‘লোডশেডিং’
পর্ব ১১.
তাবিনা মাহনূর
______________
নিঃশব্দে চলে এলো চৈতি। দরজা আটকাতে গিয়ে শব্দ হলো, স্বাধীন একবার সেদিকে তাকিয়ে ভাবলো নিশ্চয়ই চৈতি আসছে। কিন্তু দরজা আটকানোর পর অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরও কাউকে না আসতে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। পরক্ষণে নিছক ভাবনা ভেবে গুনগুন করে গাইতে লাগলো সে, ‘আস-সুবহু বা’দা…’
চৈতি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঘরে চলে গেল। মনটা প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছে। ঘরে বসে ক্বুরআন শরীফ খুলে পাঠ করতে শুরু করলো। দেখলো, অনেক ভুলভাল উচ্চারণ করছে সে। ছোট থাকতে একবার আমপাড়া পড়েছিল। তখন ক্বুরআন এক খতম দেয়ার পর আর পড়া হয়নি। মডারেট মুসলিম সমাজে একটা অলিখিত নিয়ম হলো, ক্বুরআন একবার খতম দিতেই হবে! পরে না পড়লেও চলবে এমন ভাব সবার। কিন্তু জীবনে একবার খতম না দিলে যেন শত সহস্র গুনাহর ভাগিদার হবে। অথচ যে কুরআন পড়তে জানে, সে যদি না পড়তে পড়তে উচ্চারণ ও নিয়ম ভুলে যায় তাহলে তার শাস্তি ভয়াবহ।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্বুরআন পড়ে ভুলে যায়, সে কিয়ামতের দিন অঙ্গহানি অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে।’ (আবু দাউদ : ১৪৭৪)
চৈতি গুগলে ক্বুরআন ভুলে যাওয়া বিষয়ক হাদিস সার্চ করতেই তার কাছে এই হাদিস চলে এলো। সাথে সাথে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো আর কল্পনা করলো সেই দৃশ্য। হাত নেই, অথবা কান কিংবা নাক কাটা। মোট কথা, তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন খসে পড়ছে। জান্নাত জাহান্নাম নির্বাচনের পূর্বেই যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে সেটা কতটা নিকৃষ্ট! আর আল্লাহর সামনে সে সেই অবস্থায় কি জবাব দিবে! ভয়ে তার হাত পা গুটিয়ে এলো। বুকে হাত দিয়ে সে বারবার পড়লো, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’ মনে মনে ঠিক করলো সে, কালকেই শিমুলের কাছে যাবে। ক্বুরআন শিখতে হবে নতুন করে।
________
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। কামিনীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়েছে জানুয়ারি মাসের চার তারিখ। আজ ডিসেম্বরের সতেরো তারিখ। খুব বেশি সময় নেই তাই বিয়ের পোশাক, গহনা আর যাবতীয় জিনিসপত্র কিনতে শপিং মলে ছুটছে সবাই।
বেলা এগারোটা। ভোরে চৈতির ঘুম হয়নি। ফজরের নামাজের পর আকাশ পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনের তিলাওয়াত শুনেছে সে। এতক্ষণ জেগে থাকায় সকালে ঘুমের ঘাটতি পূরণ করছে। কিন্তু এগারোটা বাজার পরপরই কেউ তাকে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলো। বিরক্ত হয়ে মুখ কুঁচকে তাকালো চৈতি। শিমুল হাসিমুখে বলছে, ‘কিরে? পাগলের মতো ঘুমাচ্ছিস। রাতে ঘুম হয়নি?’
চৈতি উঠে বসে বড় করে হাই তুললো। সাথে সাথে শিমুল বললো, ‘এভাবে “হাই” তুলবি না। হাই তোলা শয়তানের পক্ষ থেকে আসে।’
চৈতি চোখ দুটো খুব কষ্টে খুলে রেখেছে। ধীর স্বরে সে বললো, ‘এতো সকালে ডেকেছো কেন?’
– সকাল মানে! এগারোটা বেজে পার হয়ে গিয়েছে। দেখেছিস?
– কি!
চৈতি তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। বের হয়ে শিমুলকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো সে, ‘তুমি নাস্তা করেছো আপু?’
– হ্যাঁ রে। তুই করে নে তাড়াতাড়ি।
– এতো তাড়াহুড়ো কেন?
– আগে নাস্তা করে আয়। তারপর বলছি।
চৈতি টেবিল থেকে নাস্তা প্লেটে নিয়ে ঘরে চলে এলো। খেতে খেতে শিমুলকে প্রশ্ন করলো, ‘কি ব্যাপার আপু? পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে নাকি?’
