চৈতি সত্যিই অবাক। সে তাকিয়ে থাকার পরও স্বাধীন চোখ ফিরিয়ে নেয়নি দেখে অবাকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। হঠাৎ সারাফ সাহেব বলে উঠলেন, ‘আরে স্বাধীন! বাবা কেমন আছো তুমি?’
চমকে উঠে মুচকি হেসে স্বাধীন এগিয়ে এলো, ‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনারা সবাই ভালো আছেন?’
এরই মাঝে স্বাধীনের আত্মীয় পরিজন এসে হাজির। সবার মাঝে বেশ আলাপ আলোচনা চললো। স্বাধীনের বড় মামা বেশ মিশুক মনের মানুষ। সারাফ সাহেবের সাথে হাসি গল্পে মেতে উঠলেন তিনি। তারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জানার পর গল্প আরো জমে উঠলো।
চৈতি পড়েছে বিপাকে। স্বাধীন অপলক তাকিয়ে আছে যা দেখে চৈতি বেশ দ্বিধায় পরে গেছে। তার কি কাঁধ থেকে আঁচল নেমে গিয়েছে নাকি পেট দেখা যাচ্ছে, এসব ভেবে চৈতির অস্বস্তি বেড়েই চলেছে। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে সে বললো, ‘শাড়ি পরে কাঁধ পেট উন্মুক্ত রাখবো না আর। তুমি দয়া করে আমাকে সাহায্য করো আল্লাহ!’
চৈতি খেয়াল করলো স্বাধীনের দৃষ্টি নেমে গিয়েছে। মনে মনে শান্তি পেলো আর শিমুলের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল তার, ‘ছেলে যত সাধুই হোক, দৃষ্টির হেফাজত করা তার কাছে চোখে পেরেক ঢোকানোর মতো কষ্ট।’
কথাবার্তা শেষে এক পর্যায়ে স্বাধীন হঠাৎ চৈতির কাছে এসে মুচকি হেসে বললো, ‘সৌরভ আসেনি?’
সবাই ব্যাপারটা সাধারণ ভেবে নিলো। এটাই স্বাধীনের চতুরতা। চৈতি যখন মাথা দুলিয়ে না বোঝালো তখন সকলের দৃষ্টির আড়ালে স্বাধীন বললো, ‘মনে এখনো আশা রেখেছো?’
চৈতি নিশ্চুপ। স্বাধীন আশেপাশে তাকিয়ে দুই হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙার ভান করে বললো, ‘বেলি ফুলের অভাব, তবু গন্ধ ছড়িয়ে আছে সর্বাঙ্গে!’
_______
চলবে ইন শা আল্লাহ…….
[এক বোনের আবদারে ৮নং পর্বটা দিয়েই দিলাম। যেহেতু লেখা ছিল আগে থেকেই।]