‘লোডশেডিং’
পর্ব ১৯.
তাবিনা মাহনূর
__________________
সজীব সাহেব ড্রইং রুমে সোফায় বসে টিভির দিকে অমনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মস্তিষ্কে বিচরণ করছে গত কিছুদিনের নোংরা পরিস্থিতিগুলো, দৃষ্টির সম্মুখে খেলার খবর চলছে। দিলারা সকাল সকাল স্বামীর এই রূপ দেখে সব বুঝে গেলেন। বেশি চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতে সজীব এই পথ বেছে নেন। কাউকে বুঝতে দিতে চান না, তিনি ভেতরে ভেতরে কতটা উদ্বিগ্ন। স্ত্রীর চোখকে অবশ্য ফাঁকি দিতে পারেন না।
সজীব সাহেবের পাশে বসে দিলারা কণ্ঠস্বর নিচু করে বললেন, ‘কি এতো ভাবছো?’
টিভির দিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে সজীব উত্তর দিলেন, ‘ভাবছি, কুলাঙ্গার ছেলেটাকে নিয়ে কি করা যায়।’
দমে গেলেন দিলারা। তিনি নিজেও জানেন ছেলে কত বড় অপরাধ করেছে। দুই একবার সকলের অগোচরে ছেলেকে বকেছেন সস্তা একটা মেয়ের জন্য কলঙ্কিত হওয়ার জন্য। কিন্তু সকলের সামনে ছেলের কুকীর্তি ঢাকা তার দায়িত্ব বলে উল্টো অভিযোগ তুলছেন চৈতির নামে।
– এভাবে বলছো কেন?
প্রচন্ড রেগে গেলেন সজীব, ‘কীভাবে বলছি? কীভাবে বলছি আমি? চুপ করে আছো কেন? আজ বাদে কাল কামিনীর বৌভাত। জামাই আসবে বাসায়। লোকে কি চুপ করে থাকবে যে জামাইয়ের কানে কিছুই যাবে না! কি মনে করেছো? দুনিয়া খুব সোজা? খুব সহজে সবাই সবকিছু ভুলে যাবে? এ বাড়ি ছেড়ে অন্য এলাকায় না যাওয়া পর্যন্ত তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হতেই হবে।’
দিলারা এবার বললেন, ‘এ বাড়ি ছাড়ার কথা বলছো? আমাদের তো এটা ছাড়াও আরো দুটো বাড়ি আছে। উত্তরায় চলে যাই চলো।’
সজীব রাগী স্বরে বললেন, ‘মাথা মোটা মহিলা একটা! বললো আর চলে গেলাম। এতে কি প্রশ্ন তৈরি হবে না যে কেন এই বাসা ছাড়লাম? উত্তরার বাড়ি পুরোটা ভাড়া দেয়া। সেখানে ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলে কমপক্ষে এক মাস সময় দেয়া লাগবে। এছাড়া কুলাঙ্গার ছেলেকে কে বিয়ে করবে? কি বলে বিয়ে করাবো? ওকে আমি সারাজীবন চোখের সামনে দেখতে পারবো না। বিয়ে করে বাসা আলাদা করিয়ে দিব সেই সুযোগও নেই।’
– কেন? চৈতি বিয়ে করবে ওকে।
– তুমি দেখছি আসলেই গাধা!