– ধুর! এসব কিছু না। আজকে শপিং মলে যাওয়া হবে।
– ওহ। যাও। কামিনী আপুর বিয়ের জন্য, তাই তো?
– হ্যাঁ। কিন্তু আমি একা যাবো না। তোকে নিয়ে যাবো।
– আমি যাব না।
– তুলে এক আছার মারবো। তোকে যেতেই হবে।
– আপু!
– কোনো আপু আপু শুনবো না। আরেকটা কথা, বিয়েতে তোর কি পরার ইচ্ছে আছে? সবাই নাকি লেহেঙ্গা পরবে।
– সবাই যেটা পরবে আমিও সেটাই পরবো। তুমি কি চাও?
– আমার তো বোরখা পরতে ইচ্ছা করে।
– বিয়েতেও বোরখা!
শিমুল বললো, ‘পর্দা সবখানে করতে হবে। জাঁকজমক বিয়ে তো আমাদের ধর্মে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সেখানে আবার জাঁকজমক পোশাক পরে কীভাবে?’
– কিন্তু তোমাকে বোরখা পরা অবস্থায় দেখলে কাকী রাগ করবেন না?
– সেটাই তো ভয় রে। আমি আমার বান্ধবীকে বলেছি, আম্মু কথা শোনেন না। আমাকে বোরখা পরতে দেখলে রাগ করবেন। তখন ও বললো, আল্লাহর রাগকে ভয় না করে মায়ের রাগকে ভয় করছিস?
– কিন্তু এখনকার যুগে এসব পালন করা সত্যিই কষ্ট!
– এটাই আমি ওকে বুঝাতে পারছি না চৈতি। আমি অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করি সবচেয়ে বেশি। আর এজন্য আমি পরিবর্তনের চেষ্টায় আছি। কিন্তু আমি যদি বোরখা পরি তাহলে বাসায় অশান্তি তৈরি হবে যেটা আমার জন্য মানসিকভাবে কষ্টদায়ক। আমি বুঝছি না কী করবো! তাওয়াক্কুল আছে আমার, কিন্তু শয়তান বারবার ঘায়েল করছে আমাকে।
চৈতি বলে উঠলো, ‘তুমি লেহেঙ্গা পরতে না চাইলে বড় ঢিলা জামা পরো।’
– সেটাই করবো ভাবছি। এদিকে আম্মু আগেই বলে রেখেছেন, কামিনী আপুর বিয়েতে যদি আমারও কোনো বিয়ে উঠে যায় তাই আমাকে সুন্দর করে সাজতে হবে।
– হায় আল্লাহ!
– আমি বোঝাতে পারছি না কাউকে। আমি একজন উত্তম জীবনসঙ্গী চাই যে আমাকে পর্দা করতে সাহায্য করবে। তুই বল, কামিনী আপুর বিয়েতে কি তেমন কেউ আসবে যে পর্দানশীল? আপুর হবু স্বামী তো আল্ট্রা মডার্ন।
– আল্লাহ যা চাইবেন তাই হবে আপু। আল্লাহ যদি চান তোমাকে ভালো পরিবারের কারো সঙ্গে বিয়ে দিতে তাহলে বোরখা নিকাব পরে ঢেকে গেলেও সেই বিয়ে হবে। আল্লাহ যদি চান তোমাকে একটা অশান্তিময় পরিবারে বিয়ে দিয়ে তোমার জীবনের পরীক্ষা নিতে তাহলে তুমি হাজার সাজগোজ করে গেলেও সেখানে হবে।
শিমুল মলিন মুখে বললো, ‘এটা ঠিক বলছিস। আম্মুকে বোঝাতে পারলেই হলো।’
চৈতি ডেকে উঠলো, ‘আপু’
– বল।
– আমিও হিজাব পরতে চাই।
– মা শা আল্লাহ! তাহলে চল আমরা একই রকম জামা নিই এবার। লেহেঙ্গা না পরে। মন খারাপ হবে তোর?
– না না। বরং খুশি খুশি লাগছে।
– ওহ। আরেকটা কথা বলবো।
– বলো আপু।
– শিল্পী ফুপি আসবেন আজকে। তিনিও শপিং করতে যাবেন।
চৈতি চুপচাপ খাচ্ছে। শিল্পী ফুপি হলেন চৈতির নামমাত্র ফুপি। আদরের কোনো অংশ সে পায় না। কুহুর মেয়ে বলে তার সেই আদর জুটে না। অন্যদিকে জেবিন আর শিল্পী পরস্পর খালাতো বোন হওয়ায় তাদের ভাব এবং মিল বেশি। তাই দুজনের মাঝে সুখ দুঃখের গল্প সবসময় হয়ে থাকে। সেখানে জেবিনের দুঃখের গল্প হিসেবে একটি অধ্যায়ের নাম চৈতি। তাই শিল্পীর চোখেও চৈতি জেদি মেয়ে।
খাবার খেয়ে প্লেট ধুয়ে ঘরে এলো চৈতি। শিমুল তখনো বসে আছে। সে চৈতিকে নিয়ে তার ঘরে গিয়ে তৈরি হতে চাইছে। চৈতি বাহিরে পরার জামাকাপড় বের করে শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শিল্পী ফুপি এতদিন পর আসছেন কেন? প্রায় দুই তিন মাস হয়ে গেল তার না আসার। এর আগে তো দিনে দুইবারও আসতেন।’
– ফুপির শাশুড়ি অসুস্থ ছিলেন। তিনি গ্রামে থাকেন বলে ফুপিও গ্রামে থাকতেন। ফুপির শাশুড়ি নাকি ঢাকায় আসতে চাইতেন না।
– সুস্থ হয়েছেন?
– মারা গেছেন উনি।
– ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ফুপি কবে ঢাকায় এসেছেন?
– গত পরশু দিন। একবারে মিলাদ করে এসেছেন।
চৈতি আর কিছু বললো না। জামা কাপড় হাতে নিয়ে শিমুলের সাথে বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার পথে দেখলো, জেবিনের ঘরের দরজায় ফাঁক দিয়ে শিল্পী আর জেবিনকে হাসি ঠাট্টা করতে দেখা যাচ্ছে। তারমানে ফুপি এখানে এসেছেন, সেটাও টের পায়নি চৈতি। এসব খেয়াল করে সিঁড়িতে চৈতিকে থামিয়ে দিয়ে শিমুল বললো, ‘শোন চৈতি, পৃথিবীতে কেউই সবার থেকে সমান ভালোবাসা পায় না। সবাই সমান নয়। এটা যদি তুই আশা করিস তাহলে এটা তোর বোকামি।’
– আমি এটা কখনোই আশা করি না আপু। কিন্তু আমার কষ্ট এক জায়গায়, আমার কি দোষ বলো তো? কোন অপরাধে আমাকে তারা পছন্দ করেন না? মামণি আমাকে একটুও সহ্য করেন না। এটা নাহয় মানলাম যে আমি মামণির সতীনের মেয়ে। কিন্তু ফুপি এমন করেন কেন? আমি তো তার ভাইয়ের মেয়ে তাই না?
– তুই নবী রাসূলদের কথা চিন্তা কর। তাদেরকে বিনা কারণে কাফিররা অপছন্দ করতো। শুধু অপছন্দ নয়, তাদেরকে কষ্ট দেয়া হতো। মেরে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্র করা হতো। তারা কিন্তু কখনো ধৈর্য হারা হননি।
– আল্লাহ আমাকেও ধৈর্য ও শান্তি দিন।
– আমিন।
________
ঢাকার সবচেয়ে বড় শপিং মলে ঘুরতে এসেছে চৈতির পরিবার। এখানে সবই নারী সদস্য। কিন্তু তাদের ভাষ্যমতে, একজন পুরুষ সদস্যকে প্রয়োজন। সেই দুর্ভাগা পুরুষ হলো, সৌরভ। মুখ কুঁচকে বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে সে এক কোণে, আর বাকি সবাই শপিং করছে দোকানের ভেতরে। শপিংয়ে এসে তার পা ব্যথা হয়ে এলো, কিন্তু মহিলাদের পায়ে যেন আজ সুপার পাওয়ার ধারন করেছে।
অবশ্য প্রিয়তমাকে দেখে চোখের শান্তি পাচ্ছে সৌরভ। খয়েরি রঙের হাঁটু সমান লং ফতুয়া পরেছে চৈতি, তার সাথে ক্যারামেল রঙের হিজাব ও প্লাজো। ফোলা গাল দুটো হিজাবের ফাঁকে আরো ফুলে আছে যেন। দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিলো সৌরভ, বিয়ের পর চৈতির গালে যখন আদর করবে তখন হিজাব কিংবা কাপড় দিয়ে চৈতিকে ঢেকে দিবে যেন গাল দুটো আরো ফুলে উঠে।
চৈতি এখন লেহেঙ্গার দোকানে। শিমুল আর সে চুপচাপ এক কোণে বসে আছে। শিল্পী ফুপির মেয়ে রিয়ানা এসেছে। সে কামিনীর সাথে বসে বিভিন্ন পোশাকের নকশা দেখছে আর রং পছন্দ করছে। চৈতির ফোন বেজে উঠলো। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, সৌরভ আছে কিনা। তা নাহলে ফোন ধরার পূর্বে কয়েক মিনিট জেরা করবে ফোনে বেশি কথা বলার কারণ জানতে চেয়ে। সৌরভ বাহিরে গিয়েছে প্রাকৃতিক কাজ সারতে। এটা জানার পর ফোন ধরলো সে। অচেনা নম্বর থেকে এসেছে।
– আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম। চৈতি? আমি মাইমুনা বলছি।
– মাইমুনা আপু!