দিলারা অপমানিত বোধ করলেন, ‘এখন বেশি বাড়াবাড়ি করছো। সেই তখন থেকে আমাকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছো। আমি এবার কি ভুল বলেছি? আমার ছেলের একটা গেলে আরেকটা আসবে। টাকার কাছে আজকাল সব মেয়ে তুলোর মতো। চৈতির কি আছে? সতীত্ব হারালো, টাকা পয়সা নাই ঘরে, পড়াশোনাও আর করবে না মনে হয়। এইচএসসির আগেই এমন বাজে কান্ড ঘটলো। পড়বে কোন মুখে? এবার বলো ওই মেয়েকে কে বিয়ে করবে? চেহারাও আহামরি না যে রূপে গুনে মুগ্ধ হয়ে ছেলেরা সব মেনে নিবে।’
সজীব সাহেব চুপ করে ভ্রু কুঁচকে বসে থাকলেন। দিলারা কথাগুলো ভুল বলেননি। তার নীরবতা দেখে দিলারা আরো বেশি ফুঁসে উঠলেন, ‘এখন কিছু বলছো না কেন? শোনো, কোনো কিছু বলার আগে ভেবে বলবে। চৈতির কিছুই নেই। সৌরভের সবই আছে। আমি চৈতিকে এখনো বৌমা হিসেবে ভাবতে পারি না। শুধুমাত্র ছেলেটা চৈতিকে পাগলের মতো পছন্দ করে বলে মানতে বাধ্য হচ্ছি।’
সজীব প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার ছেলের সবই আছে? কি আছে একটু বলো তো শুনি।’
– কি নেই ওর? সুন্দর ছেলেটা আমার পড়ালেখায় যেমন ভালো তেমনি পাড়ার সবাই ওর ভালো ব্যবহারের সাথে পরিচিত। কখনো কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। টাকা পয়সা সব আছে।
– ভুল বললে। ছেলে সুন্দর আর পড়াশোনায় ভালো মানলাম। কিন্তু চরিত্র কেমন তা চৈতির সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনী থেকেই বোঝা যায়। আর টাকা? হাঃ! বাপের হোটেলে ভাত খেয়ে বলে সোনারগাঁ খেয়ে এলাম!
– মাঝে মাঝে মনে হয় ওকে তুমি তোমার ছেলে বলে মানতেই চাও না!
– এটা কখনোই হয়নি। এই নিকৃষ্ট কাজের পর থেকে বারবার মনে হয় ছেলেটা যদি আমার না হতো!
– তুমি সত্যিই অদ্ভুত মানুষ!
– ওর নাম সৌরভ বদলে দুর্গন্ধ দেয়া উচিত। আকিকার ব্যবস্থা করো তো!
– বাপ নামের কলংক!
শেষ কথাটি বলে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের ঘরে এগিয়ে গেলেন দিলারা। সজীব সাহেব সোফায় হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলেন, চৈতি কি তার নিষ্ঠুর ছেলেটাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
__________
– রাগ করেছো চৈতি? কালকে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে আসতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ আম্মু ফোন করে বললো বাসায় তাড়াতাড়ি যেতে। তাই আসতে পারিনি।
মাইমুনা হেসে হেসে চৈতির সাথে কথা আগানোর চেষ্টা করছে। চৈতি হাসছে না। তবে সেও টুকটাক কথা বলছে। এরই মাঝে জেবিন দুই বাটি সবজি স্যুপ নিয়ে এসে বললেন, ‘মাইমুনা মা, তুমি নাকি নাস্তা করে এসেছো? এই স্যুপটা খাও তাহলে।’
– আন্টি, এত কষ্ট করার কি দরকার ছিল?
– চৈতির জন্য এমনিতেই রান্না করতাম। দুজনেই খাও। চৈতি, তোমাকে লেবু দিব?
দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে চৈতি বোঝালো তার লেবু লাগবে না। জেবিন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু চৈতি দূরত্ব বজায় রাখছে। এই অবহেলা জেবিন কেন যেন সহ্য করতে পারেন না। দ্রুত সেখান থেকে সরে গেলেন তিনি।
মাইমুনা বললো, ‘শরীর ভালো তো?’
– আলহামদুলিল্লাহ আপু। তোমার বাবা কেমন আছেন?
– এ কথা আর কি বলবো! বললেই মনটা ভার হয়ে আসে। ডাক্তার বলেছে আশা ভরসা ছেড়ে দিতে। বেশিদিন ডায়ালাইসিস করে চালানো সম্ভব নয়।
– তোমরা নাকি সিরাজগঞ্জ চলে যাবে?
– আম্মু আর ইমাম চলে যাবে বাবাকে নিয়ে। সিরাজগঞ্জে আমার দাদার বাড়ি আছে। যেহেতু ওটা সদর এলাকা তাই হাসপাতাল নিয়ে সমস্যা হবে না। ওখানে ডায়ালাইসিসের সুবিধা আছে। ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা দিয়ে আরো কিছুদিন ডায়ালাইসিস করানো যাবে।
– আর তোমার বড় ভাই? তিনি কোথায় থাকবেন?
মলিন মুখে মিষ্টি হাসি হাসলো মাইমুনা। কঠিন সময় যাচ্ছে তাদের। এই দুর্বিষহ দিনগুলোর মাঝে আরেক বিপদ এসে হাজির, সেটাই ব্যক্ত করছে চৈতির কাছে।
– মাহিন ভাইয়া বিয়ে করেছে একা একাই। এটা নিয়ে আম্মু রাগ করেননি তেমন। ভাইয়া চাকুরিজীবি। খুব ভালো বেতন পায়। সে অনায়াসে দু চারজনের ভার নেয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই বিয়ে করে বউকে খাওয়াবে কি, এমন ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু… বলতেও লজ্জা করছে। ভাবি বাবার চিকিৎসার টাকা দিতে রাজি নন।
– আচ্ছা আপু, বলতে হবে না। আমি বুঝে গিয়েছি।
মাইমুনা হতাশ কণ্ঠে বললো, ‘তারা শুধু নিজের স্বার্থ দেখে। আশেপাশে কি হলো সেটা নিয়ে ভাবে না। শুধু ছেলেদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। ভাবী না থাকলে ভাইয়া নিশ্চয়ই অল্প কিছু টাকা হলেও দিতেন।’
এমন সময় সারাফ এসে বললেন, ‘কি গল্প হচ্ছে দুজনের?’
মাইমুনা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, ‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। ভালো আছেন?’
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা। আলহামদুলিল্লাহ। তুমি এসেছো দেখে খুব ভালো লাগলো। খাওয়া দাওয়া করেছো?
– জি আঙ্কেল। আপনি?
– আমিও করেছি। চৈতালির ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে তো তাই এসেছি। মামণি, ওষুধ খেয়েছো?
চৈতি বললো, ‘না বাবা।’
– জানতাম। আমি না আসা পর্যন্ত ওষুধ খাবে না মেয়েটা!
নিজের হাতে ওষুধ খাওয়ালেন সারাফ। মাইমুনার চোখে পানি চলে এলো। এই দৃশ্য তার আর তৌফিক সাহেবের হওয়ার কথা। অথচ সে এখন উল্টো চিত্র দেখে। নিজের হাতে বাবাকে ওষুধ খাওয়ায়।
সারাফ সাহেব চলে গেলে চৈতি বললো, ‘আপু, তুমি কত ভাগ্যবতী তুমি কি সেটা জানো?’
মাইমুনা মুচকি হাসলো। চৈতি আবারো বললো, ‘নিজের হাতে বাবা মায়ের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছ। এর বিপরীতে কি পরিমান সওয়াব তুমি পাবে তা কল্পনা করতে পারবে না। এর জন্য তোমার বাবা মা প্রতিনিয়ত তোমার জন্য দুআ করছেন। তুমি হয়তো এর বিনিময়ে জান্নাত পেয়ে যেতে পারো!’
মাইমুনা অশ্রুসজল চোখে হেসে বললো, ‘আমিন!’
__________
বিকেলের দিকে চৈতির ছাদে যাওয়ার ইচ্ছে হলো। এখন সে সারাফ সাহেবের ঘরে বই হাতে বসে আছে বাবার পাশে। শিমুল আজ বাসার কাজে ব্যস্ত হওয়ায় উপরে আসতে পারেনি। নীরা নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে শিমুলকে কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। তিনি নাকি অসুস্থ, শিমুলকে আজ রান্না করতে হবে। জেবিন সাদিয়া ও সাদিককে পড়াচ্ছেন। চৈতি পাশ ফিরে বাবাকে দেখলো, সারাফ হা করে ঘুমাচ্ছেন। সে নিঃশব্দে বাবার পাশ থেকে উঠে গিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো। ঘরে গিয়ে বড় একটা চাদর গায়ে পেঁচিয়ে মাথার চুলও ঢেকে নিলো। মূল দরজা খুলে বেরিয়ে চলে গেল ছাদে।
মাত্র তিনদিন। তাতেই মনে হচ্ছে কতদিন সে ছাদে আসেনি! ছাদের গোলাপ ফুল আর বনসাই গাছগুলোর অবস্থা করুণ। গাছে অনেকদিন পানি দেয়া হয়নি। সে পানির পাইপ নিয়ে সবগুলো গাছে পানি দেয়া শুরু করলো। আর মনে মনে এই অবসর সময়টাকে কাজে লাগালো সারাক্ষণ ইস্তিগফার করার মাধ্যমে।
পাশের ছাদেই আরেক মানব তাকিয়ে আছে। একবার তাকাচ্ছে, আরেকবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। শয়তানের সাথে এমন লুকোচুরি খেলতে খেলতে শেষ পর্যন্ত তার ঈমান জিতে গেল। সে ঘরে ঢুকে গেল যেন চৈতিকে আর দেখা না যায়। তবে মন খচখচ করতে লাগলো মেয়েটার শরীরের অবস্থার কথা একবারও জিজ্ঞেস না করার কারণে।
চৈতি গুনগুন করছে। বিকেলের আকাশে লাল নীলের সমারোহ। সেখানে পাখিরা উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। কেউ দল ছাড়া নয়। গাছে পানি দিতে দিতে সে সেদিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। সেই ঘটনার পর আজ প্রথম হাসলো সে। মুক্ত পাখিগুলো দেশ বিদেশ অনায়াসে ঘুরতে পারে। মুচকি হেসে কিছু একটা ভেবে চৈতি আবারো কাজে মনোযোগ দিলো। পানি দেয়া শেষে ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর বুঝতে পারলো, একজন তার সাথে কথা বলতে চায়। তবু সে চুপচাপ হাঁটতে থাকলো।
সেই একজন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। ঘরের মাঝে উসখুস করতে করতে বেরিয়ে এসে চৈতিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন কি অবস্থা?’