মনে পড়ে গেল, চৈতি মাইমুনার নাম্বার নিয়েছিল কিন্তু সেভ করতে মনে নেই। মাইমুনা ঠিকই ফোন করেছে।
– হ্যাঁ বোন। তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ আপু। তুমি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। আমি একটা দরকারে ফোন করেছি।
– হ্যাঁ বলো?
– তোমার ফেসবুক আইডি পাচ্ছি না।
চৈতি বেশ ভালো বুঝতে পারলো, মাইমুনা চৈতির নয়, সৌরভের আইডি খুঁজতে গিয়ে পায়নি।
– আপু, আমার টেস্ট পরীক্ষার সময় আইডি ডিএক্টিভ করে রেখেছিলাম। এরপর আর খোলা হয়নি, বলতে গেলে প্রয়োজন পরেনি।
– ওহো! আমি তো ফেসবুকে অনেক খুঁজেছি।
– আমি এখন বাহিরে তো, বাসায় গিয়ে ফেসবুক একটিভ করে তোমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাবো।
মাইমুনা দ্রুত বলে উঠলো, ‘দুঃখিত, তোমার ডিস্টার্ব হলো।’
– সমস্যা নেই আপু। আমি শপিংয়ে এসেছি।
– কোন শপিং মল? বিয়ের জন্য?
– হ্যাঁ আপু। কামিনী আপুর বিয়ে।
– একটা ভালো খবর। বাবা আমাকে বিয়েতে থাকার পারমিশন দিয়েছেন।
– খুবই ভালো খবর! সবাই লেহেঙ্গা পরবে। তুমিও পরতে পারো।
– কিন্তু, আমার একটা লেহেঙ্গা আছে যেটার রং একটু জ্বলে গিয়েছে।
– আমি অবশ্য থ্রি পিস পরবো। একটু লং আর গোল।
– আচ্ছা। তাহলে আমিও তেমন একটা পরে আসবো। কি রং পরবো বলো তো?
– দাঁড়াও, আমি সৌরভ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করি। উনি রং সম্পর্কে ভালো জানেন।
ওপাশে কোনো কথা নেই! চৈতি মনে মনে খুব হাসছে। তার কেন যেন খুব আনন্দ হচ্ছে মাইমুনার সাথে সৌরভকে চিন্তা করে। সে ফোন কেটে দিয়ে সৌরভের কাছে গেল। ততক্ষণে সৌরভ তার কাজ সেরে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। চৈতিকে দেখে সে বলে উঠলো, ‘ভাবছি তোকে বিয়ের পর সবসময় হিজাব পরিয়ে রাখবো। মা শা আল্লাহ! আমার নজর লেগে যাচ্ছে রে!’
চৈতি মনে মনে বকে নিলো, ‘তোর কুনজর তুই রাখ ব্যাটা। তোর ব্যবস্থা করতেছি আমি।’
কিন্তু সে মুখে বললো, ‘ভাইয়া, আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই। আমাকে তোমার ফোনটা একটু দিবে?’
শুরু হলো সৌরভের জেরা, ‘ফোন দিয়ে কি করবি?’
– কালকে বাবার বন্ধু এসেছিল। উনার মেয়ে মাইমুনা আমার বোনের মতো হয়ে গিয়েছে। আপুকে ফোন করতে হবে। জামার রং নিয়ে কথা বলবো।
– আমার সামনে ডায়াল কর। তারপর লাউড স্পিকার দিয়ে কথা বল।
– আচ্ছা। আপনার প্রিয় রং কি?
– তুই জানিস না? আমি ল্যাভেন্ডার কালার খুব পছন্দ করি।
– কিন্তু ওই রঙের জামা পরলে কি মানাবে?