চৈতি একবারও তাকালো না স্বাধীনের দিকে। কড়া কণ্ঠে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
আর কোনো কথা নেই। স্বাধীন ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। প্রতিজ্ঞা করলো, এই মেয়ের সাথে আর কখনো কথা বলবে না।
চৈতি নির্বিকার ভঙ্গিমায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরে চলে গেল। তাকে নিয়ে কে কি ভাবলো, কেউ চিন্তিত কিনা, এসব নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। এখন সে শুধু নিজের জগতে বিচরণ করে। কেউ তার জগৎ নিয়ে প্রশ্ন তুললে অথবা সেই জগতে প্রবেশ করতে চাইলে সে বাধা দিবে না। সে জানে, তারা তার জগৎ ধ্বংস করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয়।
চৈতি ঘরে এসে শিমুলকে দেখে বললো, ‘কখন এসেছো আপু?’
– মাত্র আসলাম। ছাদে গিয়েছিলি?
– হ্যাঁ আপু। তুমি যাবে?
– নাহ। আমি বিরাট ঝামেলায় পড়েছি রে!
– কি হয়েছে?
শিমুলের পাশে বসলো চৈতি। শিমুল মুখটা ভার করে বললো, ‘কামিনী আপুর বিয়ের মাঝে এক মহিলা আমাকে দেখে পছন্দ করেছে তার বোনের ছেলের জন্য।’
চৈতির খুব খারাপ লাগলো। শিমুলের বিয়ে হয়ে গেলে চৈতিকে সাহায্য করার মতো আর কেউ থাকবে না। কিন্তু জীবনে কেউই চিরস্থায়ী নয়। শিমুলের নিজস্ব স্বাধীনতা আছে। তার ব্যক্তিগত জীবন আছে। চৈতি দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে বললো, ‘মহিলা কে?’
– কামিনী আপুর বান্ধবীর মা। আন্টি আধুনিক মনের হলেও তার বোন নাকি ছেলের জন্য পর্দানশীন মেয়ে খুঁজছে।
– তাহলে মন খারাপ কেন আপু? ভালোই তো হলো। একজন দ্বীনদার পাত্র পাবে।
শিমুল তার আশংকা প্রকাশ করে বললো, ‘এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না। আজকাল ছেলেরা রাস্তায় চলাফেরা করা আধুনিক মেয়েদের সাথে প্রেম করে, কিন্তু বিয়ের সময় ইনটেক মেয়ে খুঁজে। এই ছেলে এমন নয়, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি?’
– আগে ছেলে আসুক। তুমি তাকে দেখবে, সে তোমাকে দেখবে। দেখে কিছুটা হলেও বোঝা যায় যে ছেলে কেমন। কিন্তু ছোট কাকীর মতামত কি?
– আম্মু ভেবেছে আন্টি যেহেতু মডারেট মুসলিম, সেহেতু ছেলেও এমনি হবে। তাই আসতে বলে দিয়েছে আমাকে না জানিয়ে।
– আল্লাহই ব্যবস্থা করেন আপু। কাকী ভাবছেন ছেলে মডার্ন। আসার পর যদি দেখো দ্বীনদার ছেলে তাহলে না করো না। এটাই সুযোগ।
– কিন্তু যদি দেখি আম্মুর ভাবনা সঠিক?