– উহু। তার চেয়ে তুই কালো আর লালের মিশ্রণে কোনো জামা পর। আমি কিনে দিব তোকে।
চৈতি একটুও চিন্তিত হলো না। কালো আর লাল রঙের জামা মাইমুনাকে পরাবে সে। সৌরভ হয়তো রেগে যাবে অনেক। কিন্তু পরের চিন্তা এখন করে লাভ নেই। তাই চুপচাপ মাইমুনার নাম্বারে ডায়াল করলো সে। মাইমুনা সালাম দিলে সে বলল তার ফোনের ব্যালেন্স শেষ তাই সৌরভের ফোন থেকে ফোন করেছে। সৌরভ মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে স্বস্তি পেলো। চৈতি জামার রং সিলেক্ট করার নাম করে সেখান থেকে সরে গিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকলো।
– তুমি কালো আর লাল রঙের জামা পরো।
– এটা কি তোমার ভাইয়া বলেছেন?
– হ্যাঁ আপু। ভাইয়ার কালার চয়েজ অনেক ভালো।
– আচ্ছা। আমি চেষ্টা করবো।
– আমিও চেষ্টা করবো এমন কিছু পরার।
– তুমি ভিন্ন রকম পরো। সবাই এক রকম হলে ভালো দেখাবে না। এটা আমার মতামত। তোমার ইচ্ছা তুমি কি রং পরবে।
– আমার মনে হয়, তোমার কথাটাই ঠিক। আমি অন্য রং পরবো। সুন্দর দেখাবে তাহলে।
– আচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ আপু।
ফোন কেটে চৈতির মাথায় আরেক বুদ্ধি চেপে গেল। সে দ্রুত সৌরভের কল লিস্ট চেক করে স্বাধীনের নম্বর টুকে নিলো নিজের ফোনে। তাড়াতাড়ি সৌরভকে ফোন ফেরত দিয়ে দোকানে গেল সে। এই দোকান থেকে বেরিয়ে সবাই এখন অন্য দোকানে গিয়েছে। শিমুলকে বলে সে টয়লেটে যাওয়ার নাম করে বাহিরে গেল। সৌরভ তাকে ফিমেল ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করছে। আর সেই সুযোগে চৈতি ডায়াল করলো মনচোরার নম্বরে।
রিং হচ্ছে, সেই সাথে ধুক ধুক শব্দে চৈতির হৃদযন্ত্র কাঁপছে। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে ভরাট কণ্ঠে কেউ বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম। কে?’
শুনেই বুকে শান্তি অনুভূত হলো চৈতির। তবে টয়লেটে সালামের উত্তর দেয়া উচিত হবে না ভেবে মোটা কণ্ঠে সে বললো, ‘কিরে স্বাধীন? কি করস?’
স্বাধীন চমকে উঠলো, ‘কে? কে আপনি? আমার নাম জানেন কি করে?’
– আরে আমাকে চিনতে পারস না? আমি মাহিয়া।
– মাহিয়া? তোর কন্ঠ এমন লাগছে কেন? প্রতিধ্বনি হচ্ছে। তুই কই রে?
– এতো কথা বলতে পারবো না। আমার ঠান্ডা লেগেছে। তোর প্রিয় রং বল।
– হঠাৎ প্রিয় রং! কিরে? তুই মাহিয়াই তো?
– আহ! বল তো। তোর পাঞ্জাবি কিনবো।
– আমার পাঞ্জাবি কিনবি কেন? কি হয়েছে তোর?
চৈতির খুব কষ্ট হচ্ছে মোটা কণ্ঠে এতক্ষণ কথা বলতে। কিন্তু সে প্রিয় রং না জানা পর্যন্ত থামবে না।
– খুব কথা বলছিস তুই। তাড়াতাড়ি বল।
– আমার প্রিয় রং অফ হোয়াইট। এবার বল আমার পাঞ্জাবি কেন কিনবি? আমি তো আগেই বলেছি মেয়ে মানুষের সাথে আমি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। তুই যতই বান্ধবী হস, আমার কাছে তুই গায়রে মাহরাম।
প্রিয় রং অফ হোয়াইট, এটুকু শোনার পর বাকিটা শুনতে পায়নি চৈতি। কল্পনা করে ফেললো সে, নিজেকে এক সাদামাটা পোশাকে যেখানে তার শুভ্রতা যেন নূরের প্রতীক। ভুল করে নিজ কণ্ঠে সে বলে ফেললো, ‘অফ হোয়াইট রঙের জামা কিনতে হবে তাহলে। আপনি একটা অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি পরে আসবেন।’
– চৈতি!
ঝট করে ফোন কেটে দিলো চৈতি। বুঝে গিয়েছে চালাকটা!
______
ইন শা আল্লাহ চলবে….