– তখন যেকোনো উপায়ে বিদায় করে দিও। আমি সাথে থাকবো। আগেই চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। তাওয়াক্কুল রাখো আর দুআ করো।
– আমিন।
কিছুক্ষণ চিন্তিত থেকে হঠাৎই শিমুল বললো, ‘এই চৈতি, তোকে একটা প্রশ্ন করবো রাগ করবি না।’
– ওই পশুর নাম নিও না। তাহলেই হবে।
– ওটাই বলতে যাচ্ছিলাম। দেখা হয়েছে একবারও?
– নাহ।
– লোকজন আসছে তোকে দেখতে। ছোট কাকা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। ভালোই করছেন।
– হুম। আর দুই আড়াই মাস পর আমার পরীক্ষা। ভাবছি কাল থেকে মডেল টেস্ট দিব কোচিংয়ে।
– কোচিং কোথায়?
– এইতো কাছেই। হেঁটে গেলে পনেরো মিনিট।
– তোর কষ্ট হবে না?
চৈতি অবুঝের মতো বললো, ‘কষ্ট কিসের? এর আগেও তো হেঁটে গিয়েছি।’
– আমি অন্য কষ্টের কথা বলছি চৈতি।
– বুঝতে পেরেছি। আমার দোষ কোথায় যে আমি কষ্ট পাবো?
– তোর দোষ নেই বলেই কষ্ট পাওয়ার কথা বলছি। অপরাধী অনুতপ্ত না হলে তার অপরাধ নিয়ে কে কি বললো তাতে তার কিছু আসে যায় না। তুই নিরপরাধ, অথচ লোকে তোর নিন্দা করছে। এটা সহ্য করা যায়?
চৈতি শিমুলের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপু, ওই ঘটনার পর থেকে আমি কোন চৈতিতে পরিণত হয়েছি সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। সহ্য ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে অলৌকিকভাবে দিয়ে দিয়েছেন। জানি না অন্য ধর্ষিতাদের মত কি, তবে আমি বলবো আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।’
অবাক হলো শিমুল, ‘সত্যি চৈতি! তুই এতো বেশি বদলে গেছিস!’
– হুম। হয়তো অনেকেই বলবে, এই ভালোটা অন্য পন্থায় হলো না কেন? বাজেভাবেই কেন হতে হলো? আল্লাহ তো সব পারেন! কিন্তু আমি এসব অভিযোগ কখনোই তুলবো না। কারণটা কাউকে বলতে পারছি না। শুধু দুআ করো, আমি যেন হিদায়াত প্রাপ্ত বান্দাদের মাঝে শামিল হই।
– তুই এখন নামাজ পড়িস, ছোট থেকে রমাদান মাসে রোজা রাখিস। এখন পর্দা শুরু কর। বোরখা পরে কোচিং এ যাস। তাহলে সবদিক দিয়েই ভালো থাকবি।
– একটা কথা বলি, শুনতে খারাপ লাগবে। আমি বোরখা পরবো না আপু।
– কি বলিস! আচ্ছা হিজাব পরতে থাক। ধীরে ধীরে পর্দা হবে।
– না আপু। আমি আমার মতোই চলবো।
শিমুল অবাক হলো চৈতির এমন কথায়। সে বললো, ‘এভাবে চললে হিদায়াত কীভাবে পাবি?’
– জানি না। কিন্তু এখন আমি বোরখা পরবো না। পরলে মানুষ ভাববে আমি দোষী তাই মুখ ঢাকার চেষ্টা করছি।
– বোকা মেয়ে! শোন…
– আপু আমার ঘুম পাচ্ছে। মাগরিবের সময় হলে আমাকে ডেকে দিও।
চৈতি গায়ে লেপ জড়িয়ে শুয়ে পরলো। শিমুল বুঝতে পারলো, চৈতি এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না। সেই সাথে বুঝতে পারলো, শয়তান চৈতিকে ভুলভাল বুঝিয়ে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করছে। চৈতি পর্দা শুরু করবে না লোকজন তাকে দোষী ভাববে বলে, এটা নফসের কথা।
শিমুল উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আমি অনেক ভালো আছি। হে আল্লাহ! তাহমিদকে ভুলে গিয়েছি, ভুলে গিয়েছি সব নোংরা স্মৃতি। তোমার কাছে হাজার কোটি শুকরিয়া!’
______________
চলবে ইন শা আল্লাহ…..